“এসব পানিতে ভেজালে কোনো অসুবিধা হবে না; তবে মাটির সঙ্গ পেলে দুই-তিন বছরের মধ্যে ডিকম্পোজড হয়ে যাবে,” বলেন সহ-প্রতিষ্ঠাতা রনি।
Published : 04 May 2024, 09:34 AM
কফি রংয়ের গয়না হয়ত অনেকে পছন্দ করেন, কিন্তু সেই গলার হার বা কানের দুল যদি হয় কফির নির্যাস থেকে তৈরি!
পরিবেশ রক্ষার উপায় খুঁজতে গিয়ে চট্টগ্রামের একদল তরুণ-তরুণী কফি বর্জ্য থেকে গয়না তৈরির অভিনব পদ্ধতি বের করেছেন। এসব গয়না দেখতে অন্য সাধারণ গয়নার মতোই; কিন্তু সেগুলো তৈরির গল্পটা আলাদা।
উদ্ভাবকরা বলছেন, ব্র্যাকের একটি উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রকল্প ঠিক করতে গিয়ে এ উদ্ভাবনের পথে হেঁটেছেন তারা।
কফি বর্জ্য পরিবেশের ক্ষতি না করে দৃষ্টিনন্দন কাজে ব্যবহারের উপায়ের কথা বলছেন তারা।
‘ইকোকেয়ার’ নামে প্রকল্পের অধীনে গয়নাগুলো তৈরি করা হচ্ছে। সবশেষ ফুলদানিও তারা তৈরি করেছেন বর্জ্য দিয়ে। প্রকল্পের সঙ্গে বর্তমানে জড়িত ছয় তরুণ-তরুণীর কেউ এখনো পড়াশোনা করছেন, আর কেউ সদ্য স্নাতকোত্তরের গণ্ডি পেরিয়েছেন।
নিজেদের উদ্যোগের গল্প বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শুনিয়েছেন ইকোকেয়ার-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা আক্তার আয়ুশী এবং আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রনি।
নিজেদের উদ্যোগের শুরুর গল্প শুনিয়ে আয়ুশী বলেন, পরিবেশবান্ধব ও নারীর ক্ষমতায়নকে কেন্দ্র করে একটি প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা ছিল তাদের। অনেক ভেবে কফি বর্জ্যকে পুনঃব্যবহারযোগ্য করার উপায় মাথায় নেন তারা।
আর রনি বললেন, কফি বর্জ্যের পরিমাণ চায়ের বর্জ্যের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু চায়ের বর্জ্যকে সহজে কম্পোস্ট সার হিসাবে ব্যবহার করা গেলেও নাইট্রোজনের পরিমাণ বেশি থাকায় কফি বর্জ্য পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর।
কফি বর্জ্য থেকে মাটি, পানি দূষণ ও মিথেন গ্যাস নিঃসরণের যে ঝুঁকি আছে তা তুলে ধরতে গিয়ে আয়ুশী বলেন, “প্রচুর পরিমাণ নাইট্রোজেন আছে। আমরা যদি এটাকে সরাসরি মাটিতে ফেলি, তাহলে সেখানে প্রচুর এসিড মাটিতে চলে যায়। তখন ব্যালেন্সটা নষ্ট হয়ে উদ্ভিদটা বাড়তে পারে না।”
তিনি বলেন, রেস্তোরাঁর মালিকরা এটাকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। ফলে এর গন্তব্য হয় ল্যান্ডফিল্ড, না সরালে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ হয়ে থাকে।
“অনেকে সিংকে ধুয়ে ফেলে, সেটা করলে সরাসরি পানির মধ্যে চলে যায়। নিউট্রিশনের যে ভারসাম্য, সেটা নষ্ট হয়ে প্রতিবেশটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনটি ক্ষতির দিক বিবেচনায় আমরা এটার সমাধান হিসাবে কফি ওয়েস্টকে রিসাইকেল করার চেষ্টা করলাম।”
আইডিয়া মাথায় নিয়ে কাজে নেমে পড়ার কথা তুলে ধরে মোহাম্মদ রনি বলেন, “আমরা ভাবলাম যে, এটা দিয়ে আমরা কিছু করতে পারি কি না। আমরা কয়েকটা রিসার্চ পেপার দেখলাম, কফি ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে।
“সেখানে আমরা দেখলাম, দুইটা উপায়ে কফি ওয়েস্ট ম্যানেজ করা যায়, একটা হচ্ছে ডিকম্পোস্ট এবং আরেকটা কফি ওয়েস্ট থেকে নতুন কিছু তৈরি করা।”
কফি বর্জ্যকে সার বানানোর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ও অর্থের যোগ থাকায় গয়না তৈরির ‘সহজ’ পথে হাঁটার কথা জানান তিনি। কিন্তু উদ্যোগের পুরো প্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনকে কেন্দ্রে রাখার কথাও বলেন রনি।
কীভাবে তৈরি হয়
মোহাম্মদ রনি বলেন, শুরুতে কফির গুঁড়া বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাত করেন তারা। এরপর সেটিকে শক্ত রূপ দিতে ‘বাইন্ডিং এজেন্ট’ যোগ করা হয়।
“এই বাইন্ডিং এজেন্টও কিছু গাছ থেকে বের হয়, তা নিচ্ছি আমরা। আমরা ওটার সাথে কেমিক্যাল যোগ করে আঠা তৈরি করেছি।”
এরপর বাজার থেকে কিনে আনা ছাঁচে বসালে নির্দিষ্ট সময় পর গয়না বা অন্যান্য জিনিস তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা জানান তিনি।
প্রকল্পের উদ্দেশ্যে হিসাবে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছে ‘ইকোকেয়ার’। প্রকল্পটিতে চট্টগ্রাম শহরের ঝাউতলা রেলওয়ে বস্তির নারীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
আয়ুশী বলেন, “কাজের অংশ হিসাবে বেনিফিশিয়ারি এরিয়া বাছাই করতে হয়েছে, ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টদের একটা বস্তি এলাকা ছিল। সেখান থেকে তিনজনকে সিলেক্ট করা হয়। যে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয় ছিল, সেজন্য নারীদের টার্গেট করে জুয়েলারি দিয়ে শুরু করেছি।”
কফি বর্জ্যের প্রাপ্তি এবং প্রতি গয়নায় সেটা কতটুকু লাগে, সে বিষয়ে ধারণা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “একটা রেস্তোরাঁ থেকে আমরা কফি ওয়েস্ট নিয়েছিলাম ৫ দিন। ৫ দিনে পরিমাণ ছিল ১৫০ গ্রামের মতো। ওখান থেকে আমরা ১০০’র বেশি জুয়েলারি বানিয়েছি।”
সবশেষে কফি বর্জ্য দিয়ে ফুলদানি তৈরি করেছে ইকোকেয়ার; সেই বর্জ্য দিয়েই কফির মগ বানানোর ভাবনাও আছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
আয়ুশী বলেন, ফুলের পাত্র তৈরিতে ৫০ গ্রামের মতো কফির বর্জ্য প্রয়োজন হয়েছে তাদের। কফি মগ তৈরি করতে ১০০-১৫০ গ্রাম বর্জ্য লাগতে পারে। তবে কমবেশি হতে পারে।
মোহাম্মদ রনি জানান, কফির বর্জ্য দিয়ে তৈরি কানের দুল আর গলার হারের দাম ১৫০ টাকা রাখা হচ্ছে। কফির বর্জ্য সংগ্রহ, ছাঁচ খরচ এবং অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তাদের খরচ হয় ৬০ টাকার উপরে। এখন পর্যন্ত লভ্যাংশের ৭০ শতাংশ যাচ্ছে কাজের সঙ্গে যুক্ত পিছিয়ে পড়া নারীদের হাতে।
কফির বর্জ্য থেকে তৈরি এসব গহনা কতটুকু টেকসই, এমন প্রশ্নে রনি বললেন, “আমরা যে সাবঅর্ডিনেটটা ব্যবহার করতেছি, সেটা বায়োডিগ্রেডেবল, ওটা একটা নির্দিষ্ট তাপ অবধি রাখা যায়। এটা যদি ৫০ ডিগ্রির উপরে যায়, এটা ডিকম্পোজড হয়ে যাবে। আমরা ট্রাই করতেছি, যত কমানো যায়, এই তাপমাত্রাটা।
“ঘরের তাপমাত্রার মধ্যে আমাদের এই অলঙ্কারগুলো বানাতে হয়। এটা মাটিতে ফেলে দেওয়ার দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে অটোমেটিক ডিকম্পোজড হয়ে যাবে।”
ইকোকেয়ার’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা রনি বলেন, “(এসব অলঙ্কার) পানিতে ভেজালে বা সাধারণভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে মাটির সঙ্গ পেলে দুই-তিন বছরের মধ্যে ডিকম্পোজড হয়ে যাবে।”
নিজেদের ভবিষৎ পরিকল্পনার বিষয়ে রনি বলেন, “কফি ওয়েস্ট দিয়ে শুধু জুয়েলারি না, বিভিন্ন তৈজসপত্র বা বাসাবাড়িতে ব্যবহার করার জিনিস তৈরি করব। সেজন্য বাসাবাড়ির ফুলদানি তৈরি করেছি, আর ফুলদানির ভেতরে গাছ দিচ্ছি।”
বাজারে পাওয়া সাধারণ ছাঁচ ব্যবহার না করে নিজেদের নকশায় পণ্য তৈরির ভাবনা জানালেন আয়ুশী।
তিনি বলেন, “আমরা চাচ্ছি, নিজেদের কাস্টমাইজ ডিজাইনগুলো আনতে। মোল্ডটাই কাস্টমাইজ ডিজাইন করতে গেলে ফান্ডটা বেশি লাগছে।
“ফান্ডে যেহেতু পিছিয়ে, সেহেতু কাস্টমাইজ ডিজাইন করতে পারছি না। তাই বাজারে যে মোল্ডগুলো পাচ্ছি, সেগুলো ব্যবহার করতেছি। যেহেতু আমাদের পরিকল্পনা নিজেদেরটা করা, সেহেতু ফান্ড পেলে আমরা নিজেদেরটাই বাস্তবায়ন করব। আমরা ফান্ড অ্যাট্রাক্ট করার ট্রাই করছি।”