‘জ্যাকব ভাইর ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘আমরা সবাই জ্যাকব সেনা, ভয় করি না বুলেট-বোমা’ স্লোগান দিতে দিতে তার পেছন পেছন আসেন সমথর্করা।
Published : 01 Oct 2024, 09:22 PM
সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলমকে হত্যা চেষ্টার মামলায় ভোলা-৪ (চরফ্যাশন-মনপুরা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের রিমান্ড শুনানিকে ঘিরে আদালতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিত সৃষ্টি হয়েছে।
মঙ্গলবার ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করে তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মো. জহুরুল ইসলাম।
‘কঠোর’ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সকাল ১০টার দিকে আদালতে আনা হয় জ্যাকবকে। এরপর তাকে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলার হাজতখানায় রাখা হয়।
বেলা ৩টার কিছুক্ষণ আগে তাকে একই ভবনের ষষ্ঠ তলার ৬০২ নম্বর কক্ষে ঢাকার ১ নম্বর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে আনা হয়। এ সময় বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরানো হয় তাকে।
দুপুর ২টা ৫৬ মিনিটে সিঁড়ি দিয়ে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলার হাজতখানা থেকে ষষ্ঠ তলার এজলাস কক্ষে আনার সময় জ্যাকবের সমর্থনে মিছিল করেন তার কয়েকজন সমর্থক।
‘জ্যাকব ভাইর ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘আমরা সবাই জ্যাকব সেনা, ভয় করি না বুলেট-বোমা’ স্লোগান দিতে দিতে তার পেছন পেছন আসেন সমথর্করা।
জ্যাকবের সঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনিকেও আদালতের এজলাসে আনা হয়।
এসময় মিছিলের ধ্বনিতে আদালতপাড়ার আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা হতচকিত হয়ে পড়েন। ষষ্ঠ তলার এজলাস কক্ষের সামনে মিছিলসহ জ্যাকব ও গিনিকে আনা হলে ক্ষিপ্ত হন বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীরা।
এ সময় একজন আইনজীবী এজলাস কক্ষ থেকে বেরিয়ে তাদেরকে নিবৃত্ত করেন। তিনি আঙুল উঁচিয়ে উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, “এই চোরের পক্ষে কে? চোরের পক্ষে কে আছেন? চোরের পক্ষে একটা স্লোগান হবে না।”
এ সময় জ্যাকবের এক সমর্থক বিতণ্ডা করতে চাইলে তিনি তাকে ধাক্কা দিয়ে এসলাস কক্ষের সামনে থেকে সরিয়ে দেন। এরপর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা বাঁশি বাজিয়ে জ্যাকব সমর্থকদের এজলাস কক্ষ থেকে সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
রিমান্ড শুনানিতে রাষ্ট্র পক্ষে সহযোগিতার জন্য উপস্থিত ছিলেন বিএনপির অন্যতম জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী।
জ্যাকব সমর্থকদের মিছিল করতে দেওয়ায় তিনি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশদের ওপর ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন, “তারা কীভাবে আদালতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ধৃষ্টতা দেখাতে পারে? পুলিশ নিচে কী করছে? পুলিশের তো উচিত ছিল নিচেই ব্যাটিং করে তাদের নিবৃত্ত করা!
“এভাবে চললে আমরা আইনজীবীদের খবর দেব। আপনারা সামলাতে না পারলে আইনজীবীরা বিষয়টি দেখবে।”
কিছুক্ষণ পর ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম রাবেয়া বেগম রিমান্ড শুনানির জন্য এজলাসে উঠলে এ বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ওমর ফারুক ফারুকী।
ফারুকীর কথায় সায় দিয়ে আদালতে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশকে আরও সতর্ক হতে নির্দেশ দিয়ে শুনানি শুরু করেন বিচারক।
শুনানিতে আইনজীবী ফারুকী বলেন, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি ছিল। সেখানে ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন নেতা কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেলেন। সেদিন আমিনবাজার ব্রিজ এলাকায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ডাকসুর সাবেক এজিএস নাজিম উদ্দিন আলম।
“সেই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের ছোড়া শটগানের গুলিতে নাজিম উদ্দিন আলম গুরুতর আহত হন এবং তার পেটে ও মাথায় গুলি লাগে। সেদিনের সে ঘটনায় নির্দেশদাতা অন্যতম এই আসামি। নাজিম আলম একই আসনে ওনার আগে সংসদ সদস্য ছিলেন।”
রিমান্ডের বিরোধিতা করে জ্যাকবের জামিন চেয়ে শুনানি করেন আইনজীবী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ও মো. আবুল কাসেম।
শাহাবুদ্দিন বলেন, মামলার বাদী এবং আসামি দুজনের বাড়িই ভোলায় এবং তারা দুজন একই এলাকা থেকে সংসদ নির্বাচন করেন। এটা থেকে স্পষ্ট হয় যে তাকে প্রতিহিংসাবশত এই মামলায় জড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে কাউকে রিমান্ড নিতে হলে ঘটনা স্থলে আসামির উপস্থিতি থাকতে হয় অথবা ঘটনায় তার সহায়তা থাকতে হয়। কিন্তু মামলার আবেদনে কোথায় তার উপস্থিতি অথবা সহায়তার সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই লেখা নেই। তাই তাকে রিমান্ডে নিয়ে তথ্য উদঘাটনের কথাটি অযৌক্তিক।
এসময় জ্যাকব আদালতে কিছু বলার অনুমতি চাইলে অনুমতি দেন বিচারক। তিনি আদালতে বলেন, “আমি একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। আমার পিতা একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৯ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমি ২০০৮ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি।
“আমি আমার বাবার আদর্শকে ধারণ করে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় আমি আমার এলাকায় কোনো রূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে দিইনি।
তিনি বলেন, “মামলার অন্য আসামিরা, দেখবেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের লোক। এ মামলায় আমি ছাড়া সবাই সরকারি লোক। আমি কখনোই ঢাকার রাজনীতি করিনি, আমি কেন্দ্রীয় রাজনীতির কেউ ছিলাম না, তাই এ মামলায় নির্দেশদাতা হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
জবাবে আইনজীবী ফারুকী বলেন, তিনি ভোট চুরি করেছেন, কেন্দ্র দখল করে নিজেকে এমপি ঘোষণা করেছেন। তিনি যদি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের আমলে সংসদ সদস্য হয়ে থাকেন, পরবর্তীতে গত ১৫ বছর ধরে কেন স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন, তার জবাব দিতে পারবেন?
ফারুকী বলেন, বলা হচ্ছে তারা দুজনেই ভোলার সংসদ সদস্য। এটাতে তো এটাই স্পষ্ট হয় যে, তিনি এলাকায় হত্যা না করে তাকে ঢাকায় হত্যা করে নিরাপদ থাকতে চেয়েছেন।
প্রায় ২৫ মিনিট শুনানি শেষে জামিন আবেদন নাকচ করে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন বিচারক।
এর পরপরই একই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আশুলিয়া থানার শিক্ষার্থী রবিউস সানি শিপু হত্যাচেষ্টা মামলায় গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনির রিমান্ড শুনানি হয়। শুনানি শেষে তার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
শুনানি শেষে রিমান্ডের আদেশ দিয়ে এসলাসেই বসে থাকেন হাকিম রাবেয়া বেগম। তিনি পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, বিজ্ঞ আইনজীবীরা সবাই নেমে গেলে তারপর এদেরকে এলজাস থেকে নামাবেন। প্রায় ৫ মিনিট পর এজলাস কক্ষ খালি হলে বিচারক এজলাস থেকে খাস কামরায় চলে গেলে এজলাস কক্ষ থেকে জ্যাকব ও মাহবুব আরা গিনিকে নিয়ে যায় পুলিশ।
তাদেরকে এজলাস থেকে নামানোর কিছুক্ষণ পর আবারও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় আদালত প্রাঙ্গণে। সেখানে জ্যাকব সমর্থক কয়েকজন কর্মীকে দেখতে পেয়ে তাদের ওপর চড়াও হন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।