নিঃসঙ্গ বের্গামো ও পাপা জোভান্নি

সাইফ শাহীন
Published : 10 May 2020, 03:26 PM
Updated : 10 May 2020, 03:26 PM


তুমি কি ঈশ্বরের রহস্যময় সত্তার কথা উপলব্ধি করতে পার না কি?
সর্বশক্তিমানের পূর্ণতা যে কতখানি, তুমি কি তা দেখে নিতে পার না কি?
তা-যে নভোলোকের উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে যায়! তাই কী-ই বা করতে পারবে তুমি?
তা যে অধোলোকের গভীরতা-কেও ছাড়িয়ে যায়! তার কতটুকুই বা জানতে পারবে তুমি?
তা যে জগতের চেয়ে দীর্ঘ-প্রসারী,
সমুদ্রের চেয়ে মহা বিস্তারী।

(যোব ১১, ৭-৯), পবিত্র বাইবেল, প্রজ্ঞামূলক গ্রন্থাবলী

বাইবেলের কয়েক স্তবক পড়ছিল এই নিস্পন্দ সময়ে। বাইবেলের নূতন নিয়ম আর পুরাতন নিয়মের বিভিন্ন অধ্যায় নানা সময় পড়ছে ঘরের নির্জনতায়। এখন ঘরের মধ্যে মৃদুলয়ে বাজছে ইতালিয়ান আঞ্চলিক গান। মনোযোগ সরিয়ে নিতেই গান শুনতে চেষ্টা করে যাচ্ছে কয়েক দিন যাবত। ভেতরে নিরন্তর অস্থিরতা কঠিন সময়ে। এই অস্থিরতা কমানোর জন্য কখনো সখনো পিয়ানো বাজায় আনমনে ওর দু'রুমের অ্যাপার্টমেন্টে,আবাসিক এরিয়া এটা, ভিয়া আন্তোনিয়ো লোকাতেল্লিতে। কাসসা এদিলে দে বের্গামো এলাকায়। বাণিজ্যিক শহর মিলানো থেকে ষাট কিলোমিটার-এর মতো দূরে ওদের মনজুড়ানো শহর বের্গামো!
এই মুহূর্তে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মিকেলাঞ্জেলো, বন্ধুরা ডাকে মিকি!! ধূসর চাউনি চোখে, চিন্তাক্লিষ্ট, ম্রিয়মান, মলিন চেহারা হয়েছে ওর। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মুখহাত ভালো করে ধুয়ে ডিসিনফেক্ট্যান্ট স্প্রে করেছে দরজার হ্যান্ডেলগুলোয়, ডিপ ফ্রিজ আর রেফ্রিজারেটরের বাইরের দিকটায়, এছাড়া অন্যান্য বেশী করে ছোঁয়াছুঁয়ি-র প্রত্যেকটা জায়গায় সতর্কতার সাথে। ভীষণ মনঃসংযোগের সাথে অন্যান্য আরো কিছু জায়গাও মুছে ফেলতে হচ্ছে প্রতিদিন বেশ ক'বার করে। আদতে এখন এটাই মূল কাজ টেনশনের সারাটা দিনের অখন্ড অবসরে। প্রচলিত কেতাদু্রস্ত পাস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ে সপ্তাহে'র পাঁচ পাঁচটা দিন চরম ব্যস্ততার ইতালীয় প্রবচন " কাসা আ লাভোরো- লাভোরো আ কাসা" মানে 'বাসা থেকে কাজে, কাজ থেকে বাসা' প্রত্যয়ে ছেদ পড়েছে অনাহুত এবং রবাহুত ভয়ানক আগন্তুকের চরম আগ্রাসনে, হিমশীতল বাস্তব এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র না জড়-না জীব নিংড়ে নিয়েছে মানুষের জয়গান!একটা গুলি বা বোমা না ছুঁড়েও যে পুরো পৃথিবীর মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যায় তা দেখে আতংকিত দিশেহারা জনপদ, থেমে গেছে জনকলরব এর নিরন্তর আখ্যান, আর এক্ষেত্রে এই শহর উহানের পরেই উঠে এসেছে সংবাদে।
নিজেদের ফুটবল দল অর্থাৎ আতালান্তা আর স্পেনের ভালেন্সিয়ার মধ্যে যে ফুটবল ম্যাচটা হয়েছিলো ,ফেব্রুয়ারি-র ঊনিশ তারিখে,স্পস্ট মনে আছে ও নিজেও গেছিলো মিলানোর সান সিরো-তে জিউসেপ্পে মেয়াৎসা স্টেডিয়ামের ঐ মহা হুল্লোড়ে, শত হ'লেও চ্যাম্পিয়নস লীগের মহা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। অ্যাওয়ে ম্যাচ জিতলে পরের রাউন্ডে ওঠার সুবর্ণ সুযোগ, এ রকম দারুণ একটা সময়ে নিজেদের একদম কাছের শহর মিলানোর মাঠ তো কানায় কানায় ভরবেই। ইতালিয়রা ফুটবল পাগল জাতি। এই বের্গামো-র মানুষেরাও তার বাইরে নয়, দলের দু রঙা জার্সি নীল আর কালোর স্ট্রাইপে রাস্তাঘাট,মাঠ পরিপূর্ণ। ওরা ভালোবেসে দলের নিকনেম দিয়েছে " ই নেরাৎসুরি"। চার এক গোলের ব্যবধানে গুড়িয়ে যায় এস্পানীয়া'র দল ভালেন্সিয়া আতালান্তা-র কাছে।সে কী দুরন্ত উচ্ছ্বাস জিউসেপ্পে মেয়াৎসা-য়, আতালান্তা-র দু রঙা পতাকা নিয়ে।গা ভাসিয়ে দিয়েছিলো সবাই মিলানোর বারগুলোয়। ট্রেন আর বাস ভরে ভরে গাদাগাদা হয়ে বের্গামোতে ফিরেছে সমর্থকরা । কিছুতেই ভাবতে পারেনি এই উচ্ছ্বাসের উৎরোল রূপ নেবে হতাশার মর্মন্তুদ আহাজারিতে, ঘাপটি মেরে থাকা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে শহরময় এমনকি শহরতলী ছাড়িয়ে।নিস্তব্ধ আকাশ, হিমশীতল বাতাস আর মাঝেসাঝে বুক কাঁপানো সাইরেনের শব্দ তৈরি করবে আধি ভৌতিক ছবির আবহ।
মিলানোর দুটো দল এসি মিলান আর ইন্তেরমিলানো-র খ্যাতি বিশ্বব্যাপী।মিলানো-র সান সিরো-র মেয়াৎসা স্টেডিয়াম তো শানশওকতের। কিন্তু এই কম দূরত্বের বের্গামো-র নিজস্ব দলের প্রতি ভালোবাসা অপরিসীম।আর ২০১৮-১৯ মৌসুমে আতালান্তা মূল ফুটবল লীগ সেরিএ-আ বা প্রথম বিভাগে তৃতীয় স্থান পাওয়ায় ভীষণরকম খুশী বের্গামো-র সর্বস্তরের সব্বাই। পরবর্তীতে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ায় মার্চ এর ১০ তারিখে স্পেনের ভালেন্সিয়াতে অ্যাওয়ে ম্যাচেও জেতে আতালান্তা, চলে যায় উয়েফা লীগের পরের রাউন্ডে।স্বগতোক্তির মতো করে ভাবছে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ।
অবচেতন মন থেকে মিকি আবার ফিরে এলো বাস্তবে। আলুসেদ্ধ, মোৎসারেল্লা গুড়ো আর পাস্তা সসে মাখানো পাস্তা খেয়েছে সকালে, খাবার গলা দিয়ে নামছিলো না কিছুতেই। সারা রাত দুঃস্বপ্ন দেখেছে ও। শাদা কাপড়ে মোড়ানো শবদেহ, কফিন আর কফিন আর পেছনে অপেরা মিউজিক।রূপকথার মতো হুট করে পাল্টে গেছে পৃথিবী গত কিছুদিনের মধ্যে। চীনের উহান থেকে এই না-জীব না-জড় ভাইরাসের অদৃশ্য তান্ডবের ঝড় এসে সব কিছু এলোমেলো করে দিয়েছে এই ছোট্ট, ছিমছাম পর্বত ঘেরা উত্তর ইতালির লোম্বারদিয়া-র এ শহরটায়। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত রুদ্ররোষ ঝাড়ছে এখানে। সমস্ত হাসপাতালগুলো ভরে গেছে নোভেল করোনা আক্রান্ত রোগীতে।।এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হতে হতে এখন সামলে নিয়েছে আপনাআপনি। এক অব্যক্ত কষ্ট, যন্ত্রণা আর আহাজারি ভেতরের দিকটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে……এই ছটফট করানো বিষম পরিস্থিতিতে মনের জোর রাখবার কোন বিকল্প নেই, এই সত্য বুঝতেও অসুবিধে হছে না। কিন্তু কিছুতেই বাঁধ মানছে না। জানে যদিও সব কিছুর শেষ থাকে, এবং আবারো ঘুরে দাঁড়াবে সঞ্জীবনী শক্তি নিয়ে।
মাঝে সাঝেই নিজের পিয়ানো বাজায় একমনে বসে বসে, ঘরেই সময় কাটানোর বাধ্যগত সময়ে। খুবই ভালো পিয়ানো বাজায় মিকেলাঞ্জেলো। বন্ধুরা শোনে প্রায়ই, আর এই বের্গামোর ছেলে, বের্গামো-তেই জন্মেছেন বিখ্যাত কম্পোজার দোমেনিকো গায়েতানো দোনিজেত্তি,১৭৯৭ সালে, দোনিজেত্তি-র একটা অপেরা কম্পোজিশন বাজাচ্ছিলো গতকালও… জনপ্রিয় " উনা ফুরতিভা লাগিরমা"( A furtive tear)…দোনিজেত্তি অস্টাদশ শতাব্দীর ইতালির বিখ্যাত সুরকার, দারুণ বাজিয়ে মাত করেছিলো রোম ও মিলানো-তে। এই সময়ের লুচিয়ানো পাভারোত্তি ও প্লাসিদো দোমিঙ্গো-ও এই গেয়েছেন দোনিজেত্তির অপেরা সঙ্গীত। আর নিয়ে জনপ্রিয় ইতালিয় গানের সুর ভাঁজে নিজের এই ফ্ল্যাটের ভেতরের রুমে, গলা ছেড়ে গেয়ে উঠে রাস্তার ধারের ব্যালকনিতে বসে , অন্যদের দেখাদেখি। এই শহরের অগুনতি মানুষের এই বিস্রস্ত অসহায় মারা যাওয়া বড্ড বেশী অসহায় করে দিয়েছে ডাক্তার আর অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আপ্রাণ চেষ্টার পরেও। বিকালের দিকটায় ব্যালকনিগুলো ভরে যায় প্রতিবেশীদের সবাইসহ, ওদের রাস্তার ওপর নীচ, উল্টোপাশ, ডান আর বাম সব দিককার ঝুলন্ত বারান্দাগুলোর। পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় হয় গানে গানে,অপার সহমর্মিতায়। গলা ছেড়ে গান গাইতে থাকে ঐতিহ্যবাহী "বেল্লা চাও"…অনেক দেশ গলা মেলাচ্ছে ফাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে গনতন্ত্রমনা ইতালীয়দের একসময়কার এই ভীষণ জনপ্রিয় ইতালিয়ান গানের সাথে, ভালোবাসায়!!
উনা মাত্তিনা মি সোনো আলসাতো
ও বেল্লা চাও, বেল্লা চাও, বেল্লা চাও, চাও চাও
কুয়েস্তা মাত্তিনা মি সোনো আলসাতো
এ ও ত্রোভাতো লি'নভাসোর
ও বেল্লা চাও, বেল্লা চাও, বেল্লা চাও, চাও চাও …
লোম্বারদিয়া এলাকা ইতালীতে ধনী এলাকা বলে স্বীকৃত। ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট, মিলানোর সাথে চীনের উহানের সরাসরি ফ্লাইট আছে। প্রচুর চীনারা কাজ করে ভিন ভিন শিল্প প্রতিষ্ঠানে,পুঁজিও আছে, ইতালীতে করোনা সংক্রমণের প্রথম আক্রান্তের সাথে চীনা যোগসূত্র থাকতে পারে তবে মিলানো লকডাউনে চলে যাবার আগ থেকেই লোম্বারদিয়া ছাড়তে শুরু করে স্ত্রানিয়েরি-রা বা বিদেশীরা, এমনকি আন্তঃ অভিবাসনে প্রায় ৪০,০০০ ইতালিয়ান দেশের লোম্বারদিয়া আর এমিলিও রোমানীয়া প্রদেশ অর্থাৎ উত্তর পাশ থেকে দেশের দক্ষিণের প্রদেশগুলোয় পাড়ি জমিয়েছে সংক্রমণ থেকে দূরে থাকার জন্য।
ভীষণ সুন্দর শহর ওদের বের্গামো। বেশ উঁচু ভেনেশিয়ান দেয়াল দিয়ে ঘেরা শহরের একাংশ, অদুরে লেক আর এর এর উপরাংশে পর্বত, নীচের দিকে মালভূলির মতো সমতল ভুমির মধ্যে নীচের শহর আর আর চড়াই এর উপরের পাহাড়ি গা বেয়ে ওঠা উচ্চ শহর। এই আপার টাউন থেকেও আরও ওপর দিকে আল্পি ওরোবিয়ে বা য়্যুরোপীয় আল্পস পর্বতমালার সারি দৃশ্যমান। সুনীল আকাশে শাদা বরফের সারি সারি চূড়ো চোখ ধাধিয়ে দেয়। ধাঁধানো চোখে পর্যটকদের বিস্মিত মুখ এই শহরে টেনে আনে আরো অনেককেই……মিলানো থেকে অনেকে চলে আসে ছুটিছাটায়। এখন প্রেতপুরীতে পরিণত হয়েছে প্রাণের এই ছোটমোটো নগর, পিক্কোলা চিত্তা!!হাসিখুশী, চরম আড্ডাবাজ মানুষ , অথচ বেদনায় নীল হতে হতে শরীর মন ডুবে গেছে অজানা অচেনা অনিশ্চয়তায় ভাইরাসের দাহনে। নেটে "কোরিয়েরে দেল্লা সেরা" সান্ধ্য দৈনিকে চোখে পড়লো আজ ১১ এপ্রিল, ২০২০ অব্দি কেবল লোম্বারদিয়া প্রদেশে মারা গেছে ১০৮৭৭ জন, আক্রান্ত সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯,৫৩০ জন। স্থানীয় খবরের কাগজ লে'কো দি বের্গামো বলছে শুধু মার্চ মাসেই এই ছোট্ট শহর বের্গামোতে মারা গেছেন প্রায় ৪৫০০ জন। ফেব্রুয়ারি-র র তৃতীয় হ'প্তায়ই বের্গামো উপত্যকার কাছে ভাল সেরিয়ানোর দু দুটো গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাস, আলসানো আর নেম্ব্রো-তে,যেটা এখন হয়ে গেছে মহামারির গ্রাউন্ড জিরো।
বের্গামোর কনফুদিস্ত্রিয়ার প্রেসিডেন্ট স্তেফানো স্কালিয়া ও মেয়র জোর্জিও গোরি প্রথমে রপ্তানীর চিন্তা মাথায় রেখে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এনং কারখানা চালু রাখেন হ্যাশট্যাগ ঝুলিয়ে, "#বের্গামোইজরানিং#'। এখন দু'জনকেই দোষারোপ করা হচ্ছে প্রথমেই লকডাউন না করে মৃত্যুর মিছিল বাড়ানোয়। ইতালিয়ান সেনাবাহিনী কফিনে ভরা শবমিছিল নিয়ে বের্গামোর সান্ধ্য আলো আধারিতে শহরের বাইরে চলে যাচ্ছে, এই অত্যন্ত পীড়াদায়ক ছবি ভাইরাল হয়েছে বিশ্বব্যাপী।কারণ সিমেট্রিগুলোতে স্থানাভাব। এই ভাইরাস ফেলে দিয়েছে নিরন্তর হতাশায়, জ্বলজ্বলে নিয়ন আলোয় উদ্ভাসিত বের্গামো রূপ নিয়েছে ভয়াল উপত্যকার কাতারে। শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রাণস্পন্দন কমে গেছে ইদানিং, বাসায় বাসায় বেড়ে গেছে প্রার্থনার আতিশয্য। আর কিছুতেই কাজ হচ্ছে না ভেবে ভাবলেশহীন হয়ে মলিন জবথুবু হয়েছে চেহারা।

হঠাৎই গত কিছুদিনের মাঝে ভোজবাজির মতো পালটে গেলো সব এক লহমায় বলতে গেলে…কস্টটা বেশী করে বেজেছিলো তখন সাইরেনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে ছিলো দিন বিশেক আগে ওদের ডান দিকের সাতটা বাসা পরেই ঘনিস্ট বন্ধু পাওলোর বাবা মারা গেলো যখন, পাওলোর বাবা আলবের্তো-র শবদেহ দেখার সুযোগ পায়নি…ওরা কেউ। শুধু খবর পেয়েছিল, শেষ দেখবার সুযোগ পায়নি, পরে কারাবিনিয়েরিরা 'পাপা জোভান্নি তেইশ', হাসপাতালের নাম আদতে, হাসপাতাল থেকে আলবের্তো-র মরদেহ সোজা নিয়ে যাওয়া হয়েছে বের্গামো-র সিমেট্রিতে……পাপা জোভান্নিতে ভীড় বেশি কোভিড-১৯ –এ আক্রান্তদের। বেশ বড়োসড় জায়গা নিয়ে হাসপাতাল পাপা জোভান্নি। চারপাশ বেশ খোলামেলা কিছু বায়োটেক কোম্পানী ওষুধের ট্রায়াল করছে এই হাসপাতালে। ভাইরাসের ধরণটা এক্কেবারে নতুন হওয়ায় বিপদে পড়ে গিয়েছে ডাক্তাররা। ইতালী স্বাস্থ্যসেবায় ইয়োরোপে সেরাদের অন্যতম।কিন্তু এই নোভেল করোনাভাইরাসের আগাপাশতলা, ভেতর বাহির কিছুর-ই তত্ত্বতালাশ করতে পারছে না হঠাৎ প্রাদুর্ভাব ঘটায়। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অন্যান্য পরিষেবা যারা দিচ্ছেন, গলদ্ঘর্ম হয়ে গেছেন ইতিমধ্যে, মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে কেবল।স্বাস্থ্যসেবার সংগে সংশ্লিষ্ট ডাক্তাররাও মারা যাচ্ছেন বা আক্রান্ত হচ্ছেন কিন্তু থেমে নেই কেউ।সুতরাং দরকার হয়ে পড়ছে গবেষণার। খবরের কাগজে পড়েছে বিশেষ করে সিলভ্যান্ট বা সি এন টিও ৩২৮ মেডিসিন ব্যবহারের প্রায়োগিক দিক পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে রোগীদের উপর পাপা জোভান্নি-তে। পরীক্ষা করছে অনকোলজি ও হেমাটোলজি বিভাগ, এটিকু শুনতে পেয়েছে সেও।

আলবের্তো ছিলো মিকি-র ইল পাদ্রিনো বা গডফাদার। খুব ভালোবাসতো মিকিকে আলবের্তো, ছোটবেলায় ইতালীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আলাদা থাকা স্বার্বভৌম রাজ্যগুলোর রিইউনিফিকেশনের কাহিনী শোনাত মিকিকে, জাতীয় বীর জ্যুসেপ্পে মাৎসিনি আর জ্যুসেপ্পে গারিবালদির কাহিনী।, ইতালীয় ভাস্কর দা ভিঞ্চি আর ওর নামে নাম মিকেলাঞ্জেলো বুয়োনাররোত্তি বাদে অন্যান্য,শিল্পী, সুরকার ।বিমুগ্ধ হয়ে সেসব শুনত ও। আরো অনেক স্মৃতি ইল পাদ্রিনোকে নিয়ে, ভাবতে গিয়ে চোখ ভিজে যাচ্ছে। ব্যালকনির দেয়াল ধরে ঝুঁকে ডানে তাকালো ও এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে, ফোন পেয়ে কাউকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দিয়েছে ওটা। ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলো এ্যাম্বুলেন্স।

এরপর একে একে মারা গেছে মাত্তেও-র আর গাব্রিয়েলে-র বাবা আর ভানেসা-র শ্বাশুড়ী। ওদের অফিসের কলিগ রিকার্দো-র নানা সালভিনি।ফোন এর রিংটোন বেজে উঠলেই চমকে ওঠে মিকি, আবার কী অমন কোন সংবাদ পায় কীনা। গত তিনদিন পরিচিত কারো মারা যাবার খবর পায়নি, কিন্তু হাসপাতালে আছে, সেরে উঠেছে এমন খররই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে, এটা একটা ভাল দিক। নিরবচ্ছিন্ন লকডাউনের ধারাবাহিকতায় বাইরে বেরোনো হচ্ছে না, টিভি আর নেট-ই বাঁচিয়ে রেখেছে এই শহরের মানুষকে না হলে প্রাণহীন হয়ে যেতো সব। চেষ্টা করেছে নিজ দেশের কিছু কিছু পুরানো সিনেমা দেখার এ সময়ে, জ্যুসেপ্পে তোরনাতোরে আর পাসসোলিনি-র সময় কাটানোর তাগিদে, কিন্তু পেরে ওঠেনি মোটেও, হালের নান্নি মোরেত্তি-র স্যাটায়ার "হাবেমুস পাপুম"। কোনটা অর্ধেক আর কোনটা সিকিভাগ এরপর আর মনিটরে চোখ রাখতে পারছে না। বাবা আর মা থাকে শহরের উপরিভাগের উঁচু পাহাড়ী এলাকায়, ফোনে কথা হয় হররোজ, বয়স হয়েছে ওনাদেরও। দুঃশ্চিন্তা ওর মাকে নিয়ে নিয়ে, ক'দিন ধরে স্বাস্থ্যটা ভালো যাচ্ছে না বাহাত্তর বয়সে এসে,, হালকা একটু কাশি আছে, ডাক্তারের কথামতো ওষুধ খাচ্ছেন তিনি।

মিস করি খুব শহরের প্রাণকেন্দ্র পিয়াৎসা ভেক্কিয়া-র ফুটপাতে বসে বন্ধুদের সাথে কফির কাপে চুমুক দিয়ে তুমুল আড্ডাবাজি, ভেনেশিয়ান দেয়ালের পাশ দিয়ে গাড়ী ছুটিয়ে ট্রেকিং এর জন্য ভাল ব্রেম্বানায় দুদ্দাড় ছুটে যাওয়া। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে একাকী।চমকে ওঠে হঠাৎ মুঠোফোনের রিনরিনে শব্দে। বাবা ফোন করেছে ওকে। বিষয় শুনে পিঠের মেরুদন্ড বেয়ে তীব্র শীতল স্রোত বয়ে যায় মিকির। ভাবতে পারছে না ও। হুট করে খুক খুক কাশিটা বেড়ে গেছে মা'র। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে এবং উপায় না দেখে বরাবরের মতো কাছাকাছি পাপা জোভান্নি হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স এর জন্য ফোন করে দিয়েছেন। রওনা দিয়েছে এম্বুলেন্স বাবা-র বাসার দিকে। সাতপাঁচ ভাববার সময় নেই এখন, টেস্ট পজিটভ হ'লে, আর ভাবতে পারছে না ও। এক ভয়ানক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কোনদিন আর মা'কে দেখতে পাবে না। গাড়ীর চাবিটা নিয়ে ঝটিতি বেরিয়ে যায়, ধুপধাপ লাফিয়ে পার হয় সিঁড়ি। এখান থেকে হাসপাতাল প্রায় অনেকটা দুরে।পোলিৎসিয়া বা কারাবিনিয়েরি রাস্তায় থামাতে পারে এই পুরো শাটডাউনে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করছে না। দ্রুত গাড়ী চালিয়ে ভিয়া মিলানো গিয়ে টার্ণ নিয়ে যে করেই হোক এ্যাম্বুলেন্স এর আগে পৌঁছুতেই হবে তাকে। ভরসন্ধ্যার আলোছায়ায় খালি রাস্তায় দুদ্দাড় দুর্দম্যভাবে চালাচ্ছে, চোখ ভিজে ঝাপসা হয়ে আসছে কিন্তু মিকির চোখ স্থির সামনের দিকে।