কৃষকদের ভাষ্য, বালুর স্তুপ জমে যাওয়াই অধিকাংশ জমিই এবার চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
Published : 03 Sep 2024, 12:28 AM
“হানির লাই দুইবার জালাবিছানা করছি, পরেরবার রোয়া রুকছি বানের পানিতে হেগুন বেক বালুর তলে চাপা পড়ি গেছে। এখন মন কর যেন মরি যাই।”
বলছিলেন ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের উত্তর কাউতলী গ্রামের কৃষক হারুন।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় হারুনের মত এ ইউনিয়নের সব কৃষকের জমি পানিতে তলিয়েছে, জমে গেছে বালুর স্তর।
কৃষকদের ভাষ্য, বালুর কারণে এবার বেশিরভাগ জমি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। যেসব জমিতে বালুর স্তর কম পড়েছে, কেবল সেগুলোতে চাষাবাদ হতে পারে, যা বেশ কষ্টসাধ্য।
বন্যার শুরুতেই আক্রান্ত হয় ভারতঘেঁষা মির্জানগর ইউনিয়ন, যেই বান ছড়িয়ে পড়ে ফেনীজুড়ে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, নদী ও সীমান্তবর্তী এ ইউনিয়নটি বন্যা কবলিত এলাকা। গত দুই মাসে এ ইউনিয়নটি তিন দফায় বন্যা আক্রান্ত হয়। তবে শেষবারের বন্যার মতো ভয়াবহতা তারা আগে কখনও দেখেননি।
আষাঢ়ের বৃষ্টির মধ্যে ১ জুলাই বানের মুখে পড়ে মির্জানগর। এরপর ২ অগাস্ট বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। বাঁধটি সাময়িকভাবে সংষ্কার করা হলেও ২০ অগাস্ট অতি বৃষ্টি আর ঢলের পানিতে সেই বাঁধের বেশকিছু অংশ ভেঙে যায়; দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যার।
ইউনিয়নের কাশিনগর, উত্তর কাউতলী, দক্ষিণ কাউতলী ও চম্পক নগর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ফসলি জমিগুলোর বেশির ভাগ অংশে বালুর স্তুপ জমেছে। বন্যার আগে আবাদ করা আমন ধানের চারাগুলো বালুর নিচে চাপা পড়েছে।
কৃষক হারুর জানালেন, তিনি তিন কানি এবং তার চাচা আবুল খায়ের পাঁচ কানি জমিতে আমান আবাদ করেছিলেন। কিন্তু বন্যায় জমিতে বালুর স্তূপ জমে সব শেষ হয়ে গেছে।
মির্জানগর ইউনিয়নের মূল সড়ক দিয়ে হেঁটে যাবার সময় পঁচা গন্ধ লাগছিল। কৃষকরা জানালেন, সেটি ধান পঁচা গন্ধ। মানুষের বাড়ির গোলার ধানে পানি ঢুকে সেগুলো পঁচে যাচ্ছে। যতটুকু পারছে, তারা সেগুলো রোদে শুকিয়ে ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। তবে বেশির ভাগ ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত ২০ অগাস্ট রাত থেকে এ ইউনিয়ন পুরোপুরি তলিয়ে যায়, যা তিন থেকে চারদিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
হারুনের দাবি, ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম সাত থেকে আট ফুট পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। সড়ক, খাল, বিল ও নদী সবকিছুই পানিতে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সবগুলো ঘর তলিয়ে গিয়েছিল পানিতে। কেউ প্রতিবেশীর দ্বিতল পাকা ভবনে, কেউ স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল।
পানির তীব্র সাথে স্রোত থাকায় প্রথম দুই দিন কেউই আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বের হতে পারেনি। ওই সময় সেখানে কেউ ত্রাণও পৌঁছাতে পারেনি। সাঁতার কাটা ছাড়া তাদের কোন বিকল্প ছিল না।
নিজের দুই কানির ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে বালুর স্তুপ জমেছে জানিয়ে চম্পক নগর গ্রামের ইসমলাইল বলেন, “এবছর সব শেষ, কেউ হাইতে পারব না…।”
তবু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা
মির্জানগর সড়কে হেঁটে যাওয়ার পথে এক কৃষককে আবার ধান লাগাতে দেখা গেল। জিজ্ঞেস করতেই বলেন, “চেষ্টা করতাছি…যদি কিছু করা যায়।”
আবু তাহের নামে এ কৃষক বলেন, “বছর ৬০ হাজার টিয়া দিয় পাঁচ কানি জমি লাগিত লই। দুই খন্দ চাষের মধ্যে এক খন্দ আমন করি। বানের পানিত সব শেষ… আবার রুকি দেখি কিছু হয় কি না।”
তাহের জানালেন, অন্যদের জমিতে অনেক বেশি পরিমাণ বালু জমলেও তার জমিতে কিছুটা কম জমেছে। বন্যার আগে আমন রোপণ করে যে চারা উচ্ছিষ্ট ছিল, সেগুলো এনে আবার আমন চাষাবাদ করছেন।
এরইমধ্যে সার ও বীজ নিয়ে জমিতে যাচ্ছিলেন জাফর নামের এক কৃষক।
জাফর জানালেন, ১৪ কানি জমিতে তিনি এবার ধান চাষ করেছিলেন। বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।
“আমার জমিত বালুর সাথে পেকও (মাটি) আছে। একধারে বালু আইলে চাষ অয়ত না। তাই চেষ্টা গড়ি চাইর এরি… হয়ত ভালাওতো অয়ত পারে।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযাী, পরশুরামের মত একই অবস্থা ফেনীর সবকটি উপজেলায়। সব জমিতে চাষাবাদ করা ফসল আক্রান্ত হয়েছে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস আমন ধান রোপণের সময়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে কৃষকরা ধান তোলেন তাদের ঘরে।
ফেনী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ জেলায় ৩২ হাজার ৪৮৬ হেক্টর জমিতে আমন ধান লাগানো হয়। আর দুই হাজার ৭৩ হেক্টর জমিতে ছিল বীজতলা। সবগুলো জমিই বন্যার পানিতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমির ধান পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।