সংখ্যায় অপ্রতুল, সেবার মানও তলানিতে। সে কারণে রাজস্ব খাতের কেন্দ্রে সন্তানকে ভর্তি না করাতে মধ্যবিত্ত মায়েদের ‘নিষেধ’ করা হয় বলে জানালেন একজন কর্মকর্তা।
Published : 27 Sep 2024, 01:52 AM
মা হওয়ার পর চাকরি চালিয়ে যাওয়া কঠিন ঠেকছিল ঢাকার বাসিন্দা তানিশা আহমেদের। শিশুসন্তানকে বাড়িতে রেখে কাজে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাদ সাধে পরিবার। যদিও তার পরিবারটি যৌথই ছিল।
তখন সন্তানের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে-কেয়ার সেন্টারের কথা মাথায় আসে তানিশার। তবে সরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সেবার মানে ভরসা পাচ্ছিলেন না তিনি। মনে হচ্ছিল, ওখানে সন্তানকে দিয়ে মানসিক শান্তিতে থাকতে পারবেন না।
বেসরকারির মান খানিকটা ভালো হলেও খরচ বেশি হওয়ায় সেখানেও যেতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত চাকরিই ছেড়েছেন তানিশা।
কর্মজীবী মায়ের সন্তানকে দেখভালের পাশাপাশি খেলাধুলা, ছবি আঁকা, বর্ণ পরিচিতি, ছড়া শেখা ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকার কথা বলা হচ্ছে সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রে। তবে এখনো কেন্দ্রগুলো মায়েদের আস্থার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি।
গৃহকর্মী আসমা খাতুনের কাছের স্বজন বলতে কেউ নেই ঢাকায়। তিনি থাকেন রায়েরবাজার বধ্যভূমি এলাকায়। কাজে গেলে ৩ ও ৫ বছর বয়সী দুই ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়।
ওদের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে দেন না কেন? প্রশ্ন শুনে আসমা বললেন, “বাসার কাছে এমন কিছু নাই। হের লইগ্যা পাশের বাড়ির খালাম্মার কাছে পোলাপান রাইখ্যা যাই।”
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে রাজস্ব খাত ও প্রকল্প থেকে অর্থায়ানের মাধ্যমে মোট ১১৯টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। রাজস্ব বাজেটে পরিচালিত ৪৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৫টি পরিচালিত হচ্ছে ঢাকায়।
এর বাইরে দেশে ২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, যেখানে ৫-৯ বছর বয়সীদের দেখভাল করা হয়।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে মিরপুর, আজিমপুর, ইস্কাটন গার্ডেন রোড, সেগুনবাগিচা, সচিবালয় ও খিলগাঁওয়ে আছে ছয়টি মধ্যবিত্ত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র।
আর মগবাজার, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, রামপুরা, আজিমপুর, ফরিদাবাদ ও কামরাঙ্গীরচরে আছে আটটি নিম্নবিত্ত কেন্দ্র।
কর্মকর্তারা বলছেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কর্মজীবী নারীদের সন্তানদের জন্য আলাদা আলাদা কেন্দ্র করা হলে সুযোগ-সুবিধা ভিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই।
বাস্তব চিত্র কেমন?
ঢাকার আদাবর ১৬ নম্বর সড়কে সুনিবিড় হাউজিংয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য আছে আদাবর শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র। কেন্দ্রের বাইরে সিটিজেন চার্টার বোর্ডে ১১টি নিয়ম-নীতি ও সুবিধার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, কেন্দ্রটি সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকবে; অপুষ্টি রোধে দেওয়া হবে সুষম ও বিকল্প খাবার। থাকবে ইনডোর খেলাধুলার সুবিধা। কেন্দ্র পরিষ্কার রাখা এবং শিশুদের পরিষ্কার থাকার অভ্যাস গড়ে তোলার কথাও বলা হয়েছে।
সুনিবিড় হাউজিংয়ের ডে কেয়ার সেন্টারটিতে কেমন সেবা শিশুরা পাচ্ছে একদিন দেখতে গেলে বিকাল ৫টার পর কেন্দ্রটিতে কোনো শিশু, শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। সেখানে তখন উপস্থিত কেবলমাত্র একজন তত্ত্বাবধায়ক। তিনি জানান বিকেল ৫টায় সকলে চলে গেছেন।
তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেন্দ্রে শিশুরা আসে সকালে সাড়ে ৮টায়। তবে ‘ম্যাডাম’ আসেন সকাল সাড়ে ৯টায়। ‘ম্যাডামের’ সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সকাল ১০টার পরে যাওয়ার পরামর্শ দেন সেই তত্ত্বাবধায়ক।
কেন্দ্রটির আয়তন ৯০০ বর্গফুটের মত। একটি কক্ষে পড়াশোনা, একটিতে খাওয়া, একটি ঘুমের এবং একটি খেলার ঘর হিসেবে ব্যবহার হয়। আছে একটি টয়লেট ও একটি স্টোররুম। আর একটি কক্ষ ব্যবহার হয় দাপ্তরিক কাজে।
শিশুদের দিবাকালীন পরিচর্যা ও নিরাপত্তার জন্য সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি পর্যায়ে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার বিষয়ে দেশে আইন হয়েছে বছর তিনেক আগে। পরের বছর ‘শিশু দিবাযত্ন বিধিমালা, ২০২২’র খসড়া প্রস্তুত করেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
ওই খসড়া বিধিমালায় বয়সভিত্তিক আলাদা খেলার ঘর রাখার কথা বলা হলেও আদাবর শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে তা দেখা যায়নি। প্রতিটি শিশুর জন্য গড়ে ৫০ বর্গফুট হারে সর্বনিম্ন মোট ৩ হাজার বর্গফুট জায়গার কথা খসড়া নীতিমালায় বলা হলেও তা রক্ষা করা হয়নি।
কেন্দ্রটির প্রবেশের পথ ও ভেতরে পর্যাপ্ত আলো না থাকায় দিনের বেলাতেও জ্বালানো ছিল বৈদ্যুতিক বাতি। কেন্দ্রের প্রথম কক্ষে নেই কোনো জানালা, বাতাসের ব্যবস্থা না থাকায় নাকে লাগে বোটকা গন্ধ। দেয়ালে কোথাও জমেছে কালো ময়লা, কোথাও উঠে গেছে রং। মেঝেতেও দেখা গেছে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। ভবনের বাইরেও পচা খাবার ও আবর্জনায় পোকা ও মাছি উড়তে দেখা গেছে।
খসড়া বিধিমালায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার ও অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থাকার কথা।
কেন্দ্রের শিক্ষিকা তানজিলা বলেন, “বেডরুমে শিশুদের দুধ খাওয়ানো যাবে। তবে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার ও অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নেই। এটি সরকারি ভবন নয়, ভাড়া ফ্ল্যাটে চলছে। ভবনে কোনো ব্যবস্থা আছে কি না জানি না। আমি নিজেও মাত্র এক মাস আগে জয়েন করেছি।”
কেন্দ্রটির ডে কেয়ার অফিসার সম্পিতা সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার তৈরির জন্য সব তথ্য নেওয়া হয়েছে ২০২৩ সালে, কিন্তু এখনও কাজ শুরু হয়নি। আর বিধিমালায় অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের উল্লেখের বিষয়টি জানা ছিল না। আমাদের এখানে যে নেই, সেটা কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।”
কেন্দ্রের আয়তন এত ছোট হওয়ার কারণ কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এই এলাকার আশেপাশে কোনো সরকারি ভবন নেই। বড় ফ্ল্যাটে কেউ ডে কেয়ার সেন্টার ভাড়া দিতে চায় না। আবার সবাই অগ্রিম ভাড়াও চান, যা সরকারি বাজেটের মধ্যে নেই। তাই ছোট ফ্ল্যাটেই চলছে সেন্টার।”
এই কেন্দ্রে নতুন কোনো শিশু ভর্তির সুযোগ নেই। বর্তমানে এখানে ৫০ জন ভর্তি আছে, অপেক্ষামান আছে আরো ১৫ জন।
লালমাটিয়ায় একটি সরকারি ভবনে চালু আছে মোহাম্মদপুর দিবাযত্ন কেন্দ্র। একদিন দুপুরে সেখানে গিয়ে পাওয়া গেল দুই কর্মকর্তা ও এক তত্ত্বাবধায়ককে।
কেন্দ্রটিতে বর্তমানে ৮০ শিশু ভর্তি আছে। চার কক্ষের মধ্যে একটি ব্যবহৃত হয় কর্মকর্তাদের জন্য, শিশু ও কর্মকর্তাদের জন্য টয়লেট আছে একটি করে।
কলাপসিবল গেইট খুলে প্রবেশ করতেই ডান দিকে ঘুমানোর ঘরে দেখা গেল শুয়ে আছে দুই শিশু। খাট নেই, মেঝেতেই চারটি তোশক পাতা। বিছানার চাদর ও বালিশের কভারে চিটচিটে ভাব।
স্কুলে যাও কি না- জানতে চাইলে শুয়ে থাকা তামজিদ বলল, “এখানেই থাকি।”
বাম দিকে একটি সিঁড়িতে চুপচাপ বসে থাকা ৪/৫ বছরের এক মেয়ে শিশুকে খেলাধুলার কথা জিজ্ঞেস করতেই উত্তর না দিয়ে দৌড় দিয়ে ভেতরের ঘরে গেল।
ডে কেয়ার অফিসার নিশা পাল প্রথমে কথা বলতে রাজি না হলেও পরে বললেন, “সিট এখন খালি নাই।”
কক্ষে থাকা একজন কেয়ারগিভার বললেন, “বাচ্চা ভর্তি করার জন্য দুই-একটা সিট খালি করা যাবে।”
তখন নিশা পাল বলেন, “শিশুরা সব সুবিধা পায়। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সপ্তাহে ৫ দিন খোলা থাকে। আর সবার জন্য একই খাবার।”
এই কেন্দ্রে সকালে শিশুদের নাশতায় দেওয়া হয় দুধ, সেমাই বা সুজি। দুপুরে ভাতের সঙ্গে দুই দিন মাছ অথবা মাংস, দুই দিন ডিম এবং বাকি দিনগুলোতে সবজি ও ডাল দেওয়া হয়। বিকালের নাশতায় থাকে বিস্কুট, একটি ফল ও জুসের মধ্যে যে কোনো দুটি খাবার।
তবে বিধিমালা (খসড়া) অনুসারে শিশুর বয়স ও স্বাস্থ্য বুঝে আলাদা সুষম খাবার দেওয়া হয় না। ৬ মাস বয়সী শিশু ভর্তি করানো হয় না এখানে।
নিশা পাল বলেন, “৬ মাস বয়সী থেকে ১ বছরের কম শিশুদের ভর্তি করাই না। কারণ এই শিশুদের জন্য একজন করে ভিন্ন আয়া দরকার, যা আমাদের এখানে নেই।”
অভিভাবক পরিচয়ে দিবাযত্ন কেন্দ্রটির ভেতরে দেখতে চাইলে এই কর্মকর্তা বললেন, ‘ঘুরে দেখার নিয়ম নেই’।
কেন্দ্রটির ডে কেয়ার অফিসার কামরুন নাহারকে ফোন করলে তিনি সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, “আমাদের এখানে সব কিছুই খুব লিমিটেড- যেহেতু সব সরকারি। আমাদের ২ জন আয়া, ২ জন কেয়ারগিভার, ১ জন ক্লিনার ও ১ জন কেয়ারটেকার আছে।”
কয়েকটি ডে কেয়ার সেন্টারের সেবার মানের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে কামরুন নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, রাজস্ব খাত ও প্রকল্প- কোনো ডে কেয়ারেরই সেবার মান ভিন্ন হওয়া উচিত নয়। কেন্দ্রের কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এমন পার্থক্য হওয়ায় কথা নয়। রাজস্ব ও প্রকল্প সব ডে কেয়ারে বেতন, খাবার, রুটিন সবই এক।”
নিম্নবিত্ত কর্মজীবী মায়েদের রাজস্ব খাতের এ দুটি কেন্দ্রে সন্তানকে ভর্তির জন্য ২০০ টাকা ও প্রতিমাসে ১০০ টাকা ফি দিতে হয়।
সেবার মানে পার্থক্য
মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রকল্পের অধীনে পান্থপথের পানি ভবনের নিচতলায় চালু আছে পানি ভবন ডে কেয়ার সেন্টার। এ দিবাযত্ন কেন্দ্রটিতে ঘুরে দেখা গেছে, রাজস্ব খাতের দুটি কেন্দ্রের সঙ্গে এটির পরিবেশ ও সেবার মানের অনেক পার্থক্য।
কেন্দ্রে প্রবেশের রাস্তা বেশ প্রশস্ত ও আলো-বাতাসের ব্যবস্থা আছে। সিট আছে ৬০টি। ভর্তির সময়ে দিতে হবে ৩১৫০ টাকা এবং আড়াই বছরের শিশুর জন্য মাসিক খরচ ১২০০ টাকা।
কেন্দ্রটির তরফে জানানো হয়, খাবার তালিকায় সকালে শিশুদের জন্য থাকে সেমাই, দুপুরে খিচুড়ি, মাংস ও বিকালে সবজি ও মাংসের স্যুপ। তবে প্রতিদিন এক ধরনের খাবার থাকে না। তালিকায় অন্য খাবারও আছে। তবে এখানেও শিশুদের বয়স বুঝে আলাদা খাবার দেওয়া হয় না।
৬০ জন বাচ্চার যত্নের জন্য এখানে আছেন ১২ জন কর্মী। আছে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, সিসিটিভি ক্যামেরা ও অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র। পুরো কেন্দ্রটির আয়তন সাড়ে ৪ হাজার বর্গফুট। রাজস্ব খাতের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের চাইতে প্রকল্পভিত্তিক এই কেন্দ্রে সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকলেও তা পরিপূর্ণ নয়। কেন্দ্রের ভেতরে পাওয়া গেছে গুমোট গন্ধ।
সেখানে এক শিশু কেঁদে উঠতেই দেখা গেল এক কেয়ারগিভার ধমক দিয়ে প্রশ্ন করছেন–“কেন কান্না করছ তুমি?”। তাতে শিশুটি আর জোরে কান্না শুরু করে।
কেন্দ্রের বাইরে কথা হচ্ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করা এক মায়ের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “এর চেয়ে ভালো মানের ডে কেয়ার আর কোথায় পাব? কিছু বিষয় তো মেনে নিতেই হবে।”
শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থেকে খাবার দেওয়া হলেও এই মা নিজেই সন্তানের জন্য রান্না করে দেন।
কেন্দ্রের অফিস ঘরে এক দম্পতি তাদের শিশুকে ভর্তি করানোর জন্য অনুরোধ করছিলেন ডে কেয়ার কর্মকর্তা সুলতানা পলিকে। কারণ বাচ্চার নানু কিছুদিনের জন্য বাড়ি চলে যাবেন, আর বেসরকারিতে খরচ বেশি।
তবে নিরুপায় হয়েই কর্মকর্তা পলি বললেন, “এই কেন্দ্রের সিট খালি নেই। লম্বা সিরিয়ালে আছে ১০৫ জন।”
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (দিবাযত্ন শাখা) মেহেরুন্নেছা মনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিধিমালাটি করা হলেও এটি পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। আর রাজস্ব খাতে ও প্রকল্পের অধীনে থাকা কেন্দ্রের সেবার মানে পার্থক্য রয়েছে। রাজস্ব খাতের কেন্দ্রে বাজেট কম। নেই যোগ্য স্বাস্থ্য শিক্ষক। দুর্বলতার কারণেই সেবার মানে পার্থক্য তৈরি হয়েছে।”
সেবার মান এতই তলানিতে যে রাজস্ব খাতের কেন্দ্রে সন্তানকে ভর্তি না করাতে মধ্যবিত্ত মায়েদের ‘নিষেধ’ করা হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি জানান, রাজস্ব খাতের কেন্দ্রে সাধারণত পোশাক শ্রমিক, কারখানা শ্রমিক ও গৃহকর্মীর সন্তানরা ভর্তি হয়।
প্রয়োজনের তুলনায় দেশে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় বিপুল সংখ্যক অভিভাবক যে সন্তানদের ভর্তি করাতে পারছেন না তা মানছেন মনিও।
তার ভাষ্য, “এলাকাভিত্তিক দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকা উচিত। তবে আমাদের দেশে এমন নেই। তবে সংকট কমাতে সারা দেশে আরো ৬০টি কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও এক বছরেও কার্যক্রম শুরু হয়নি।”
বেসরকারিতে খরচা ‘অনেক’
স্থান, মান, শিশুর বয়স অনুসারে একটি শিশুর জন্য বেসরকারি কেন্দ্রে মাসিক খরচ হয় প্রায় ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
ধানমন্ডি ২৮ নম্বর সড়কে রয়েছে বেসরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্র কিডস প্যারাডাইস বিডি। এই এলাকার মোটামুটি সচ্ছল মায়েরাই কেন্দ্রটিতে শিশুদের ভর্তি করান।
কেন্দ্রটির পরিচালক তানিমা ফারহানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেবার মান ভাল রাখতে খরচ বেশি হয়, ফ্ল্যাটের ভাড়াও বেশি হয়।
“বিধিমালায় বেসরকারি কেন্দ্রের জন্য কঠিন শর্তের ফলে অনেক ডে কেয়ার সেন্টারই বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্যায় পড়েছেন কর্মজীবী মায়েরা।”
বেসরকারি কেন্দ্রের খরচ কমাতে সরকারি প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণ দরকার মন্তব্য করে তানিমা বলেন, “দরকার নমনীয় বিধিমালা। তাছাড়া সরকারি কেন্দ্রগুলোর মানোন্নয়ন এবং প্রকল্পভিত্তিক কেন্দ্র বেশি বেশি করা দরকার।”
বেসরকারি কেন্দ্রের মানে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও কেবল খরচ বেশি হওয়ায় তা কুলাতে না পেরে কয়েক বছর আগে চাকরি ছেড়েছিলেন তানিশা আহমেদ।
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “প্রাইভেটের খরচ যদি সাধ্যের মধ্যে থাকত, তাহলে আমি সন্তানকে ওখানে দিতে পারতাম। তখন হয়তো চাকরিটাও চালিয়ে যেতে পারতাম।”
কেন্দ্র দরকার কর্মস্থলেও
কোনো কর্মক্ষেত্রে ৪০ জন বা এর বেশি নারী থাকলে ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য আলাদা কক্ষ রাখার বাধ্যবাধকতার কথা বলা আছে শ্রম আইনে।
তবে বাস্তবে কর্মস্থলে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে কেয়ার সেন্টারের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ২০১৬ সালে মতিঝিলের দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় ২১টি বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় পুষ্পিতা নামের একটি কেন্দ্র।
ব্র্যাক ব্যাংক ঢাকার তেজগাঁওয়ে তাদের প্রধান কার্যালয়ে ২০১৭ সালে ‘ক্রেইশ’ এবং গত ফেব্রুয়ারিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আদর’ নামে একটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
আদর নামের কেন্দ্রটিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের দেখভাল করা হয়। বর্তমানে ৩০-৩৫ জনের মতো শিশু সেখানে সেবা পায়। কর্মীদের আয় অনুযায়ী খুব কম খরচে এ সেবা দেওয়া হয় বলে শিক্ষালয়টির অফিস অব কমিউনিকেশনস জানিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি অনুষদ ও একটি ইনস্টিটিউটে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রে ৪৫ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে পরিচালিত কেন্দ্রে ২৫ জন শিশুর দেখভাল করা হয়। এছাড়া সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের কেন্দ্রের ১০ জন শিশুর দেখভাল করার সুবিধা আছে।
বাস্তবতার নিরিখে সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্র ছাড়াও কর্মস্থলে দিবাযত্ন কেন্দ্র জরুরি বলে মনে করেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (দিবাযত্ন শাখা) মেহেরুন্নেছা মনি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সেবার মান বাড়াতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত, যেখানে কর্মীরা প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন।”
দুই বছরেও দিবাযত্ন কেন্দ্র সংক্রান্ত বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ার কারণ কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "বেশ কিছু বিষয়ে এখনো পর্যালোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে দেরি হওয়ার কারণ কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবেন।"