দেশাত্মবোধক গানের ইতিহাস

গোলাম মুরশিদ
Published : 15 August 2021, 02:59 PM
Updated : 15 August 2021, 02:59 PM


আমরা বাঙালী, কিন্তু একটা সময় ছিলো, যখন আমাদের ভাষায় 'বাঙালী' শব্দটা ছিলো না। এমন কি, আমাদের ভাষার নামও 'বাংলা' ছিলো না। তখন আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে কেউ বলতো, শুধু 'ভাষা'; কেউ বলতো 'দেশী ভাষা', কেউ বা বলতো 'বাঙ্গালা ভাষা', আর সতেরো শতকের কবি আবদুল হাকিম তাকে বলেছেন 'বঙ্গদেশী বাক্য'। তারপর কবিত্ব করে তিনি বলেছিলেন 'বঙ্গবাণী'। আসলে তখন বঙ্গদেশটা বিভক্ত ছিলো ছ/সাতটা ভাগে। অখণ্ড বঙ্গদেশ বলে কোনো দেশ তখন ছিলোই না। দেশের ভূগোল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাও তাই পরিষ্কার ছিলো না। দেশপ্রেম জন্মলাভ করবে কিভাবে?

'দেশ' বলতে তখন বোঝাতো দেশের একটা অঞ্চলকে। যেমন, এখনো কোন্ জেলার লোক বোঝাতে গিয়ে জেলা না-বলে 'দেশ' বলা হয়। তাই তখন যে-প্রেম ছিলো, তা ছিলো অঞ্চল বিশেষ এবং ভাষার প্রতি। দেশাত্মবোধক না-বলে তখনকার এই প্রেমকে তাই বলা যায় ভাষাত্মবোধক। তাতে কী থাকতো? আবদুল হাকিমের রচনা থেকে তার আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলছেন যে, যাদের বই পড়ার ক্ষমতা নেই, তাদের শেখার বাসনা মেটাতে তিনি তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় লিখছেন। তাঁর মতে, আল্লাহ নবীর কথা লিখলে আরবী, ফারসী এবং হিন্দীতে কোনো পার্থক্য থাকে না। কারণ আল্লাহ সব ভাষাই বোঝেন।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।

হিন্দুদের ভাষা মনে করে যারা বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করে, বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করে যারা বঙ্গবাণীকে ঘৃণা করে, তারা কার জন্ম তিনি তা ভাবতে পারেন না:
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

এ ধরনের লোকেদের লক্ষ করে তিনি বলেছেন যে, দেশী ভাষা ও বিদ্যা যাদের মনে তৃপ্তি দেয় না, তারা নিজেদের দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে যায় না কেন? যারা পুরুষানুক্রমিকভাবে বঙ্গদেশে বাস করে আসছে, দেশীয় ভাষা শিক্ষা তাদের জন্যে হিতকর:
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।

আবদুল হাকিম বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করার ফাঁকে ফাঁকে বঙ্গদেশের প্রতিও তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন।
এর প্রায় দেড় শো বছর পরে মাতৃভাষার প্রতি নিধুবাবু ওরফে রামনিধি গুপ্তও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন, তবে ঠিক কবিতার ভাষায় নয়, গানের সুরে:
নানান দেশের নানান ভাষা
বিনে স্বদেশীয় ভাষা, পুরে কি আশা?
কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর
ধারাজল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা?

তাঁর কথাটা সহজ, সরল। নানা দেশে নানা ভাষা প্রচলিত আছে। কিন্তু নিজের দেশের ভাষা ছাড়া কি তৃপ্তি হয়? তারপর একটা তুলনা দিয়ে তিনি এই অতৃপ্তির কথাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন – নদী এবং সরোবরে অনেক জল আছে, কিন্তু বৃষ্টির জল ছাড়া কি চাতকের তৃষ্ণা মেটে? এখানেও ভাষার আড়ালে দেশের কথা উহ্য আছে।
নিধুবাবু যখন এ গানটি রচনা করেন, ইংরেজ রাজত্বের ততো দিনে পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছে এবং দেশ সম্পর্কিত ধারণাও খানিকটা দানা বেঁধেছে। সেটা উচ্চবর্ণের হিন্দুধর্মীয় হলেও, তার মধ্যে এক ধরনের জাতীয়তাবোধের ছবি ফুটে উঠছিলো।
১৮৬৭ সালে নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে 'হিন্দুমেলা' নামে একটি মেলা আয়োজিত হয়। তা ছিলো এই স্বাদেশিকতারই বহিঃপ্রকাশ। এই মেলার কথা মনে রেখে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি দেশপ্রেমের গান রচনা করেছিলেন। কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডে থাকার সময়েই তিনি ইংরেজি ভাষায় বহু দেশাত্মবোধক কবিতা ও গানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে থাকবেন।
মিলে সব ভারত-সন্তান
একতান মনপ্রাণ গাও ভারতের যশোগান
ভারত-ভূমির তুল্য আছে কোন স্থান?
কোন অদ্রি হিমাদ্রি সমান?

অতঃপর তিনি বিভিন্ন বস্তু এবং ব্যক্তির উল্লেখ করে অন্য দেশের সঙ্গে তার তুলনা করেছেন। এবং প্রতিটি স্তবকের শেষে ঘোষণা করেছেন:
হোক ভারতের জয় / জয় ভারতের জয় / কি ভয় কি ভয় / গাও ভারতের জয় /
এ গানে দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং দেশকে নিয়ে গর্ববোধ—দুই-ই প্রকাশিত হয়েছে। দৃষ্টান্ত দিয়ে এ গানে স্বদেশের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার প্রয়াসও আছে। এর আগে বাংলা ভাষায় এ ধরনের গান রচিত হয়েছিলো কিনা, সন্দেহ আছে। গানটি সাধারণত সমবেত সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। সমবেত সংগীতের ধারণাও অনেকটাই পাশ্চাত্য থেকে ধার করা।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো তাঁর ছোটো ভাইয়েরাও দেশপ্রেমের পরিবেশে লালিত হয়েছিলেন। এই পরিবেশের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো প্রাচীন ভারতের প্রতি ভালোবাসা, সে ভালোবাসা বোঝানোর জন্যে যবনদের ঘৃণা করা আর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা দেখানো। যেমন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফরাসী নাট্যকার জঁ রাসিনের একাধিক নাটকের অনুবাদ করেছিলেন। তাতে গানগুলো দিয়েছিলেন নিজের লেখা। একটি নাটকের গানঃ
এত স্পর্ধা যবনের / স্বাধীনতা ভারতের / করিবে হরণ/
তারা কি করেছে মনে / সমস্ত ভারতভূমে / পুরুষ নাহিক একজন
মূল নাটকে মুসলমানদের সামান্যতম উল্লেখ না-থাকলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ গানে যবনদের কথা নিয়ে এসেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন তখনকার আপোশহীন জাতীয়তাবাদীদের একজন। তিনি দেশকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। তবে তিনি যে-ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে ভারতবর্ষ মুসলমান-বর্জিত। এমন কি, ইংরেজরাও তাঁদের কাছে ছিলেন অবাঞ্ছিত ও উৎপাত-বিশেষ। তাঁর শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমের গান হলো: 'বন্দেমাতরম।'
তিনি সংস্কৃত ভাষায় এ গানটি রচনা করেন ১৮৭০-এর দশকের প্রথম দিকে। তারপর গানটি তিনি ব্যবহার করেন তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে (১৮৮২)। এ উপন্যাসে মুসলমান-বিরোধী এক ধরনের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। তাই এ গানে আপাতদৃষ্টিতে মুসলমান-বিরোধী মনোভাব না-থাকলেও প্রথম থেকেই মুসলমানরা এ গানটিকে প্রত্যাখ্যান করে। গানটাতে 'দেশ'কে দেবী দুর্গা বলে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁকে প্রণাম করার কথা বলা হয়েছে।
বন্দে মাতরম্ ৷
সুজলাং সুফলাং
মলয়জশীতলাম্
শস্যশ্যামলাং
বন্দেমাতরম্
শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনীম্
ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদলশোভিনীম্
সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্
সুখদাং বরদাং মাতরম্ ৷৷

সংস্কৃত ভাষায় লেখা হলেও, এ ভাষাও জয়দেবের গীতগোবিন্দের ভাষার মতো সুন্দর ও সরল। বোঝাও যায় সহজে। অর্থ বিচার করলে এ পর্যন্ত গানটিতে আপত্তিকর কিছু দেখা যায় না। তবে এর পর দেশকে নয়, এ গানে বঙ্কিমচন্দ্র সরাসরি দেবী দুর্গাকে সম্বোধন করে তাঁকে প্রণাম জানিয়েছেন। মুসলমানরা তাতে অবশ্যই আপত্তি করতে পারেন। কিন্তু এ গানে দেশের সৌন্দর্য সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং সামগ্রিকভাবে দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। গানটিতে সুর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেসের অধিবেশনে গেয়েছিলেন ১৮৯৬ সালে।
এর ন বছর পরে, ১৯০৫ সালে, বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ বিশটি দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন। এ গানগুলোর প্রত্যেকটিতেই দেশের প্রতি অশেষ ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, একটি গানে তিনি বলছেন, 'আমার জন্ম সার্থক যে, আমি এই দেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার জন্ম সার্থক যে, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি।' তারপর এ গানে তিনি দেশের অতুলনীয় সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন।
'রানীর মতো তোমার ধনরত্ন আছে কিনা আমি জানিনে, কিন্তু এটা জানি যে, তোমার ছায়ায় এলে আমার অঙ্গ জুড়িয়ে যায়। কোন বনের ফুলের গন্ধে এমন আকুল করে, কোন আকাশে এমন হাসি হেসে চাঁদ ওঠে, তোমার আলোতে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়, আবার ওই আলোতে চোখ রেখেই আমি শেষে চোখ বন্ধ করবো।'
এ গানে যে-সূক্ষ্ম ভাব প্রকাশ পেয়েছে, তা সাধারণ মানুষের বোঝার পক্ষে একটু কঠিন। তদুপরি এ গানটি তালহীন এবং তানপ্রধান অর্থাৎ টপ্পা-চালের। ফলে কথাগুলোর অর্থ সম্যকভাবে অনুভব করা কঠিন। গানটি তাই শিক্ষিত এবং সংগীতজ্ঞান-সম্পন্ন ব্যক্তিদেরই উপযোগী। তুলনা করলে বরং 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা' গানটি বোঝা সহজ। বাউল সুরে রচিত বলে এই গানের সুরটি তার সরল সৌন্দর্য দিয়ে সাধারণ মানুষকেও আকৃষ্ট করে।
অপর পক্ষে, কী কথার দিক থেকে, কী সুরের দিক থেকে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটির আবেদন শ্রোতার কাছে গভীর এবং একেবারে সরাসরি। 'সোনার' শব্দটি দিয়ে প্রথমেই বাংলাদেশের সৌন্দর্য এবং তার মূল্য বোঝানো হয়েছে আর 'ভালোবাসি' শব্দটি দিয়ে তার প্রতি গায়ক ও শ্রোতার অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। কবি এ গানেও আকাশ ও বাতাসের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তার অর্থ সহজে বোঝার মতো—আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি। কবি দেশকে মা বলে সম্বোধন করে বলেছেন যে, ফাল্গুনে আমের বন থেকে যে-ঘ্রাণ আসে, তা তাঁকে পাগল করে দেয়। আর অঘ্রানের ভরা ক্ষেতে তিনি দেখেছেন বাংলা মায়ের মধুর হাসি। মনে হয় বটগাছের নীচে এবং নদীর তীরে তীরে বাংলা মায়ের আঁচল বিছানো রয়েছে। কী শোভা, কী ছায়া, কী স্নেহ, কী মায়া! বাংলা মায়ের মুখের বাণী সুধার মতো মধুর, বাংলা মায়ের মুখখানা মলিন হলে কবি চোখের জলে ভাসেন। গানের শেষ পর্যন্ত এমনি বাংলা মায়ের সৌন্দর্য ও তাকে ভালোবাসার কথা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন।

এ গানে মাতৃভূমির যে-ছবি অঙ্কিত হয়েছে, তাকে রক্ত-মাংসের মায়ের মতো মনে হয়। তাঁর প্রতি কবির যে-ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে, তা অন্তহীন। লক্ষ করার বিষয় হলো, উপরে যে-চারটি গানের উল্লেখ করেছি, তাতে দেশকে মা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। তার ফলে বহু মুসলমান এ গানগুলোর প্রতি সন্তুষ্ট নন। তাঁদের ধারণা, দেশকে মা বললে তার মাধ্যমে পৌত্তলিকতা প্রকাশ পায়। এ কথা বন্দেমাতরম গানটি সম্পর্কে খাটতে পারে, কারণ ঐ গানের শেষ দিকে দেশমাতাকে দেবী দুর্গা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। 'আজি বঙ্গদেশের হৃদয় হতে' গানটির কথাও বলা যোত পারে। কিন্তু 'সার্থক জনম আমার' এবং 'আমার সোনার বাংলা' সঙ্গে দুর্গার কোনো সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া, রবীন্দ্রনাথ নিজেও পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করতেন না। তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের এক শ্রেণীর লোক দেশের জাতীয় সংগীতের প্রতি যথোচিত সম্মান দেখান না। একে তাঁদের নিতান্ত সাম্প্রদায়িক মনোভাবই প্রকাশ পায়।


নয়তো দেশাত্মবোধক গান 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' জাতীয় সংগীত হিসেবে আদর্শ স্থানীয়। কারণ এ গানে দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সম্মান দেখানো হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে, ভারতের জাতীয় সংগীত 'জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে'র সঙ্গে তুলনা করলে 'আমার সোনার বাংলা'কে শ্রেষ্ঠতর বলতে হয়। 'জনগণমন-অধিনায়ক' গানটিতে সরাসরি দেশের প্রতি কোথাও কোনো ভালোবাসা প্রকাশ পায়নি। প্রশংসা করা হয়েছে জনগণমনের অধিনায়ক এবং দেশের ভাগ্যবিধাতাকে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, ভারতের ভাগ্যবিধাতা কে? যখন রবীন্দ্রনাথ গানটি রচনা করেন, তখন দেশ ছিলো পরাধীন। দেশের বিধাতা ছিলেন রাজা পঞ্চম জর্জ। আর ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখলে দেশের বিধাতা ছিলেন অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তা। এ গানের প্রথম স্তবকে ভারতের অঞ্চলগুলির উল্লেখ করা হয়েছে:
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ

তারপর কবি বলেছেন, দেশের এসব অঞ্চল, পর্বতমালা, সাগর ও নদনদী
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।

এমনি করে প্রতিটি স্তবকের শেষে ভারতের ভাগ্যবিধাতার জয়গান গাওয়া হয়েছে। এ গান ঈশ্বর উপাসনার গান হতে পারে অথবা দেশের রাজা-বন্দনার গানও হতে পারে, কিন্তু দেশাত্মবোধ গান নয়।
রবীন্দ্রনাথ দেশপ্রেমের বহু গান লিখেছেন, 'গীতবিতানে'র বিভাজন হিসেবে তার সংখ্যা ….। এর মধ্যে বেশির ভাগেই প্রকাশ পেয়েছে বঙ্গদেশের প্রতি ভালোবাসা এবং বঙ্গদেশের হৃদয়হরণকারী সুন্দর প্রকৃতির প্রতি বিমুগ্ধ বিস্ময়। কোথাও কোথাও তার সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গও মিলে গেছে। দেশ মানে তো শুধু মাত্র একটি ভূমিখণ্ড নয়। দেশ মানে দেশের ভূমিখণ্ড, দেশের মানুষ এবং দেশের সংস্কৃতি। এক একটা গানে প্রকৃতি; কোনো গানে মানুষ; আবার কোনো গানে সংস্কৃতি প্রাধান্য লাভ করেছে। মার্চের তালে তালে ঘুম ভাঙানোর গানও আছে।

এর পর আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি বিখ্যাত গান, সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত গান—'ধনধান্যপুষ্প-ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা'। দেশাত্মবোধক গান বলতে তিনি কী বুঝতেন – এ গানটা হলো তারই দৃষ্টান্ত। এ গানের প্রথমেই তিনি গর্বের সঙ্গে বলেছেন যে, ধনধান্যপুষ্প ইত্যাদি সম্পদে পরিপূর্ণ আমাদের এই পৃথিবী, তার মধ্যে একটি দেশ আছে, যে-দেশ সকল দেশের মধ্যে সেরা। কোথাও খুঁজে এমন একটি দেশ পাবে না, এ দেশ হলো সকল দেশের রানী—আমাদের জন্মভূমি। কোনো দেশে চন্দ্রসূর্যগ্রহতারা এমন উজ্জ্বল নয়, কোনো দেশে এমন স্নিগ্ধ নদী, এমন সবুজ মাঠ, এমন বাতাসের ঢেউ-খেলানো ধানের ক্ষেত খুঁজে পাবে না। ভাইয়ের, মায়ের এত স্নেহ কোথাও পাবে না। ওগো মা তোমার পা দুটি আমি আমার বুকে চেপে ধরছি। মা, আমার যে-দেশে জন্ম, আমি যেন সেই দেশেই মরি।

সহজ সরল ভাষায় লেখা এই গানটি দারুণ আবেগ ও আবেদনপূর্ণ। এ গানটি শুনলে দেশের জন্যে গর্বে বুক ভরে যায়। 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি' এবং 'সকল দেশের রানী' বলে কবি বারবার সেই গর্ববোধকে উস্কে দেন। সবশেষে কবি দেশের কাছে আবেদন জানান যে, তাঁর যে-দেশে জন্ম, তিনি যেন সেই দেশেই মরতে পারেন।
দ্বিজেন্দ্রলালের সমসাময়িক কবি হলেন রজনীকান্ত সেন এবং অতুলপ্রসাদ সেন। তাঁরাও দেশকে নিয়ে গান লিখেছেন। কিন্তু তাঁদের কোনো গানই রবীন্দ্রনাথ অথবা দ্বিজেন্দ্রলালের দেশাত্মবোধক গানের মতো অতো জনপ্রিয় বলে বিবেচিত হয়নি। স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে রজনীকান্তের 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই' তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর একটি। এটি অবশ্যই স্বদেশী গান বলে স্বীকৃতি লাভ করতে পারে, কিন্তু সত্যিকার দেশাত্মবোধক গান হিসেবে নয়। কারণ এ গানে দেশ, দেশের প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে কোনো গর্ব অথবা ভালোবাসা প্রকাশ পায়নি। বরং এতে প্রকাশ পেয়েছে একটি রাজনৈতিক স্লোগান। অতুলপ্রসাদের 'মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি! বাংলা ভাষা' গানটিও ঠিক দেশাত্মবোধক গান নয়, ভাষাত্মবোধক গান। বাউল সুরে রচিত এই গানটি খুবই জনপ্রিয়। তবে গানটি খানিকটা আনুষ্ঠানিক। শ্রোতাদের হৃদয়ে আবেগ জাগিয়ে তোলে কিনা, তা বলা কঠিন। বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো অনেকেই গান লিখেছিলেন, এক শো বছরের মধ্যে সেসব গানের কথা পাঠক ও শ্রোতারা ভুলে গেছেন।

১৯২০-এর দশকে গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সে আন্দোলনও স্বদেশী গান লিখতে নজরুল-সহ অনেককে অনুপ্রাণিত করেছিলো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গান ছাড়া অন্য যাঁরা তখন দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছিলেন, সেসব গান এখন বড়ো একটা শোনা যায় না। বিশেষ করে নাগরিক কবিদের লেখা দেশাত্ববোধক গান। সময়ের ধুলোয় চাপা পড়ে সেসব গান মুছে গেছে। মুকুন্দ দাসের মতো কবিকে সাধারণত নাগরিক কবি বলা হয় না। তা সত্ত্বেও তাঁর রচিত অন্তত দুটি গান তাঁর মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দী পরে আজও শোনা যায়। গান দুটি হলো:
একবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি
ভয় কি মরণে, রাখিতে সন্তানে /মাতঙ্গী মেতেছে আর সমররঙে
এর মধ্যে একবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি গানটি ক্ষুদিরাম দাসের ফাঁসির ঘটনাকে স্মরণ করে রচিত হয়েছিলো। গানটি আজও শহরে এবং গ্রামে শোনা যায়। 'ভয় কি মরণে' গানটিও তার উদাত্ত সুরের জন্যে অমর হয়ে আছে। বিশেষ করে সবিতাব্রত দত্তের কণ্ঠে এ গানের যে-রেকর্ড আছে, তা অতুলনীয়।
ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমররঙ্গে
তা থৈ তা থৈ থৈ দ্রিমি দ্রিমি দ্রম দ্রম
ভূতপিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে
দানবদলনী হয় উন্মাদিনী
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে
সাজ রে সন্তান হিন্দু-মুসলমান
থাকে থাকিবে প্রাণ, না হয় যাইবে প্রাণ
নিতে হয় মুকুন্দেরে নিও রে সঙ্গে।

দানব বঙ্গভূমি দখল করেছে। দেবী কালী উন্মাদিনী হয়ে ভূত-পিশাচ-যোগিনী নিয়ে সমররঙ্গে মেতে উঠেছেন। কালীর ধারণা বাস্তবসম্মত কিনা, সন্দেহ আছে। অপর পক্ষে, মুকুন্দ দাসের অন্তত এটুকু বাস্তবতার জ্ঞান ছিলো যে, বঙ্গদেশে যে-ব্রিটিশ শাসন চলছে, তা থেকে মুক্তি পেতে হলে হিন্দু-মুসলমান উভয়কে একত্রিত হতে হবে।
মুকুন্দ দাসের আর-একটি উল্লেখযোগ্য জাগরণী গান হলো, 'তোমরা এখনও ঘুমাও'।

নজরুল ইসলাম বয়সে মুকুন্দ দাসের চেয়ে বছর দশেকের ছোটো। আলোচ্য কালে দেশকে নিয়ে তিনি শতাধিক গান রচনা করেন। তাঁর এই গানগুলোর মধ্যে অনেক গানেই প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তা লাভ করে। জনপ্রিয়তার মাপে এসব গান হয়েতো রবীন্দ্রনাথকেও হারিয়ে দেয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অথবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের যে-গানগুলোকে আমরা যথার্থ দেশাত্মবোধক গান বলে উল্লেখ করেছি, সেগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে নজরুলের দেশাত্মবোধক গানের বিষয়বস্তু ঠিক মেলে না। যেমন, নজরুলের সম্ভবত প্রথম দেশাত্মবোধক গান 'কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট' অন্যদের রচিত দেশাত্মবোধক গান থেকে একেবারে আলাদা। এ গানে দেশ অথবা দেশের কোনো অঞ্চলকে নিয়ে গর্ব প্রকাশ করা হয়নি। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে তার প্রশংসাও করা হয়নি, অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে নিজের দেশকে শ্রেষ্ঠও বলা হয়নি অথবা ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়নি। বরং এ গানে সকল দেশবাসীর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে, যাতে দেশকে ভালোবাসার দরুন যারা কারারুদ্ধ হয়েছে,তাদের যেন তারা কারাগার ভেঙে মুক্ত করে আনে। এগুলো রাজনৈতিক দেশাত্মবোধক গান।

আসলে, তখন দেশে যে-ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক ও স্বাধীনতা আন্দোলন চলছিলো, নজরুল ইসলাম তারই উপযোগী গানের জোগান দিয়েছিলেন। 'শিকল-পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল' গানটির কথা 'কারার ওই লৌহ কপাট' গানটির সঙ্গে মিলে যায়। এ জন্যেই তাঁর রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলো এতো জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো।
তাঁর কোনো কোনো দেশাত্মবোধক গান তখনকার সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলো। 'কারার ঐ লৌহকপাট' গানটিও তার মধ্যে একটি। দেবব্রত বিশ্বাস গানের আসরে বিশেষ করে গণসংগীত গাইতে পছন্দ করতেন। তাঁর কাছে শুনেছি যে, তিনি আসরে 'কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট' গানটি গেয়েই সভা ছেড়ে দৌড়ে পালাতেন, পুলিস যাতে ধরতে না-পারে।

প্রকৃত পক্ষে, নজরুলের রাজনৈতিক গানগুলোই বেশি জনপ্রিয়। তাঁর এ ধরনের গানের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গান হলো 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার' গানটি। তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের একজন—সুভাষচন্দ্র বসু এক ভাষণে এ গানটি সম্পর্কে বলেছিলেন যে, তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বহু গান শুনেছেন, কিন্তু 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ারে'র মতো অমন দেশপ্রেমের গান তিনি কোথাও শোনেননি। গানটির শুরুতেই কবি মনে করিয়ে দিয়েছেন, সমস্যাটি গুরুতর:
দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার,
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রিনিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার!

এর পর তিনি তরণীর কাণ্ডারী এবং যাত্রীদের সতর্ক করিয়ে দেন যে, অসহায় জাতি, সাঁতার জানে না। কবি প্রশ্ন করেন যে, এই যাত্রীরা হিন্দু, নাকি মুসলমান—এ কথা কে জিজ্ঞেস করছে? কাণ্ডারী, অর্থাৎ দেশের নেতা, তুমি বলে দাও যে, যারা ডুবে মরছে, তারা আমাদের মায়ের সন্তান। এর আগে দেশের বীর সন্তানদের কেউ কেউ ফাঁসির মঞ্চে আত্মাহুতি দিয়ে জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন। আজ যে-সংকট দেখা দিয়েছে, তা হয় জাতকে, নয়তো জাতিকে রক্ষা করবে। তরঙ্গ উথলে উঠছে, তরণী দুলছে—কাণ্ডারী হুঁশিয়ার।

এ গানটি কবি রচনা করেছিলেন, ১৯২৬ সালের মে মাসে, কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক অধিবেশনে তিনি গাইবেন বলে। তার এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯২৫ সালের জুন মাসে চিত্তরঞ্জন দাস মারা যান। তিনি শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্যে চেষ্টা চালিয়ে যান। তা সত্ত্বেও, কৃষ্ণনগরের সম্মেলন হওয়ার এক মাস আগে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙা আরম্ভ হয়। নজরুল এই উপলক্ষে প্রবন্ধ এবং কবিতা রচনা করেন। সে জন্যে এ গানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবি বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

১৯৩০-এর দশকে রেকর্ডের জন্যে গান লেখার আমলেও নজরুল ইসলাম শতাধিক দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছিলেন। এসব গানের মধ্যে জাগরণমূলক গানই ছিলো বেশি। তা ছাড়া, সমগ্র ভারতের পরাধীনতা ও দীন দশা, বাংলা মায়ের দুর্দশা, নদনদীর সৌন্দর্য, ভারতবর্ষের বিভিন্ন ধর্মের সন্তান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি বহু গান রচনা করেন। যেমন, সর্বভারতীয় নদনদীর সৌন্দর্য বর্ণনা করে লিখেছিন 'গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা।' বঙ্গদেশের নদনদীকে লক্ষ করে লিখেছিলেন, 'পদ্মা মেঘনা বুড়িগঙ্গা-বিধৌত।' রবীন্দ্রনাথের গানের অনুকরণে লিখেছিলেন, 'জননী মোর জন্মভূমি, তোমার পায়ে নোয়াই মাথা।' জনগণকে ভরসা দিয়ে লিখেছিলেন, 'দুঃখ কি ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে।' এমন কি, ধর্মের উল্লেখ করে লিখেছিলেন, 'ধর্মের পথে শহীদ যাহারা।' এসব গানের বেশির ভাগই রেকর্ড কম্পেনির ফরমায়েশে লেখা। এ রকম গানের মান থেকে বলা মুশকিল কবি কতোটা আন্তরিকতা এবং আবেগ নিয়ে এগুলো রচনা করেছিলেন। তবে তারই মধ্যে কোনো কোনো গান উৎকর্ষ লাভ করেছে। যেমন, নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম; বল ভাই মাভৈ মাভৈ নবযুগ ঐ এল ঐ; এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী; আমার শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা, আয় রে আয় ইত্যাদি।

শেষের গান দুটি সম্পর্কে একটা মন্তব্য না করে পারা যায় না। নজরুলের জ্ন্ম প্রত্যন্ত গ্রামে। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বড়োও হয়েছেন গ্রামে। তা সত্ত্বেও, তাঁর গানে পল্লীর প্রকৃতি প্রায় অনুপস্থিত। তাঁর সুপরিচিত কবিতাগুলো সম্পর্কেও এ কথা খাটে। অথচ দেশাত্মবোধক গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে মাটি ও মানুষের উল্লেখের দরুন। খুব সম্ভব তাঁর গানে প্রকৃতির কথা অতো কম হওয়ার কারণেই তাঁর বহু দেশাত্মবোধক গান জনপ্রিয় হয়নি, অথবা তাঁর অনেক দেশপ্রেমের গানের কথা জনগণ মনে রাখেননি।

নজরুল অসুস্থ হন ১৯৪২ সালে। আর দেশবিভাগ হয় ১৯৪৭ সালে। এই সময়ে অন্য কবিরাও নতুন দেশাত্মবোধক গান খুব বেশি রচনা করেননি। এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তাঁর 'অবাক পৃথিবী' এবং 'রানার' অসামান্য কবিতা। এ দুটি কবিতায় সুর দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। এখনো কবিতা/গান দুটি তাদের আবেদন হারায়নি। 'অবাক পৃথিবী'কে যদিবা দেশাত্মবোধক গান বলে চালানো যায়, 'রানার' গানটিকে কিছুতেই দেশাত্মবোধক গান বলে আখ্যায়িত করা যায় না। এ দুটি গানকেই বলা যেতে পারে 'গণসংগীত।' অবাক পৃথিবী কবিতাটির প্রথম অংশ পড়ে দেখা যাক
অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। …
অবাক পৃথিবী আমরা যে পরাধীন
অবাক কি দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন
অবাক পৃথিবী অবাক করলে আরো-
দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো। …
অবাক পৃথিবী অবাক যে বারবার
দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার। …
হিসেবের খাতা যখনই নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত- 'রক্ত খরচ' 'রক্ত খরচ' তাতে
'রক্ত খরচ' তাতে।
এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম
এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম
অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম!

এ গানে দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি অথবা ভাষার প্রতি কোনো ভালোবাসা প্রকাশ পায়নি। বরং প্রকাশ পেয়েছে অভিমান এবং ক্ষোভ। এ দেশে জন্ম নেওয়ার জন্যে জন্মভূমির কাছে তিনি এক প্রকার কৈফিয়ৎ চেয়েছেন। এ গান রেকর্ডে বের হওয়ার ছোট্টো একটা ইতিহাস আছে। রেকর্ড হবার আগে আইপিটিএর অনুষ্ঠানে এ গানটা গাইতেন দেবব্রত বিশ্বাস। সুর তাঁরই দেওয়া কিনা জানা যায় না। কিন্তু রেকর্ডে যে-সুর তা দিয়েছিলেন তা সলিল চৌধুরীর দেওয়া। তিনি তখন গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। একদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে তিনি দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে যান এবং তাঁকে গানটি রেকর্ড করার অনুরোধ জানান। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের ধারণা যে, রেকর্ড কম্পেনি তাতে রাজি হবে না। তিনি বরং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে রেকর্ড করতে বলেন। সলিল চৌধুরী অর্কেস্ট্রেশন সম্পর্কে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে কিছু উপদেশ দেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য-রচিত 'রানার' কবিতায়ও সুর দেন সলিল চৌধুরী। অর্কেস্ট্রেশন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এটিও দেশাত্মবোধক গান নয় – গণসংগীত। দুটি গানই জনপ্রিয় হয়েছিলো। গণসংগীতের আর-একটি অবিস্মরণীয় সংকলন হলো জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের 'নবজীবনের গান'। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের কথা আগেই বলেছি।

১৯৪০-এর দশকে মোহিনী চৌধুরীর লেখা আরও একটি গান আজও আবেদন হারায়নি। প্রায় এক শো বছর পরে এখনো তার কথা, সুর ও গায়কীর জন্যে গানটি মানুষের মনে রয়ে গেছে। গানটিতে সুর দিয়ে রেকর্ডে গেয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। ১৯৪৯ সালে রচিত এ গানটির প্রথম কটি কথা হলো:
মুক্তির মন্দির সোপাান-তলে কত প্রাণ হলো বলিদান / লেখা আছে অশ্রুজলে
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল-ভাঙা / তারা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে?
দেশের স্বাধীনতা আনতে গিয়ে যাঁরা আত্মত্যাগ-সহ নানা রকমের ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, এ গানে তাঁদের স্মরণ করা হয়েছে।

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশাত্মবোধক গানের আবেদন অনেকটাই হারিয়ে গেলো। তবে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি আগের তুলনায় প্রকাশ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে আরম্ভ করলো। ফলে দেশাত্মবোধক গান গতি হারিয়ে ফেললেও গণসংগীতের ধারা সেখানে জোরদার হলো। অপর পক্ষে, পূর্ববঙ্গ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীন হলেও কার্যত সে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হলো। সেখানে প্রচণ্ড অসন্তোষ এবং আন্দোলন দেখা দিলো বাংলা ভাষা নিয়ে। কারণ, পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলো। এই আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। একুশে এবং বাইশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার করার দাবিতে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করে। এই বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে পুলিশ গুলি চালায়। সঠিক সংখ্যা জানা যায় না, তবে তার ফলে অন্তত দশ-পনেরো জন প্রাণ হারান। একুশের রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এই আন্দোলন নিয়ে রচনা করেন বিখ্যাত ভাষাত্মবোধক গান—আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি?
একটি হিন্দী ফিল্মি গানের সুরে গানটিতে সুর দেন আবদুল লতিফ। গানটির বাণী খুব কাব্য গুণসম্পন্ন ছিলো না। সুরটিও খুব আকর্ষণীয় ছিলো না। তা সত্ত্বেও, গানটি ব্যাপকভাবে গাওয়া হয় ১৯৫৩ ও ৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর পর করাচি থেকে ঢাকায় এসে দৃশ্যপটে দেখা দেন আলতাফ মাহমুদ। তিনি গানটিতে নতুন করে সুরারোপ করেন। এই সুর ম্যাজিকের মতো তাবৎ মানুষের চিত্তকে আকর্ষণ করে এবং রাতারাতি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

২০০২ সালে এই গান রচনার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমি বিবিসির বাংলা বিভাগ থেকে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করি। তাতে গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং সুরকার আবদুল লতিফ—দুজনই যোগ দিয়েছিলেন। আলতাফ মাহমুদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় শহীদ হন। তিনি যখন এ গানটিতে নতুন করে সুর দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন আবদুল লতিফ তাতে আপত্তি করেননি। আবদুল গাফফার চৌধুরী, আবদুল লতিফ এবং আলতাফ মাহমুদ একই জেলার লোক এবং তাঁরা পরস্পর বন্ধু ছিলেন। আবদুল লতিফের সুরটি ছিলো দ্রুত তালের। তা ছাড়া, একাধিক লয় ও তাল ব্যবহার করে তিনি এ গানের সুরে বৈচিত্র্য আনতে চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে, আলতাফ মাহমুদের সুরটি ছিলো টেনে-টেনে গাইবার, অনেকটা চার্চের গানের মতো। সৌভাগ্যক্রমে সেই সুরই জনগণের চিত্ত হরণ করে। এ গানটি সম্ভবত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'র মতো অথবা তার চেয়েও বেশি জনপ্রিয়।

ওদিকে, আবদুল লতিফ ১৯৫৩ সালে নিজের থেকে আর একটি গান রচনা করেন এবং তাতে সুর দেন—ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।/ ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়ে। এ গানে সুরও দিয়েছিলেন তিনি নিজে। সে গানটিও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো।

৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরে ভাষাত্মবোধক আরও গান রচিত হয়েছিলো। সে গানগুলো আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সব সময়ে নতুন গান নয়, অনেক সময়ে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামের গানও ব্যবহৃত হয়েছে আন্দোলনে উৎসাহ দেওয়ার জন্যে। যেমন, 'আমার সোনার বাংলা'। বাংলাদেশ সরকার এ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার আগেই হাটে-মাঠে-ঘাটে গেয়ে গেয়েই জনগণ এটিকে নিজেদের জাতীয় সংগীতের সম্মান দিয়েছিলো। তারপর সরকারের পক্ষে একে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা না-দিয়ে উপায় ছিলো না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা' গানটিও খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো। নজরুল ইস
লামের দেশাত্মবোধক গানের তুলনায় জাগরণী গান অনেক বেশি। বাংলা ভাষাকে নিয়ে তাঁর কোনো গান নেই।
মুক্তিযুদ্ধের পরেও বাংলা ভাষা এবং বাংলা মাকে ভালোবাসার গান রচিত হয়েছে। এ রকম একটি অসাধারণ গান রচনা করেছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়, খুব সম্ভব ১৯৯৪ সালে। গানটিতে সুর ও কণ্ঠও দিয়েছেন তিনি। এমন কি, গেয়েছেনও তিনি। গানটির প্রথম কয়েকটি পংক্তি হলো:
আমি বাংলায় গান গাই / আমি বাংলার গান গাই /
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই।
আমি বাংলার কথা কই / আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি /
আমি বাংলায় জেগে রই।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে খেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার।
বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান ক্ষিপ্র তীর ধনুক,
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, সেই বাংলার মুখ

এ গানে বাংলার বিশেষ অঞ্চলের প্রতি অথবা বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি অথবা বাংলার রাষ্ট্রনৈতিক পরিচয়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়নি। বরং প্রকাশ পেয়েছে বাংলা ভাষা এবং বঙ্গভূমির প্রতি আন্তরিক আবেগ এবং সীমাহীন ভালোবাসা। গানটিতে বাংলা ভাষা বা দেশের বিস্তারিত বিবরণ বলতে গেলে কিছুই নেই, কিন্তু সহজ সরল কথার মধ্য দিয়ে এতে প্রগাঢ় আবেগ প্রকাশিত হয়েছে। এই আবেগ প্রকাশ করতে সুরকার কথার ওপর সুরের ঐশ্বর্য চাপিয়ে দেননি। বরং বারবার মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি উভয় অর্থে 'বাংলা' শব্দটি ব্যবহার করে এবং জীবনের ছোটো ছোটো কাজের সঙ্গে সেই 'বাংলা'র প্রগাঢ় যোগাযোগ ঘটিয়ে নিরাভরণ কথাগুলোকে শ্রোতার হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছেন। ফলে তাঁর দরদের সূক্ষ্ম স্পর্শও শ্রোতাদের হৃদয়তন্ত্রীকে অনুরণিত করে। গানটি পাশ্চাত্যের ফোক সং-এর মতো বক্তব্যপ্রধান এবং আবৃত্তিধর্মী। ভাষাত্মবোধক শ্রেষ্ঠ বাংলা গানগুলোর মধ্যে এ গানটি অন্যতম। সেই জন্যেই গানটি যথেষ্ট পুরোনো না-হলেও
এটিকে বর্তমান রচনার ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলাম।

পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস প্রকৃত পক্ষে প্রতিবাদ ও সংগ্রামের ইতিহাস। তার ছায়া পূর্ব পাকিস্তানের গান এবং সংস্কৃতির ইতিহাসেও প্রতিফলিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ষড়যন্ত্র করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শোষণ এবং নির্যাতন চালানোর। বাঙালিরাও তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে। ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি নানা স্তরে বিভক্ত ছিলো এই আন্দোলন। এই পটভূমিতে দেশাত্মবোধক এবং ভাষাত্মবোধক গান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে উৎসাহ দিতে থাকে।

সিকান্দার আবু জাফর ১৯৬০-এর দশকে 'জনতার সংগ্রাম চলবেই' লিখেছিলেন একটি কবিতা হিসেবে। কাব্য-অকাব্য যাই বলা হোক, এ কবিতা শেষ পর্যন্ত গানের রূপ নেয় এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামে উৎসাহ জোগায়। পাকিস্তানী আমলে এ জাতীয় গান দেশাত্মবোধক গান হিসেবে পরিচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে অথবা মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এ গানগুলোর নাম হয় মুক্তির গান/জাগরণী গান। এ গানগুলো অতো পুরোনো নয়। কাজেই গানের ইতিহাসে এগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত হবে না। এ রকমের গানের একটি তালিকা দিচ্ছি:
১. এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে (১৯৬০এর দশক)। রচয়িতা আবু জাফর, গায়িকা ফরিদা পারভিন।
২. সালাম সালাম হাজার সালাম (১৯৭০?)। রচয়িতা ফজল-এ-খোদা, সুরকার আব্দুল জব্বার।
৩. জয় বাংলা বাংলার জয় (১৯৭০)। রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুরকার আনোয়ার পারভেজ।
৪. একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট (১৯৭৬)। রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুরকার আনোয়ার পারভেজ।
৫. একতারা তুই দেশের কথা। রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুরকার আনোয়ার পারভেজ। গায়িকা শাহনাজ রহমতুল্লাহ।
৬. এক নদী রক্ত পেরিয়ে (১৯৭০-এর দশক)। রচয়িতা খান আতাউর রহমান। গায়িকা শাহনাজ রহমতুল্লাহ।
৭. মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি (১৯৭১)। রচয়িতা গোবিন্দ হালদার, সুরকার আপেল মাহমুদ।
৮. পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে (১৯৭১)। রচয়িতা গোবিন্দ হালদার, সুরকার সমর দাস।
৯. এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১)। রচয়িতা গোবিন্দ হালদার, সুরকার আপেল মাহমুদ।
১০. শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি (১৯৭১)। রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুরকার ও গায়ক অংশুমান রায়।
১১. মাগো, ভাবনা কেন (১৯৭১)। রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
১২. বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান (১৯৭১)। রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুরকার সমর দাস।
১৩. ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা (১৯৭১)। রচয়িতা মো ফখরুদ্দীন, সুরকার আলাউদ্দীন আলী।
১৪. জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো। রচয়িতা নয়ীম গওহর, সুরকার আজাদ রহমান, গায়িকা সাবিনা ইয়াসমীন।
১৫. পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা / আমার এ দেশ ভাইরে। রচয়িতা আজিজুর রহমান। সুরকার সুবীর নন্দী। গায়িকা ফাহমিদা নবী।
১৬. সব ক'টা জানালা খুলে দাও না (১৯৮২)। নজরুল ইসলাম বাবু। সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ। গায়িকা সাবিনা ইয়াসমীন।

দেশের প্রতি ভালোবাসা কমবেশি সবার মধ্যেই আছে। তবে দেশের সংকটের সময়ে দেশাত্মবোধক গান বেশি রচিত হয়। এসব গান সভায়, আসরে, বিক্ষোভ-সমাবেশে, মিছিলে গাওয়া হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অসংখ্য গান লেখা হয়েছিলো। পশ্চিমবঙ্গেও ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় দেশাত্মবোধক গানের সমাদর বৃদ্ধি পেয়েছিলো। ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশে ভাষাত্মবোধক গান যেমন রচিত হয়েছে,পশ্চিমবঙ্গে সে তুলনায় প্রায় কিছুই রচিত হয়নি। আমরা আরো লক্ষ করেছি যে, দেশাত্মবোধক গান বিষয়বস্তু অনুযায়ী নানা শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। 'সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে' অথবা 'এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে' এমন গান যা আন্তরিকভাবে দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। অপর পক্ষে, ভাষা আন্দোনের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব গান রচিত হয়েছিলো, সেসব গানের দৃষ্টিকেন্দ্র কিছু সীমিত। এমনি বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে যেসব গান রচিত হয়, তাদের আবেদন তখনকার মতো তীব্র হলেও, তাদের আয়ু সীমাবদ্ধ। কোনো গানের আবেদন আবার অঞ্চলবিশেষেই সীমাবদ্ধ।