“নারীর অধিকার যে মানবাধিকার, পুরুষরা এ বিষয়টি বিবেচনায় আনলে সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে।”
Published : 09 Mar 2025, 09:59 PM
আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা বন্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদের মানবাধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক।
রোববার রাজধানীর ধানমন্ডিতে উইমেন্স ভলান্টিয়ার অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এসব সুপারিশ তুলে ধরেন নেটওয়ার্কের সভাপতি ফাল্গুনী ত্রিপুরা।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও কাপেং ফাউন্ডেশন যৌথভাবে ‘আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ান নিশ্চিত করি: আদিবাসী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুলেখা ম্রংয়ের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফাল্গুনী ত্রিপুরা।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার ৫০ বছরের অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জন একটি বৈশ্বিক দৃষ্টান্ত। নারী-পুরুষ বৈষম্য বা জেন্ডার ব্যবধান নিরসনে বাংলাদেশের অবস্থান ধীরে ধীরে উন্নীত হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের সামগ্রিক নারী সমাজের সাথে নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে এবং নিজ সমাজের উন্নয়নে, আদিবাসী অর্থনীতিকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
“তবে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসীর অর্ধেক অংশ নারীদের যুগ যুগ ধরে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। যা তাদের টেকসই উন্নয়নে অংশীদারত্বের পথকে রুদ্ধ করে তুলেছে।”
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেশি কিছু উদ্যোগের কথা বলা হলেও আদিবাসী নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তা ‘যথেষ্ট নয়’।
নারী ও কন্যাশিশুদের সুরক্ষার জন্য জাতীয় বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা থাকলেও আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য যে নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই, সে কথা তুলে ধরে ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, সংবিধানে নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পৌরসভাসহ উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য আইন পাস হয়।
“এতে জাতীয় স্তরে ও স্থানীয় প্রশাসনে নজিরবিহীনভাবে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু আদিবাসী নারীদের জন্য জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোতে কোনো আসন সংরক্ষিত নেই। ফলে দেশের শাসনব্যবস্থায় ও উন্নয়নে বিশেষ করে সমতলের আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই বললেই চলে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে জেন্ডার বাজেটেও আদিবাসী নারীদের জন্য পৃথক কোনো বরাদ্দ নেই। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ কার্যাদি বিভাগ থেকেও আদিবাসী নারীদের ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক কাজে ও আদিবাসী নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিশেষ বরাদ্দ নেই। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ নীতিমালায় আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য বিশেষ কোনো কিছু উল্লেখ নেই।”
মূল প্রবন্ধে আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ান নিশ্চিত ও আদিবাসী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১২ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সভাপতি ফাল্গুনী।
>> আদিবাসী নারীর সকল মানবাধিকার নিশ্চিত করা।
>> আদিবাসী নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা বন্ধে দ্রুত ও কার্যকর হস্তক্ষেপ ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিরাপত্তা জোরদার করা।
>> আদিবাসী নারী ও শিশুর উপর সহিংসতার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি প্রদান করা।
>> সহিংসতার শিকার আদিবাসী নারী ও শিশুদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা প্রদান করা।
>> নারী উন্নয়ন নীতিমালায় আদিবাসী নারীদের জন্য আলাদা একটা অধ্যায় রাখা এবং সকল ধরনের নীতিমালা গ্রহনের পূর্বে আদিবাসী নারী নেতৃবৃন্দের পরামর্শ গ্রহণ করা।
>> পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা এবং এ লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করা।
>> আদিবাসী নারীদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।
>> আদিবাসী মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু কমানোর লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
>> ভূমি ও সম্পত্তির উপর আদিবাসী নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং বন, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করা।
>> শিক্ষা কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের জন্য কোটা নিশ্চিত করা এবং বিধবা ও বয়স্ক ভাতা নিশ্চিত করা।
>> জাতীয় সংসদে অঞ্চলভিত্তিক এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আদিবাসী নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
>> সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও মন্ত্রণালয় গঠন করা।
আলোচনায় ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, “নারীরা এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সব ক্ষেত্রেই অবদান রাখছে। আদিবাসী নারীরাও সেক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় আদিবাসী নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে তাদের ওপর নেমে আসে নানান ধরনের সহিংসতা, যা নারীর উন্নয়নে দৃষ্টান্তমূলক বাধা সৃষ্টি করছে। এর অন্যতম কারণ হল সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের কথাই প্রাধান্য পায়।
“নারীর অধিকার যে মানবাধিকার, পুরুষরা এ বিষয়টি বিবেচনায় আনলে সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভয়ের ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। নারী উন্নয়নে প্রান্তিক নারীদের কথা মূলধারায় যুক্ত করতে হবে।”
আদিবাসীদের যেখানে সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই, সেখানে আদিবাসী নারীরা কীভাবে তাদের অধিকারের কথা বলবে– সেই প্রশ্ন রাখেন আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সভাপতি ফাল্গুনী।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুলেখা ম্রং আদিবাসী নারীদের ওপর চলমান ইভটিজিংয়ের কথা তুলে ধরে বলেন, “বাঙালি কিংবা স্যাটেলার জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই আদিবাসী নারীর প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। নারীদের নিয়ে যেসব অপসংস্কৃতি সমাজে চর্চা হয় তা বন্ধ করতে হবে। স্বামী মারা গেলে চুড়ি পরা যাবে না এসব বাদ দিতে হবে।
“আমার স্বামী মারা গেছে তবুও আমি চুড়ি পরি। এ ছাড়া সমাজে বাল্যবিবাহ ও ধর্ষণ বন্ধ হয় নাই। সমাজে এত এত সমস্যা তবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
“আমাদের নারীদেরকে মনে রাখতে হবে আমরা ঘর করি স্বামীদের সাথে। স্বামী যদি নির্যাতন করে, প্রকৃত ভালোবাসা না দেয়, তাহলে নারীর উন্নয়ন সম্ভব নয়। কেননা অনেকাংশেই নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণ হয় আমার স্বামী দ্বারা।”
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক শাহনাজ সুমি বলেন, “আদিবাসী ও প্রান্তিক নারী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে আদিবাসী কোটার কথা তুলতে হবে। তাদের নিজস্ব দাবি-দাওয়া নিজেদেরকেই আন্দোলন দ্বারা মূলধারায় যুক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সৃষ্টিতে আদিবাসীদের রক্ত রয়েছে। সমাজকে টিকিয়ে রাখে নারী, সেটা সমতলে কিংবা পাহাড়ে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, “২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর সর্বপ্রথম এই গণঅভ্যুত্থানকে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান বলে নারীদেরকে আলাদা করা হয়। দেশের রাজনীতিবিদ, লেখক, সাহিত্যিকরা এই গণঅভ্যুত্থানকে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান না বলে শিক্ষার্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থান বললেই পারতেন। নারীরা তাদের সাহসিকতার জন্য নানান ধরনের পুরস্কার পাচ্ছেন কিন্তু কল্পনার চাকমার গল্প কোথায়? তার পুরস্কারটি কোথায়?
নারীদের ওপর চলমান সহিংসতা বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার টিকে থাকার কোনো মোরাল গ্রাউন্ড নেই।”
স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, “ওয়াজের নামে মৌলবাদীরা নারী বিদ্বেষী আলাপ দ্বারা নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করছে এবং বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে। তারই পরিণতি হিসেবে আমরা আজ বাংলাদেশ শিশু আছিয়ার ওপর ঘটে যাওয়া সহিংসতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। হিজাব পরিধান কিংবা ওড়না পরিধান শুধুমাত্র ইসলামী সিম্বল না। বিশ্বে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নারীরাও হিজাব পরে থাকেন। তাই এটাকে নিয়ে রাজনীতি করা একদম উচিত নয়।”
নারীদের উন্নয়নে তিনি নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
জাতীয় নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, “আমাদের জন্যই আজন্ম পাপ। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী যে বৈষম্যহীন সমাজ আমরা চেয়েছিলাম সেখানে বর্তমানে নারীদের উপস্থাপন বলে দেয় শুরু থেকেই এদেশে আবারো বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।”
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য লুনা নূর বলেন, “দেশে গণতন্ত্র ও সহনশীলতার চর্চা না থাকলে নারীদের বিশেষভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন আদিবাসী নারীর অস্তিত্ব স্বীকার করা সম্ভব নয়। বর্তমানে তৌহিদী জনতার দেওয়া সংবিধানবিরোধী স্লোগান নারী পুরুষের সমতা নিশ্চিতে অন্যরকম বাধা হিসেবে প্রতীয়মান হবে।
“আমাদের আদিবাসী সমাজে গারো ও খাসিয়া বাদে বাকি গোষ্ঠীতে নারীরা কোনো সম্পত্তির ভাগ পান না। আমাদেরকে এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে আলোচনায় আনতে হবে। নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। হেডম্যান শুধু পুরুষ কেন নারীরা কেন নয়?”