এ বছর ২ জানুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান দেশের স্থাপত্য, ক্রীড়া, পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনের অগ্রপথিক মোবাশ্বের হোসেন।
Published : 25 Dec 2023, 08:19 PM
বহুপথে আলো ছড়িয়ে যাওয়া স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনকে স্মরণ করলেন তার সহকর্মী-অনুরাগীরা, বললেন, তার কর্মময় জীবন ‘প্রদীপের আলো’ হয়ে পথ দেখাচ্ছে আজও।
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক স্মরণসভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের হোসেনকে স্মরণ করে স্মৃতির আগল খুলে দেন নানা অঙ্গনের প্রতিনিধিরা।
এ বছর ২ জানুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান দেশের স্থাপত্য, ক্রীড়া, পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনের অগ্রপথিক মোবাশ্বের হোসেন।
তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ’ শীর্ষক স্মরণসভার আয়োজন করে ‘গেরিলা ১৯৭১’।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হাফিজা খাতুন স্মরণসভায় বলেন, "প্রদীপ হয়ত শেষ হয়ে গেছে, উনি হয়ত আজকে জীবিত নেই, কিন্তু উনার প্রদীপের আলো কিন্তু আমাদের মাঝে আছে।
“শিক্ষক হিসেবে আমাদের অনেক দায়িত্ব। মাঝে মাঝে একটু বিপথে যাই, এটা অস্বীকার করার কিছু নাই। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে দিক-নির্দেশনা দেওয়া এবং আলোর পথে নিয়ে আসা।”
স্থপতি কাজী গোলাম নাসির মনে করেন, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনকে নির্দিষ্ট সময় বা গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা যায় না।
‘ভাল কাজের জন্য সুযোগ বা অর্থের প্রয়োজন হয় না’- মোবাশ্বের হোসেনের এই পরামর্শ স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “কখনও যদি কোনো যুদ্ধ করতে চান, কখনও যদি প্রতিবাদ করতে চান, সদা সাদা পথে চলতে চান, পরের জন্য কাজ করতে চান, একজনকে অনুপ্রেরণায় নেবেন। আপনার পথচলাটা সহজ হবে। তিনি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন।”
কাজী গোলাম নাসির জানান, তার বড় ভাই না থাকার আক্ষেপ ঘুচেছিল স্থাপত্য পাস করার পর মোবাশ্বের হোসেনের সন্ধান পেয়ে।
“তিনি আদর করতেন, শাসন করতেন”, বলেন এই স্থপতি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান মনে করেন, মোবাশ্বের হোসেন অনুসরণীয় ব্যক্তি হিসেবে নতুন প্রজন্মকে পথ দেখাতে পারেন।
“আজ যাকে ঘিরে অনুষ্ঠান, উনার চেতনা- উনার প্রেরণা আমরা অনুসরণ করতে পারি। আমরা যেখানে যে অবস্থানে আছি, সেখান থেকে সে যদি নিজের কাজটা সততার সাথে সঠিকভাবে করতে পারি, তাহলে সেটাই সবচেয়ে বড় অবদান হবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এবং স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের প্রতি।”
মোবাশ্বের হোসেনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা এই স্থপতি দেশের বেশ কয়েকটি আলোচিত স্থাপনার কাজ করেছেন। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন, প্রশিকা ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক ভবন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস এবং আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল, এশিয়ার (আর্কেশিয়া) প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেছেন।
ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাবেক এই সভাপতি সম্মিলিত ক্রীড়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনে সোচ্চার এই স্থপতি ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) আহ্বায়ক এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সহ-সভাপতি ছিলেন।
গেরিলা ১৯৭১ এর প্রধান সমন্বয়ক এম এন কোরেশী বলেন, “আমরা তাকে স্মরণ করছি তা নয়, আমরা তার জীবনটাকে উদযাপন করছি।”
আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, “আজকে তিনি আমাদের মাঝে উপস্থিত হতে পারেননি, কিন্তু উনাকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তিনি আমাকে বকছেন, স্নেহ করেন- তাকে একদিনের জন্যও ভুলিনি। তার প্রতি ঋণ এক জীবনে শেষ হবার না।”
তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতীয় পতাকার প্রতীক হস্তান্তরের মাধ্যমে এ স্মরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্মাননা দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের অবদান তুলে ধরে জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, “এই জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তথ্যের একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই জাদুঘর নির্মাণ আমাদের কাছে স্বপ্নের চাইতেও বড় ছিল।
“স্থপতি ইনস্টিটিউটকে তিনি যুক্ত করলেন এ কাজে। স্থাপত্য নকশা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই জাদুঘরের নকশা নির্বাচন করা হয়। এই প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার ছিল একটি ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাট তিনি নিজে দিয়ে দিয়েছিলেন যেন জাদুঘরের কাজটা ভালোভাবে হয়ে যায়। কিন্তু এটা উনি কোনোদিন জানাতে চাননি।”
বাবার স্মৃতিচারণ করে ছেলে সাঈদ হোসেন তমাল বলেন, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের ভাবনায় সবসময় ছিল বাংলাদেশেকে ভালো অবস্থায় রেখে যেতে কাজ করার তাগিদ।
“উনি বিদেশে থাকলে হয়ত, আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন। কিন্তু উনার কথা হল, এদেশেই যেন ওইরকম শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়। আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণ দক্ষ-যোগ্য মানুষ আছে। কিন্তু আমাদের একটাই সমস্যা, আমরা একসাথে কাজ করি না। একত্রে কাজ না করলে আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাব।”
মোবাশ্বের হোসেনের মত ব্যক্তিদের সহযোগিতা করার তাগিদ দিয়ে সাঈদ হোসেন তমাল বলেন, “তরুণ প্রজন্মের ঘাড়ে বার বার দায়িত্ব দিয়ে আমরা ভাবি, আমাদের কোনো দায়িত্ব নাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সুষ্ঠুভাবে গবেষণা করে এই প্রজন্মের হাতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব এই মাঝবয়সী জেনারেশনের। যেটা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমার আব্বার মত আরও অনেকে আছেন, যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন। আমাদের উচিত তাদের সাহায্য করা।”
‘আব্বা চলে যাওয়ার পর ঘটনাগুলো জেনেছি’
মোবাশ্বের হোসেনকে স্মরণ করে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী ইয়াসির আজমান বলেন, “আমি এখানে এসেছি একজনের স্মরণসভায়, আসলে এই শ্রদ্ধাটা সব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। বিজয়ের মাসে এই শ্রদ্ধা জানাতে পারাও অনেক বড় ব্যাপার।
“মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের কথা বলতেন না। একটু আগে মোবাশ্বের স্যারের ছেলে বলে গেছেন, উনি মারা যাওয়ার পরে উনি জানতে পারছেন, উনার বাবা কতকিছু ছিলেন। কত লোক উনার বাবাকে চিনতেন। কত কিছু উনি করেছেন।”
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “গত ৬ বছর ধরে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি বুঝতে পারছি আসলে উনি কী ছিলেন? তার আগে আসলে শুনি নাই।
“উনি মারা যাওয়ার পর জানতে পারলাম ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যের নাম দেওয়া আমার বাবার। চাঁদপুরে যে ভাস্কর্য ‘অঙ্গীকার’, সেটার নাম দেওয়া আমার বাবার। সুনামগঞ্জে স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার বানিয়েছেন নিজে এঁকে, নিজে ডিজাইন করে নিজের হাতে।”
তরুণ প্রজন্মকে সঠিক তথ্য দিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সততা, আবেগ, সাহস নিয়ে গবেষণার তাগিদ দিয়েছেন ইয়াসির আজমান।
“নির্মলেন্দু গুণের একটি বইয়ে পেলাম, সালেহ চৌধুরী ১৯৬৯ সালে মতিউর রহমানের লাশ নিয়ে মিছিল করতে করতে রক্তভেজা শার্ট নিয়ে তার বাসায় এসেছে একটা শার্ট নিতে। সে আবারও মিছিলে যেতে চায়। এই ঘটনাগুলো আব্বা চলে যাওয়ার পর জেনেছি। আগে কখনও তিনি বলেননি।”
ইয়াসির বলেন, “আমাদের বিজয়, আমাদের স্বাধীনতা- এগুলো আমাদের গর্ব। এগুলো আমাদের উদ্যাপন করা দরকার। আমরা এগুলো উদযাপনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে যদি নিয়ে যেতে না পারি, তাহলে বিপরীত শক্তিরাই সবসময় আনন্দ-উল্লাস করবে।
“আমরা সবাই বাংলাদেশের সন্তান এবং সবাই বাংলাদেশের যোদ্ধা হবেন। এই অনুষ্ঠানগুলোতে যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, তারাই না; যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাকেও নিয়ে আসবেন।”
‘গেরিলা ১৯৭১’ এর প্রধান উপদেষ্টা, ষাটের দশকে ডাকসুর ভিপির দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক মাহফুজা খানম অনুষ্ঠানে বলেন, “যারা তরুণ প্রজন্ম, তাদের দায়বদ্ধতা আছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি।
“কিন্তু ৫২ বছর পরে এতো অসংগতি- দেখে আমরা কষ্ট পাই। কখনো কখনো অনেক মনঃকষ্ট ভুগি, কোন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, কোন বাংলাদেশে আমরা আছি! এই কষ্টগুলো লাঘব করার দায়িত্ব তোমাদের। আসো আমরা প্রবীণ ও তরুণরা মিলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নিয়ে যাই।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক বলেন, “কিছু হলেই আমরা প্রজন্মের কাঁধে বন্দুক দিয়ে দেই যে, প্রজন্ম দেশটাকে ঠিক করে দেবে। আমরা গোড়ায় যদি গলদ করি, তাহলে প্রজন্মের দোষ দিয়ে লাভটা কী?
“আজ অবধি যে সরকার এসেছে, তারা যদি ইতিহাস ঠিক রাখে; তাহলে প্রজন্ম ঠিক থাকবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। যে যাই বলেন না কেন, ইতিহাস কাউকে ছাড় দেবে না।”
পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম নিহত হওয়ার পর তার পরিবারকে কতটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সে কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তার মেয়ে সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান। যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করেন বীরাঙ্গনা রিজিয়া খাতুন। যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে লেখক ফেরদৌসী লিনু হক, শাহিনা হাফিজ ডেইজি, ইমন শিকদার, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সালেক খোকনকে পদক দেওয়া হয়। সালেক খোকনের পক্ষে পদক গ্রহণ করেন তার মেয়ে পৃথা প্রণোদনা।
অন্যদের মধ্যে স্মৃতিচারণ করেন মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) খুরশিদ রেজা টুলু, গীতিকবি ও গবেষক মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মু. আসাদুজ্জামান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
ইফতেখার আনোয়ারের নির্দেশনায় অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত ও তিনটি গানের অর্কেস্ট্রা পরিবেশন করা হয়। আবৃত্তিশিল্পী শিমুল মুস্তাফার আবৃত্তি শোনান। এছাড়াও শীলা ভদ্র ও তার দল এবং স্বর্ণমতি জামান গান গেয়ে শোনান। এছাড়াও তরুয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবৃত্তি ও নৃত্যু পরিবেশন করে।