আলেহান্দ্রা পিজারনিকের তিনটি কবিতা

সামসাদ মর্তূজাসামসাদ মর্তূজা
Published : 10 March 2022, 05:04 PM
Updated : 10 March 2022, 05:04 PM


নীরবতা

সব যেন অন্য এক ভাষায় যা আমার অজানা।
-লুইস ক্যারোল ('থ্রু দি লুকিং গ্লাস')

পৃথিবীর সব ব্যথা আমি অনুভব করি ভিনদেশি ভাষার মতো।
– সিসিলিয়া মেইরেলেস

তারা বেশ বিচ্ছেদের চরিত্রে অভিনয় করে চলে।
– মি'শঅ

কেউ কিছু একটা হত্যা করে গেলো ।
– লুইস ক্যারল ('থ্রু দা লুকিং গ্লাস')

১.
এই ছোট নীল পুতুল — পৃথিবীতে আমার দূত।
বাগানে এক অনাথ মেয়ে বৃষ্টির মতো ঝরছে
যেখানে লাইলাক রঙের এক পাখি গোগ্রাসে খায় লাইলাক,
আর গোলাপি রঙের এক পাখি গোগ্রাসে খায় গোলাপ।

বৃষ্টির ভেতর ঘুরে বেড়ানো ছাই রঙের নেকড়েকে আমার খুব ভয়।
দেখা যায়, নেয়া যায় তাকে — কিন্তু বলা যে যায় না।
শব্দরা সব দরজায় দিয়েছে ছিটকিনি।

মনে পড়ে যায় সিকামুর গাছের নীচে ঘুরে বেড়ানো। …
কিন্তু নাটকতো থামেনা, আমার ছোট পুতুলের হৃদয় ফুলে ফেঁপে ওঠে বাতাসে।
অসম্ভবে আমার বাস, অসম্ভবে সর্বনাশ।

হায়, আমার অশুভ সব অনুভুতি
বাধা পরে কোন এক প্রাচীন কোমলতায়।

২.
আজকাল কেউ আর সবুজ দিয়ে রং করে না;
সব এখন কমলা।
নিষ্ঠুরতা এখন আমার একমাত্র পরিচয়।
রঙেরা নীরব আকাশে ছড়িয়ে পড়ে পঁচে যাওয়া পশুর মতো।
আর তাই নিয়ে কেও আবার কবিতা লেখার চেষ্টা করে — মাত্রাহীন, বর্ণহীন, তেঁতো আর খাঁপছাড়া।
(চুপ, আলেহান্দ্রা! বাচ্চারা ভয় পাবে তো !)

৩.
কবিতা হলো সেই স্থান যা রেখে যায় দাগ।
আমিতো আমার সেই ছোট নীল পুতুল না যা এখনো পাখির দুধ খায়।
সেই ভয়াল সকালে তোমার কণ্ঠস্বরের স্মৃতি
আঁকড়ে থাকে কাছিমের চোখে ঠিকড়ে আসা সূর্যের আলোয়।

আমার বোধের আলো ছড়িয়ে পড়ে সেই সবুজেরও আগে তোমার কণ্ঠস্বরের স্মৃতির কথা ভেবে—
সমুদ্র আর আকাশের এই বিয়ে – কেমন দৈবিক!

আর আমি তৈরী হই মৃত্যুর জন্য।


শিরোনামহীন

কথা বলতে চায় সে, কিন্তু আমিতো জানি কি সে। সে ভাবে ভালোবাসা মৃত্যুর আরেক নাম — যদিও ভালোবাসাহীন সব কিছুতে তার প্রবল ঘেন্না। তার ভেতর যতক্ষণ প্রেম ততক্ষণ সে নিষ্পাপ, তাহলে কি দরকার কথা বলার? দুর্গের মালকিন, সর্বনামের আয়নায় চালায় আঙ্গুল।

প্রতিটা শব্দ লেখার সাথে সাথেই আমার মনে পড়ে যায় সে শূণ্যতা যা আমাকে বাধ্য করে লিখতে অথচ তোমাকে আসতে দিলে তা হয়ত আর হত না।

কবিতার পশে এসে দাঁড়াই আমি। সে নিয়ে যায় সব জীবিতের ঘর ছেড়ে অন্য কোন এক প্রান্তে। আচ্ছা সব ফেলে যখন অদৃশ্য হব–কোথায় থাকব আমি ?

কেও বোঝেনা আমাকে। আমার যা কিছু থাকে তোমার অপেক্ষায়, তার পরেও আমি শিকার করি কবিতার রাত্রি । আমার কবিতার শরীর ভাঙা গড়ার সময় মনে পড়ে শুধু তোমার শরীর যা আগে থেকেই রয়েছে ভেঙে।

অথচ কেউ বোঝেনা আমাকে। আমি জানি ভালোবাসা আর জীবনকে হতে হবে বদল। মুখোশের আড়ালে জন্তু আমার মুখে এহেন উক্তি শব্দ আর ছায়ার মাঝে এক আত্মীয়তা নির্দেশ করে । আর সেখান থেকে উৎসারিত হয় মানবতাকে ধ্বংসকারী এক ভীষণ ভয়াবহতা।


সারা রাত ভরে আমি পানির কান্নার শব্দ শুনি

সারা রাত ভরে আমি পানির কান্নার শব্দ শুনি। সারা রাত ধরে আমি আমার ভেতর তৈরী করি রাত, আমি তৈরী করি দিন —যার শুরু আমাকে ঘিরে; সে কাঁদে কারন সারা রাত ভরে দিন ঝরে পড়ে পানির মত করে।

সারারাত ধরে আমি শুনি সে আওয়াজ যা কিনা আমাকে খুঁজে ফিরে। সারারাত ধরে তুমি আস্তে আস্তে আমাকে ছেড়ে চলে যাও যেমনি করে আস্তে আস্তে ঝরা পড়া পানি ডুকরে ডুকরে কাঁদে। সারারাত ধরে আমি লিখে যাই আলোকিত বার্তা, বৃষ্টির বার্তা —সারারাত ধরে কে জানি আমার খবর রাখে, আর আমি খবর রাখি তার।

বিষাদ আলোর ধারে বারবার ফিরে আসা এই আওয়াজের জন্ম আমার নির্ঘুমতায়। সে আওয়াজ একজনের যে আর এখন কোথাও যায় না, লেখেও না। সারা রাত কে জানি পিছু টানে, তারপর পেরিয়ে যায় তিক্ত এক আলোর চক্র।

সারারাত তোমার চোখ হারিয়ে আমার চোখ হয়ে যায়। সারারাত আমি আমি এগিয়ে যাই সে ছিন্নমুল বসতি যেখানে রয়েছে আমার নীরবতার বৃত্ত। সারারাত আমি দেখি কে যেন আসছে ধেয়ে আমার চাহনির পাণে, নীরবতা ভাঙা ভেজা আর কান্না জড়ানো।

আবছা অনুপস্থিতি গাঢ় থেকে গাঢ় হয়ে অন্ধকার নামে। রাত সে যেন মৃত্যুর চোখের পাপড়ি, ভয়ানক সেই রাত থেকে নির্গত কালো তেল আমাকে ঠেলে দেয় এক বিরান স্থানের খোঁজে যেখানে নেই উত্তাপ, নেই শীতলতা। সারারাত আমি পালিয়ে বেড়াই কোন একজনের কাছ থেকে। তাড়িয়ে বেড়ানর শীর্ষে আমি, বিচ্ছেদের সুরের শুরুতে আমি। আমার গলায় বিরহের গান। রাতের কালো চাদরের উপর কালো পাখির দল। আমার মস্তিস্কে কান্নার ক্ষরণ। স্মৃতি ভুলানিয়া বাতাস। আমার উত্তেজিত হাতকে আমি সামলে নেই। এই নিরন্তর কান্না ছাড়া আমার কিছুই আর জানার নেই – উদভ্রান্ত এই রাত, এই বিলম্ব, এই অপবাদ, এই খোঁজ, এই অস্তিত্বহীনতা।

সারারাত ধরে এই ছেড়ে যাওয়া আমি, ক্রন্দনরত স্বর আমি। লন্ঠন দিয়ে তাকে খুঁজে যায় ছায়ার আবডালে। হৃদয় এসে ঠেকে উরুর কাছে —সশব্দে, হৃদয় থেকে কোন এক প্রাচীন পানি —যায় হারিয়ে।

সারারাত আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করি "কেন"। সারারাত তুমি বল – "না"।