ফ্রাঙ্কো ফেররুচি : ছুটির মত্ততা

সোহরাব সুমনসোহরাব সুমন
Published : 9 Feb 2022, 06:40 PM
Updated : 9 Feb 2022, 06:40 PM


ফ্রাঙ্কো ফেররুচি (১৯৩৬-২০১০) ছিলেন একাধারে একজন ইতালীয় ঔপন্যাসিক, দীপ্যমান প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক। তিনি ১৯৩৬ সালে ইতালির পিসা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। উনিভারসিতা দি পাভিয়া থেকে স্নাতক শেষে তিনি রডগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইতালীয় অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং তিনি ছিলেন বিখ্যাত দান্তে-বিশেষজ্ঞ। তিনি অসংখ্য সাহিত্য সংক্রান্ত প্রবন্ধ, নন্দনতাত্ত্বিক সমালোচনা, এবং বেশকিছু উপন্যাসের রচয়িতা। তার অসংখ্য পুস্তকের মাঝে, হোমার, দান্তে ও শেক্সপিয়ারের আত্মচরিতমূলক গ্রন্থ: দ্য পোয়েটিকস অব ডিসগাইস এর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বইটির ইংরেজি অনুবাদও পাওয়া যায়। তার দ্য লাইফ অব গড প্রথম পুরুষের অনির্দেশ্য বর্ণনাধর্মী একটি বহুল আলোচিত উপন্যাস। লানাত্রা নেল কুরতিলে, ১৯৭১; ইল কাপ্পেলো দি পানামা, ১৯৭৩; আ সুদ দি সান্তা বারবারা, ১৯৭৬; ই স্যতেল্লিতি দি স্যতুরনো, ১৯৮৯; ইল মন্দো ক্রেয়াতো, ১৯৮৬; তার কয়েকটি গল্পগ্রন্থ। আদিও আল পারনাসো, ১৯৭১; ইল জারদিনো সিম্বোলিকো: মোতেল্লি লেতেরারি এ অতোবিয়োগ্রাফিয়া দিল'ওপেরা, ১৯৮০; লেতেরা আ উ রাগেৎসো সুলা ফেলিচিতা, ১৯৮২; ইত্যাদি তার কয়েকটি তথ্য নির্ভর সাহিত্যকর্ম। মিচেল ফুকো'র হিস্ট্রি অব ম্যাডনেস ইন দ্য ক্ল্যাসিকেল এজ, ১৯৬৩; অথবা ওসকার ওয়াইল্ড এর দ্য পোট্রেইট অব ডোরিয়ান গ্রে, ১৯৯৬; সহ বিশ্বসাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য কর্মও তিনি নিজ ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি তার অপ্রকাশিত তথ্যনির্ভর সাহত্যকর্মের জন্য সর্ব প্রথম পিসা জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার প্রেমিও নেৎসিওনালে লেত্তেরারিও পিজা লাভ করেন, এবং ১৯৮৭ সালে মন্দাদোরি থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ইল মন্দো ক্রেয়াতো গ্রন্থের জন্য তিনি ইল প্রেমিও গ্রীনসানে ক্যাভুর পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ২০১০ সালের ৩০শে আগস্ট আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে মৃত্যুবরণ করেন।

মূল: ফ্রাঙ্কো ফেররুচি
অনুবাদ: সোহরাব সুমন

আমি সরু অন্তরীপ পেরিয়ে আসি। ঠিক সেই সময় ছোট্ট উপদ্বীপটি এর একটি বাহিনীর ওপর অপরটির বিজয় উদযাপন করছিল। আর গ্রীষ্মের এক উষ্ণ বিকেলে, আমি আরনো নদী মুখের কাছে, র্তীরেইনো উপকূল পৌঁছাই। আশপাশ জুড়ে যে সকল প্রাকৃতিক ভূমিদৃশ্য আমি ঘুড়ে বেড়িয়েছি তার মাঝে এই জায়গাটি আমার এতোই প্রিয় যে এখানে আসলে আমার মন জুড়ে স্মৃতিরা ভীড় করে। একশত বছরেরও আগের কথা, এই একই বেলাভূমিতে, উপকূলে এক ঝড় আছড়ে পড়ার পর আমি শেলীর দেহ শনাক্ত করেছিলাম। আমি আমার তখনকার যে দুঃখের কথা স্মরণ করলাম এখন তা সুদূর অতীতের এক ঘটনা মাত্র। সময়টুকু আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি, আর আমার কথাগুলো বাতাসের সঙ্গে মিলিত হয়ে, গোলাপ আকৃতির মেঘের তলদেশে, জলকুক্কুটদের কলরবে গুলিয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে। বহু ক্রোশ দূর নয়, অপর এক কবি তখন রাজদ্রোহের কারণে কারারুদ্ধ। সাগরের ধারে ছাউনির ওই কয়েদীদের মাঝে সে যখন তার কবিতাগুলো লিখে, আমি দূর থেকে তাকে দেখি। সম্ভবত এটাই সবচেয়ে ভালো হতো যদি কবিরা বিশ্বকে বদলে দেবার চেষ্টা না করত, মনে মনে এই কথাটা আমি নিজেকে বলি।

আমার যত স্মৃতি আর খেদের তাড়ায়,আমি মারিনা দি পিসার অদূরে বিস্তৃত পাইনবীথির দিকে চলে যাই। আমি ছিলাম সুদীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত আর আমার দরকার ছিল সামান্য বিশ্রাম। দূর থেকে আমি শুনতে পাই পাথরের উপর ক্রমাগত ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ। পাশের গ্রামখানা ছিল দুপুরের নীরবতায় নিমজ্জিত, আর শতবর্শী-প্রাচীন পাইন বৃক্ষ সারির ফাক গলে সূর্যটা আমাকে ছুঁয়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার একটি পাইন গাছ বা একটি বালুকণা অথবা একটি কাঁটাঝোপ নতুবা বৃক্ষশাখায় ঘুমন্ত একটি পাখি হবার সাধ জাগে। এক অদম্য ক্লান্তির কাছে পরাস্ত হয়ে আমি পাইনকুঞ্জের বালুকার পরে টানটান শুয়ে পড়ি। তখনই আমি এমন একটি ভুল করি যার জন্য আমাকে ভীষণ মূল্য দিতে হয়। পাশেই বালির উপর আমি একটা গিরগিটিকে ঝিমাতে দেখি। ওটাকে এতোটাই বিশ্বস্ত মনে হয়েছিল যে শেষে আমি ওর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ি। শৈশবের কোনো স্নানের মতোই আমি আমার গিরগিটি-নিদ্রায় নিমজ্জিত হই। এ ছিল পরিপূর্ণ বিস্মৃতির এক স্বপ্নহীন ঘুম, কোনো জন্তুর জন্য সত্যিকার তন্দ্রা।

যখন জেগে উঠি আমি ছিলাম এক ছোকরার কবজায় যে কি-না খুব কাছ থেকে বড় বড় আর ক্রূর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে ছিল পাইন বাদাম আর অত্যাচারের আশায় জন্তু-জানোয়ারের খোঁজে কুঞ্জবনের ঝোপঝাড়ে ঘুরে বেড়ানো এক পালের গোদা। আমি হতচেতন অবস্থায়, ওপরের দিকে, উন্মাদের মতো লাথি ছুঁড়তে থাকি। পুরু অক্ষিপল্লবগুলোর আড়ালে আমাকে শিহরণে আচ্ছন্ন করা ছোকরার চোখ জোড়া তখন, ফ্যাকাশে সবুজাভ।
আমি বাতাসে গা ঝাড়ি আর তখনও আশা ছিল দঙ্গলটি আমাকে ওখান থেকে চলে আসতে দেবে। আমি ওদের দোটানা ভাবটুকু আঁচ করতে পারছিলাম। ঘাতক দ্বিধান্বিত! হতে পারে মুহূর্তটি বিশ্বের জন্য ঘুরে দাঁড়াবার সূচনা বিন্দু, কিন্তু ছোকরার দল তাদের শিকার হাতছাড়া করে না। খেলা শুরুর জন্য সবকিছুই ছিল প্রস্তুত যেখানে আমাকে হতে হবে শিকার।

হঠাৎ-ই পালের গোদাটা মাটিতে ফেলে দিয়ে তীক্ষ্ণভাবে শানানো একটি ছোরা দিয়ে পুচিয়ে আমাকে ফালা করে কাটতে শুরু করল। কী এক অদ্ভুত শিহরণ। প্রচণ্ড যন্ত্রণা, তারপর কেবল এক মৃদু শিরশিরানি যেন ছুরির ফলা আমার শরীরে প্রবেশ করছে আর রেলগাড়ির ওপর থেকে ট্রেনের বগিগুলো আপনা থেকে একে একে লাইন চ্যূত হয়ে বিচ্ছিন্ন হবার মতো করে, তা অসংখ্য খণ্ডে ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছে। তবে মাথা কিন্তু সবই টের পাচ্ছিল। দেখলেন "আমি"র বদলে আমি বললাম "মাথা"; আর বাস্তবেই "আমি" বলতে আসলে যা ছিলাম তা অসংখ্য টুকরোয় বিখণ্ডিত? সেই অন্তবর্তীকালে আমি ছিলাম বিযুক্ত এবং আমাকে সংযুক্ত রেখেছিল শুধু সেই আঙুলগুলোর সাহায্যে একত্রে আঁকড়ে থাকায় যদিও আমি ছিলাম আস্ত। অদ্ভুত এক মগ্নচৈতন্যে, আমি তখনও সবকিছু দেখছিলাম। ছেলেগুলোর মাঝ থেকে একজন দূরে সরে গিয়ে একটি ঝোপের আড়ালে বমি করে।

আমি এখন সম্পূর্ণ টুকরো করে কাটা, খেলার দ্বিতীয় পর্ব শুরু। খানিক বিরতী দিয়ে, আঙুলগুলোও নিজেকে শিকারের কাছে সঁপে দেয় আর আমার শরীর আতশবাজির মতো বিস্ফোরিত হয়। টুকরোগুলো বালির উপর ছড়িয়ে পড়ে, অন্ধের মতো লাফাতে থাকে; কেবল আমি (আমি বলতে চাইছি, আমার মাথা) নড়ি না, বরং দেখার জন্য ওখানেই বহাল থাকি। যাতে সেই বিনোদনের সবটুকু আমি এড়িয়ে যেতে সক্ষম না হই। আমি আমার নির্যাতকবৃন্দের পানে তাকাই। আমি, এক দন্তহীন বামন কুম্ভির যে কি-না ঘাস, শুঁয়াপোকা আর কীটপতঙ্গ খেয়ে বেঁচে আছি, আমার ওপরকার দৈত্যেরা আমাকে ওদের উৎসুক আর নিমগ্ন চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। ঠিক যেমন করে ঝুলন্ত বহুধা জালে সদ্য আটকে পড়া মাছি মাকড়সার দিকে চেয়ে থাকে তেমনি করে আমি ওদের দিকে তাকাই। সূর্য থেকে লক্ষ কোটি ক্রোশ দূরে, বিশ শতকের এক গনগনে দুপুরে, সাগর আর পল্লী এলাকার মাঝামাঝি, ওখানে ওই পাইনবৃক্ষ সারির নীচে আর আকাশের তলদেশে, অন্তহীন মাত্রার হিংস্রতায় আক্রান্ত একটি শিশু ও একটি মাছির মাঝামাঝি কোনো, অশুভ কক্ষপথের ভেতরে আমি ছিলাম একটি বিন্দু মাত্র।

একটি গিরগিটি রূপে আমার জীবনের চূড়ান্ত উত্তেজনায়, পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ কোনো বাহিনীর মতো, আমি আমার শরীরের সমূহ পেশীর তলব করি, এবং ক্রূর চোখের পাণ্ডুর জন্তুগুলোর ওপর ঝাঁপ দেই। আমার এক একটি টুকরো ওর প্রতিটির ভেতর থেকে খতম হয়, আর আমি ওদের আত্মা সমূহের গোলকধাঁধার সর্পিল পথের বাঁকে হেঁটে বেড়াই। গিরগিটির এই নিপীড়কেরা স্রষ্টার মাধ্যমে হানা দিয়েছিল। একজন আমাকে নেড়ে চেড়ে দেখে। অপর একজন আমাকে বয়ে নিয়ে কোথাও ঘুরতে চলে যায় তাতে করে আমি সব নিশানা হারিয়ে ফেলি, তবে শত হাতে আমার গল্পটা লিখার সময় আবারও আমি তা স্মরণ করতে পারব। তখনও অন্য আরেক জন আমাকে তার আত্মার এক দেরাজে গচ্ছিত রাখে এবং এত দীর্ঘক্ষণ আমার কথা ভুলে থাকে যে পুনরায় তা খুলবার পর সে যে স্মৃতির মুখোমুখি হয় তার কাছে সেটা অন্যকারো মালিকানাধীন বলে মনে হয়।

তবু পাইন বনে আলতো এক চিলতে প্রত্যাশার ইঙ্গিত এইটুকুই যে কেউ একজন বিশ্বের এক কোণে আমার খানিকটা খুঁজে পাবে, তাতে করে আমি আমার অপরিমিত বিস্মৃতি শেষে আবারও নিজেকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো। ওই পাইন কুঞ্জবনে, বলির ঢিবি লাগোয়া, নির্জন এক আশ্রমে ধ্যানমগ্ন এক দুর্ভাগা ব্যক্তির আত্মার মাঝে, আমার একটি অংশ লুকিয়ে রয়েছে। আমি ওখানে যাই আর মাঝে মধ্যেই লোকটির সঙ্গে দেখা করি, আর তার সঙ্গে একত্রে প্রার্থনায় অংশ নেই। প্রার্থনা কালে স্রষ্টা দৃষ্টিগ্রাহ্য কিছু একটা হয়ে ওঠেন। আমি যা আছি তার চেয়ে ভালো কিছু হবার প্রার্থনা করি, অপর দিকে । আমার তপস্বী আস্তিক আমার জন্য প্রার্থনা করে— তাকে কৃপা করো। তাকে কৃপা করো! তার মুখের আদ্যোপান্ত জুড়ে দৃষ্টিগোচর গভীর সারল্যের জন্য, আমার তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। "আমাকে কৃপা করো, যদি তুমি কখনও আমাকে জেনে থাকো," আমি ফিসফিস করে তাকে বলি; "আর আমাকে খুব বেশি প্রশ্ন করো না! আমি ওর সব জবাব না-ও জেনে থাকতে পারি"। তখনই সে অনুভব করে স্রষ্টা নিকটে, একেবারে তার চোখের কাছাকাছি, বিনয়ে সে মাথা নত করে। "সে খুবই অমায়িক," মনে মনে আমি ভাবি। "তপস্বীকতা ভীষণ ব্রীড়াময়। তাই বোধ হয় সে খুব কমই বাইরে বের হবার সাহস করে"।
আমার অপর একটি অংশ একটি বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু আর ফিরতী প্রবীণদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্বময় নিরুদ্দেশ ঘুরে বেড়ায়। তাদের কেউ কেউ ক্ষুধার জ্বালায় পালিয়ে বাঁচে, কেউ কেউ পালায় তাদের নেতাদের নিষ্ঠুরতার কারণে, অন্যেরা ভাগে স্রেফ অস্তিত্বের হেঁয়ালী থেকে মুক্তি পেতে।
আমি আমার পেছনে গতানুগতিক সব চিহ্ন রেখে আসি: শীত ও গ্রীষ্ম, বসন্ত আর শরৎ, হরেক রকম চিঠি যাতে কোনো এক সময় তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। ওর অসংখ্য চিঠি অখোলাই রয়ে যায় আর জীবনের বুনিয়াদ সমূহের মাঝে পুঞ্জীভূত থাকে। একদিন ওগুলো জবাব না দেয়া সব চিঠিপত্রের সঙ্গে পুড়ে যাবে; এবং কাগজের তা, খাম, ডাকটিকিট, ডাক মোহর, কেরানির আঙুলের ছাপ, ভাঁড়ারের ধূলি, যে দেয়াশলাই আগুনটা জ্বালাবে এই একই ভাগ্য বরণ করবে— সবকিছু ভস্মে পরিণত হবে।

মাঝেমধ্যে আমি একটি ক্যাব নিয়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য কোনো শহরে ঘুরে বেড়াই। লিও, স্যান ফ্রান্সিসকো, মস্কো, হংকং-এ আমি এটা করে থাকি। যতটা সম্ভব আমি খুব মনোযোগ দিয়ে সাধারণ জনতাকে দেখি। কল-কারখানায় গিয়ে আমি শ্রমিকদের দেখি, অফিস-আদালতে গিয়ে আমি কর্মব্যস্ত লোকগুলোকে দেখি। সাধারণত লোকেরা আমাকে নিয়ে কী ধারণা করছে তা না বুঝেলেও, আমাকে নিয়ে তারা কীভাবে ভাবছে তা আমি ঠিকই আঁচ করতে পারি। ওরা ওদের ঘড়িগুলোর দিকে তাকায়, আর জানে না ওরা আমার কথাই ভাবছে। ওরা ওদের প্রেমিকাকে আদর করে, আর ওরা জানে না যে ওরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে। ওরা একটি স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার পর এরইমধ্যে তা ভুলে বসে থাকে, আর ঠিক এটাই সেই মুহূর্ত যখন তারা আমার সবচেয়ে কাছের। লোকেদের ওসব জায়গায় ছুটোছুটি করা উচিত নয় যেখানে শুদ্ধাচার উদযাপিত হয়! আমাকে রোলগাড়ী অথবা সাক্ষাতের স্থানগুলোর বদলে ওখানে দেখতে পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রায়ই আমি নিজের সম্পর্কে সচেতন হবার জন্যে মনোযোগি হই। এর সহজ কৌশলটা হলো কোনো বস্তুতে পরিণত হওয়া: আস্ত একটি পাহাড়, হোটেল কক্ষের কোনো আরামকেদারা, একটি কল থেকে ঝরে পড়া এক ফোঁটা জল। কিন্তু যখনই আমি বিশ্রামে থাকি, আমার সঙ্গে বিস্ময়কর কিছু একটা ঘটে। আমি বিচলিত বোধ করি আর নিজের ভেতরে এক চাপা আগুন, অথবা প্রান্ত ঘেঁষে গলতে থাকা তুষারের মতো এক তাড়িত শক্তি অনুভব করি। আমার মনে পড়ে জাপানের ওপর আমার বিস্ফোরিত হবার সময়, আমি আমার সমস্ত কণার শক্তি অবমুক্ত করি, বোমাখানি আস্ত একটি পিষ্টকের চেয়ে খুব একটা বড় ছিল না। পুনরায় একটি ব্যাঙের ছাতা আকৃতির মেঘে উদয় হলে পরে, আমি প্রচণ্ড বেগে ছুটে ধরণী থেকে দূরে সরে আসি যাতে করে আমার অব্যহত বিলাপ আর অনুশোচনা নীচের ওই, ক্লিষ্ট নরক যা ছিলাম স্বয়ং আমি নিজেও, শুনতে না পায়। আমাকে যে ফেলেছিল সেই বৈমানিকের সঙ্গে আমি পাকড়াও হই, সেই অজ্ঞাত পিতার মতো যে কি-না আমাকে আমার নিজস্ব মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য সময়ে সময়ে আমাকে শূন্যে পরিত্যাগ করে। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই কিন্তু সফল হই না। আমি ক্রু সমেত পৃথিবীতে ফিরে আসি, সামরিক বিমানের কোণ থেকে ওদের বিদ্রুপ শুনতে শুনতে, সারি সারি মেঘের পানে তাকাই যার মাঝ দিয়ে আমরা ত্বরা করে ছুটে চলা ব্যতিব্যস্ত দেবদূতেদের মতো অগ্রসর হচ্ছিলাম।

কেনো টেলিভিশন সেটের সামনে বসে থাকার সময় আমার নিজস্ব স্মৃতি আমার কাছে ফেরত আসে তার কারণ আমি জানি। এর কারণ, দেয়ালের একটি ফুটোর মধ্যে বসবাসরত কোনো মাকড়শার মতো বা ছায়াপথ সমূহের এড়োপথগুলোর কোনো নাক্ষত্রিক সংকেতের মতো, আমি নিজেও ওখানেই বসবাস করি, অনুষ্ঠান সমূহের অবকাশের মাঝে। টেলিভিশন আর পারমানবিক বোমা এরা আমার অস্তিত্বের আলাদা কিছু চিহ্ন, এবং উভয়েই দৃষ্টিগোচর করে আমার সমগ্রতা উপলব্ধি করা কতটা কঠিন; ওই বোমা রূপে, আমি আমার অপর এক অংশের পরে বিস্ফোরিত হই। প্রতিবার আমি এই ছোট্ট পর্দায় ব্যাঙের ছাতা আকৃতির মেঘ দেখি, আমি নিজেকে জীবনের মঞ্চে উঠে আসতে দেখি, অবিকল যেন কোনো একটি দিনের প্রত্যুষ যখন বার বার করে প্রতিবার সবকিছু আবারও প্রথম থেকে শুরু হয়। এভাবে যখন আমি নিজেকে মুকুরিত করি, আমি বরং কোনো সরোবরের একটি কুসুম হয়ে উঠি— এতোটাই প্রশান্ত ও সতেজ আর নভোনীল আলো সমেত ক্রমশ ব্যাপ্ত— অথবা স্কুল শেষে বাড়ী ফেরার পথে কোনো শিশুর মুখে আইসক্রিমের উপাদেয় সুগন্ধ।

আমি পরীক্ষাগারে লুকিয়ে থাকি যেখানে প্রকৃতির কলকব্জাগুলোকে কাজে লাগানো হয়, আর আমি এমন একটি প্রাণীর ধারণায় বুদ হয়ে থাকি যা ওর নিজ দেহের দেহযন্ত্র সমূহের মতোই সৌন্দর্য ও জ্ঞান পুনরুৎপাদনে সক্ষম। তারপর আমার মনে পড়ে যে সৌন্দর্য আর জ্ঞান সম্ভবত অস্তিত্বের যন্ত্রণার বিরুদ্ধে প্রতিকার হয়ে থাকতে পারে। যে জগতে ভোগান্তি নেই সেখানে ওরা কী করবে? আমি এখন এবং চিরতরে বিশ্বের যাবতীয় অসম্পূর্ণতার দক্ষ কারিগর।

আমি আরোগ্যনিকেতন সমূহে যাই যেখানে লোকেরা মৃত্যু বরণ করে। কেউ কেউ এতে দীর্ঘ সময় নেয়, কেউ কেউ মুহূর্তেই মরে। মেয়েটা একটি নীল জিনস আর একটি সুতির সোয়েটার পরা ছিল। চোখে কালো চশমা তাই আমি ওর চোখের ভেতরটুকু দেখতে পারিনি। আমি প্রসূতি অংশের দিকে অগ্রসর হই আর শিশুদের জন্ম দেখি। পৃথিবীতে আগমনের জন্যে কী যে প্রাণান্তকর লড়াই! জীবন সবসময়ই এখানে, আর মেয়েটার বোন মিলনায়তনের দিকে নেমে গেলে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু ওর চোখগুলো এখন আর লুকোনো নয় তাই আমি ওদের দিকে তাকাই। ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যু আসে আর একটি শিশু বা মা অথবা ওদের দু'জনকেই নিয়ে ভাগে। যখনই এরকম কিছু একটা ঘটে, দুই বোনের কেউ এমনকি পরস্পরের চোখের পানে পর্যন্ত তাকায় না। যা করণীয় ওরা তাই করে।

পৃথিবীতে কী ঘটছে এ সম্পর্কে যদি আমি আগের চেয়ে আরো বেশি কৌতুহলী হয়ে উঠি, তাহলে অবশ্যই এর কারণ হবে আমার প্রস্থানের কাল নাগালে চলে এসেছে এমন একটি সিদ্ধান্ত। এরই মধ্যে আমি স্মৃতিকাতরতায় ভুগতে থাকি। কিন্তু আমার সংকল্প সম্পর্কে আমার কোনো দ্বিধা নেই। আলো হবে আমার পরিবহনের মাধ্যম, আর আমি মহাবিশ্বের প্রান্ত নাগাদ নিরবিচ্ছিন্নভাবে গমনের জন্য একটি খোলা টিকিটের অধিকারী হবো। অনাগত এক পৃথিবীর পানে এ এক একমুখী টিকিট যেখানে আমি আমার সুদীর্ঘজীবনের বিগত পরিণতির মাঝে বিশ্রাম নিতে চাই। আমি আর শৈত্যের ভয়ে ভীত নই।
প্রেমের জন্য অতীত-আর্তি আমাকে বিশেষভাবে আবেগ প্রবণ করে তোলে। প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রমোদ-উদ্যানের বেঞ্চিগুলোতে বসে থাকে, একত্রে বিছানায় শুয়ে থাকে, দূরে চলে গেলে একে অপরের অভাব বোধ করে, ওরা সব সময়ই আমাকে তাদের পাশে পেয়েছে, আর ওরা তা বেশ বুঝতেও পেরেছে। আমি শিশুদের দিকে তাকিয়ে, খেলার স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে যাই, সৃষ্টির প্রান্ত ধরে হেঁটে এসে, আমার দরজার কড়া নাড়ি। আমি ঘাসের উপরে বসি, আর আমি অদৃশ্য, তবে আমি ওদের সবার দ্বারা অনুভূত হই।

আমার যত পরিকল্পনা, অন্তত আমার প্রস্থান ব্যর্থ হতে দেয়া যায় না। নির্ভরযোগ্য পরিকল্পনা প্রনয়ণের জন্য আমি কম্পিউটর ব্যবহার করি, কর্মক্ষম ও উচ্ছৃঙ্খল মানব জাতির সবচেয়ে আধুনিক উপহার। একটি এ্যাটাশে কেসের চেয়ে অতিরিক্ত কোনো জায়গা এ নেয় না, তাই লটবহর সমস্যার সমাধান হলো। তারপরও, আমি লোলুপ দৃষ্টিতে আরও হাল আমলের মডেলগুলোর দিকে নিজেকে তাকিয়ে থাকতে দেখি, নোটবুকগুলো আরো বেশি বেশি স্মৃতি ধারণ করছে, ক্ষুদে একটি চাকতির মাঝে কতগুলো আস্ত শতাব্দী। এমনকি এধরনের স্মৃতির ক্ষুদ্র একটি অংশও সংগ্রহ করে একজন মানুষ কী করবে? এই প্রশ্নটি যদি আমি একটি কম্পিউটরের কাছে রাখি, তা ঝলকে ওঠে আর পিট্ পিট্ করে বন্ধ হয়ে যায়, কেননা আমার প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। এর চেয়ে নিরর্থক জিনিস আমি কখনই দেখিনি। এটা আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হতে পারে যদি তা না হয় তার কারণ হবে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে এর অতিশয় অক্ষমতা। আমার যদি পরামর্শের দরকার হয় তখন কী হবে?

আমি গিয়ে ইতস্তত চারদিকে ঘুরে, দরজাগুলো বন্ধ করি, বাতিগুলো নেভাই। চলে আসার আগে গাছে পানি দেয়ার অনিশ্চয়তাবোধ থেকে আমি একাধিক জায়গায় উপচে সেচ দিয়ে ফেলি। আমার আসবাবপত্র নাড়াচারা আর দেরাজগুলো খালি করতে গিয়ে সম্প্রতি যে ভূমিকম্পগুলো সংগঠিত হয়েছে আমার দিক থেকে আরো অধিক সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে তা এড়ানো যেত। এর জন্য আমি দুঃখিত।

আমি বইগুলো সরিয়ে নেই, আমি গান বন্ধ করি, আমি ছবিগুলো দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে রাখি। সংঙ্কেতের প্রতি অনুগত হয়ে, মনুষ্যজাতি বলতে গেলে উদ্ভাবন প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, আর অতীত গলধকরণ করে টিকে আছে। সঙ্গীতের পরিত্যক্ত টুকিটাকি এবং ছবির টুকরোগুলো প্রস্থানের বিশ্রাম কক্ষটিকে এমনভাবে অলঙ্কিত করেছিল যেমনটা বিশ্ব পরিণত হয়েছে। বিপণীবিতান ও সুপারমার্কেট সমুহের মজুদ সৃষ্টিজগতের প্রতিচ্ছবি সংরক্ষণ করে— অকেজো আর বিস্মৃতির অফুরন্ত পণ্যাগার।

বিমানবন্দরের কন্ট্রোলটাওয়ারের মতো, নিউ ইয়র্কের গগনচুম্বী ইমারতগুলো অনবরত তুঙ্গে উঠছে। নিজেকে আমি প্রায়ই ওদের চূড়াগুলোতে খুঁজে পেয়ে, সঠিক পথ ধরতে, আমার গমনের খসড়া প্রস্তুত করি। নিজেকে আমি খেয়ালী যত অনুমানের মাঝে হারিয়ে ফেলি। কী ঘটবে তখন যদি আমি দু'টি চিন্তাশীল প্রাণী সৃষ্টি করি? সম্ভবত সবকিছু তখন অপেক্ষাকৃত আরও ভালোর দিকে মোড় নেবে। দৃষ্টান্ত সরূপ, আমি ভাবি, মানুষ ও সারমেয় পাশাপাশি হাঁটছে আর স্রষ্টার অস্তিত্ব বা অনুরূপ কোনো বিমুগ্ধ বিষয়ে কথা বলে, তাদের একে অপরের সম্পর্কে ভীষণ বৈরী অনুভূতিগুলো অতিক্রম করবার চেষ্টা করছে। শৌব গঠনশৈলী এবং খেঁকশিয়াল ও শৃগাল একই প্রজাতির স্বত্বাধীন কি-না চলমান এমন একটি বিতর্কসহ লুব্ধক বিকাশের প্রতিটি রীতি-পদ্ধতিতে বিশ্ব অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কুকুরেরা হয়তো আমাকে সেইন্ট বারনার্ড বর্গের বা পাহাড়ী নেকড়ের মতো কিছু একটা ভাববে।

আমার চলে যাবার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যদিও এ নিয়ে আমি খুব একটা কথা বলিনি। কেউ কেউ ধাক্কাধাক্কি আর হুড়োহুড়ি করে এব্যপারে তাদের প্রতিক্রিয়া জানান দেয়, যেন ভাবছে তারাও যেতে পারবে আর পোতে আরোহণের জন্য কক্ষ খুঁজে পাবেনা বলে শঙ্কায় আছে। কেউ কেউ ভাবে আমার পাশে একটুকু জায়গা পাবার ক্ষেত্রে দরিদ্রতা তাদের জন্য অন্তরায় হয়ে উঠবে তাই অর্থ সঞ্চয়ে যথাসাধ্য সচেষ্ট হয়। কেউ কেউ গ্রীষ্মের সময় উন্মত্তের মতো ঘুরে বেড়ায়, সম্ভবত প্রশিক্ষণটা ওদের সবার সার্থক পর্যটনের উদ্দেশ্যে।

আমি আমার রওনা হবার দিনক্ষণ স্থির করি। এক মল্ল-ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দেখার সময় আইডিয়াটা আমার মাথায় আসে। চীনের এক হারিকেন আর মেসসিকান (মেক্সিকান) উপসাগরে কানাডীয় হাঁসের পরিযান এই দুয়ের মাঝপথে, খানিকটা বিশ্রামের আশায়, বার্সেলোনার স্টেডিয়ামটায় থামি, আমার প্রিয় এথলেট ইভেন্ট : খুঁটি লাফ (পোল ভল্টিং) আর শত মিটার দৌড় দেখতে। এ দুটোই ছিল মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর, আর খুঁটি লাফে একটি বিশ্ব রেকর্ড অর্জিত হয়। ঠিক যেভাবে খুঁটি লাফিয়ে ব্যক্তি, করতালি দেয়া দর্শকদের মাঝ দিয়ে তার চিহ্নীত গতিপথ ধরে ছুটে, অবিকল আমিও সেই ইভেন্টের সবশেষ রেকর্ড স্থাপনের দিন চলে আসবো বলে সিদ্ধান্ত নেই— এবং সকল প্রতিযোগিতার জন্যই দিনটি আসবে। আমি খবরের কাগজে খেলার পাতা খুলি আর আমার পর্যটন পরামর্শ মিলিয়ে দেখি। রেকর্ডটা হলো পাঁচ মিটার নব্বই, ছয় মিটার বারো, ছয় মিটার বিশ! ঠিক যেভাবে উলম্ফনকারী তীর্যক খুঁটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তেমনি আমিও প্রত্যাশায় শিহরিত হই।

এক সৌম্য অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে। এখন গ্রীষ্ম। আমি জলারাশি, অরণ্য আর হিমবাহের ওপর দিয়ে কলোরাডো হতে আলাস্কার পানে উড়ে যাই। সূর্যটা সারি সারি মেঘের চিড় ভেদ করে। আমি শ্বেতকায় কার্পাসের মাঝ দিয়ে উঁকি দেই তখনই আমার চারপাশ ঘিরে থাকা অন্তহীন এক নীল গোচরে আসে। এমন সৌন্দর্য ছেড়ে আসা খুব সহজ নয়।
বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো দিয়ে বিভাজিত হয়ে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় যত প্রার্থনা আমার কাছে পৌঁছায়। ওসব কথা আমি খুব সামান্যই বুঝে উঠতে পারি।
রাইমন্ড রোজেনথাল ও ফ্রাঙ্কো ফেররুচি অনূদিত