আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, মৌলবাদীরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙছে, ভাবতে পারেন?

অলাত এহ্সান
Published : 14 Feb 2021, 03:37 PM
Updated : 14 Feb 2021, 03:37 PM

বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে ছিল বাংলা ভাষার অধিকার। এই অধিকারের জন্য শহীদ হয়েছিলেন বাংলার বীর সন্তানেরা। তাদের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসকে নানান অনুষ্ঠান ও মেলায় রাঙিয়ে তোলা। মাসব্যাপী বইমেলা তারই এক অনন্য রূপ। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক আ্ত্মপরিচয়েরও এক প্রকাশ যেখানে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলন ঘটে। কিন্তু কোভিড ১৯-এর কারণে এবারের বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে না হয়ে, জনগণের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মার্চের ১৮ তারিখে শুরু হতে যাচ্ছে। শত শত প্রকাশকের অংশগ্রহণে মুখরিত বইমেলা আমাদের মন ও মননের এক নান্দনিক অভিব্যক্তি। গত কয়েক বছর ধরে কম করে হলেও প্রতি বছর চার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। গতবছর প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ হাজারের মতো নতুন বই। কিন্তু বাংলা একাডেমির মতে এর সবটাই মানসম্পন্ন নয়। বড় জোর সাড়ে সাত শ' বইকে তারা মানসম্পন্ন বই বলে মনে করেন। প্রতি বছরই মেলায় বইয়ের বিক্রি বাড়লেও লেখকরা তাদের রয়ালটি ঠিকমত পাচ্ছেন কিনা, তার কোনো বিধিবদ্ধ রূপ আদৌ আছে কিনা তা অনেক লেখকেরই জানা নেই্। বই উৎপাদনের ক্ষেত্রে মান রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে– এই বিষয়টিও বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকদের একটি প্রধান কৌতূহল। করোনা ভাইরাস প্রকাশনাশিল্পকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা আমাদের কাছে অনেকটাই অজানা। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পক্ষে তরুণ গল্পকার অলাত এহসান এসব কৌতূহল ও প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশকদের। প্রতি পর্বে মোট পাঁচজন প্রকাশকের অভিমত প্রকাশিত হচ্ছে গোটা ফেব্রুয়ারি মাসে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে তৃতীয় পর্ব। এতে অংশগ্রহণ করেছে ইউপিএল, আগামী প্রকাশনী, জাগৃতি প্রকাশনী, বিপিএল এবং বলাকা প্রকাশনী। বি.স


…………………….
মাহরুখ মহিউদ্দীন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক,
দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)

…………………….

বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: করোনার প্রভাব পড়েনি এমন কোন ব্যবসাই হয়তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল— সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব— যেভাবেই বলেন না কেন। বই যেহেতু ততটা অপরিহার্য সামগ্রী নয় আমাদের সংস্কৃতিতে, তাই প্রকাশনা শিল্পে যেমনটা শুরুতে আশঙ্কা করা হয়েছিল, ততটা না হলেও মোটের ওপর নেতিবাচক প্রভাবই পড়েছে; এবং এই নেতিবাচক প্রভাবের সময়টা এখনও সম্ভবত শেষ হয়ে যায়নি।

বিডিনিউজ: করোনা শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে প্রতিশ্রুতি করতে দেখেছি— যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারেন নি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে বিস্তর পড়বেন। অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ই সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: অনলাইনে বই বিক্রির হিসাব যদি দেখেন, তা নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে; তবে বইয়ের প্রত্যাশিত মোট বিক্রির তুলনায় এই বৃদ্ধি কিছুই না। হ্যাঁ, অনেকে হয়তো লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে অনেক রকম ফেলে রাখা শখের দিকে ফিরে তাকাবার ফুরসৎ পেয়েছেন— বই পড়া সেই নানান শখের মধ্যে একটি হয়তো। এবং অনেক পড়ুয়া হয়তো তাদের ইতিপূর্বে কিনে রাখা বইগুলি শেলফ থেকে নামিয়ে ঝেড়ে-টেড়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। নতুন বই কতটা কিনে পড়েছেন তা গবেষণা করলে খানিকটা পরিষ্কার জানা যাবে। ইউপিএল যে ধরণের বই প্রকাশ করে, তার পাঠক কাটতি এমনিতেই কম। তাই এই সব বইয়ের বিক্রি থেকে খুব আশাব্যাঞ্জক কিছু বলতে পারাটা কষ্টসাধ্য।

বিডিনিউজ: কাঁটাবন এলাকাসহ ঢাকার নানান স্থানে বইয়ের কয়েকটি আউটলেট উঠে গেছে। এটা কি শুধুই করোনার কারণ বলবেন, না কি সারা বছর মানুষের যে পাঠ-স্বল্পতা, তারই ঘনিভূত প্রভাব? কারণ এতদিনের ব্যবসা সাময়িক দুর্যোগেও কি দাঁড়িয়ে থাকার কোনো সঞ্চয় দেয়নি— এই প্রশ্ন সামনেই আসে।

মাহরুখ মহিউদ্দীন: আমি যে কথাটা নানান সময়ে বলে এসেছি যে, প্রকাশনা শিল্পের নানান পর্যায়ের যেসব সংকটের কথা বলি আমরা সারা বছর— বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা হা-হুতাশ করি— সেই সঙ্কটগুলিই সম্ভবত করোনাকালে তুঙ্গে উঠেছে। প্রকাশনা ব্যবসা, দেশি বইয়ের বিপণন, এই প্রক্রিয়াগুলিই একধরণের নড়বড়ে ভিত্তির উপর চলছে। সত্যিকার সৃজনশীল প্রকাশনায় নতুন বই নির্মাণের পরিতৃপ্তি আর মান-সম্মান যা-ও-বা কিছুটা রয়েছে, আর্থিক সাফল্য বলতে গেলে নেই একেবারেই। প্রতি বছর আমরা এমনিতেই কোনভাবে টিকে থাকার সংগ্রাম করে পরের বছর আবার আশায় বুক বাঁধি, কিন্তু গল্পটা প্রায় একই রকমই থাকে। করোনা এসে গল্পটিকে চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সের দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। ধুঁকেধুঁকে মরার যন্ত্রণার চেয়ে হয় বেপরোয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর, অথবা রণেভঙ্গ দেয়ার মধ্যে যেকোনো একটি রাস্তা বেছে নিতে হবে গল্পের নায়কদের।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে ইউপিএল কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: দেশি বইয়ের বিপণন বরাবরই একটা চ্যালেঞ্জ। আমি নিশ্চিত যে, দোকান থেকে বই বিক্রির টাকা উদ্ধার করা নিয়ে সব প্রকাশক একাধিক ট্র্যাজিক ছোটগল্প লিখতে পারবেন। অনলাইনে বই বিক্রির সুযোগ সেই দিক থেকে একটা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে— এবং তা করোনার আগেই। অনলাইন স্পেসকে আরো কত উদ্ভাবনী কায়দায় ব্যবহার করা যেতে পারে— সেটা বরং এই সংকট আমাদের দেখিয়েছে। আমরা এখনো সংকটের ভেতরেই রয়েছি, তাই এই যাত্রার শেষে আমাদের আরো কী কী উপলব্ধি ঘটে তা আমিও দেখার অপেক্ষায় আছি।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা ওঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— সেক্ষেত্রে আপনাদের সুনামও আছে। কারো কারো এটি এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাত হচ্ছে, এগুলো বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল নয়। আপনাদের কী অভিজ্ঞতা? কতটা মানতে পারছেন?

মাহরুখ মহিউদ্দীন: আমরা যে নীতি অনুসরণ করি তাতে লেখককে তার পাওনা যথাসময়ে বুঝিয়ে দেয়ার কোন বিকল্প আমাদের জানা নেই। সংকটে পড়লে সেটিও আমরা লেখকদের অবগত করি। কিন্তু এই বিষয়ে কেবল ইউপিএল বা এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের চর্চাকে একমাত্র বিবেচনায় নিলে চলবে না। বাংলাদেশে লেখক-প্রকাশক সম্পর্কে যে তিক্ততা, তার প্রধান অনালোচিত কারণ আসলে বইয়ের বাজারটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র। ফলে অধিকাংশ প্রকাশক আর্থিক দিক দিয়ে চাপে থাকেন, অনিশ্চয়তায় থাকেন। সর্বদাই দেখতে পাবেন, যেখানে বইয়ের বাজার বড়, সরকারি সহায়তা বড়, সেখানে লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক ভালো। যদি বাজারে টান পড়ে, তখন এই সম্পর্কে তিক্ততা দেখা যায়। ফলে লেখকের স্বার্থের বিষয়টা দেখার পাশাপাশি বইয়ের সংস্কৃতিক বৃদ্ধি করবার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতির শেকড়ে হাত দেয়ার কাজটাতে লেখক আর প্রকাশককে যৌথভাবেই ভূমিকা রাখতে হবে। সঙ্কটের আসল সমাধান সেইখানে। প্রকাশনা শিল্পে মুনাফার পরিমাণ বাড়লে, সম্পদ বাড়লে পেশাদারিত্বও বাড়বে।

বিডিনিউজ: লেখকস্বত্ব নিয়ে লেখকদের ক্ষোভ বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। বিষয়টা অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। খোদ আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানসহ সাম্প্রতিক অনেক লেখককে দেখেছি এ নিয়ে সভা-সংবাদ সম্মেলন করতে। পত্র-পত্রিকা বিভিন্ন সময় লেখা বা টিভি চ্যানেলে আলোচনা হয়েছে। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, কোনো কোনো লেখক মনে করেন, লেখকদের সাথে প্রকাশকদের চুক্তি ও রয়্যালটি প্রদানের তথ্য যে-সব প্রকাশনীর নেই, সেসব বই বা প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা। আপনি কি তাদের এই দাবীর সঙ্গে একমত? আপনার পরামর্শে এর সমাধান কী হতে পারে?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: এই দাবির সঙ্গে আমি একমত। তবে এটি আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় প্রায় অকার্যকর দাবি, কারণ তখন দেখা যাবে যে, জনা দশেক প্রকাশক ছাড়া আর কেউ মেলায় অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত হবেন না। পরিস্থিতিটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমার বিশ্বাস আগের প্রশ্নটির সাথেই উত্তরটা অনেক খানি চলে এসেছে।
প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে ইউপিএল দেশী শুধু নয়, বিদেশী লেখকদের সাথেও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করে। কিন্তু আমরা যদি সামগ্রিকভাবে প্রকাশনা শিল্পের দিকে তাকাই, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা ভাবি, তাহলে নিষিদ্ধ করাটা কোন সমাধান না। বরং ভালো বই যদি পাঠাগারগুলো কিনতেন, প্রকাশকরা লেখকের প্রাপ্য সম্মানী বুঝিয়ে দিয়েই ভালো বই প্রকাশের জন্য প্রতিযোগিতা করতেন।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলোর নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। ইউপিএল এটা কিভাবে করছে?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: এটা বিস্তর আলোচনা দাবি করে। এই পরিসরে এর উত্তর দেয়া দুষ্কর। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে একাডেমিক প্রকাশক হিসেবে, এবং যেহেতু আমরা চেষ্টা করি বিশ্বমানের বই তৈরি করতে। আমাদের যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটি তাই সময়সাপেক্ষ, তবে আমরা তা নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সাথে করার চেষ্টা করি। এ কারণে আমাদের বইয়ের দামও প্রায়ই বেশি হয়ে যায়।
কিন্তু পাশাপাশি এই প্রশ্নটাও করা দরকার, যথাযথ সম্পদনার জন্য যে মানের শিক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি প্রকাশনা শিল্পে প্রয়োজন, তাদেরকে যোগ্যতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেয়ার বাস্তবতাটা কি এই ছোট্ট বাজারে আছে? দশ ফর্মার একটা ইতিহাস/বিজ্ঞানের বই ঠিক মত সম্পাদনা করতে যে অর্থ ব্যয় হবার কথা, সেটার পরে বইয়ের যা দাম দাঁড়াবে, সেটা দিয়ে পাঠকের পক্ষে কি এই বাজারে বই কেনা সম্ভব হবে? তাহলে সরকারি ক্রয়, পাঠাগারের ক্রয় ছাড়া পেশাদার সম্পাদনা কিভাবে সম্ভব হবে?

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: ইউপিএল ঐতিহাসিকভাবে বইমেলার নির্ভরতার বাইরেই থেকেছে, তবে বইমেলা অবশ্যই অন্য সব প্রকাশকদের মত আমাদের জন্যও একটা বড় ঘটনা। অবশ্যই এককভাবে বইমেলার উপর নির্ভরতা গ্রন্থসংস্কৃতির জন্য উপকারী নয়। তবে এর দায় প্রকাশকদের দেয়াটাও আমি সমর্থন করতে পারছি না। প্রকাশনার ইকোসিস্টেমে বিপণনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে সরকারকে, বই বিক্রেতাদের এবং গ্রন্থাগারগুলিকে। এই স্বপ্নের ইকোসিস্টেম থেকে আমরা অনেক দূরে অবস্থান করছি। তাই এই নিয়ে কথা বলা একরকম ক্লান্তি আর গ্লানির অনুভূতি দেয়। বাংলাদেশের বইয়ের দোকানগুলোতে আপনি বহু গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি বইয়ের উপস্থিতি দেখবেন না।

বিডিনিউজ: ইউপিএল ইতিমধ্যে ১৫০০-এর উপরে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। শুরু থেকে মননশীল ও মানসম্মত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি রেখে আসছেন আপনারা। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: পেশাদারিত্বের কোন বিকল্প নেই, এটা আমরা শুধু বিশ্বাসই করি না, এর ফল আমরা দেখতে পাই। হয়তো আমাদের দীর্ঘসূত্রিতার জন্য আমরা কখনো কখনো পাণ্ডুলিপি হারাই; যেসব লেখক রাতারাতি বই তৈরি চান, তাদের আমাদের হতাশ করতে হয়। তবে আমরা প্রতি ক্ষেত্রে আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে— লেখক কিংবা সম্পাদক— যারাই আমাদের সঙ্গে ধৈর্য নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরা আমাদের কাজকে মূল্যায়ন করেছেন, এবং এই প্রক্রিয়াটির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জেগেছে। এটা আমাদের ভাগ্য যে, আমাদের মত বুদ্ধিজীবিতাবিমুখ দেশেও এমন লেখক ও সম্পাদকদের সঙ্গে আমরা কাজ করতে পারছি।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো— সেই ধরণের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকার রাখতে পারে?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: আবারও গভীর ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে বলব যে— এই সংকটের শিকার আসলে প্রকাশনা শিল্পও। এই সংকট উত্তরণে, ওই যে বললাম— ইকোসিস্টেমের অন্য খেলোয়াড়দেরকেও সচল, সৎ ও দূরদর্শী হতে হবে। এই স্বপ্ন ক্রমেই সুদূর পরাহত হচ্ছে।

বিডিনিউজ: একটা বিষয় নিয়ে বাড়তি কথা বলতেই হয়, তা হচ্ছে প্রকাশকের নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। মৌলবাদের বিরুদ্ধে বা বিজ্ঞান নিয়ে লেখার কারণে লেখক শারীরিক আক্রমণ সম্ভবত ২০০৪ সালে হুমায়ূন আজাদ স্যারকে দিয়ে দেশে শুরু হয়েছে। পরে বই প্রকাশের কারণে জাগৃতি'র ফয়সল আরেফিন দীপনকে মরতে হয়েছে, শুদ্ধস্বর'র আহমেদুর রশিদ টুটুল আক্রান্ত হয়েছে। এখন দেশে লেখা ও বই প্রকাশেও সেন্সর আনা হয়েছে। এগুলো দেশের প্রকাশনায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে? প্রকাশকরা এখনো ঝুঁকির মধ্যের আছেন, আপনি কি মনে করেন?

মাহরুখ মহিউদ্দীন: এই প্রসঙ্গে আলাপ অনেক হয়েছে। ফয়সল আরেফিন দীপন নিহত হওয়ার পর বিবিসি আমার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, সেখানে আমি আমার বক্তব্য স্পষ্টভাবে বলেছি। বরং আজকের আলোচনার প্রসঙ্গ হওয়া উচিত— ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। আমি জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদে নির্বাচিত হয়ে সেমিনার পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হই, এবং আমার প্রথম সেমিনারের প্রস্তাব ছিল— এই আইন কিভাবে আমাদের প্রকাশনার স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা। প্রকাশক সহকর্মীদের মাঝে এই প্রসঙ্গে আলোচনায় অনাগ্রহ লক্ষ্য করলাম, এবং আমাকে জানানো হল যে, সরকারি পর্যায় থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে এই আইনের কারণে লেখক বা প্রকাশকগোষ্ঠী কোনভাবে বিপদ্গ্রস্ত হবে না।
সাংবাদিকগণ, কার্টুনিস্ট বা সামাজিক মাধ্যমে যারা সক্রিয় তাদের মধ্যে অনেককে এই আইনের অন্যায্য শিকার হতে হয়েছেন। লেখক বা প্রকাশকদেরকেও যে সর্বক্ষণ সতর্ক হয়ে সত্যবচনে আত্মসম্বরণ করতে হয়, সেটিকে আমাদের সামাজিক আত্মার একটা নীরব রক্তক্ষরণ ছাড়া আর কী বলবেন? এই ধরণের দমনমূলক চর্চার দীর্ঘমেয়াদী ফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা আমাদের নেতৃস্থানীয় লেখক, বুদ্ধিজীবী, প্রকাশকরা কতটা উপলব্ধি করেন সেটা ভাবতে ধাঁধাঁ লাগে।

বিডিনিউজ: আশঙ্কা কাটিয়ে এখন পর্যন্ত মধ্য মার্চে গ্রন্থমেলার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ইউপিএল এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: আমরা গতবছর কোভিডকালেও প্রকাশকাজ বন্ধ রাখিনি। যদিও স্বাভাবিকের চেয়ে গতি শ্লথ ছিল। মেলায় এবার আমাদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণাগ্রন্থ আসবে। এছাড়াও মুজিববর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে কেন্দ্র করে আরও কিছু বই প্রকাশিত হবে।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: আমাদের সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' সহ বঙ্গবন্ধুর উপর রচিত খুব গুরুত্ববহ কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ বিভিন্ন সময়ে ইউপিএল থেকে প্রকাশিত হয়েছে। নতুন অনেক বই রচিত ও প্রকাশিত হচ্ছে নানান পরিসরে, এবং অনেক নতুন তথ্য ও গবেষণাও হচ্ছে এই বিষয়ে। এই উপলক্ষে আমাদের প্রকাশনাগুলোও সঙ্গত কারণেই পরিমিত ও যত্নের সঙ্গে নির্বাচিত। আমরা মনে করি, এভাবেই বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকারভাবে উদযাপন করা যায়।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে লেখকের হয়তো সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: ইউপিএল-এর প্রকাশনার আঙ্গিক ও ব্যাবসা কৌশল যেহেতু জনপ্রিয় সাহিত্যকেন্দ্রিক নয়, বরং গবেষণাকেন্দ্রিক, তাই আমাদের পাণ্ডুলিপি আরোহণের প্রক্রিয়াটিও ভিন্ন। তবে তরুণ গবেষক এবং মৌলিক গবেষণাকে আমরা সবসময় অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন? বলা ভাল, প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
মাহরুখ মহিউদ্দীন: এই নিয়ে এক সপ্তাহের একটি লাগাতার আলাপ হতে পারে। আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে থাকতে হবে আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি থেকে শুরু করে কাগজের দামের রাজনীতি পর্যন্ত সকল প্রসঙ্গ। আলোচনা সিরিজের নাম হতে পারে 'প্রকাশনা শিল্পের বিকাশে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ইকোসিস্টেমের ভূমিকা'। বিডিনিউজ২৪ ডটকম-কে আহ্বান জানাচ্ছি এমন একটি আলাপের আয়োজন করতে।
বিডিনিউজ: ধন্যবাদ আপনাকে, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
মাহরুখ মহিউদ্দীন: ধন্যবাদ, আপনাকেও।


…………………….
ওসমান গনি, প্রকাশক, আগামী প্রকাশনী
…………………….

বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
ওসমান গনি: গত বছর অমর একুশের বইমেলা নানা কারণে সফল হয়নি। মেলার পর পরই করোনা মহামারি সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। এই মহামারির কারণে বাংলাদেশের সকল সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রকাশনা সেক্টর। কারণ বই নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা পূরণের পর মানুষ সৃজনশীল বই পড়েন, সংগ্রহ করেন জ্ঞান অর্জনের জন্য, মেধা বিকাশের জন্য। অথচ বিভিন্ন সেক্টর সরকারি প্রণোদনা পেলেও প্রকাশনা সেক্টর কোনো প্রণোদনা পায়নি।

বিডিনিউজ: করোনার শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে প্রতিশ্রুতি করতে দেখেছি— যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারেন নি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে বিস্তর পড়বেন। অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ই সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কি?
ওসমান গনি: অনলাইনে বই বিক্রি অনেক আগেই চালু হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে বিক্রি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি মনে করি, অনলাইনে বই বিক্রি আরো জন্যপ্রিয় হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। আগে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বুকপোস্টে কম খরচে বই পাঠানো যেত। আমি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি একমত হয়ে প্রথাটি চালু করলে অনলাইন ব্যবসায়ীরা কম খরচে বই পাঠাতে পারবেন। যেহেতু আমরা সারাদেশে বই বিক্রির নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারিনি, তাই অনলাইনে বিক্রির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে এবং আরো গুরুত্ব দিতে হবে।

বিডিনিউজ: কাঁটাবন এলাকাসহ ঢাকার নানান স্থানে বইয়ের কয়েকটি আউটলেট উঠে গেছে। এটা কি শুধুই করোনার কারণ বলবেন, না কি সারা বছর মানুষের যে পাঠ স্বল্পতা, তারই ঘনিভূত প্রভাব বলবেন? কারণ এতদিনের ব্যবসা সাময়িক দুর্য়োগেও কি দাঁড়িয়ে থাকার কোনো সঞ্চয় দেয়নি— এই প্রশ্ন সামনেই আসে।
ওসমান গনি: ঠিকই বলেছেন, শুধু করোনাকালীন কেন, আগেও এমন আউটলেট বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে সরকারি সহযোগিতা দরকার। সরকারি উদ্যোগে ঢাকা শহরসহ সারা দেশে মার্কেট তৈরি করা হয়। কিন্তু কোন বইয়ের মার্কেট তৈরি করা হয়নি। যদি এখনও সারা দেশের বড় বড় শহরে বইয়ের মার্কেট তৈরি করা হয় তাহলে এই সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে আগামী প্রকাশনী কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
ওসমান গনি: সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বলছেন কেন! আমরা সাধারণ মানুষের কাছে বইয়ের খবর পৌঁছাতে পারিনি, একথা বলা যায়। আমরা চেষ্টা করছি, বইয়ের তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। সেই ক্ষেত্রে ফেসবুক-ইউটিউবের সহায়তা আমরা নিচ্ছি। তবে এককভাবে নয়, সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে আরো সফলতা অর্জন করা সম্ভব।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা ওঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? বড় প্রকাশনী হিসেবে আপনার সুযোগ আছে সেই উদারহণ তৈরি করা। আপনার প্রকাশনী এসব কতটা মেনে চলছে?
ওসমান গনি: আগামী প্রকাশনী বই প্রকাশ সংক্রান্ত সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলার পক্ষে। বইয়ের স্বত্ব লেখকের। লেখক যখন তার পাণ্ডুলিপি প্রকাশককে প্রকাশ করতে দেবেন তখন চুক্তি করেই দেওয়া উচিত নয় কি? এ বিষয়ে লেখককে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। কারণ সম্পদের মালিক তিনি।

বিডিনিউজ: লেখকস্বত্ব নিয়ে লেখকদের ক্ষোভ বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। বিষয়টা অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। খোদ আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানসহ সাম্প্রতিক অনেক লেখককে দেখেছি এ নিয়ে সভা-সংবাদ সম্মেলন করতে। পত্র-পত্রিকা বিভিন্ন সময় লেখা বা টিভি চ্যানেলে আলোচনা হয়েছে। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, কোনো কোনো লেখক মনে করেন, লেখকদের সাথে প্রকাশকদের চুক্তি ও রয়্যালটি প্রদানের তথ্য যে-সব প্রকাশনীর নেই, সেসব বই বা প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা। আপনি কি তাদের এই দাবীর সঙ্গে একমত? আপনার পরামর্শে এর সমাধান কী হতে পারে?
ওসমান গনি: অনেক সমস্যা তৈরি হয় লেখকের অসচেতনতার জন্য। লেখক সচেতন হয়ে চুক্তি করলে এই অবস্থার সৃষ্টি হবে না। চুক্তির দায় শুধু প্রকাশনীর থাকবে কেন? আর চুক্তির জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে বইমেলায় স্টল বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনায় আসতেই পারে না।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। আগামী প্রকাশনী এটা কিভাবে করছে?
ওসমান গনি: আগামী প্রকাশনীর একাধিক সম্পাদক রয়েছে। বইকে মানসম্মত করার জন্য সম্পাদনার বিকল্প নেই। লেখকের এ বিষয়ে আক্ষেপ দেখি না তো। লেখকের দৃষ্টিতে যে-সব প্রতিষ্ঠান এই কাজ করে না, তাদেরকে পাণ্ডুলিপি দেওয়া থেকে বিরত থাকা দরকার নয় কি?

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
ওসমান গনি: আমি প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত প্রায় চার দশক। দেখেছি, লেখার মান ভালো না হলে কৌশল করে বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া যায় না।

বিডিনিউজ: আগামী প্রকাশনী ইতিমধ্যে দুই হাজারের উপর গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। আগামী প্রকাশনী শুরু থেকে মননশীল ও মান সম্মত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি বলে আসছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
ওসমান গনি: আগামী প্রকাশনীর প্রকাশনা সংখ্যা আড়াই হাজার অতিক্রম করেছে। আমি প্রকাশনার সঙ্গে ১৯৭৮ সাল থেকে যুক্ত থাকলেও আগামীর যাত্রা শুরু ১৯৮৬ সাল থেকে। এই ৩৫ বছর ২,৫০০ বই খুব বেশি নয়। বইয়ের মান রক্ষা করার জন্য আমাদের রয়েছে সুদক্ষ কর্মীবাহিনী, নিজস্ব প্রেস এবং বাঁধাই ব্যবস্থা।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো— সেই ধরণের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকার রাখতে পারে?
ওসমান গনি: প্রকাশনার দুটো ধারা— জনপ্রিয় এবং মননশীল। আমরা কিন্তু মননশীল ধারার প্রকাশক এবং আমরা এমন কিছু বই প্রকাশ করেছি যা অন্য কোনো প্রকাশকের পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। আর যদি ভিন্নভাবে বলি, প্রকাশনা একটি সৃজনশীল কর্মের পাশাপাশি এটি ব্যাবসাও। যদি অধিকাংশ প্রকাশক ব্যবসা হিসেবে নিতো তাহলে বাংলাদেশের প্রকাশনার যে উন্নতি হয়েছে, তা হতো না। আর বিজ্ঞানসহ গবেষণাধর্মী প্রচুর বই প্রকাশিত হয়, যা আগে চিন্তা করা যেত না।

বিডিনিউজ: আগামী প্রকাশনী'র সঙ্গে কথা বলতে গেলে একটা বিষয় নিয়ে বাড়তি কথা বলতেই হয়, তা হচ্ছে প্রকাশকের নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। মৌলবাদ বিরুদ্ধে বা বিজ্ঞান নিয়ে লেখার কারণে লেখক শারীরিক আক্রমন সম্ভবত ২০০৪ সালে হুমায়ূন আজাদ স্যারকে দিয়ে দেশে শুরু হয়েছে। পরে বই প্রকাশের কারণে জাগৃতি'র ফয়সল আরেফিন দীপনকে মরতে হয়েছে, শুদ্ধস্বর'র আহমেদুর রশিদ টুটুল আক্রান্ত হয়েছে। দেশে লেখা ও বই প্রকাশেও সেন্সর আনা হয়েছেছে। এগুলো দেশের প্রকাশনায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে? আপনি হুমায়ূন আজাদের সবচেয়ে বেশি বইয়ের প্রকাশক। প্রকাশকরা এখনো ঝুঁকির মধ্যের আছেন, আপনি কি মনে করেন?
ওসমান গনি: মৌলবাদ আজও ঘাপটি মেরে আছে। যখন সুযোগ পায় তখনই তারা আক্রমণ করে। এ ধরনের বই প্রকাশে ঝুঁকিতো রয়েছেই। একটি উদাহরণ দেই, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, মৌলবাদীরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙছে, ভাবতে পারেন? তাদের কঠিন হস্তে দমন করা না গেলে দেশ পিছিয়ে পড়বে।

বিডিনিউজ: আগামী প্রকাশনী এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
ওসমান গনি: আগামী প্রকাশনী এ বছর ১০০-এর অধিক বই প্রকাশ করছে। বইয়ের নাম না বলে শুধু লেখকের নাম বলি। শেখ হাসিনা, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামান, হুমায়ুন আজাদ, বেলাল চৌধুরী, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসনাত আবদুল হাই, আবদুল মান্নান, পান্না কায়সার, আনোয়ারা সৈয়দ হক, অসীম সাহা, ড. মেজবাহ কামাল, ড. মোহাম্মদ হাননান, ড. এম. আবদুল আলীম, আসাদ মান্নান, ড. মোহাম্মদ আমীন, সাজ্জাদুল হাসান, শিকদার আনোয়ার, আবদুল মান্নান চৌধুরী, ড. আনু মাহমুদ, ড. মুকিদ চৌধুরী, মঞ্জু সরকার, ইসতিয়াক আলম, সৈয়দ জাহিদ হাসান, পিয়াস মজিদ প্রমুখ।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
ওসমান গনি: 'মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তচেতনা, দুয়ের প্রত্যয়ে আমাদের প্রকাশনা' এই অঙ্গীকার নিয়ে আগামী প্রকাশনী যাত্রা করে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৪০০-এর অধিক বই প্রকাশ করেছে। এবারও অনেক বই প্রকাশিত হবে। লেখকের তালিকা দেখলেই অনুমান করা যাবে।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে লেখকের হয়তো সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
ওসমান গনি: একটি কথা বলতেই হয়, আগামী প্রকাশনী অনেক লেখকের প্রথম বই প্রকাশ করেছে। এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ বছরও কমপক্ষে পাঁচজন নতুন লেখকের বই প্রকাশিত হবে। অনেক পাণ্ডুলিপি যেমন আমাদের কাছে আসে, আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি দেখেও আমরা অনেক বই প্রকাশ করেছি।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
ওসমান গনি: একটি বিষয়ই শুধু বলছি, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশনার বিষয়টি দেখভাল করে। এই মন্ত্রণালয়ের বাজেট সবচেয়ে কম। বই কেনার বাজেট এতই কম, শুনলে মানুষ হাসবে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আড়াই কোটি, পাবলিক লাইব্রেরি আড়াই কোটি। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বই কেনার বাজেট প্রায় একশত কোটি।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
ওসমান গনি: প্রকাশনা শিল্পের বিকাশে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে গতিশীল করতে হবে। পাড়া পাড়ায় পাঠাগার গড়ে তুলতে হবে। দেশের সাহিত্যকে বিদেশে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি অনুবাদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রত্যেক স্কুলের পাঠাগারকে কার্যকর করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে ঢাকাসহ কমপক্ষে প্রত্যেক জেলা শহরে বইয়ের মার্কেট করার উদ্যোগ নিতে হবে। বই কেনার বাজেট ১০০ কোটি টাকা করতে হবে। সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য একটি রিডিং সোসাইটি গঠনের বিকল্প নেই।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, ওসমান গনি ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
ওসমান গনি: ধন্যবাদ আপনাকে এবং বিডিনিউজ কর্তৃপক্ষকে। আপনাদের সহযোগিতায় প্রকাশনা শিল্প আরো এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা করছি।


…………………….
রাজিয়া রহমান জলি, প্রকাশক, জাগৃতি প্রকাশনী
…………………….

বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
রাজিয়া রহমান জলি: করোনার প্রভাব গতবছরের বইমেলার ওপরই পড়েছিল। চীন থেকে আসা কাঁচামালের সংকট তৈরি হয়ে ছিল ছাপাখানায়। মেলায় বই বেচা বিক্রীর হিসাবটাও অন্যান্য বারের তুলনায় ছিল কম। বইমেলা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই লকডাউনে যেতে হয়েছে। অনেক ধরনের হিসাব-নিকাশ অসম্পূর্ণ রেখেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠিানগুলি সাময়িকভাবে বন্ধ কর দিতে হয়েছে। কর্মচারীদের বেতন, কার্যস্থলের ভাড়া ও অন্যান্য খরচ সামলাতে পুস্তক ব্যবসায়িরা বিপদে পড়েছেন। বই যেহেতু কোনো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নয়, তাই করোনাকালীন লকডাউনের সময়টাতে বইয়ের বিপনন আশঙ্কাজনক হারে কমে গিয়ে ছিল। লকডাউন তুলে দেয়ার পর অনলাইনে বই বিক্রির বিষয়টি কিছুটা গতি পেলেও সার্বিক পরিস্থিতি পুস্তক ব্যবসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সীমিত হয়েছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে জাগৃতি প্রকাশনী কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
রাজিয়া রহমান জলি: জাগৃতি প্রকাশনী কোনো বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে অপারগ হয়েছে। কর্মচারীদের মূল অংশ ঢাকায় টিকতে না পেরে গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় সব কার্যক্রম বন্ধ ছিল জাগৃতির। স্বল্প পরিসরে আমরা কাজ শুরু করি আগস্টে এবং সেপ্টেম্বর মাস থেকে নতুন বইয়ের প্রকাশনা শুরু হয়। বিপনন ক্ষেত্রে অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। নতুন বছরে পাবলিক লাইব্রেরি ও মুক্তযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কিছু অর্ডার আমাদের কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। তাছাড়া বইমেলা হবে ঘোষণা পাওয়া পর থেকে লেখকরাও পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছেন। ক্ষতিপূরণ সম্ভব না হলেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সাথে অনেকগুলো মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা ওঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনী এসব কতটা মেনে চলছে?
রাজিয়া রহমান জলি: (তিনি এই বিষয়ে উত্তর দেননি। তাই প্রশ্নটি উহ্য রাখার জন্য বলেছেন।)

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এনিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। জাগৃতি প্রকাশনী এটা কিভাবে করছে?
রাজিয়া রহমান জলি: গত দশ বা বিশ বছরে বই প্রকাশের সংখ্যা বিপুল হারে বেড়েছে। অর্থাৎ প্রচুর মানুষ লেখালেখির দিকে ঝুঁকেছেন। বিভিন্ন পেশার মানুষ আজকাল বই প্রকাশে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এটা একদিকে যেমন সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়েছে, অন্যদিকে মানহীন লেখার প্রচারের একটা ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিকই আছে। ভাল লেখক তৈরির প্লাটফর্ম পাওয়া গিয়েছে। খারাপ মানের লেখা এমনিতেও টিকে থাকে না। প্রকাশনার মান উন্নত রাখতে সম্পাদনা পরিষদ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বহিঃবিশ্বে দেখেছি সম্পাদনার জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, প্রকাশকবৃন্দ তাদের ওপর পুরোমাত্রায় নির্ভরশীল। আমাদের দেশে ব্যাপারটি বহুল প্রচলিত হয়নি এখনো, তবে প্রকাশনা সংস্থাগুলি স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গ দিয়েই সম্পাদনার কাজটি সম্পন্ন করেন। সম্পাদনা ছাড়া যে বইগুলি প্রকাশিত হয় সেগুলি বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করলেও ওটা সঠিক নয় বলে মনে করি। জাগৃতি প্রকাশনী সম্পাদনার ব্যাপারটিতে যথেষ্ট মনোযোগী। বিশেষ করে গত দুই বছরে সম্পাদনার কাজটি জোরদার করা হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা কমিয়ে বরং গুণগত মান উত্তরণের চেষ্টা করছি।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
রাজিয়া রহমান জলি: আসলে বহু বছরের প্রচলিত অভ্যাসেই আমরা ফেব্রুয়ারি বইমেলা কেন্দ্রিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এটা এখন আমাদের স্বভাবজাত। সারা বছর বইয়ের পাণ্ডুলিপি জমা পড়ে না, পাঠকরা বই খুঁজেন না, কিংবা লেখক-পাঠক-প্রকাশক তিন গোষ্ঠিই বইমেলার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব কি না, জানি না। দেশের সর্বত্র বইয়ের ভাল দোকান খুব একটা দেখা যায় না, দেখা গেলেও বইয়ের বেচাকেনা ততটা উল্লেখযোগ্য নয়। বরং ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে কেন্দ্র করেই প্রেস-বাঁধাই সহ সবগুলি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দুই-তিন মাস চরম ব্যস্ত সময় কাটায়। সারা বছর এই ব্যস্ততা থাকে না বা বলা যায় বেশিরভাগ সংস্থাই ঝিমিয়ে থাকে। এই অভ্যাস প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য অবশ্যই অন্তরায়।

বিডিনিউজ: জাগৃতি প্রকাশনী ইতিমধ্যে দেড় হাজারের উপর গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
রাজিয়া রহমান জলি: জাগৃতি প্রায় ২ হাজার গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। ১৯৯২ সালে জাগৃতি 'র যাত্রা শুরু। তখন থেকেই মানসম্পন্ন বই প্রকাশের জন্য প্রতিষ্ঠানটি সুনাম অর্জন করেছে। জনপ্রিয় লেখকদের পাশাপাশি নতুন, তরুণ লেখকদের ভাল মানের লেখা পেলে জাগৃতি তা প্রকাশ করতে এগিয়ে আসে।

বিডিনিউজ: জাগৃতি'র সঙ্গে কথা বলতে গেলে একটা বিষয় নিয়ে বাড়তি কথা বলতেই হয়, তা হচ্ছে প্রকাশকের নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। বই প্রকাশের কারণে ফয়সল আরেফিন দীপনকে মরতে হয়েছে, শুদ্ধস্বর এর আহমেদুর রশিদ টুটুল আক্রান্ত হয়েছে। এগুলো দেশের প্রকাশনায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে? আর প্রকাশকরা এখনো ঝুঁকির মধ্যের আছেন, আপনি কি মনে করেন?
রাজিয়া রহমান জলি: বই প্রকাশের দায়ে জীবন দিতে হলে সেটা সত্যিই দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক প্রকাশক সংস্থা (IPA— International Publishers Association) যে আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে, তা হল— Publishing Should not be matter of life and death.
ফয়সল আরেফিন দীপনের আত্মত্যাগ IPA শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। ২০১৮ সালে IPA-র ৩২তম কংগ্রেসে ফয়সল আরেফিন দীপনকে মরণোত্তর Prix Voltair Award for Freedom of Speech প্রদান করা হয়। এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক বইমেলায় দীপন হত্যার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন বছর। ২০২০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জাগৃতি প্রকাশনী কে Freedom to Publish বিভাগে সম্মানজনক Jerry Laber Award এর জন্য মনোনীত করে ঘোষণা দেয় AAP (Association of American Publishers)। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অঙ্গণে প্রকাশকের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে দীপন হত্যার পর।
আমাদের দেশে এখনো স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অনুকূল পরিবেশ নাই। যুক্তিসঙ্গত কারণেই একজন প্রকাশক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদ বিষয়ে জিরো টলারেন্স ধারণ করেন এবং দীপন হত্যার বিচারকার্য সম্পাদনে আন্তরিক ভূমিকা নিয়েছেন। ১০ ফেব্রুয়ারি নিম্ন আদালতে দীপন হত্যার সন্তোষজনক রায় ঘোষিত হয়েছে। আপিল বিভাগ ও উচ্চ আদালতে একই রায় যেন বহাল থাকে এবং এটা যেন দ্রুত কার্যকর হয়, আমরা সেই কামনা করি। প্রকাশকদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসবে। তবে তাঁরা যে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হবেন এ কথা বলা যাবে না।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায় মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো— সেই ধরণের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ হয়েছে। তো, এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকার রাখতে পারে?
রাজিয়া রহমান জলি: এখানে প্রকাশকের চাইতে সরকারে ভূমিকা বেশি। দিনশেষে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একটি বাণিজ্যিক সংস্থা। সৃজনশীল বই, জনপ্রিয় বই প্রকাশ করে আর্থিকবাবে লাভবান হওয়াটাই মূখ্য উদ্দেশ্য। মননশীল প্রকাশনার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ রে জনসচেনতা তৈরি, বইয়ের বহুল প্রচার এবং প্রাপ্যতা নিশ্চিত রতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানেরই এগিয়ে আসা উচিত। অপেক্ষাকৃত সক্ষম প্রকাশকেরা নিজ উদ্যোগে বিজ্ঞাপন বিষয়ক এবং একাডেমিক বই করে থাকেন বা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাদেরকেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করতে পারে।

বিডিনিউজ: জাগৃতি প্রকাশন এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
রাজিয়া রহমান জলি: অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও জাগৃতি নানা বিষয়ের ওপর বই প্রকাশ করছে। ৩টি প্রবন্ধ, ১টি উপন্যাস, ১টি কবিতা ও ১টি গল্প সংকলন অলরেডি চলে এসেছে। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে ভ্রমণ, মিথোলজী, স্বাস্থ্য ও রান্না বিষয়ক, কিশোর অ্যাডভেঞ্চার, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, রম্য এবং গল্প কবিতার বই। সব মিলিয়ে গোটা তিরিশ হবে।

বিডিনিউজ: বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
রাজিয়া রহমান জলি: অনেক প্রকাশনীই তরুণ লেখকদের উৎসাহ দেয়ার জন্য পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন, এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দীপন তরুণ লেখকদের একটু মজবুত প্ল্যাটফর্ম দিতেন। কারো লেখা পছন্দ হলে নিজে যোগাযোগ করে বই ছাপাতেন। সেইসব লেখকদের অনেকেই আজ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। দীপনের প্রয়াণের পর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নেয়া আমরা মতো অন্য পেশার একজন মানুসের পক্ষে দূরূহ। নিজের একটা ফুলটাইম জব সামলে জাগৃতি 'র জন্য সবরকম আয়োজন করাও কষ্টসাধ্য। ২০১৮তে পেন্সিল-জাগৃতি যৌথভাবে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৯ জনের বই জাগৃতি থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ হয়েছিল। ভালমানের পাণ্ডুলিপি পেলে প্রতিবছরই জাগৃতি তরুণ লেখকদের ১ম বই প্রকাশ করে। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদের সংকলনটি আমরা করছি।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
রাজিয়া রহমান জলি: অবশ্যই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। যতটা আছে সেটা অপ্রতুল। প্রকাশকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব শিল্পটিকে অনেকাংশে পঙ্গু করে রেখেছে। প্রকাশনার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো মনিটরিং কমিটি নাই। সামগ্রিকভাবে তরুণ প্রজন্মের বই বিমুখতা এই শিল্প প্রসারের সবচেয়ে বড় বাঁধা।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
রাজিয়া রহমান জলি: পয়েন্ট করে বলা যায়—
• প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হওয়ার জন্য নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বেঁধে দেয়া উচিত।
• মান নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা যেতে পারে। তাহলে শুধু বইমেলাকেন্দ্রিক ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলির দৌরাত্ম কমবে।
• প্রকাশক সমিতিকে আরো স্বাধীন ও শক্তিশালী হতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল বিচার করলে অন্যান্য দেশে প্রকাশকদের সংস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেকবেশি গুরুত্ব বহন করে। বইমেলা আয়োজনের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা কমাতে।
• বই এর বিপনন সহজ ও সুন্দর করা প্রয়োজন। শহরে-গ্রামে কোথাও ১টা সুন্দর বইয়ের দোকান চোখে পড়ে না। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরির চল'টাও উঠে গেছে। এই জায়গাতে কাজ করার বিশাল ক্ষেত্র আছে। বই প্রেমিক উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে শহরজুড়ে বুক ক্যাফে অথবা পরিপূর্ণ বইয়ের দোকান তৈরি করা সম্ভব। বইকে জনপ্রিয় করার পেছনে মিডিয়াও ভূমিকা রয়েছে। মিডিয়াকেও মনযোগী হতে হবে। শুরু ফেব্রুয়ারিতে বই নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার না করে সারা বছরই বই নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
• স্কুল লাইব্রেরিগুলি সমৃদ্ধ হলে শিশুকাল থেকেই পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে। তাই সরকারি প্রণোদনায় প্রতিটি জেলার স্কুল লাইব্রেরিতে বিপুল সংখ্যক ভাল মানের বেই কেনা উচিত। তাতে যেমন প্রকাশক সরাসরি উপকৃত হবেন, তেমনি পরোক্ষভাবে একটি বইমুখী প্রজন্ম তৈরি হবে। যা প্রকাশনা শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখবে।

বিডিনিউজ: শেষ প্রশ্ন একটু স্মৃতি টেনে করতে চাই। দীপন নিহত হওয়ার পর পর, সম্ভবত পাঁচ বছর আগে, বইমেলায় এক সাক্ষাৎকারে আপনি আমাকে বলে ছিলেন— সব প্রতিকূলতার মধ্যেও দীপন স্মরণ করা যেতো। তারপর এই কয়েক বছরে বইমেলা কি কোনোভাবে তাকে স্মরণ করেছে? আপনি তেমন কিছু প্রত্যাশা করেন?
রাজিয়া রহমান জলি: পাঁচ বছর আগে দীপন হত্যার ঠিক তিন মাস পর ২০১৬তে বইমেলা করতে যেয়ে আমি বিপন্ন বোধ করেছি। সেটাই হয়তো আপনার স্মৃতিতে আছে। মেলার মাঠজুড়ে কোথাও দীপনকে স্মরণ করা হয়নি। শুধু জাগৃতি প্রকাশনী দীপনের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সবার মধ্যে অহেতুক ভয় বিরাজ করতো। এমনকি দীপনের ঢাকা কলেজের বন্ধুরা মেলার মাঝামাঝি সময়ে দীপনের ছবি সম্বলিত ব্যানার লাগাতে রাজি হন নি। পরের বছর, ২০১৭ সালে, আমি নিজ উদ্যোগে জাগৃতি স্টলের পেছনে 'দীপন কর্নার' নাম দিয়ে একটা গোছানো আড্ডাস্থল তৈরি করেছিলাম। ২০১৮তেও পেরেছি। কিন্তু তারপর সেরকম সুবিধাজনক জায়গায় স্টল পড়ে নাই বলে পারি নাই। এই উদ্যোগটা প্রকাশক সমিতি থেকে নেয়া যেত। দীপন স্মরণে কোনো স্মারক পুরস্কার প্রচলন করা যেতে যারে, যা প্রতিবছর উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতিশীল কোনো প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়ে দীপনের নামকে অমর করা যেত— দীপনকে সম্মানিত করা যেত।


…………………….
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু, হেড-অব-অপারেশানস, বিপিএল
…………………….

বিডিনিউজ: করোনার প্রভাব পুস্তক ব্যবসার উপর কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্যতম পুস্তক ব্যবসা। অন্ততঃ বাংলাদেশে। বই বিকিকিনি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের জীবিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিডিনিউজ: বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে বিপিএল কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: গত বইমেলার পরপর মার্চের দিকে যখন ঘরে থাকার নির্দেশ এলো তখনো আমরা নতুন প্রকাশিত বইগুলোর বিপণন করে উঠতে পারিনি। আমাদের প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের নিরাপত্তার তাগিদে বাসা থেকে কাজ করার নির্দেশনা এলো। তারপর তো কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে লাগলো। দোকান বন্ধ থাকায় বিক্রেতারা বই বিক্রি করতে পারেননি এবং নতুন অর্ডারও তারা নেয়া বন্ধ করে রাখলেন। ফলে শুধুমাত্র আমাদের অনলাইন bpl.bdnews24.com এর উপরই নির্ভর করতে হলো।

আমরা অনেক আগে থেকেই অনলাইনে বই বিক্রি করে আসছি। সারাদেশে আমরা অর্ডার করা বই সরবরাহ করি। এখন কোভিড-১৯ পরিস্থিতির উন্নতির পর দোকান-পাট খোলা শুরু হলে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও আশাব্যঞ্জক কিছু নয়। এতদিন বাংলাবাজারে আমাদের কোনো পরিবেশক ছিল না। এখন উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পেরেছি।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে যেসব নীতিমালা, যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা— এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? আপনার প্রকাশনী কি এসব মেনে চলছে?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: বই প্রকাশের নীতিমালা আমরা মেনে চলি। বিদেশী লেখকদের বই অনুবাদের ক্ষেত্রে লেখক কিংবা বিদেশী প্রকাশকের সাথে অনুমতির চর্চাটা এদেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গুলোর জন্য নতুন ভাবনা। অনুমতি পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় সেটা এক অর্থে পাঠককেই তো দিতে হয়, বাংলাদেশের সাধারণ পাঠক এখনো সেভাবে প্রস্তুত নয় বলেই আমার মনে হয়। ফলে সেসব বইই বেশি অনুবাদ হবে যেগুলোর বয়স কপিরাইট মুক্ত।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। বিপিএল এটা কিভাবে করছে?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বিপিএল খুব কঠোর অবস্থানে। নিজস্ব সম্পাদনা পরিষদের বাইরেও আমরা সম্পাদনার কাজ করে এরকম প্রতিষ্ঠানের সার্ভিসও কখনো কখনো নেই। এটা বইয়ের কন্টেন্টের উপর নির্ভর করে।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: বাধা অনেক আছে। দুয়েকটার কথা বলছি। বই ছাপার কাগজ একটা বড় সমস্যা। বইয়ের জন্য পৃথক বিশেষ ধরণের কাগজের প্রয়োজন আছে। যেটা ওজনে হালকা হবে আবার ছাপাটাও ভাল হবে, দামেও সুলভ হবে। দেশে তৈরি সেরকম কাগজ থাকা দরকার।
এদেশে ভাল কাগজ মানে আমদানী করা কাগজ। আমদানী করা কাগজ মানেই ব্যয়বহুল কাগজ। র ম্যাটেরিয়াল ব্যয়বহুল হলে উৎপাদিত পণ্য তো আরো ব্যয়বহুল হয়ে যায়। দেশেই ভালমানের কাগজের উৎপাদন হওয়া দরকার।
পাঠক দোকানে বই কিনতে গেলে ধরেই নেন তিনি ১৫% থেকে ২০% ডিসকাউন্ট পাবেনই। এটা বইয়ের গায়ের দাম বাড়িয়ে দেয়। পাঠক নিজের অজান্তেই নিজের উপর চাপ তৈরি করছেন, যেটা প্রকাশকের উপরেও চাপ তৈরি করে। তাই এ বিষয়ে পাঠকের মাইন্ড সেটেরও পরিবর্তন দরকার। আর গবেষণামূলক কিংবা প্রবন্ধের বই বিপণনের ক্ষেত্রে পরিবেশকরা তেমন আগ্রহী হন না। এটাও এক ধরণের বাধা।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে আছে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: প্রকাশনী ছোট নাকি বড় সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো কি বই প্রকাশ করছে। আর নতুন কৌশল আসুক, এতে ক্ষতির কিছু নেই। পাঠককে ঠকানো না হলেই হয়। ছোট হোক বড় হোক একুশের বইমেলার বিক্রির উপর সবাইকেই নির্ভর করতে হয়। পাঠকদের বড় একটা অংশ মানসিকভাবে নিজেকে বইমেলার জন্য গুছিয়ে রাখেন।

বিডিনিউজ: বিপিএল ইতিমধ্যে ৬০টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: আমরা মনে করি, বই একবার পড়ে ফেলে দেয়ার জিনিস না। সংগ্রহে রাখার কিংবা উপহার দেয়ারও জিনিস। তাই বইয়ের পাণ্ডুলিপি নির্বাচন ও বাছাইয়ে আমরা সচেতন। নির্ভুল থাকার বিষয়ে আমরা বেশি রকমের জোর দেই। আমাদের বইয়ের কাগজ নির্বাচনে রুচিশীলতার পরিচয় পাবেন। আমাদের বই হাতে নিলেই সেটা পাঠক বুঝতে পারেন। বইয়ে ব্যবহৃত ছবিটা যেন ঠিকমতো পরিস্ফুটিত হয় সেটাও আমরা নজরে রাখি। শিশুদের বই আমরা নতুন শুরু করেছি। কোনখানেই গুণগত মানের বিষয়ে আমরা ছাড় দিই না।

বিডিনিউজ: বিপিএল এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: গত বছরের তুলনায় এবছর আমাদের নতুন বইয়ের সংখ্যা কম হবে। কাজ চলছে।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর বই হচ্ছে। এটা খুব আশাব্যঞ্জক। আমরাও কাজ করছি। এ বছরই প্রকাশ করবো। বইয়ের নাম নির্বাচন এখনো হয়নি। আশা করি শিগগীরই নামগুলো জানাতে পারবো।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: নতুন লেখক সন্ধানমূলক বিশেষ কোনো কার্যক্রম আমাদের নেই। আর লেখক বয়সে তরুণ নাকি প্রবীন এটাও আমরা বিবেচ্য বলে মনে করি না। যে পাণ্ডুলিপিটি পাঠকের কাছে না পৌঁছালে পাঠক বঞ্চিত থেকে যাবেন বলে মনে হয় সেটিকেই আমরা গুরুত্ব দিই বেশি।

বিডিনিউজ: প্রকাশনাশিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু: জাতি গঠনে সৃজনশীল বইয়ের বিশাল ভূমিকা। সৃজনশীল বইয়ের জন্য সরকারের নীতিগত সহায়তা দরকার। সারাদেশের লাইব্রেরিগুলোতে নজর দেয়া দরকার। সরকারি বই কেনার ক্ষেত্রে বইয়ের কন্টেটের দিকে আরো নজর দেয়া দরকার।


…………………….
জামাল উদ্দিন, প্রকাশক, বলাকা প্রকাশন
…………………….

বিডিনিউজ: গতবছর গ্রন্থমেলার পরই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরু হয়। অর্থনীতি-জনজীবনে এই প্রভাব এখনো আছে। পুস্তক ব্যবসার উপর করোনার প্রভাব কিভাবে পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
জামাল উদ্দিন: বৈশ্বিক মহামারির কারণে অর্থনীতি-জনজীবনে কঠিন সংকটকাল অতিক্রম করছে বিশ্ব। জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক ব্যবসায় পূর্ব থেকেই মন্দা চলছিল, মহামারির কারণে সেটি আরো প্রকটরূপ ধারণ করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সৃজনশীলতার জায়গায় একধরণের স্থবিরতা বিরাজ করছে। ফলশ্রুতিতে পুস্তক ব্যবসা আজ হুমকির মুখে।

বিডিনিউজ: করোনা শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে প্রতিশ্রুতি দিতে দেখেছি যারা ব্যস্ততার কারণে বই পড়তে পারেননি, তারা লকডাউন বা হোম অফিসের সুযোগে বিস্তর পড়বেন। অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ই সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। দিনশেষে তারা কেমন বই পড়েছেন তা বোঝার বড় উপায় বই কেমন বিক্রি হলো। প্রকাশক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
জামাল উদ্দিন: অনলাইনে বই বিক্রি এই সময়ে সবচেয়ে বিস্তৃত হয়েছে— আপনার এই কথার সাথে ভিন্নমত পোষণ করছি। জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক অনলাইনে বিক্রিতে আমি বিশ্বাসী নই। আমাদের বইগুলো একটু পড়ে না দেখলে বিষয়বস্তু না-দেখে, না-বুঝ কেনার নয়। তবে এ কথা বলতে হয় যে, করোনাকালীন সময়ে পাঠকের বই কেনার উপায় ছিল অনলাইন মাধ্যম। এই মাধ্যমে প্রচুর বই বিক্রয় হয়েছে, যা এখনো চলমান।

বিডিনিউজ: আগে থেকেই বই বিপননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দূরত্ব ছিল। করোনা তাকে আরো কঠিন করেছে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে বলাকা প্রকাশন কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে?
জামাল উদ্দিন: জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তকের জগৎটা মননের জগৎ। এ জগতে বিপননই আর দশটা পণ্যের মতো নয়। বলাকা প্রকাশন সুদীর্ঘ সময় ধরে একটা মান বজায় রেখে জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশ করে আসছে। বইয়ের বিপনন, প্রচার আর পাঠকলগ্ন করার ব্যাপারে প্রকাশনার মান ধরে রাখাই আমাদের পদ্ধতি।

বিডিনিউজ: বইপ্রকাশের ব্যাপারে নীতিমালা নিয়ে প্রায়ই কথা ওঠে। লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়, মনোযোগী পাঠকের অতৃপ্তি থেকে যায়। যেমন লেখকের সঙ্গে চুক্তি করা, তাদেরকে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রিত বইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেয়া, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভ করা এসব কি আপনাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে অনুকূল? বড় প্রকাশনী হিসেবে আপনার সুযোগ আছে সেই উদারহণ তৈরি করা। আপনার প্রকাশনী এসব কতটা মেনে চলছে?
জামাল উদ্দিন: আমার প্রকাশনী শতভাগ মানার চেষ্টা করছে। লেখক-পাঠক-প্রকাশক এই তিনে মিলে একটা বন্ধন। লেখক অখুশি থাকলে যেমন ভালো লেখা আসবে না, তেমনি প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রকাশনা বন্ধ থাকবে। তাতে পাঠক তার আরাধ্য বই পাবে না। আমরা লেখকের সাথে সম্পর্কের সেতু বন্ধন করি। বলাকা'র আজকের অবস্থানে আসার পিছনে আমাদের স্বচ্ছতাই কাজ করছে বলে মনে করি।

বিডিনিউজ: লেখকস্বত্ব নিয়ে লেখকদের ক্ষোভ বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি। বিষয়টা অনেক সময় সভা, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, কোনো কোনো লেখক মনে করেন, লেখকদের সাথে প্রকাশকদের চুক্তি ও রয়্যালটি প্রদানের তথ্য যে-সব প্রকাশনীর নেই, সেসব বই বা প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা। আপনি কি তাদের এই দাবীর সঙ্গে একমত? আপনার পরামর্শে এর সমাধান কী হতে পারে?
জামাল উদ্দিন: আমি একটু ভিন্নভাবে উত্তর দিতে চাই। মানুষের মধ্যে দিন দিন পাঠ অভ্যাস কমছে। বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে। জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক এমনিতেই হুমকির সম্মুখীন। বিনিয়োগে এ অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। সবার ভাবতে হবে তরুণ প্রজন্মকে কিভাবে জ্ঞান ও মননের চর্চায় আনা যায়। তারা যদি জ্ঞান, মননের চর্চায় আসে তবে বিপনন সংকট কেটে যাবে। সংকট কাটলে প্রকাশনা টিকবে। প্রকাশনা টিকলে মান সম্মত লেখা ও লেখকের সম্মানী বিষয়ে কেউ না-করবে না।

বিডিনিউজ: বই মানসম্পন্ন করতে সম্পাদনার বিকল্প নেই। প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব একটা সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ে। এ নিয়ে প্রায়ই লেখকদের আক্ষেপ করতে দেখা যায়। বলাকা প্রকাশন এটা কিভাবে করছে?
জামাল উদ্দিন: অবশ্যই একটা বই সুচারুরুপে প্রকাশিত হওয়ার মূল শর্তই হলো সম্পাদনা। বলাকা প্রকাশনের সম্পাদনা পরিষদের একজন চিফ এডিটরের নেতৃত্বে এ কার্যক্রমটি দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে সম্পাদন করে।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে যে-বইমেলা হয়, তার উপর নির্ভর করে অনেক ছোট ছোট, স্বল্পস্থায়ী প্রকাশনী বিপননের নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবনে বিমুখ হয়ে থাকে। এটা কি প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য হুমকি নয়? আপনাদের মতো বড় বড় প্রকাশনীও এই মেলায় বিক্রি হওয়ার উপর খুব বেশি নির্ভর করেন?
জামাল উদ্দিন: মৌসুমী বা সিজনাল প্রকাশক অবশ্যই প্রকাশনা শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। সত্যিকার প্রকাশনা সংস্থা সারা বছর জুড়ে বই প্রকাশ করবে— এটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিত। তবুও অনেকেই বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন বা বাধ্য হন। মেলাকে কেন্দ্র করে বেশি বই বিক্রি আশা করা খারাপ কিছু নয় তবে বেশি বই প্রকাশ করা প্রকাশনা শিল্পের জন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক নয়।

বিডিনিউজ: বলাকা প্রকাশন চট্টগ্রামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। দেশের বড় শহর থেকেও ভাল প্রকাশনা হওয়া উচিত। বিপরীতে দেশের অনেক লেখক, বই বিপনন ব্যবস্থা ঢাকাকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে বলাকা প্রকাশন কে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। এগুলো কেমন? আপনারা কিভাবে তা সমাধান করেন? দেশের বড় শহর থেকেও কিভাবে ভাল প্রকাশনা চলতে পারে?
জামাল উদ্দিন: বই প্রকাশনা ঢাকা-কেন্দ্রিক হতে হবে— এমন কোনো কথা নেই। আমি চাই-দেশের বড় বড় শহরে শুধু নয়, সব শহরেই জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠুক। এমনকি বইমেলাও একযোগে দেশের সব বিভাগীয় শহর বা জেলা শহরে করা যায়। আগেও বলেছি-লেখক, পাঠক, প্রকাশক মেলবন্ধন ঘটাতে পারলে শহরতলীতেও প্রকাশনা সংস্থা চালানো সম্ভব। আমি আরো আশাবাদ ব্যক্ত করছি-দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে বইমেলা হোক।

বিডিনিউজ: বলাকা প্রকাশন ইতিমধ্যে আটশতাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। বলাকা প্রকাশন শুরু থেকে মননশীল ও মান সম্মত প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। এতো সংখ্যক বই প্রকাশ করতে গিয়ে গুণ ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদ্ধতি আপনারা অবলম্বন করেন?
জামাল উদ্দিন: বলাকা প্রকাশন ইতোমধ্যে ৮৩০টির মতো বই প্রকাশ করেছে। বই প্রকাশের একটা ধ্রুপদী ধারা আছে। সেটা ব্যবস্থাপনা করতে পারলে গুণমান ধরে রাখা সমস্যা হয় না। বলাকা প্রকাশনের দীর্ঘদিনের কর্মপদ্ধতিই বলাকা প্রকাশনের কাজের ধারাবাহিকতা, আর তার পিছনেই সাফল্য।

বিডিনিউজ: একটা অভিযোগ প্রায়ই মনোযোগী পাঠকের কাছ থেকে পেয়ে থাকি, বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে বেশি নজর দেয়ার ফলে মননশীল বই, যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় একটু বেশি লাগতে পারতো, সেই ধরণের বইয়ের চর্চাই কমে গেছে! যে কারণে দেখছি, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আবার এক জরিপে দেখছি, গত বছর চীন ও ভারতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশিত হয়েছে। এই সংকট উত্তরণে প্রকাশক কি ভূমিকার রাখতে পারে?
জামাল উদ্দিন: বহুল বিক্রিত বা প্রকল্প নির্ভর বইয়ের দিকে নজর দেয়ার পরও মননশীল বই— যার বিনিয়োগ উঠে আসতে সময় লাগে সেই ধরনের বইয়ের চর্চা বাড়ানো যায়, যদি সমন্বয় প্রথা মেনে চলতে পারে। এটি সংকট নয়, আমার মতে, চিন্তা-ভাবনার দুর্বলতা। পূর্বেই বলেছি লেখক, পাঠক, প্রকাশক একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সবাই সবার দায়িত্ব পালন করলে, একটি স্থিতিশীল বাজার সৃষ্টি হলে, সব ধরনের বই প্রকাশ সম্ভব।

বিডিনিউজ: বলাকা প্রকাশন এ বছর কী কী বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে?
জামাল উদ্দিন: এ বছরও বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ প্রায় সব ধরনের বই প্রকাশের ধারা চলমান আছে বলাকা প্রকাশনে।

বিডিনিউজ: বহু প্রকাশক গত বছর থেকে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রচুর বই বের করেছেন এবং আরো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে আপনারা কী কী গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন?
জামাল উদ্দিন: বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে অতি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনাত সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের উপর সারাদেশের বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই কাজটা আমরা শুরু করেছিলাম বিংশ শতাব্দীর '৯০ দশক থেকে। আমাদের প্রকাশনা থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রায় অর্ধশত গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে আরো ২৫টি গ্রন্থ। প্রকাশের পথে আছে প্রায় ১৮টি বই। এসব বই শুধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর গবেষণা গ্রন্থ।

বিডিনিউজ: প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় প্রচুর বই থাকে, লেখকের হয়তো সেবারই প্রথম। এর মান নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। বড় প্রকাশনীর একটা দায় থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখককে তুলে আনার। সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা করা, পত্রিকার লেখা দেখে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আপনি কিভাবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে নির্বাচন করেন?
জামাল উদ্দিন: আমরা তরুণদের মধ্য থেকে সম্ভবনাময় লেখক উঠে আসুক, চাই। এ বিষয় মাথায় রেখে আমরা কাউকে চেহারা দিয়ে বিচার করি না। পাণ্ডুলিপি জমা নিয়ে সম্পাদনা পরিষদ দিয়ে যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিই।

বিডিনিউজ: বাংলাদেশে প্রকাশনা-শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
জামাল উদ্দিন: প্রকাশনা শিল্পের বিকাশে বাধা অনেক। প্রথমত এটিকে সরকারিভাবে প্রকৃতই শিল্প হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের কোনো ব্যবস্থা নেই। মেধাবী লেখক-গবেষকদের সঠিক মূল্যায়ন নেই। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে বই ক্রয় ও পাঠকদের হাতে বই পৌঁছে দেয়ার কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই।
যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান বই ক্রয় করে থাকে সেগুলোকে স্বজনপ্রীতি-মুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতা-বিরোধী, মৌলবাদী লোকগুলো থেকে সজাগ থাকতে হবে। তারাই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদে পদে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা গ্রন্থ সমুহের সঠিক মূল্যায়ন ও প্রচার হচ্ছে না এমন অনেক সমস্যার মাঝে আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি।

বিডিনিউজ: প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আপনার কি কোনো প্রস্তাব আছে?
জামাল উদ্দিন: প্রকাশনা শিল্পের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য সরকারি, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু নীতিমালার মাধ্যমে বই ক্রয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দেশের প্রতিটি উপজেলায় পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষকে বই পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
জাতীয় গণগ্রন্থগার ও পাবলিক লাইব্রেরিতে বই ক্রয়ের বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। সুষ্ঠু নীতিমালার মাধ্যমে মানসম্মত বই ক্রয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে, দুর্নীতিবাজ, মৌলবাদী চক্রান্ত থেকে সজাগ থাকতে হবে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গবেষণা ও সাহিত্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। কোনো প্রকারের স্বজনপ্রীতি ব্যতিরেকে প্রকৃত লেখককে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।

বিডিনিউজ: ধন্যবাদ, জামাল উদ্দিন ভাই, আন্তরিক সময় দেয়ার জন্য।
জামাল উদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ বিডিনিউজ পরিবারের সব সদস্য ও এই পরিবারের লক্ষ লক্ষ পাঠকের প্রতি। সবার প্রতি রইল বলাকা পরিবারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছ ও অভিনন্দন।