বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে নাসির আলী মামুন-এর নিবেদন

শাহাবুদ্দিন আহমেদ
Published : 10 March 2020, 05:24 PM
Updated : 10 March 2020, 05:24 PM


আলোকচিত্র: নাসির আলী মামুন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর আমি ও আমার সহযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্রসহ ঢাকায় প্রবেশ করি। হানাদার বর্বর পাকবাহিনী তখন বিপর্যস্ত এবং পরাজিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা হানাদার-মুক্ত হচ্ছে খবর পাচ্ছি, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড়ছে। মুক্তির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা দলে-দলে ঢাকায় প্রবেশ করছে। নাসির আলী মামুনের সঙ্গে আমার দেখা হয় কলাবাগানে আমাদের বাসায় ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, সকালে। আমরা একটা খোলা জিপগাড়ী নিয়ে 'জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু' শ্লোগান দিয়ে শাহবাগের দিকে এগোচ্ছিলাম। আমি রেডিও ভবনের ছাদে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেই। আমরা তখনও জানতাম না আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করতে যাচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেখানে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিজয়ের এইসব রোমাঞ্চকর ঘটনার সময় আলোকচিত্রশিল্পী মামুন আমার সঙ্গে ছিল।

বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। মামুন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর পোরট্রেট ফটোগ্রাফীর উদ্বোধন করল বাংলাদেশে। আমাদের গৌরবময় দিনগুলিতে রাজনীতি, সাহিত্য, সংগীত বা শিল্পকলায় যারা অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন তাদের সকলের বিশেষ মুহূর্তগুলো সে তার ক্যামেরায় ধরে রাখতে আরম্ভ করলো। ওই কৈশোরে কেন সে তার সমসাময়িক অন্য সকল আলোকচিত্রী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক শিল্পভুবন রচনা করলো ভেবে অবাক হই আমি। প্রকৃতিনির্ভর আলোকচিত্র ধারনে প্রায় সবাই যখন ক্যামেরা ফোকাস করছেন, মামুনের তীব্র দৃষ্টি তখন বিভিন্ন বিষয়ের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের মুখে। প্রকৃতি থেকে সরে এসে সে আলো ফেললো সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বে। বাংলাদেশের আলোকচিত্রের সাম্রাজ্যে এই পরিবর্তন যেমন অভিনব তেমনি সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আলোকে বৈশিষ্টপূর্ণ।


আলোকচিত্র: নাসির আলী মামুন
মাত্র আঠার বছর বয়সে নাসির আলী মামুন-এর ক্যামেরা ফোকাস করেছে বঙ্গবন্ধুকে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জাতির জনকের পিছু নিয়েছে তার ক্যামেরা। অন্য আলোকচিত্রীদের চাইতে তার ক্যামেরায় তোলা বঙ্গবন্ধু অনেক বৈচিত্রপূর্ণ ও অবারিত। একই সঙ্গে বলিষ্ঠ এবং শিল্পের উচ্চতায় এমন আশীর্বাদপুষ্ট যার প্রশংসা না করে পারি না। মামুনের তোলা বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক ফটোগ্রাফ দেখে আমি ব্যাকুল হই। মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর কতগুলো ছবি এঁকেছি সে সংখ্যা বলতে পারব না আমি। মামুনের ক্যামেরায় তোলা বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখেও আমি কয়েকটি পেইন্টিং করেছি। সে যে-কারও পোরট্রেট করলে তার ভেতরে অনুপ্রবেশ করে সেই আলোকচিত্রগুলো দেখে আমি ওর ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে দেখার সরল শক্তিকে শ্রদ্ধা করি। সব আলোকচিত্রীই সার্থক পোরট্রেট করতে পারে না। কেউ কেউ সফল হন। ওর সাদাকালো পোরট্রেট দেখে মেনে নিতেই হবে যে সে কী ভালোবাসায় এবং পারদর্শিতায় বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করতো। এত নিরাপত্তার মধ্যে জাতির জনককে কীভাবে সে দারুণ মমতায় ক্যামেরাবন্দি করেছে এ বিষয়ে তার সাথে কোনদিন আলোচনা করিনি। আমি অবাক হয়েছিলাম যখন মামুন ১৯৭৩-এ চারুকলার বার্ষিক প্রদর্শনীতে এসে আমার একটি একক প্রদর্শনীতে ক্যামেরা হাতে উপস্থিত। বঙ্গবন্ধু আমার প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন। তিনি শিল্পকর্মগুলো দেখে আমাকে ভীষণ উৎসাহ দিয়েছিলেন। পরে আমি ফ্রান্স সরকারের স্বলারশীপ নিয়ে প্যারিস চলে যাই। এসবই বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অবদান ছিল। নাসির আলী মামুন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতার এত কাছে গিয়ে যেসব সাদাকালো অসাধারণ আলোকচিত্র গ্রহণ করেছিল তা আজ আমাদের সংস্কৃতির অমূল্য শিল্পসম্ভার। রাষ্ট্রীয়ভাবে এইসকল আলোকচিত্র সংরক্ষণ করা জরুরী, অনেক ছবি নষ্ট হয়েছে, হারিয়ে গিয়েছে, আমরা বঙ্গবন্ধুর কোন ছবিই হারাতে চাই না। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী বা জাতীয় জাদুঘর উদ্যোগ নিতে পারে। আমার প্যারিসের বাসভবনে মামুন কয়েকবার এসেছে। প্রত্যেকবার সে আমার স্টুডিওতে ঢুকে বঙ্গবন্ধুর পেইন্টিংগুলো বার বার দেখে। তারপর চলে যায় ডাইনিং টেবিলের ওপরের দেয়ালে যেখানে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ছবিটি থাকে। যারা আমার বাসায় আসেন তাদের সবচাইতে পছন্দের জায়গা ডাইনিং টেবিলের পাশের বিরাট জানালা, দেখা যায় প্যারিস নগরী ও দূরে আইফেল টাওয়ার। প্যারিসে আমার বাসায় এসে আনন্দ পায় সবাই। কিন্তু মামুনের মন খারাপ হয়ে যায়; সে আমাকে জানায়। সে বলে প্যারিসে নিঃসঙ্গ বঙ্গবন্ধু, মনে হয় কেউ নেই তাঁর সঙ্গে। আমার আঁকা ক্যানভাসে তিনি যেন অনন্তের পথে চেয়ে আছেন। এই প্রতিভাবান আলোকচিত্রশিল্পী ছবির ভাষা বোঝে, এটা আমি জানি। কিন্তু ছবিতে বঙ্গবন্ধু একা এবং ভারাক্রান্ত তা আমিও কখনও ভাবিনি। আলোকচিত্রশিল্পী মামুনের ছবির মর্মে প্রবেশ করার তীব্র ক্ষমতা হতবাক করে দেয় আমাকে। বঙ্গবন্ধুতে তার অগাধ শ্রদ্ধা এবং ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখার যে নান্দনিক পর্বটি, সেটি আমাদের সামনে চলে আসে যখন মামুনের তোলা জাতির জনকের সাদাকালো ও আলো আঁধারির পোরট্রেট ফটোগ্রাফির সামনে দাঁড়াই। ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় ইতিহাসের নানান অনুষ্ঠানে সে অনুসরণ করেছে তাঁকে। নাসির আলী মামুনের ছবিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে সরব এবং প্রাণময় তাতে বোঝা যায় এই আলোকচিত্রশিল্পী সাধারণ কেউ নয়। জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নাসির আলী মামুনের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী 'জয় বঙ্গবন্ধু' আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি মাইল ফলক হয়ে রইল।