কবিজীবনের ছাপ রেখে চলে গেলেন কাজী রোজী

আনিসুর রহমান
Published : 20 Feb 2022, 05:15 PM
Updated : 20 Feb 2022, 05:15 PM


বাংলাদেশের অর্ধশত বছর আয়ুষ্কালে চারজন নারী তাদের যাপিত সময়ের পুরোটা জুড়ে কবিজীবনের ছাপ রেখে গেলেন। এরা হলেন সুফিয়া কামাল, খালেদা এদিব চৌধুরী, রুবী রহমান এবং কাজী রোজী। তাদের কালে কবিতা আরো অনেক নারীই লিখেছেন। কিন্তু তাদের মতো করে নগর ও দেশকে সময়ের সঙ্গে ধারণ করে কবিজীবন যাপন করেননি। এ কারণে কাজী রোজী স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বাঙালিকে আরো কিছু কারণে তাকে মনে রাখতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রথম শহীদ নারী কবি মেহেরুন্নেসার জীবনীকার এবং মেহেরুন্নেসার খুনিদের একজন যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতে কাজী রোজীর সাক্ষ্য প্রদান।

কাজী রোজীর সঙ্গে অসংখ্যবার দেখা হয়েছে আমার, টুকটাক কথাবার্তাও হয়েছে ঢাকার সাহিত্যপরিমণ্ডলে, বিশেষ করে কবিতা উৎসবে, বইমেলায় এবং বাংলা একাডেমিতে। তারপরও কেন জানি তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ গড়ে উঠেনি।

কাজী রোজী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তিনি যেমন গদ্য লিখেছেন, লিখেছেন গান ও মঞ্চনাটক। তার মঞ্চনাটক প্রযোজিত হয়েছে ঢাকাস্থ মহিলা সমিতিতে, শিল্পকলা একাডেমিতে, এমনকি দেশের বাইরেও। তার অসংখ্য গান বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে।

তিনি গবেষণা করেছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে। শেষতক তিনি ভূমিকা পালন করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে। এসব কিছু ছাপিয়ে তিনি যাপিত সময়ের পুরোটা পথ ধরে কবিপরিচিতি শিরোধার্য করেছেন দৃশ্যে এবং অদৃশ্যে।

কবিতা প্রসঙ্গে কথা উঠলে তার কবিতা থেকে একটা উদ্ধৃতি অনেকের মুখে উচ্চারিত হতো 'ভাত দেবার মুরাদ নাই, ভাতার হবার চায়'। উদ্ধৃতির এই কবি কাজী রোজী সম্পর্কে তখনও আমার জানাশোনা হয়ে উঠেনি। এরপর নানা উপলক্ষে তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা লাভ করার সুযোগ ঘটে।

রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার লাভের শতবর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে সুইডিশ ভাষায় 'বাংলার মেঘ' (Bengaliska moln / The Bengali Cloud) নামে বাংলাদেশের কবিতার একটি সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলো অনুবাদ করেন আমার বন্ধু সুইডিশ কবি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কবিতার অনুবাদে খ্যাতি অর্জন করা ক্রিস্টিয়ান কার্লসন। এই অনুবাদ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি জড়িত থাকলেও কবিতা নির্বাচনের কাজটি করেছেন ক্রিস্টিয়ান। ক্রিস্টিয়ান তিন শতাধিক বাঙালি কবির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে সতেরো জন কবি নির্বাচন করেন অনেকটা একনায়কের মতো তার কাব্যরুচি আর কাব্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে।

এই উদ্যোগের একটা নীতিমালা ছিল পুরুষ ও নারী কবির সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে। ক্রিস্টিয়ানের কাব্যরুচি আর কবিতার বিচারের মানদণ্ডে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি সঙ্কলন থেকে বাদ পড়েন। সৌভাগ্যক্রমে কাজী রোজীর কবিতা এই সঙ্কলনে স্থান পায়। ওই সময় তার কবিতা বাংলা, ইংরেজি এবং সুইডিশ ভাষায় নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ আমার হয়। এই কাজে অনেকের কবিতা নিয়ে ক্রিস্টিয়ানের সঙ্গে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও আলোচনা করার সৌভাগ্য হয়।

এই সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত নারী কবিদের মধ্যে রুবী রহমান ছাড়া আর কারো সঙ্গেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো রকম যোগাযোগ আমার ছিল না, আগে বা পরে। এমনকি কাজী রোজীর সঙ্গেও না। আর সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত পুরুষ কবিদের দুই একজনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আগে থেকেই। তাদের সঙ্গেও আমি এখন আর যোগাযোগ খুব একটা রাখি না সচেতনভাবে। তার অন্যতম কারণ তাদের অনেকে ব্যক্তিগত লালসার স্বার্থে ক্ষমতাবলয়ের লেজ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। যেটা একজন কবির আত্মমর্যাদার সঙ্গে যায় না। একজন কবির এরকম আচরণ আমার ভালো লাগে না।

কাজী রোজী অনেক দিক থেকে ব্যতিক্রম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কেউ কেউ তার এই ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যকে বাঁকা চোখে দেখেছেন। আমি খেয়াল করেছি, সংসদ সদস্য হবার আগে এবং পরে কবি কাজী রোজীর মধ্যে কবিসুলভ আচরণের কোনো ব্যত্যয় দেখাননি। তিনি কবিজীবন আর কবিতাকে সবসময় অগ্রাধিকারের চূড়ায় স্থান দিয়েছেন। তাঁর আচরণে নাগরিক অহংবোধ দেখিনি।

তার চলন ছিল তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভরা। সভা সেমিনারে তাকে আগেভাগেই দেখা যেত। তিনি সকলের সঙ্গে দিলখোলাভাবে কথা বলতে পছন্দ করতেন। কবিতা পরিষদে শুরু থেকেই শেষ পর্যন্ত সাড়ে তিন দশক কাল ধরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। কখনো কখনো সংগঠনটির সভাপতি হবার ইচ্ছা পোষণ করতেন। এই কারণে প্রায় অগণতান্ত্রিকভাবে কর্তা নির্বাচিত হয়ে আসা সংগঠনটিতে কারো কারো বিরাগভাজন হয়েছেন, নিগ্রহের মুখে পড়েছেন। তা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, তাঁর উদ্যমকেও থামিয়ে দিতে পারেনি। তিনি প্রয়োজনে সদা উপস্থিত থাকতেন।

কাজী রোজী একধারে কবি এবং সংসদ সদস্য। নানা উপলক্ষে কাজী রোজীর উপস্থিতি খেয়াল করি, সামনে পড়লে কুশল বিনিময় করি। তিনি সংসদ সদস্য, নানা কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন। তার সঙ্গে শেষ দেখার ঘটনাটা বলি।

বাংলা একাডেমিতে বইমেলা চলাকালীন বছর কয়েক আগে মূলমঞ্চে 'সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু' শীর্ষক একটি সেমিনারে তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এই সেমিনারটি আয়োজিত হয়েছিল একই শিরোনামে রচিত আসাদ চৌধুরীর একটি বইয়ের উপর। আমি মঞ্চে বসা। খেয়াল করে দেখি দর্শকসারিতে অনেকের মধ্যে কাজী রোজীও বসে আছেন। আমার কথা বলার পালা। আমি কথা বলতে শুরু করলাম। দেখি উনি আমাকে উৎসাহ দেবার জন্যে দারুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে হাত দুটো তুলে ধরে আছেন একরকম। কথা আমি বললাম বেশ দীর্ঘ সময় নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও জীবনের নানা দিকের তাৎপর্য উল্লেখ করে, বিশেষ করে ফিলিস্তিন, কুর্দিস্তান, কাশ্মীর, বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান এবং বার্মার প্রসঙ্গ টেনে।

কাজী রোজী দর্শকসারি থেকে ইশারায় বলছেন, বলতে থেকো, আরো বলো, থেমো না। সেমিনার শেষে তিনিও যোগ দিলেন মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজীর অফিস সংলগ্ন সম্মেলন কক্ষে। উনি আমাকে কাছে ঢেকে বললেন, কাজের এবং পড়ার গতি ধরে রেখো। যোগাযোগ রেখো। নানা কারণে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। তার হঠাৎ চলে যাওয়াতে একটা আফসোস আর একটু অনুতাপ রয়ে গেলো আমার ভেতরে।

কাজী রোজীর চলে যাওয়া খুবই শোকের। কাজী রোজীর চলে যাওয়া মানে তার জায়গাটি শূন্য হয়ে যাওয়া।

ঢাকার কবিতা অঙ্গনের প্রাণসঞ্চারী যে মানুষগুলো নিকট অতীতে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সেই জায়গাগুলোর শূন্যতা কি আর কখনো পূরণ হবে? সুফিয়া কামাল, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, সমুদ্র গুপ্ত, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, সাযযাদ কাদির, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, রবিউল হুসাইন প্রমুখ। এই শূন্যতা ঢাকার বুকে, আমার মনে বড় বেশি বাজে। এমনটা কাজী রোজীর চলে যাওয়াতেও।