Published : 06 May 2025, 09:29 PM
‘কালাকানুন’ হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া আগের সরকারের সময়ের সাইবার নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা বাতিল ও কিছু নতুন ধারা সংযোজন করে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ নামে নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশে ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারী-শিশু নির্যাতন ও যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়; সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বৈঠকের পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, “‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ এর খসড়া আমরা ২৫ বার পরিবর্তন করেছি। এই আইনের সমালোচক সিভিল সোসাইটির সঙ্গে বসে তিন ঘন্টা আলোচনা করেছি। আজকে উপদেষ্টা পরিষদে উঠেছিল। একটা সংশোধনের পরামর্শ এসেছে। আমরা সেটা করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তিনি বলেন, এই সপ্তাহের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে গেজেট প্রকাশ করা হবে।
দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি ও উদ্বেগের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর ব্যাপক সমালোচিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা বাতিল করে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হলেও পুরনো আইনের বাতিল হওয়া ধারাগুলো নতুন আইনে রেখে দেওয়ায় এর অপপ্রয়োগের শঙ্কা ছিল উদ্বেগের কেন্দ্রে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালে কারাগারে মারা যাওয়ার পর ওই আইন বাতিলের দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছিল।
এরপর আইনের ‘অপব্যবহার’ বন্ধে তখনকার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আশ্বাস দিলেও সংবাদকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার থেমে থাকেনি। ২০২৩ সালের মার্চে এক প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে একজন সাংবাদিককে ভোররাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনায় ওই আইন বিলোপের দাবি নতুন করে আলোচনায় আসে।
পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম বদলে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ করে সরকার। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তা সংসদে পাস হয়। ওই আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয় পুলিশকে।
গত অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবির মধ্যে সব কালাকানুন বাতিল বা সংস্কারের দাবিও সামনে আসে। এরপর ৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।
যেসব বিধান বিলুপ্ত হল
আইন উপদেষ্টা বলেন, আগের সাইবার নিরাপত্তা আইনের নয়টা ধারা বাতিল করা হয়েছে। এই ধারাগুলো ছিল কুখ্যাত ধারা। এই ধারাগুলোতে ৯৫ শতাংশ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলাগুলো এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
“এর বাইরেও কিছু কিছু ধারার মামলা বাতিল হয়ে যাবে, যদিও ধারাগুলো নতুন আইনে রয়েছে। কারণ, সংজ্ঞাগুলো এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে যে আগের ধারার মামলাগুলো টিকে থাকবে না।”
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কিত বিদ্বেষ বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ড সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে।
মানহানিকর তথ্য প্রকাশের জন্য দণ্ড দেওয়ার বিধান বাতিল করা হয়েছে তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, সাংবাদিকরা এ ধারার মামলায় বেশি আক্রান্ত হতেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উস্কানি, আক্রমণাত্মক মিথ্যা ও ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত ধারা বিলুপ্ত করার কথাও তুলে ধরে তিনি।
যেসব বিধান থাকছে
উপদেষ্টার ভাষ্য, “প্রস্তাবিত নতুন আইনে সাইবার স্পেসে জালিয়াতির অপরাধকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। ধর্মীয় বা জাতিগত বিষয়ে সহিংসতা ছড়ানোর অপরাধ। ঘৃণা বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশ, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিং সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ অর্থাৎ এক কথায় ‘স্পিস অফেন্স’ এর মামলা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। মতামত প্রকাশ সংক্রান্ত যে কোনো অপরাধের মামলা জামিনযোগ্য করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, নতুন যে অধ্যাদেশটি হতে যাচ্ছে সেখানে সাইবার সিকিউরিটি কাউন্সিল রয়েছে। তারা আক্রমণাত্মক ও অপরাধমূলক কনটেন্ট অপসারণ করতে পারবে। এই কর্তৃপক্ষ গঠনের সময় সুশীল সমাজের সদস্যদের রাখা হবে।
“কনটেন্ট অপসারণের ৭২ ঘন্টার মধ্যে কর্তৃপক্ষকে আদালতের অনুমোদন নিতে হবে। আদালত যদি অনুমোদন না দেয় তাহলে এই কনটেন্ট পুনরায় স্থাপন করতে হবে। যেই কনটেন্টটা অপসারণ করা হবে সেটা জনগণকে জানাতে হবে।”
আইন পরিবর্তন বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, “প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো সাইবার স্পেসে নারী শিশু নির্যাতন ও যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।”
আইনের অন্যান্য পরিবর্তনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “মতামত প্রকাশজনিত অপরাধের মধ্যে মাত্র দুইটা বিষয়কে অপরাধ হিসেবে রাখা হয়েছে। একটা হচ্ছে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়নমূলক কনটেন্ট প্রকাশ, হুমকি দেওয়া। আরেকটা হচ্ছে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো। যেই ঘৃণা ছড়ানোর মধ্য দিয়ে সহিংসতাকে উস্কে দেওয়া হয়।”
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোনো সাইবার অপরাধ করলে তা শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে।
“নারী শিশুর প্রতি যৌন হয়রানির অভিযোগে মামলার ক্ষেত্রেও রক্ষাকবচ রাখা হয়েছে। এটা আমলি আদালতে যাবে। বিচারক যদি দেখেন এই মামলার কোনো সারবত্তা নেই। তাহলে তিনি প্রাক-বিচার পর্যায়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মামলা বাতিল করে দিতে পারবেন। অর্থাৎ অভিযোগপত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না, যদি দেখেন সম্পূর্ণ ভূয়া মামলা।”