জয়নুলের আদি জলচিত্র: একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রদর্শনী

কামরুল হাসানকামরুল হাসান
Published : 28 Feb 2009, 10:34 AM
Updated : 28 Feb 2009, 10:34 AM

ফেব্রুয়ারির ১৯ থেকে ২৮ পর্যন্ত শিল্পী জয়নুল আবেদিনের প্রথম পর্যায়ের ৫০টি ছবির একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ধানমণ্ডির গ্যালারি চিত্রক-এ। কিছু রেখাচিত্র ও অধিকাংশ জলরং-এ আঁকা ছবির বেশির ভাগই জয়নুলের ছাত্রজীবনে আঁকা। ময়মনসিংহের বহ্মপুত্র নদ, কলকাতা ও সাঁওতাল পরগণা দুমকার জনজীবন উঠে এসেছে এসব ছবিতে। কীভাবে সংগ্রাহক ছবি সংগ্রহ করেছেন তা থেকে শুরু করে এ সব ছবির নানান বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন লেখক। আগ্রহীদের জন্য প্রদর্শনীর ৫০টি ছবি আটর্স-এর স্লাইড শোতে সংরক্ষিত হলো।


জয়নুল আবেদিন (১৯১৪ – ১৯৭৫)

জয়নুল আবেদিনের আদি জলরং চিত্রের এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রদর্শনী। দাউদ ফারহান নামের একজন জয়নুল-অনুরাগী দীর্ঘকাল যাবৎ সযত্নে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন জয়নুলের যেসব চিত্রকর্ম তাই নিয়ে আয়োজিত হচ্ছে এ প্রদর্শনী। দ্বিতীয়ত, এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, অল্প কয়েকটি বাদ দিলে প্রদর্শনীর অধিকাংশ চিত্রই জয়নুল আবেদিনের ছাত্রজীবনে (১৯৩২-৩৮) আঁকা। এর বাইরে ১৯৩০, ১৯৩১, ১৯৩৯, ১৯৪০, ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালের কিছু চিত্রও এতে আছে। সব মিলে ১৯৩০-৪৬ কালপর্বের মোট পঞ্চাশটি চিত্রকর্মের এ প্রদর্শনী শিল্পানুরাগী মহলের জন্য এক গভীর আনন্দদায়ক ঘটনা।

কেননা ১৯৪৩এর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা বাদ দিলে এই কালপর্বের (১৯৩০-৪৬) অনেক চিত্রই এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে অনুদ্ঘাটিত। যেসব চিত্রের ছবি বইয়ে ছাপা অবস্থায় দেখা যায়, তার মধ্যে আছে : 'শম্ভুগঞ্জ' (কালিকলমের স্কেচ : ১৯৩৩), 'হাঁস' (জলরং : ১৯৩৩), 'ফসল মাড়াই' (জলরং : ১৯৩৪), 'বনানী – দুমকা' (জলরং : ১৯৩৪), 'পল্লিদৃশ্য' (জলরং : ১৯৩৪), 'ঘোড়ার মুখ' (পেনসিল-তেলরং : ১৯৩৪), 'বাইসন – জু স্টাডি' (জলরং : ১৯৩৫), 'মজুর' (পেনসিল-স্কেচ : ১৯৩৫) প্রভৃতি। এছাড়া ১৯৩৮এ ব্রহ্মপুত্র নদ সংক্রান্ত ছটি জলরং চিত্রের জন্য অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্ট কর্তৃক গোল্ড মেডেল প্রাপ্তির সংবাদ আমরা জানি। কিন্তু ওইসব চিত্র আমরা দেখতে পাই না। তবে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ৯০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যে প্রদর্শনী ঢাকায় আয়োজিত হয়েছিল, তাতে জয়নুলের এ পর্বের প্রচুর চিত্রকর্মের সঙ্গে আমরা পরিচিত হতে পেরেছি। তবু একথা স্বীকার করতেই হবে, জয়নুলের ছাত্রজীবন ও কলকাতা পর্বের এক গুরুত্বপূর্ণ অজানা দিক এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে উদ্ঘাটিত হল। বিশেষত, আমরা এর আগ পর্যন্ত জয়নুলের চিত্রকর্মের আদি যে নিদর্শন পাই তা ১৯৩৩এ আঁকা। কিন্তু এই প্রদর্শনীতে ১৯৩০, ১৯৩১ ও ১৯৩২ সালের চিত্রও রয়েছে। অর্থাৎ কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগের চিত্রকর্মও আমরা এ প্রদর্শনীতে পাচ্ছি। সেজন্য এ প্রদর্শনীটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এক
প্রদর্শনীর চিত্রমালা নিয়ে আলোচনার পূর্বে এগুলো কীভাবে সংগ্রাহকের হস্তগত হল তার নেপথ্য কাহিনীটি সংক্ষেপে বিবৃত করা আবশ্যক। এর মধ্য দিয়ে জয়নুলের জীবনবৈশিষ্ট্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকও উন্মোচিত হবে। জয়নুলের এই চিত্রগুলো দাউদ ফারহানের মালিকানায় এসেছে তাঁর পারিবারিক সূত্রে। শিল্পী আনোয়ারুল হক দাউদ ফারহানের অন্যতম পিতৃব্য। কলকাতার ছাত্রজীবনেই শিল্পী আনোয়ারুল হক (১৯১৮-১৯৮১) ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে জয়নুল আবেদিনের হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। জয়নুল ময়মনসিংহের এক দরিদ্র পরিবারের সদস্য হিসেবে কলকাতায় গিয়ে ১৯৩২ সালের জুলাই মাসে আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে তিনি ওই স্কুলের শিক্ষক হন এবং ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পূর্ব পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন ওই দায়িত্বে। কলকাতা আর্ট স্কুলে আনোয়ারুল হক ছিলেন জয়নুলের দু-বছরের জুনিয়র। জয়নুল ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা ছাত্র। সুতরাং সংখ্যালঘু মুসলিম ছাত্র হিসেবে কলকাতা আর্ট স্কুলে এ দুজনের সম্পর্ক গভীর হতে কোনো অসুবিধা হয় নি, যদিও দুজনের পারিবারিক আর্থিক সামর্থ্যগত ব্যবধান ছিল ব্যাপক। আনোয়ারুল হকের পরিবার ছিল উচ্চশিক্ষিত, ধনাঢ্য ও অভিজাত। তাঁরা ছিলেন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। তাঁদের পূর্বপুরুষ পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত বলে, এবং পরিবারের অনেকে উর্দুভাষী বলে, গর্ববোধ ছিল। কিন্তু এসব পার্থক্য জয়নুলের প্রতিভার কাছে ম্লান হয়ে পড়েছিল। জয়নুল এই পরিবারে বিশেষভাবে আদৃত ছিলেন। ছ-বছরের স্কুলজীবনের প্রথম তিন বছর ৩১ ওয়েলেসলি স্ট্রিটস্থ যোগীন্দ্র ভবনের মেসে কাটানোর পর বন্ডেল রোডের ৮১ ও ৭৪ নম্বরের (এর প্রথমটি ছিল আনোয়ারুল হকের বাড়ি এবং দ্বিতীয়টি ছিল শিল্পী অতুল বসুর স্টুডিও) মাঝামাঝি আনোয়ারুল হকদের বৃহত্তর পরিবারের মালিকানাধীন একটি কক্ষে স্টুডিও নির্মাণ করেন তিনি। তখন তাঁর খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল আনোয়ারুল হকের বাড়িতে। প্রায় তিন বছর এমন ব্যবস্থাধীনে থাকার পর ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে জয়নুল ১৪ নম্বর সার্কাস রোতে একটি কক্ষে উঠে যান এবং ১৯৪৬এ বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেন। বন্ডেল রোড ছেড়ে চলে আসার পরও ওই পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ন ছিল। কলকাতা আর্ট স্কুলেই আনোয়ারুল হক তাঁর সহকর্মী হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পূর্ব ও পরবর্তীসময়েও শিল্পী আনোয়ারুল হক ছিলেন জয়নুলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। জয়নুলের অবর্তমানে তিনিই একাধিকবার এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন। দুজনের সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে, চার বছর বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও পরস্পরকে তাঁরা 'আনু মিয়া' (আনোয়ারুল হকের সংক্ষিপ্ত নাম) ও 'টুনু মিয়া' (জয়নুল আবেদিনের ডাকনাম) বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৪২ সালে জয়নুল কর্তৃক আনোয়ারুল হকের প্রতিকৃতি অঙ্কনেও এই ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ মেলে। বন্ডেল রোডে অবস্থানকালে জয়নুল আবেদিন আনোয়ারুল হকের পরিবারের অনেককে শিল্প-শিক্ষাদান করেছেন। খাদ্য গ্রহণসূত্রে নিয়মিত অন্দরমহলে যাতায়াতের ফলে বাড়ির মহিলাদের সূচিশিল্পের অনেক নকশাও জয়নুলকে করে দিতে হয়েছে। এরূপ ঘনিষ্ঠতাসূত্রেই কলকাতা পর্বে জয়নুলের আঁকা অনেক চিত্রকর্মই আনোয়ারুল হক ও তাঁর ভাইবোনদের পরিবারের হস্তগত হয়েছে। এমনকি কলকাতা অবস্থানকালে যে ট্রাংকটিতে জয়নুল তাঁর ছবি জমিয়ে রাখতেন সেটিও এখন পর্যন্ত ওই পরিবারে রক্ষিত আছে। ১৯৩৭ সালে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টের প্রথম প্রদর্শনীতেই জয়নুলের একটি চিত্র 'হাইলি রিকমেন্ডেড' বলে সম্মানিত হয়। এই পদকটিও এখন পর্যন্ত ওই পরিবারের কাছেই সংরক্ষিত। দাউদ ফারহান পরবর্তীকালে মিসেস আনোয়ারুল হক ও তাঁদের অন্যান্য নিকটাত্মীয় পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জয়নুলের এসব চিত্রকর্ম ও মূল্যবান সামগ্রীসমূহ নিজের সংরক্ষণে নিয়ে আসেন। যতদূর জানা যায়, এই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের কাছে এখনও জয়নুলের আঁকা কিছু কিছু চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। এসব চিত্র দর্শক-সম্মুখে প্রদর্শিত হলে জয়নুলের কলকাতা-পর্বটি সামগ্রিকতা অর্জন করতে পারত।

এ প্রসঙ্গে বেগম সুফিয়া কামালের পরিবারের কাছে সংরক্ষিত তেইশটি ট্রামের টিকেটের (১৯৪১) কথা উল্লেখ করা যায়। এসব টিকেটের উল্টোদিকে জয়নুল কালিকলম দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও দৃশ্যের রেখাচিত্র এঁকেছিলেন। পার্ক সার্কাসে সুফিয়া কামালের বাসায় ট্রামে চড়ে জয়নুলের বৈকালিক ভ্রমণে যাওয়ার ঐতিহাসিক সাক্ষ্যও হয়ে আছে এসব রেখাচিত্র।

দুই
বর্তমান প্রদর্শনীতে যে পঞ্চাশটি চিত্র স্থান পেয়েছে তার মধ্যে চারটি আছে রেখাচিত্র (চিত্র ৩৬-৩৯) যা পেনসিলে আঁকা আর একটি শুধু তেলরঙে আঁকা (চিত্র ২৮), বাকি পঁয়তাল্লিশটি চিত্রই জলরঙে আঁকা। এসব চিত্রের তিনটিতে জয়নুলের সই কিংবা তারিখ কিছুই নেই (চিত্র ৪৭-৪৯)। একটি চিত্রে সই আছে তারিখ নেই (চিত্র ৪৬)। দুটি চিত্রে সই আছে, কিন্তু তারিখের ক্ষেত্রে শুধু দিন মাস উল্লেখ করা হয়েছে, সন অনুল্লেখিত (চিত্র ৪৪-৪৫)। একটি চিত্রে সই আছে, কিন্তু সন লেখার জায়গাটি আংশিক ছিঁড়ে যাওয়ায় চার অঙ্কের শেষ অঙ্কটি বিলুপ্ত হয়েছে (চিত্র ৪৩)। এই সাতটি বাদে বাকি চিত্রগুলোতে সই ও সনের উল্লেখ স্পষ্ট। এর অধিকাংশ চিত্রেই শুধু সনের উল্লেখ রয়েছে। ষোলোটি চিত্রে আছে দিন-মাসসহ পুরো তারিখ। সই আছে বিভিন্ন ধরনের। যেমন : 'ZAINAL', 'zainul', 'ZAINUL ABEDIN' ও 'জয়নুল'। বাংলা সই একটিই, তা ১৯৩৮ সনের। তবে এ দ্বারা জয়নুলের কোনো প্রবণতাকে চিহ্নিত করা যায় না। জয়নুল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলা কিংবা ইংরেজিতে, পূর্ণ কিংবা সংক্ষিপ্ত, বড়ো কিংবা ছোট অক্ষরে যখন যেমন ইচ্ছা হয়েছে সেভাবে সই করেছেন। ফলে জয়নুলের সইয়ের ব্যাপারে কোনো নিয়মবদ্ধ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করা দুরূহ। তবে এই চিত্রগুচ্ছের একটি তারিখবিহীন সই একবারেই ব্যতিক্রমধর্মী, তা হল : 'ZAINAL'। জয়নুল আবেদিনকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের অনেকে 'জয়নাল' বলে সম্বোধন করতেন, একথা সত্য। কিন্তু শিল্পী জয়নুল আবেদিন কখনও নিজেকে 'জয়নাল' বলে পরিচয় দিচ্ছেন এমন কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। চিত্রটি যে জয়নুলের তা নিয়ে সন্দেহ জাগে না। প্রশ্ন জাগে, এটি কি তাহলে ১৯৩০এরও আগে আঁকা (?), যখন তিনি নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে স্থিরনিশ্চিত হন নি। কিংবা, এমনটা কি হওয়া সম্ভব যে, ছবিটি পরবর্তীকালের আঁকা, যখন তিনি প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু নিজের প্রকৃত নামটি ব্যবহার করতে চান নি।

তিন
১৯৩০ ও ১৯৩১ সনে কিংবা ১৯৩২এর প্রথমার্ধে অঙ্কিত চিত্রগুচ্ছের দিকে তাকালে আমরা জয়নুল আবেদিনের একটি বৈশিষ্ট্যকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে পারি। এবং এর সঙ্গে 'ZAINAL' নামাঙ্কিত চিত্রটিকে যদি অন্তর্ভুক্ত করি তাহলে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই যে জয়নুল জলরং ছবি এঁকে তাঁর শিল্পীসত্তার সম্ভাবনাকে পরিস্ফুট করতে সমর্থ হয়েছিলেন তা উপলব্ধি করা যায়। আমরা জয়নুল সম্পর্কে জানি যে, তিনি প্রকৃতি ও জনজীবনের বাস্তবতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাঁর নির্যাসকে বা প্রকৃত সত্তাকে শিল্পে ধারণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। এই গুণটি যে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার পূর্বেই সহজাতভাবে তাঁর আয়ত্তাধীন ছিল, এসব চিত্র তার প্রমাণ দিচ্ছে। এর সঙ্গে আমরা যদি তাঁর সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় (১৯২৮) 'বোম্বে ক্রনিকল' পত্রিকার আহ্বানে সাড়া দিয়ে গল্ফ খেলার চিত্র অঙ্কন করে পুরস্কৃত হওয়ার কিংবা কলকাতা আর্ট স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় (১৯৩২) প্রথম হওয়ার তথ্যটি স্মরণে রাখি তাহলে এসব চিত্রে একজন দক্ষ শিল্পীর হাতের স্পর্শ দেখে অতটা বিস্মিত হই না। কলকাতা গমনের পূর্বেই ব্রহ্মপুত্রের তীরে বসে প্রকৃতি-দর্শনসহ নদী প্রবাহের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি যে চিত্র অঙ্কন করতেন সেই তথ্যটি সামনে রেখে আমরা যদি তাঁর এসব চিত্রের দিকে তাকাই তাহলে আমাদের পক্ষে সহজ হবে এর মর্মার্থ অনুধাবন। এ কালপর্বে ময়মনসিংহে আগফা স্টুডিওর সঙ্গে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে সমকালীন শিল্পকলা-সম্পর্কিত ধারণা লাভ, মণীশ ঘটক (১৯০২-৭৯) ও আশীষ ঘটকের (১৯১৪-৭৪) পরিবারের উন্নত সাংস্কৃতিক আবহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, ময়মনসিংহে বাড়ি কলকাতা আর্ট স্কুলের এমন ছাত্রদের সাহচর্য প্রভৃতি জয়নুলের শিল্পসৃষ্টির কারিগরি দক্ষতা অর্জনের সহায়ক হয়েছে, সন্দেহ নেই।

১৯৩২-৩৮ কালপর্বে তিনি কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের ছাত্র থাকাকালে শিক্ষকদের সান্নিধ্যে নিজ শিল্পবোধ ও কারিগরি দক্ষতা উভয়েরই উন্নতি সাধনে সমর্থ হন। ফলে বরাবর তিনি ক্লাসের সেরা ছাত্র হিসেবেই নিজের পরিচিতি অক্ষুণ্ন রেখে চূড়ান্ত পরীক্ষায়ও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে তার প্রমাণ রাখেন। চূড়ান্ত পরীক্ষা পাসের আগেই ব্রহ্মপুত্র নদভিত্তিক ছটি জলরং চিত্রের জন্য অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্ট আয়োজিত সর্বভারতীয় প্রদর্শনী থেকে গভর্নরস গোল্ড মেডেল লাভ করেন তিনি। জলরঙের দক্ষ শিল্পী হিসেবে ছাত্রজীবনেই তাঁর এই আবির্ভাব পরবর্তীকালে আরও সার্থক শিল্প সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। এবং এ তথ্যটি আমাদের সকলেরই জানা যে, শিল্পচর্চায় জলরং মাধ্যমেই তিনি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ছাত্রজীবনে আঁকা জলরং চিত্রমালার দিকে তাকিয়ে আমরা এ সত্য গভীরভাবেই অনুভব করি। এবং এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, জয়নুল ছাত্রজীবনে পাশ্চাত্য অ্যাকাডেমিক রীতিতে দক্ষ হওয়ার চেষ্টাই করেছেন সর্বতোভাবে। সেজন্য তিনি চতুর্থ বর্ষ থেকে বিভাগ বাছাইয়ের সময় অধ্যক্ষ মুকুল দে-র পরামর্শ সত্ত্বেও ইন্ডিয়ান আর্ট বিভাগের পরিবর্তে ফাইন আর্ট বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু জয়নুল প্রসঙ্গে আমাদের একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তিনি এই রীতিগত দক্ষতা নিয়ে পোরট্রেট পেইন্টার হতে চান নি। বরাবর তাঁর চোখ ছিল বাংলার প্রকৃতি ও সমাজজীবনের ওপর। আমাদের জাতীয় জীবনের মূল স্পন্দনকে তিনি শিল্পীর গভীর সংবেদনশীলতা দিয়ে অনুধাবন করেছেন। ফলে তাঁর হাত দিয়েই সবচেয়ে সার্থক দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা সৃষ্টি হতে পেরেছে। অর্থাৎ লক্ষণীয় যে, জয়নুল তাঁর শৈলীগত দক্ষতা নিয়ে প্রকৃতি ও জীবনের অন্তর্ময় সত্তাকে চিত্রায়িত করার ব্যাপারেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন। ছাত্রজীবনে আঁকা জলরং চিত্রমালার দিকে তাকালেও আমরা তার পরিচয় পাই। এ-পর্বেও বিষয় হিসেবে অন্বিষ্ট হয়েছে মাছ ধরা, ফসল তোলা, নৌকাসহ নদী, ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ ও আকাশ, কুমোর বাড়ি, টালিতে ছাওয়া ঘর প্রভৃতি। কোনো কোনো চিত্রে নদী, মাঠ, বনরাজি ও আকাশের জন্য চিত্রতলের পরিসর বিভাজনের সৌকর্যটি তাঁর বিরচনগত দক্ষতাই প্রমাণ করে। কোনো চিত্রতলের বৃহত্তর অংশ বিষয় দ্বারা ভরাট হলেও শূন্য পরিসরের আবেদন সম্পর্কেও এ-পর্বে যে তিনি সচেতন ছিলেন তা উপলব্ধি করা যায়। বাস্তবতার প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠা এবং পরমসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তি শুরু থেকেই জয়নুলের শিল্পবৈশিষ্ট্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নদীজলে নৌকার প্রতিবিম্ব আঁকতে যে তিনি ভোলেন নি, এতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। রং ব্যবহারেও তিনি যে কতটা সচেতন ছিলেন তা বোঝা যায় যখন দেখি, চর, নদীজল, ফসলের মাঠ, বৃক্ষরাজি ও আকাশ একই চিত্রতলে ভিন্ন ভিন্ন রং ধারণ করে নিজ নিজ অস্তিত্বের স্বরূপকে স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলে। এসব চিত্রে আলো-ছায়ার ব্যবহার ও পরিপ্রেক্ষিতের সামঞ্জস্য সৃষ্টির দিকটিও গভীরভাবে লক্ষযোগ্য।

ছাত্রজীবনের এই চিত্রমালায় ব্রহ্মপুত্র নদসহ ময়মনসিংহের জীবনধারার উপস্থিতি ব্যাপক হলেও কলকাতার পরিবেশটিও একেবারে অবহেলিত নয়। কিন্তু তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ হল, জয়নুলের সামনে এ পর্বেই উন্মোচিত হয়েছে বিষয়গত গুরুত্বের দিক থেকে এক নতুন দিগন্ত। সেটি হল সাঁওতাল পরগনার দুমকা। কলকাতার শিল্পীরা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পূজার ছুটিতে বিষয়-অন্বেষণে কলকাতার বাইরে বেরিয়ে পড়তেন। তাঁদের প্রধান আকর্ষণ-স্থল ছিল দুমকার নাতিউচ্চ পর্বত শ্রেণিবেষ্টিত শালবনঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সেখানকার সাঁওতাল নর-নারীর জীবনবৈশিষ্ট্য। ১৯৩৪ সালে প্রথমবারের মতো জয়নুল সেখানে গিয়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। 'বনানী – দুমকা' শীর্ষক জলরং চিত্রটি ১৯৩৪এ আঁকা। বর্তমান প্রদর্শনীতেও ১৯৩৪এ আঁকা চিত্রমালায় দুমকার সাঁওতাল জীবন পরিস্ফুটিত হয়েছে। শুধু ১৯৩৪ নয় পরবর্তী ১৯৩৫-৩৭ সালের চিত্রেও অঙ্কিত হয়েছে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনধারা। বিশিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের পাশাপাশি এদের সরল ও আদিম জীবনবৈশিষ্ট্য, অবয়ব অনুশীলনের উপযোগী স্বল্পবাস প্রভৃতিই শিল্পীদের আকর্ষণের অন্যতম কারণ। সাঁওতাল নর-নারী নিয়ে আঁকা জয়নুলের পরবর্তীকালের বিখ্যাত চিত্রের (১৯৫১) কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

কলকাতার জীবনধারার চিত্র হিসেবে দুপাশে উচ্চ ভবন-আকীর্ণ সংকীর্ণ গলিপথ যেমন এই প্রদর্শনীতে শোভা পাচ্ছে (চিত্র ১৩) তেমনি আছে জাহাজঘাটের দৃশ্য (চিত্র ২৭)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৩৫ সাল থেকেই ৮১ বন্ডেল রোডস্থ আনোয়ারুল হকের বাড়ির সঙ্গে ছিল তাঁর পরম ঘনিষ্ঠতা। অতএব ১৯৩৯ সালে অঙ্কিত হয়েছে এই বাড়ির চিত্রটি (চিত্র ৩৩)। এসব চিত্রে জয়নুলের দক্ষ হাতের ছাপটি স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গেই উল্লেখযোগ্য মানব অবয়ব অনুশীলনের দুটি চিত্রের কথা। ১৯৩৬ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলের ক্লাসের কাজ হিসেবে চিত্র দুটি অঙ্কিত হয়েছে। স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী, এলিমেন্টারি পর্বের তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর চতুর্থ বর্ষ থেকে বিভাগওয়ারি পড়াশুনা করতে হত ছাত্রদের। জয়নুল চতুর্থ বর্ষ থেকে ফাইন আর্ট বিভাগের ছাত্র হন। এই বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম অনুযায়ী, প্রথম বর্ষেই মানব অবয়ব অনুশীলনের নিয়ম ছিল। এ ধরনেরই দুটি কাজ এ প্রদর্শনীতে রয়েছে (চিত্র ২৩, ২৪)। জলরং মাধ্যমে করা এ দুটি অবয়ব অনুশীলনে জয়নুলের শিল্পশৈলীর দক্ষতা ফুটে উঠেছে গভীরভাবে। এ দুই চিত্রে মাধ্যমগত সম্ভাবনাকে পূর্ণতরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে প্রকাশ ঘটেছে ড্রইংয়ের ক্ষেত্রে জয়নুলের অভূতপূর্ব শক্তির। পেশীশক্তির প্রকাশ ঘটাতে, ভল্যুম সৃষ্টিতে, যথাযথ ভঙ্গিমাটিকে ও শরীরের প্রতিটি বাঁককে স্পষ্ট করে তুলতে জয়নুল অসাধারণ সামর্থ্যরে স্বাক্ষর রেখেছেন। আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে জয়নুলের নান্দনিক উৎকর্ষের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা হল : শুধু বাহ্যিক অবয়বের চিত্রায়ণই শিল্পীর কাছে প্রধান বিষয় নয়; তিনি মানুষ দুটির অন্তর্নিহিত ভাবকে পরিস্ফুট করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে এ দুটি চিত্র হয়ে উঠেছে যথাযথভাবে প্রাণবন্ত। শিল্পীর কারিগরি দক্ষতাকে ছাড়িয়ে অন্তর্গত অনুভূতি ও মনোভঙ্গির চিত্রায়ণই মুখ্য হয়ে ওঠায় চিত্র দুটি সার্থক হতে পেরেছে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ১৯৩৯ সালে পেনসিল মাধ্যমে আঁকা চারটি রেখাচিত্রের কথা (চিত্র ৩৬-৩৯)। জয়নুল তখন কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষক। কোন পটভূমিতে এগুলো আঁকা হয়েছে আমরা জানি না। তবে প্রতিটি রেখাচিত্রেই জয়নুলের দক্ষ হাতের ছাপটি স্পষ্ট। আলোছায়ার মাধ্যমে শরীরের বাঁকসমূহকে যথার্থভাবে তার দেহভঙ্গিমাসহ চিত্রিত করার ক্ষেত্রে শিল্পীর শক্তিকে অনুভব করা যায়। এ ছাড়াও কলকাতা পর্বের শিক্ষকজীবনের কয়েকটি চিত্র আছে যা জলরং মাধ্যমে অঙ্কিত। ১৯৩৯ ও ১৯৪০ সালের তিনটি চিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদকেন্দ্রিক জীবনধারা (চিত্র ৩৪, ৩৫, ৪০)। নদী, নৌকা, ফসলের মাঠ ও বিস্তীর্ণ আকাশ এর প্রতিটিরই বিষয় যা জয়নুলের নিসর্গচিত্রেরই এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এছাড়া আছে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে আঁকা দুটি সাঁওতাল জীবনচিত্র (চিত্র ৪১, ৪২)। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি যে একাধিকবার দুমকায় গিয়েছিলেন এসব চিত্র তার প্রমাণ। প্রদর্শনীর জলরং চিত্রমালার একটি বৈশিষ্ট্য হল, এগুলো তাঁর স্মৃতি থেকে স্টুডিওতে বসে আঁকা নয়, স্টুডিওর বাইরে প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অবস্থান করে তাৎক্ষণিকভাবে আঁকা। ফলে এগুলোর মধ্যে ওই তাৎক্ষণিকতার জীবন্ত ভাবটি সুপরিস্ফুট।

আমরা শুরুতেই বলেছি যে, প্রধানত ছাত্রজীবনের এতগুলো জলরং চিত্র প্রদর্শিত হওয়ায় জয়নুলের ওই সময়টাকে আমরা আরও ঘনিষ্ঠভাবে উদ্ঘাটন করতে পারছি। আর জয়নুলের ১৯৩২-পূর্ব কাজের সঙ্গে এতদিন আমাদের কোনো পরিচয়ই ঘটে নি। সে-কারণে এ প্রদর্শনীর রয়েছে একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য। এই উদ্ঘাটনের আনন্দ আমরা দর্শকদের সঙ্গে নিয়ে উপভোগ করতে পারছি, এখানেই এই আয়োজনের সার্থকতা। এজন্যে আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

জয়নুলের আদি জলচিত্র: প্রদর্শনীর ছবি
বড় আকারে দেখার জন্য ছবিতে ক্লিক করুন।

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts