“পদ্মা সেতুর সঙ্গে আপনার নাম মিশে গেছে। যতদিন এই বাংলায় সেতু থাকবে পদ্মা নদীর ওপরে, ততদিন শেখ হাসিনার নামও উচ্চারিত হবে স্বগৌরবে।
Published : 05 Jul 2024, 10:27 PM
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠানে এই সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশংসায় ভাসালেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বলেছেন, এই সেতুর সঙ্গে শেখ হাসিনার নাম মিশে গেছে। দুটি নাম সব সময় পাশাপাশি উচ্চারণ হবে।
দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ এই সেতুকে সেতু বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘হার না মানা মানসিকতা, অঙ্গীকার আর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের অনন্য প্রতীক।
শুক্রবার বিকেলে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর প্রকল্পের সমাপনী উপলক্ষে সুধী সমাবেশে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এসব কথা বলেন কাদের।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হল নিজের টাকায় পদ্মা সেতু। এই সাহস তিনি কোথা থেকে পেলেন? বঙ্গবন্ধুর মেয়ে বলেই পেরেছেন।
“বিশ্বব্যাংক অপবাদ দিয়ে সরে গেল ২০১২ সালের জুলাই মাসে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন, ‘আমি আমাদের টাকায় পদ্মা সেতু করব।’ আমার আজও মনে পড়ে।”
এই ঘোষণার পরে খোদ সরকার এবং দলেরই অনেকে তা বিশ্বাস করতে পারেননি উল্লেখ করে কাদের বলেন, “নেত্রী যখন ঘোষণা দিলেন এটা নিয়ে শোরগোল।...পাগল নাকি! বিশ্বব্যাংক যদি পদ্মা সেতু না করে, আমাদের কি এমন টাকা আছে যে, আমরা করতে পারব? “
“নেত্রী, আপনার সহকর্মীরাও সমালোচনায় মুখর। আমাকে উদ্দেশ করে অনেকই কত কথাই না বলেছেন। আজ আমরা পদ্মা সেতুর সমাপনী অনুষ্ঠান করছি”, শেখ হাসিনাকে বলেন কাদের।
পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার নামে করার চেষ্টার কথা তুলে ধরে সেতুমন্ত্রী বলেন, “সংসদে দাবি উঠেছিল, সারা বাংলাদেশে বহু মানুষ দাবি তুলেছিল। তিনি (শেখ হাসিনা) বলেন, “পদ্মা সেতু হবে পদ্মা নদীর নামে। আমার নাম ব্যবহার করা যাবে না’।”
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে কাদের বলেন, “পদ্মা সেতুর সঙ্গে আপনার নাম মিশে গেছে। যতদিন এই বাংলায় সেতু থাকবে পদ্মা নদীর ওপরে, ততদিন শেখ হাসিনার নামও উচ্চারিত হবে স্বগৌরবে।
“আপনার সাহস, আপনার দূরদর্শিতা আমাদের বিশাল সম্পদ। সংকটে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সাহস দেয়।”
কমিটমেন্ট কাকে বলে?
পদ্মা সেতুর নির্মাণকে শেখ হাসিনার কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন সেটিও তুলে ধরেন কাদের। বলেন, “কমিটমেন্ট কাকে বলে? এই পদ্মার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা, মনে আছে? ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এর আগের দিন ২৯ সেপ্টেম্বর পদ্মা এলাকায় ঘর কুয়াশা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। প্রথম স্প্যান পিলারের ওপর বসবে। নেত্রী তখন ওয়াশিংটনে, নেত্রীকে ফোন করলাম। তৎকালীন সচিব আনোয়ার সাহেব আমার পাশে। নেত্রীকে বললাম, ‘প্রথম যে স্প্যানটা বসবে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনি ফিরে আসলে আপনার উপস্থিতিতে প্রথম স্প্যান বসাব।
“তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশিংটন থেকে বললেন, ‘আমার জন্য পদ্মা সেতুর কাজ এক মিনিটও অপেক্ষা করা যাবে না। এটা হল কমিটমেন্ট। এই কমিটমেন্টে সোনালি ফসল এই পদ্মা সেতু।”
পদ্মা সেতু নির্মাণে বহু চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা ছিল উল্লেখ করে আরও একটি ঘটনা বলতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, “এক মধ্যরাতে কন্ট্রাকটরদের মাথায় হাত। ওইদিকে জাজিরা ভাঙছে, এদিকে লৌহজং ভাঙছে। এরই মধ্যে কন্ট্রাক্টরদের ইয়ার্ড, যন্ত্রপাতি হুমকির মুখে। পানির স্রোত ঠেকানো যাচ্ছে না।
“প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোন ধরলেন। আমার দু চোখ ভরে তখন পানি। আমি অশ্রুসংবরণ করতে পারছিলাম না। একই অবস্থা খন্দকার আনোয়ারের, একই সঙ্গে পিডি শফিকেরও। নেত্রী সঙ্গে সঙ্গে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কন্টাক্ট করলেন এবং এখানে যত দরকার জিও ব্যাগ সরবরাহ করতে বললেন।
“এই হচ্ছে শেখ হাসিনা। এই হচ্ছে তার বিচক্ষণ, দূরদর্শী, সাহসী নেতৃত্ব। আজ স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়ছে।”
তারা জানে পদ্মা সেতু কী ও কেন?
ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে সেতু হওয়ার আগের কঠিন বাস্তবতা উঠে আসে।
তিনি বলেন, “মুমূর্ষু মাকে নিয়ে যে ছেলেটি ঘণ্টা পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিল ওপারে, ফেরি নেই, লঞ্চ নেই, স্পিড বোট নেই, পদ্মার তীব্র স্রোত; দিন যায়, রাত গড়ায়, সকাল আসে, ওই পদ্মা পাড়েই মা ঢলে পড়ে না মৃত্যুর কোলে। সেই মাতৃহারা সন্তান জানে পদ্মা সেতু কী এবং কেন?
“লঞ্চ ডুবি, মায়ের বুকে সেদিন বাচ্চা, প্রবল স্রোত, স্রোতের টানে মায়ের আঁচল থেকে ভেসে গেল অবুঝ শিশু। সে সন্তানহারা হল। মা জানে পদ্মা সেতু কী এবং কেন?
“বাবার জানাজায় অংশ নিতে মাওয়া প্রান্তে ছেলে বসে আছে, লঞ্চ নেই, ফেরি নেই, স্পিড বোট নেই, জানায়ায় ছেলে অংশ নিতে পারেনি, সে জানে পদ্মা সেতু কী এবং কেন?”
ওবায়দুল কাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মনজুর হোসেন। প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই পদ্মা সেতুর থিম সং প্রচার করা হয়। সেতুর ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্রও দেখানো হয়।
সুধী সমাবেশে সেতুমন্ত্রীর ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা স্মারক ও পদ্মা সেতুর একটি আউটলুক উপহার দেয়া হয়।
পেছনের কথা
২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার বছরে নকশা ও অর্থায়নের বিষয়টি চূড়ান্ত না করেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ওই বছর বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসার পর প্রকল্পটি আর গতি পায়নি।
২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকের সভায় ১০ হাজার কোটি টাকায় কেবল কংক্রিটের সড়ক সেতু করার প্রস্তাব অনুমোদন হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে নকশ পরিবর্তন করে। স্টিল দিয়ে দোতলা সেতু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার নীচ দিয়ে রেল চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এতে সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যায়। আবার জমি অধিগ্রহণের খরচ বেড়ে যায় তিন গুণ দর দেওয়ার বিষয়ে সরকারের নীতির কারণে, তাদের পুনর্বাসন ও নদী শাসনেও বাড়ে ব্যয়।
শেষ পর্যন্ত ৩২ হাজার কোটি টাকায় নির্মাণ হয়েছে সেতুটি।
নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটিতে যুক্ত থাকার কথা ছিল উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর।
বিশ্ব ব্যাংকসহ চারটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সংস্থাগুলো।
এই অভিযোগ নিয়ে দেশের রাজনীতিতে ঝড় উঠলেও শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে ছিলেন অটল। শুরু থেকেই সরকার এই অভিযোগের পেছনে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহম্মদ ইউনূসের প্রতি আঙুল তোলে।
নির্ধারিত বয়স পেরিয়ে যাওয়া ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেয় বাংলাদেশ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন, ড. ইউনূস লবিং করিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংককে অর্থায়ন স্থগিত করিয়েছেন।
ড. ইউনূস এই অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করেছেন।
পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করা কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে সে দেশের আদালতে বিশ্বব্যাংক যে মামলা করেছিল, তা নাকচ করে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রায় আসে। এতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগকে ‘গালগপ্প’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করেন বিচারক।
এর আগেই বিশ্বব্যাংক পরে ফিরে আসার আগ্রহ দেখালেও বঙ্গবন্ধুকন্যা সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালের নভেম্বরের শেষে সেতুর কাজ শুরু হয়। আট বছর পর চালু হয় সড়ক যোগাযোগ।
এই ইতিহাসের কারণে আওয়ামী লীগ সব সময় তার নেতা শেখ হাসিনার প্রশংসা করে আসছে। এই সেতু শেখ হাসিনার নামে করতে সংসদে দাবিও তুলেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সংসদ সদস্য, তবে তা নাকচ করে দেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই।