এক মুঠো রূপক

রায়হান রাইন
Published : 12 Jan 2021, 07:04 AM
Updated : 12 Jan 2021, 07:04 AM


রূপক ও লক্ষণা ভাষার দুই গুরুত্বপূর্ণ শব্দবৃত্তি। নৈয়ায়িকদের মতে, শব্দবৃত্তি মানে শব্দের অর্থপ্রকাশের সামর্থ্য। রূপক ভাষায় ব্যঞ্জণা সৃষ্টি করে। ব্যঞ্জনাধর্মী ভাষার বহুবিধ ব্যবহার আছে। আমরা দেখতে পাই, চর্যাপদের রচয়িতা সহজিয়া সিদ্ধা, বৈষ্ণব কবি এবং বাউল গায়কেরা রূপক ব্যবহার করে তাদের মরমি চিন্তার প্রকাশ ঘটান। যাকে জ্ঞানের সীমায় ধরা যায় না, সেই অতীন্দ্রিয়কে এবং বাগেন্দ্রিয়ের অতীত ভাবকে গ্রেপ্তার করতে তারা ব্যবহার করেন রূপকের ভাষা।

এদেশে সাধক-ভাবুকদের রূপক নির্মাণের মরমিপনা এতো প্রবল যে, বৃহৎবঙ্গের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি মাত্র রূপক থেকে জন্ম হয়েছিল একটি দর্শন ও ধর্মের। জগৎ হচ্ছে মাতা– এটা ছিল সেই রূপক। প্রাচীন ধর্মপুস্তকগুলিতে ভূমিকে মাতা এবং মাতাকে ভূমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষিজীবী সমাজ ও সংস্কৃতিতে উদ্ভূত এই রূপক থেকে জন্ম নেয় ভাণ্ড-ব্রহ্মা-বাদী মত– অর্থাৎ যা দেহের জন্য সত্য তা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের জন্যও সত্য। তন্ত্রধর্মের এটাই মূলকথা। বাংলায় এ ধর্মের মাতৃরূপক শক্তি, কালী, অন্নদা, দুর্গা ইত্যাদি নামে যেমন ফিরে ফিরে এসেছে, তেমনই দেহাত্মবাদী মতও বৌদ্ধ সহজিয়া, নাথপন্থা এবং সুফি-বৈষ্ণব-বাউলে ঘুরে ফিরে এসেছে।

গৌতম বুদ্ধ চূড়ান্ত সত্যকে বলেছিলেন 'অব্যাকৃত'। পরাতত্ত্বের বিষয়গুলো নিয়ে কিছুই বলা যায় না, এসব বিষয় বাক্য ও ভাষার অতীত। বৌদ্ধ সহজিয়ারা বলেন 'বাকপথাতীত'। বাউলেরা সেই অধরা সম্পর্কে বলেন 'বাগেন্দ্রিয়ে না সম্ভবে'। কিন্তু এই সাধক-চিন্তকেরা রূপকের ভাষা দিয়ে সেই অধরাকে ঠিকই ধরার চেষ্টা করেছেন, গরহাজিরকে হাজির করেছেন তাদের তত্ত্বে। আমরা যখন কোনো বিমূর্ত ভাবনা বা অনুভবের মুখোমুখি হই, তখন এই ব্যঞ্জনাধর্মী ভাষা আমাদের আশ্রয় হয়ে ওঠে।

বাইবেলের জেনেসিসে বলা হয়েছে, 'বাক্যই ছিলেন ঈশ্বর।' জগৎ সৃষ্টির মুহূর্তের সেই অতীন্দ্রিয় দশা– ঈশ্বর, জগৎ ও ভাষা নিয়ে যে বিমূর্ত পরিস্থিতি, তা রূপকের ভেতর দিয়ে হাজির হয়েছে। দেখা যায়, দার্শনিকেরাও তাদের চিন্তার দুর্বোধ্য অবস্থাকে ডিঙাতে গিয়ে রূপকের দ্বারস্থ হন। গ্রিক দার্শনিক জেনোফানেস বলতেন, 'ঈশ্বর হচ্ছে এক শাশ^ত গোলক।' হেরাক্লিটাস লিখেছেন, 'বস্তু হচ্ছে প্রক্রিয়া, আমাদের দেহ হচ্ছে অগ্নিশিখা…।' ভাষার প্রকৃতি বুঝাতে গিয়ে দার্শনিক লাডভিগ ভিটগেনস্টাইন বলেন, 'ভাষা হচ্ছে খেলা।' তিনি একটা রূপক ব্যবহার করে অর্থতত্ত্বের পিচ্ছিল সীমানাকে ধরার চেষ্টা করেছেন। জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ইন্দ্রিয়নির্ভর জগৎ এবং বুদ্ধিনির্ভর জগতের মধ্যে যে ফারাক সৃষ্টি করেন তা ঘোচাতে গিয়ে ফ্রেডরিক হেগেল বলেন, 'যা যৌক্তিক তাই বাস্তব, যা বাস্তব তাই যৌক্তিক।'

এছাড়া অধিবিদ্যার আঙিনা জুড়ে দেখা মিলবে ভুরি ভুরি রূপকের, যেখানে ভাষা নিজেই জায়গা নিয়েছে চূড়ান্ত সত্তার।


আলঙ্কারিক ভাষায় যখন কোনোকিছুকে সরাসরি আরেকটা কিছু দিয়ে প্রকাশ করা হয়, তখন সেটা রূপক। রূপকগুলো সৃষ্টি করে অর্থময়তার দ্বিতীয় আরেকটি স্তর। যখন কেউ বলেন, 'দেহ হচ্ছে গাছ, তার আছে পাঁচখানা ডাল'– তখন আমরা গাছের আক্ষরিক অর্থকে ছাপিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি, কেন দেহ একটি গাছ যার মাত্র পাঁচখানাই ডাল। ভারতীয় ন্যায়-দার্শনিকেরা বলেন, ভাষার অর্থ প্রকাশের প্রাথমিক সামর্থ্য যখন ব্যর্থ হয়, তখনই দ্বৈতয়িক শব্দবৃত্তি হিসেবে লক্ষণা বা ব্যঞ্জনা থেকে অর্থ নির্দিষ্ট হয়। তাদের মতে, লক্ষণা থেকে অর্থের উৎপত্তি নির্ভর করে প্রথা বা প্রচলিত ব্যবহারের উপর। এই ব্যঞ্জনাধর্মী ভাষাই লক্ষণা ও রূপকের ভাষা।

ভাষা ব্যবহার মাত্রই প্রথা বা প্রচল নির্ভর অর্থাৎ সাংস্কৃতিকভাবে নির্ধারিত। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ভাষা ব্যবহারকারী এই ব্যবহারের সীমানা কখনো ডিঙিয়ে যান না। অতিবর্তিতা বা নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া মানবচেতনার স্বভাব বলেই ভাষাও তার অর্থপূর্ণতা ও ব্যবহারের সীমানাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারণ চেতনা আত্মসচেতন হতে পারে ভাষাকে ব্যবহার করেই। যাহোক, প্রশ্ন হলো, ভাষার শিকড় কি আদৌ প্রোথিত আছে কোনো বাস্তবতার ভেতর? নাকি ভাষার ভেতর দিয়েই সৃষ্টি হয় বাস্তব? আধুনিকদের বিশ্বাস এরকমই ছিল যে, ভাষার অর্থময়তার ভিত্তি বা পাটাতন হিসেবে বাস্তব জগৎ বলে একটা ব্যাপার আছে। এই অবস্থানের সঙ্গে বৈদিক মীমাংসকদের অনেকখানি মিল পাওয়া যায়। মীমাংসকদের ধারণা ছিল, বৈদিক মন্ত্রগুলোর অর্থ যদি প্রথানির্ভর হয়, সেটা হবে মারাত্মক এক অনাচার! কাজেই মন্ত্রগুলোর একটা অর্থ বাস্তবে থাকবে হবে। শব্দশক্তি সেটাকেই নির্দেশ করে। নব্য নৈয়ায়িকদের কাছে সমস্যা তত প্রকট ছিল না, তাই রঘুনাথ শিরোমণি তাঁর পদার্থতত্ত্বনিরূপণ-এ বলেন, 'দশরথ' শব্দের অর্থ হলো এর ব্যবহারজনিত স্মৃতি, যেমন রামচন্দ্রের পিতা, অযোধ্যার রাজা ইত্যাদি। অর্থাৎ এই বিবরণগুলো মনে যে শাব্দবোধ সৃষ্টি করে সেটাই 'দশরথ' শব্দের অর্থ।

মাধ্যমিক বৌদ্ধরা ভাষার ভেতর দিয়ে পাওয়া জগৎকে বলেন সংবৃতি সত্য। তাদের কাছে আরও এক রকমের বাস্তবতা আছে যাকে ভাষায় পাওয়া যায় না, সেটা হলো পরমার্থ সত্য। আচার্য শান্তরক্ষিত বলেন, 'পরমার্থ সত্য সমস্ত মৌখিক বিবরণ থেকে মুক্ত।' (মধ্যমকালঙ্কার: ৭০) শান্তরক্ষিতের যুক্তি ছিল এই যে, কোনো সত্তা অন্যকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত হলে সেটা তার ঐক্যধর্মিতা হারায়। এটা ভাষালব্ধ বাস্তবতার স্বভাব। অতীশ দীপঙ্করের কথাও তাই, পরমার্থ সত্য 'অবাচ্য ও অলক্ষ্য'। (সত্যদ্বয় অবতার: ৯) একই রচনায় শ্রীজ্ঞান অতীশ সংবৃতি সত্য প্রসঙ্গে বলেন, 'সংবৃতি সত্য হলো এমন কিছু যার মানে উৎপাদনের সামর্থ্য আছে।' (সত্যদ্বয় অবতার: ৩) মানে সৃষ্টির সামর্থ্য থাকা মানে ভাষার অধীন হওয়ার সামর্থ্য। অর্থাৎ সংবৃতি সত্যই ভাষালব্ধ সত্য।

এবার প্রশ্ন, সংবৃতি সত্য কেমন যা আমরা ভাষার ভেতর দিয়ে পাই। শান্তরক্ষিত বলেন, 'এটি নিরুপিত হয় কেবল প্রথাগতভাবে।' (মধ্যমকালঙ্কার: ৬৩) তিনি মধ্যমকালঙ্কার-এ দেখান, বাস্তবের সত্তাগুলো অংশযুক্ত, এগুলোর উদ্ভব ও বিলয় আছে, এবং এগুলো কার্য বা কারণ আকারে থাকে। আমরা যখন কোনো একটি বাস্তব সত্তাকে 'গাছ' শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করি, অর্থাৎ ভাষিকভাবে গাছ নামক বাস্তবতাকে বুঝি তখন এই ব্যবহারের ভেতর দিয়েই গাছ-বাস্তবতার প্রথা সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে গাছের নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই– কেননা ডালপালা, পাতা-পল্লব, কাণ্ড, শিকড় ইত্যাদি কোনোকিছুর মধ্যেই গাছ নামক সত্তা নেই। এদেরকে অংশে বিভক্ত করলেই গাছ তার অস্তিত্ব হারায়। কাজেই গাছসত্তাটি কিছু শর্ত সাপেক্ষে একটা আপেক্ষিক সত্তা যা প্রথাগতভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে।

ভাষাচিহ্নিত বাস্তবতা সাংবৃতিক বা ব্যবহারিক। বৌদ্ধদের পরিভাষায় 'সংবৃতি' কথাটির অর্থ হলো আবরণ বা আচ্ছাদন। আমরা বলতে পারি, এই আবরণ সম্মন্ধের, এটাই সংবৃতি সত্যের স্বভাব যে তা অন্যকিছুর সঙ্গে সম্মন্ধ সৃষ্টি না করে অস্তিত্বশীল হতে পারে না। এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই সংবৃতি বাস্তবতা ভাষার অধীন হতে পেরেছে। সম্ভব হয়েছে জানা ব্যাপারটি। কারণ বাস্তবতাকে জানা মানে ঐ সম্মন্ধগুলোকে জানা। পরমার্থসত্যকে জানা যায় না, কারণ তা যে কোনো সম্মন্ধের ঊর্ধ্বে।

ভাষালব্ধ জগতের যেহেতু অনপেক্ষ অস্তিত্ব নেই, সেকারণে বৌদ্ধরা একে বলেন, প্রজ্ঞপ্তিসৎ। অর্থাৎ এ বাস্তবতা কেবল নামের দ্বারা অস্তিত্বশীল। যদি কথার অস্তিত্ব না থাকতো তাহলে এ জগৎও তার অস্তিত্ব হারাতো।

গৗতম বুদ্ধ পরাজগৎকে অকথনীয় বললেও সহজিয়ারা তা নিয়ে কথা বলা থামান নি। সোজা কথায় তাকে হাজির করা যায় না বলে তারা কৌশল হিসেবে বেছে নেন ব্যঞ্জনাধর্মী ভাষা। যে 'সহজ' স্বরূপে ভাষার কারবার নেই, তাকে রূপকের আশ্রয়ে চর্যাকারেরা হাজির করেছেন ভাষায়। ভাষাতীত সহজ স্বরূপ অর্জন করে কাহ্নপা বলেন, তিনি সহজ নলিনীবনে প্রবেশ করেছেন। শবরপার অনুভব অনেকটা ভিন্ন– তিনি নিজের ঘরে গৃহিনী করে এনেছেন এক সহজসুন্দরী। ভুসুকুর দৃষ্টিতে সহজ-মহাতরু ভেদ করে ওঠে ত্রিলোক। রূপক নির্মাণের ভেতর দিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা সম্ভব করে তোলেন শ্রীচৈতন্যের রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপ হয়ে ওঠাকে। বাউল দুর্বিন শাহ গরহাজিরকে চাক্ষুষ করেন এভাবে:
এই দেহ ইস্টিমার
নূরনবী প্যাসেঞ্জার
নিজে খোদা টিকিটমাস্টার জাহাজের মাঝার।


যা জ্ঞানগোচর নয়, যা অসম্ভব তাকেই মানুষ পেতে চেয়েছে নিজেদের অভিজ্ঞতায়। রূপকের ভাষা সেই বাসনার শিকড়ে জল ঢেলেছে। মানুষের কল্পনায় থাকা ভূমিমাতা দেবী শক্তি রূপে, কখনো অন্নদাত্রী রূপে, কখনো দুর্গতিনাশিনী হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন বাড়ির আঙিনায়। কারো পরমগুরু রূপ ধরেছেন মানুষগুরুর। মানুষের পরমভাব গানের ভেতর এসে হাজির হয়েছে আলেক সাঁই কিংবা মানুষ রতন হয়ে, কারো কাছে ব্রহ্ম নিজেই এসেছেন বিশ্বরূপ ধরে, আবার কারো কাছে বাক্য হয়ে উঠেছে দেবী– মানুষ এসব অসম্ভবকে ভালোবেসেছে, ভয় পেয়েছে কিংবা ভরসা করেছে। তারা একত্র হয়েছে এসব রূপকের ছায়ার নিচে। ধীরে ধীরে রূপকের ভাষা একটা সাংস্কৃতিক মাত্রা পেয়ে যাওয়ায় এসব কেন্দ্রীভূত হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতর।

ধর্ম যখন সমাজ সংগঠনের উপাদান ছিল এবং সংহত করেছে সামাজিক ক্ষমতাকে, শ্রেণিবৈষম্যে নাকাল মানুষ তখন পাল্টা রূপক নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সেই ক্ষমতার। আলাদা সমাজ-সত্যের অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছে পাল্টা রূপক, যেমন বেদ-শরিয়তের রূপকগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে বাউলের আলেক সাঁই কিংবা সহজ মানুষ। কখনো কখনো তারা আলাদা সত্যকে হাজির করতে চেনা রূপকগুলোর অর্থই বদলে দিয়েছে। প্রয়োজনে লড়াইয়ের নেতা নিজেই হয়ে উঠেছেন ভগবান।

কাজেই আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের অনিবার্য কোনো বস্তু, ঘটনা কিংবা কোনো ব্যক্তি রূপকের মুখোশ পরে নিতে পারে যে কোনো সময়। এটা অসম্ভব নয় যে, যে যৌথ অবচেতন থেকে মিথের আদিপ্রতীকগুলোর জন্ম এবং যে অবচেতন মুখোশ পরে নেয় ব্যক্তির স্বপ্ন-প্রতীকের তারাই আদল দিতে থাকে মানুষের একেকটি দিনের গল্পকে। যে অনাথ শিশুটি ঘরের কাজ করে সে হয়ে উঠতে পারে একটা প্রত্নপ্রতীক। এসব ক্ষেত্রে আদিপ্রতীকগুলো মানুষের বাসনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে তার প্রভাব জড়ো করতে থাকে, আবিষ্টকর হয়ে ওঠে ক্রমশ। কবি, চলচ্চিত্রকার, সঙ্গীতকার এবং চিত্রশিল্পীরা এই রূপকের ভাষাকে আত্মীকৃত করে নেন শিল্পের ভাষায়।

ইতিহাসের একটা পর্যায় পর্যন্ত শিল্পের অঙ্গনে ধর্মীয় রূপক ও আখ্যানের বিচরণই ছিল প্রধান। শিল্প সৃষ্টি হয়েছে ধর্মীয় রূপকগুলোর সঙ্গে যুক্ত বোধ ও অনুভবকে আশ্রয় করে। এসময় জুড়ে সৃষ্টি হওয়া ভাস্কর্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা ও সাহিত্যের সর্বত্র এর দৃষ্টান্ত আছে, যেমন আমরা দেখি পৌরাণিক পটচিত্র, পুঁথি ও দেয়ালচিত্র, বৌদ্ধ গান, কীর্তন, বৈষ্ণব কবিতা এবং মঙ্গলকাব্যে। তবে পরবর্তীকালে শিল্প-সাহিত্যে এসব রূপকের তাৎপর্য বদলে গেছে। একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটে গেছে যে, শিল্প-সাহিত্য ধর্মীয় কাহিনি ও রূপকের বয়ান ছেড়ে মানুষের প্রতিদিনকার জীবনের গল্পকে আশ্রয় করেছে।


আমরা জানি না, এই বিশ্বজগৎ কেন অস্তিত্বশীল হওয়ার দায় নিয়েছিল। কোথায় এই জগতের শরু। আমরা কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাব, মানব অস্তিত্বের আদৌ কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা? কী এর উদ্দেশ্য? আমরা এমনকি ধূলায় পড়ে থাকা একটা পাথরকেও জানিনা, আমরা জানি না, বস্তু কী? এসব চূড়ান্ত প্রশ্নের যে জবাবই দেওয়া হোক, সৃষ্টি হবে একেকটি রূপক। তাই দার্শনিকদের ব্যবহৃত ভাষাকে বাস্তবতার বর্ণনা মনে হলেও আসলে তা ব্যাঞ্জনাধর্মী ভাষা।

দার্শনিকদের এমন ভাষার বৈশিষ্ট্য হলো, এতে একটা কিছুকে স্পষ্ট করতে একই রকম অস্পষ্ট অন্যকিছু বলে তাকে বর্ণনা করা হয়। জি ই ম্যূর এই ত্রুটিকে বলেন, প্রাকৃতিক অনুপপত্তি। আবার এমনও হয় যে, দুর্বোধ্য কিছুকে ¯্রফে একটা নাম দিয়ে দেয়া হয়, যেন ঐ নামটাই সেই বস্তু এবং তার নাম জানার ভেতর দিয়ে যেন আমরা খোদ বস্তুটাকেই চিনে ফেললাম। কখনো কখনো দার্শনিকের ভাষা ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে ওঠে তার বাসনার যুক্ততার কারণে, অর্থাৎ তিনি জগৎটাকে কিভাবে দেখেন বা দেখতে চান সেই আদলেই রূপকটি নির্মিত হয়, যেমন সোফিস্ট সম্প্রদায়ের দার্শনিক প্রোটাগোরাস বলেন, 'মানুষই হলো সবকিছুর পরিমাপক।' পিথাগোরীয়রা বলেন, 'সব বস্তুই হচ্ছে সংখ্যা' কিংবা প্লেটো বলেন, 'চিন্তা হলো আত্মার নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা।' রেনে দেকার্ত পিথাগোরীয়দের কথাটাকে সংস্কার করে বলেন, 'জগতে সবকিছুই ঘটে গাণিতিকভাবে' ইত্যাদি। অভিপ্রায়িক রূপকের দারুণ দৃষ্টান্ত এগুলো।

দর্শনের চূড়ান্ত প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে গিয়ে যেসব রূপক হাজির করা হয়েছে, ইতিহাসের নানা সময়ে সেগুলোর নাম ও ধরন বদলেছে। এগুলোর মধ্যে আছে, সাংখ্য দর্শনের পুরুষ ও প্রকৃতি, বেদান্তের ব্রহ্ম, নাথপন্থার নিরঞ্জন, বাউলের সহজ মানুষ, রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা ইত্যাদি। পাশ্চাত্য দর্শন ও খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব একে বলেছে 'ঈশ্বর' এবং হেগেল বলেছেন 'পরম'। পার্থক্য এই যে, হেগেল এই রূপককে আরও নানাকিছুর সঙ্গে যুক্ত করে হাজির করেন এবং বলেন, এই পরম হলো স্পিরিট বা যুক্তি, এটি ইতিহাসের ভেতর নিজেকে উপলব্ধি করে। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতাও বহুত্বের ভেতর নিজের ঐক্য উপলব্ধি করেন।

আমাদের ইন্দ্রিয় যেখানে প্রবেশ করে না, বুদ্ধি যেখানে তার অনুমানকে পৌঁছাতে পারে না, সেই অন্ধকার ও নিঃশব্দ নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, তখন রূপক সৃষ্টি হয় এবং এমনকি যখন অভ্যস্ত জগৎকে বুঝতে গিয়ে আমরা শব্দ ব্যবহার করি তখন চেনাজানা জগৎটাও হয়ে ওঠে সেই অন্ধকার ও নিঃশব্দের সমান। চারপাশের সবই অপূর্ণ, দুর্বোধ্য– সবকিছুকে ঘিরে থাকে অপরিচয় ও অপ্রাপ্তি, কিন্তু মানবচেতনার আছে সেই ক্ষমতা যা নিজেকে দেখতে পায়, নিজের অপূর্ণতাকে দেখতে পায় এবং ছাড়িয়ে যেতে চায় নিজেকে যা সে নয় সেটাই সে হয়ে উঠতে চায়, আর ব্যঞ্জনাধর্মী ভাষা তাকে সাহায্য করে অজেয় ও অসম্ভবকে ডিঙিয়ে যেতে।


'বিশ্বজগৎ বস্তু নয়, ঘটনার সমষ্টি'– কথাটা বলেছিলেন লাডভিগ ভিটগেনস্টাইন। তিনি ঘটনা বলতে বুঝেছেন বস্তুর বিন্যাসকে। এই বিন্যাসের বিস্তার বা ব্যাপ্তি নিয়েই গড়ে ওঠে জগতের বিস্তার। তবে আমরা এভাবেও ভাবতে পারি যে, এ জগৎ হলো সৃষ্ট রূপকের অর্থময়তার বিস্তার। কেউ যখন একটা রূপক থেকে নতুন অর্থ সৃষ্টি করে কিংবা সৃষ্টি করে নতুন রূপক, তখন তার জগতের বিস্তার ঘটে। এদিক থেকেও বলা যায় যে, আমরা বস্তুর জগতে বাস করি না, আমরা বাস করি ভাষাচিহ্নিত বিশ্বে। ভাষা ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত আমরা সৃষ্টি করে চলেছি আমাদের নিজেদের জগৎ।

যে সমাজ ও সংস্কৃতিতে আমরা বাস করি, সর্বদা তার বদল ঘটছে। এমন হতে পারে যে, এই বদলে যাওয়া আদতে ভাষারই বদল। প্রথা ও সংস্কৃতির পরিবর্তনে রূপকগুলোর তাৎপর্যও বদলে যায়, যেমন ভূমিমাতা, শব্দব্রহ্ম কিংবা যোগীদের দিব্যদেহের ধারণা আজ আর একই তাৎপর্য বহন সৃষ্টি করে না। অন্যদিকে, রাশি রাশি নতুন রূপক জন্ম দিচ্ছে নতুন সময়ের।