”এটা থেকে বের হয়ে আসতে হলে শীর্ষ পদগুলোতে দলীয় লোকজন বসানোর চর্চা থেকে বের হয়ে আসতে হবে,” বলেন স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব।
Published : 21 Aug 2024, 01:28 AM
দেশের আনাচে-কানাচে আর শহর থেকে নগরজুড়ে বিস্তৃত স্বাস্থ্য খাত সচল রাখতে অধিদপ্তরের বেশির ভাগ পদক্ষেপ নেওয়ার কাজগুলো গুছিয়ে দেন মাঝারি স্তরের কর্মকর্তারা। তেমনই এক কর্মকর্তা অধিদপ্তরে আসছেন না কয়েকদিন ধরে। সরকার পতনের পরের তিন দিন না এলেও অন্তর্বর্তী সরকার কাজ শুরুর পর তিনিসহ অন্য কর্মকর্তারা আসা শুরু করেন।
মঙ্গলবার মোবাইল ফোনে ওই কর্মকর্তা হেনস্তার ভয়ে নাম নামপ্রকাশ না করার অনুরোধ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ১৪ অগাস্টের পর থেকে আর অফিসে যাচ্ছেন না তিনি। বাসায় বসে কিছু কাজ করার চেষ্টা করছেন। আগের দিন সোমবার স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সামনে অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের হেনস্তার পর তিনি আরও ভয়ে আছেন।
“১৫ তারিখ থেকে তারা অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছে। সেদিন থেকেই আর অফিসে যেতে পারছি না, অনেককে বাধা দেওয়া হয়েছে। সেখানে শুধু চিকিৎসকরা আন্দোলন করলে কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু অধীনস্ত কর্মচারীদের কেউ যদি চড়াও হয় তখন লজ্জায় পড়তে হবে। সরকারি চাকুরি করি, পোস্টিং দিবে সেটার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু অ্যাসল্ট, ইনসাল্ট তো মেনে নেওয়া কঠিন। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সামনেই যার করেছে আমাদের অবস্থা তো আরও খারাপ।”
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর থেকে দাপ্তরিক কাজকর্ম প্রায় বন্ধ বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দ্বিতীয় শ্রেণির একজন কর্মকর্তা। অধিদপ্তরজুড়ে গত কয়েকদিন দাবি আদায় আর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার কারণে তৈরি হওয়া অস্থিরতায় সব বন্ধ হয়ে আছে।
বৈরি এ পরিস্থিতিতে নিজের নাম প্রকাশ না করা অনুরোধ করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কর্মকর্তারা অফিসে না আসায় অনেক ফাইল আটকে আছে।
“৫ তারিখের পর থেকেই স্যারেরা আসছেন না। আসলেও কিছুক্ষণ পর চলে যাচ্ছেন। স্যারেরা আসতে না পারলে আমি ফাইলটা সাইন করাব কাকে দিয়ে। ফাইল নিয়ে তো স্যারদের বাসায় যাওয়া যাবে না। গত কয়েকদিন ধরে প্রশাসনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে।”
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলীয় পরিচিতি না থাকা কর্মকর্তারা যেমন আসছেন না, তেমনি ক্ষমতার পালাবদলের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত হাসপাতালে আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতিও কমে গেছে। অনেকে নিরাপত্তার কারণে অনুপস্থিত থাকেন, কাউকে তাদের কর্মস্থলে আসতে দেওয়া হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী নতুন সরকার গঠনের পর বিভিন্ন দাবি আদায়ে নানা কর্মসূচি এবং নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা চিকিৎসক ও কর্মচারীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। যারা অফিসে আসছেন তাদের অনেকেও অফিস সময়ে এসব কর্মসূচিতে উপস্থিত হচ্ছেন।
এসব কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে চিকিৎসা কার্যক্রমেও।
এসব নিয়ে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এগুলো স্বাস্থ্যখাতের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা। এটা থেকে বের হয়ে আসতে হলে শীর্ষ পদগুলোতে দলীয় লোকজন বসানোর চর্চা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
“যারা দলীয় রাজনীতি করে তাদেরই সরকার পদে বসায়, উপযুক্ত বা অনুপযুক্ত যাই হোক। এ কারণে নতুন সরকার আসলে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়। যারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে তারা চায় সেখানে তাদের বসানো হোক। বিষয়টির সমাধান না করলে ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকবে। মাঝখানে রোগীদের ভোগান্তি হয়।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্থবিরতার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূর জাহান বেগমের মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি ধরেননি।
মঙ্গলবারও আওয়ামীপন্থি চিকিৎসক-কর্মচারীদের অপসারণের দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিক্ষোভ হয়েছে। বাধা পেয়ে ঢুকতে পারেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকসহ অনেক কর্মকর্তা।
অপরদিকে ঢাকার শাহবাগে বিক্ষোভ করেছেন কয়েক হাজার স্বাস্থ্যকর্মী। অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও।
প্রবল গণআন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এমন সব ঘটনা ঘটছে।
প্রায় স্থবির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
আওয়ামী লীগ সরকার ৫ অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই অস্থিরতা শুরু হয়েছে পুরো স্বাস্থ্য খাতে। অধিদপ্তরের আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসকদের বেশির ভাগ অফিসে আসছেন না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকসহ কিছু কর্মকর্তা অফিস করা শুরু করেছিলেন।
তিন দফা দাবিতে গত ১১ অগাস্ট মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার এসোসিয়েশন।
দুদিন পর ১৩ অগাস্ট থেকে মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের পদত্যাগসহ দুই দফা দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন চিকিৎসকরা। সেদিন থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আগের মহাপরিচালক অফিসে আসা বন্ধ করে দেন।
ওই কর্মসূচি চলার মধ্যেই ১৫ অগাস্ট আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে নার্সসহ চিকিৎসা খাতের নিয়োজিত বিভিন্ন কর্মচারীরাও। সেদিন থেকেই অনেক কর্মকর্তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আসতে পারছেন না।
এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ১৭ অগাস্ট মহাপরিচালক খুরশীদ আলমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিনকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।
তবে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার পর নিজের কার্যালয়ে আসতে পারছেন না রোবেদ আমিন।
মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে, রোবেদ আমিনের পাশাপাশি অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীরের নিয়োগ বাতিল চেয়ে বঞ্চিত চিকিৎসক, কর্মচারীদের ব্যানারে নানা স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভবনের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। তালা দেওয়া হয়েছে মহাপরিচালকের রুমেও।
ভবনের ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ কর্মকর্তা অফিসে নেই। অনুপস্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে পরিচালক, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজারসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা আছেন।
মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনের কর্মসূচিতে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে আসা চিকিৎসক-কর্মচারীরাও ছিলেন। ঢাকার বাইরের হাসপাতাল থেকেও এসেছেন কয়েকজন। ছুটিতে না থাকলে ওই সময় তাদের অফিসে কাজে থাকার কথা।
জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মো. মামুনুর রশিদের অভিযোগ, বিগত সরকারের আমলে তারা প্রচণ্ড রকম নির্যাতন এবং বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তাকেও ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছিল।
”চিকিৎসার জন্য রোগ নির্ণয় জরুরি যেটা আমরা করি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আমরা যারা বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় এক্সপার্ট তাদেরকে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করে দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষিত লোকের অভাবে সঠিকভাবে পরীক্ষাটা করা সম্ভব হয়নি।“
অফিস সময়ে তার কাজটি কে করছে জানতে চাইলে মামুনুর রশিদ বলেন, “আমরা যেহেতু এতদিন ধরে বৈষম্যের শিকার ছিলাম। এ কারণে এই প্রতিবাদে আসতে হচ্ছে। আমাদের কাজগুলো রোস্টার অনুযায়ী করছি। রোগী সেবাও করছি, আন্দোলনও করছি।”
ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক রোবেদ আমিন মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অফিস করব কিভাবে, আমার রুমে তালা দিয়ে রেখেছে। অফিসেই যেতে পারছি না, তবে বাসায় বসেই কিছু কাজ করছি। কাল উপদেষ্টা মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলব। তিনি যেভাবে নির্দেশনা দেবেন সেভাবেই কাজ করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
বুধবারও ঢাকায় চিকিৎসকদের কর্মসূচি আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে কালও সমবেত হবে চিকিৎসক ও কর্মচারীরা। এছাড়া চার বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা বা বিএসসি ডিগ্রিধারীদের প্র্যাকটিসের নিবন্ধনের দাবিতে এদিন বিএমডিসিতে লংমার্চ করবে চিকিৎসকরা।
১৪ হাজার কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার ঢাকায়
চাকরি রাজস্বকরণের দাবি নিয়ে সারাদেশের প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) সোমবার থেকে ঢাকার শাহবাগে অবস্থান নিয়েছেন।
দেশের ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন করে সিএইচসিপি কর্মরত আছেন। তারা স্থানীয় মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেন। তাদের সবাই একসঙ্গে ঢাকায় চলে আসায় বন্ধ আছে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম।
মঙ্গলবার শাহবাগে দিয়ে দেখা গেছে, জাদুঘরের সামনের সড়কের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার অংশে অবস্থান নিয়েছেন কয়েক হাজার সিএইচসিপি। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা ভজন মোহন্ত নামে একজন সিএইচসিপি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা কমিউনিটি ক্লিনিকে ‘কর্মবিরতি’ লেখা টানিয়ে দিয়ে এসেছেন।
“আমরা উপজেলায় জানিয়ে আসছি যে আমরা কর্মবিরতিতে আছি। আমরা মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেই। আমরা আসছি এখন চিকিৎসা বন্ধ। কিন্তু এছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। গত ১৩ বছর আমাদের বেতন বাড়ছে না, গত তিন মাস ধরে বেতন হচ্ছে না ফান্ড না থাকায়। এ কারণে আমরা চাই আমাদের চাকুরি রাজস্বখাতে নেওয়া হোক।”
বগুড়ার সারিয়াকান্দি থেকে আসা জাহিদ উদ্দিন নামে আরেকজন সিএইচসিপি বলেন, “আমাদের ক্লিনিকে প্রতি মাসে এক হাজারের বেশি রোগীকে সেবা দেই। কিন্তু গত ১৩ বছরে এক টাকাও বেতন বাড়েনি, বেতন না বাড়লে কেমনে চলি বলেন?”
এদিকে বৈষম্যের শিকার চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পদোন্নতি, পদায়নের দাবিতে মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. মিলন চত্বরে মানববন্ধন ও অবস্থান ধর্মঘট করার কথা ছিল ড্যাব ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার।
এদিন ১২ জন শিক্ষকের ক্লাস বর্জন এবং তাদের বদলির দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে দেওয়া ওই স্মারকলিপিতে অভিযোগ করা হয়েছে ওইসব শিক্ষক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধীতা করেছিলেন।
অপরদিকে ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টর রেজিস্ট্রারসহ শীর্ষ ৬ কর্মকর্তার পদত্যাগের কারণে অচলবস্থা তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সেখানে চিকিৎসা কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে।
বিএসএমএমইউর একজন চিকিৎসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক প্রধান। নতুন ভিসি নিয়োগ না দেওয়ায় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। তবে চিকিৎসাসেবা শুরু হয়েছে।”