হারুন আল রশিদের ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’

আনোয়ারুল হকআনোয়ারুল হক
Published : 1 June 2023, 07:27 AM
Updated : 1 June 2023, 07:27 AM

সংসারের কাজের ফাঁকে আমার মায়ের হাতে যে বই দেখেছি- তার ভেতর থেকে আমার প্রথম ভালোলাগা বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বইটি। উপন্যাসটির বিষয় এবং চরিত্র সত্তর দশকের আমার টিনএজ বয়সের বহু রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। এরপর আরও অনেক লেখকের গল্প-উপন্যাসে মন চঞ্চল হয়েছে বটে, কিন্তু বহু বছর ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ নামক উপন্যাসটি আমার হাতে আসার আগে। গ্রন্থটি শেষ করার পরও যার রেশ কাটিয়ে ওঠা যায়নি। কারণ সম্ভবত এই যে, প্রতিবছর বইমেলায় প্রকাশিত অসংখ্য কথাসাহিত্যের ভিড়ে মনোহরা উপন্যাসের প্রাপ্তি দুর্লভ হয়ে উঠেছে বিধায় তৃষ্ণার্ত মনে গ্রন্থটি তৃপ্তি দিয়েছে।

রুদেবিশ শেকাবের জীবন আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া পরিবেশের, একতরফা অনিরুদ্ধ প্রেমকে ঘিরে; যে প্রেম হতাশা থেকে কখনো জেদে, কখনো উদভ্রান্ত দোটানায় রূপ নেয়। যার স্বরূপ বহমান এ সমাজের সর্বত্র। উপন্যাসটি পাঠের সময় রুদেবিশ শেকাবের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা; যেমন-মাতৃহীন শৈশব-কৈশোরে তার বেড়ে ওঠা, একাকিত্বের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত তার বাবার জীবন, খ্যাপাবুড়ির আবির্ভাব এবং পিতার সঙ্গে গোপন সম্পর্ক, লোটাস নামের প্রতারিত নারীর সম্পর্ক-যে তাকে জীবনে প্রথম নারীর উত্তাপ গ্রহণের সুযোগ করে দেয়, গরুচোর লৌহান রুদেবিশের আরেক ভাই-যে কিনা তার পিতার অবৈধ প্রেমের ফসল; ইত্যাদি ঘটনার শৈল্পিক সংযোজন লেখকের সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় বহন করে। আমাদের জানা আছে, উপন্যাসের ক্ষেত্রে শৈল্পিক বোধ প্রতিফলনের প্রচেষ্টা, এর বিস্তার ও বাস্তবতাকে মেলানোর সুচারু কর্মের পথ সহজ নয়। এ কাজটি উপন্যাসে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। দুই খণ্ডে বিভক্ত, সব মিলিয়ে চল্লিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত উপন্যাসে কথক নিজেই তার জীবনবৃত্তান্ত জানিয়ে গেছেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে, রূপকের আড়ালে সহজ এবং সাবলীল সৌন্দর্যের সুতায় গাঁথা ঘটনাগুলো বাস্তবতার সীমা আদৌ অতিক্রম করে না। যার জন্য শেষতক পাঠকের মনোযোগ অটল থাকে।

শিল্প-প্রচেষ্টার এ শক্তি ও দক্ষতা একজন লেখকের জন্য শ্লাঘার কারণ হতে পারে সন্দেহ নেই। তবে, উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রুদেবিশ শেকাব, তার বাবা দিওনিশ শেকাব, পরিচারক নাজিফ প্রত্যেকেই ব্যতিক্রম চরিত্রের। চাচা, নারী চরিত্র লোটাস, প্রেমিকা লুনাভা মিনি, জ্যোতিষী ধ্রোন; এসব চরিত্রের নাম কোনো বাঙালির নয় এবং তাদের ভৌগোলিক অবস্থানও এ ব-দ্বীপ অঞ্চলের নয় বটে, তবে একথা মনে করার কোনো সম্ভাবনা নেই যে-এ উপন্যাসে চরিত্র কর্তৃক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশের নয়। মূলত ব্যতিক্রমী এ রূপকপ্রবণ স্বভাবের জন্য বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ উপন্যাসটি ব্যতিক্রম হয়ে থাকবে। দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রেম মঙ্গল বয়ে এনেছে এমনটি রুদেবিশ শেকাবের জীবনে ঘটেনি। সে প্রেমের অভিলাষে আগুনের শিখা অভিমুখে পতঙ্গের মতো ধেয়ে গেছে।চরিত্রটি স্বল্পায়ু জীবনের, উপন্যাস রচয়িতার বদন্যতায় এই স্বল্পায়ু জীবন বৃদ্ধি পেয়েছে (লেখক এক জায়গায় বলেছেন, রুদেবিশ শেকাবের জন্য আমি প্রাথমিকভাবে ২৮ বছর বরাদ্দ করেছিলাম। যিশু খ্রিষ্টের কথা ভেবে পরে তার আয়ু পাঁচ বছর বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যিশু বেঁচে ছিলেন ৩৩ বছর।) তাতে কথকের ভবিতব্যের কোনো হেরফের হয়নি। এক ব্যতিক্রমীকালে এবং এক ব্যতিক্রমী দেশে (মনে করি, বাংলাদেশ) রুদেবিশ শেকাবের যাপিতজীবন শুরু হয়েছে শত বছর বেঁচে থাকা এবং প্রেমের সুখে যাপন করা জীবনের স্বপ্ন নিয়ে; যা কিনা মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুতে থেমে যায় তার স্বপ্নের নারী লুনাভা মিনিতে এসে। সংক্ষিপ্ত এবং দ্রুততম সময়ের জীবনের পরিণতি সম্পর্কে জীবনের ওপার থেকে রুদেবিশ শেকাবের আত্মদর্শন মনে রাখার মতো। যদিও তা ব্যর্থতার, তথাপি এটাই যেন তার মতো পরিণতি বহন করা অধিকাংশ প্রেমে পড়া যুবক পতঙ্গের অন্তরধ্বনি। উপন্যাসের শুরুতে রুদেবিশ শেকাব অতীত বাচ্যে আমাদের জানিয়ে দেয়, আমি সুখী হতে পারতাম। ‘আমি মানুষের সুখ দেখে বেড়াতাম আর দ্রুত নিজে সুখ পেতে চাইতাম। ভ্যানিলা আইসক্রিম, শীতল পানি বা পাকা আমের মতো। আমি তাকে লাটিমের মতো ঘুরাতে চাইতাম। রাজ্যের মতো জয় আর শত্রুর মতো পরাজিত করতে চাইতাম।’ -(পৃষ্ঠা-১১) উপন্যাসের পরিণতি, সে সুখী ছিল না, সুখী হতে পারেনি। এ হলো বাস্তবতা।

উপন্যাসের এক জায়গা বলেছে সে, ‘শুরুতে আমি তা সাধারণভাবে চাই; না পেয়ে সাধনা করি; না পেয়ে আমি তা মনের জোরে পেতে চাই; না পেয়ে আমি তা কিনতে চাই। কিন্তু আমার পুঁজি অল্প। আমি ভবিষ্যৎ থেকে ধার করি। কিন্তু তার মূল্য ছিল আরও বেশি। শেষ পর্যন্ত আমি তা কিনতে ব্যর্থ হই। (পৃষ্ঠা-১১) বস্তুত গোটা উপন্যাসজুড়ে রুদেবিশ শেকাবের এমনতর অজস্র বক্তব্য তুলে আনা যেতে পারে, যার ভেতর দিয়ে কথাকারের ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গির অনন্য স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। মনে করি, এ ক্ষেত্রে লেখকের নিজের ওপর আস্থা প্রবল, যাতে তিনি হাত দিয়েছেন তাতে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি অসামান্য রূপ-বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। জানামতে, এটি তার দ্বিতীয় উপন্যাস। কাহিনির প্রয়োজনেই রুদেবিশ শেকাব সোজা-সাপ্টা কথা বলেছে। ভাষিক চাতুর্যে নিজেকে ঢাকার কোনো চেষ্টা তার চরিত্রে নেই। যার ফলে পাঠের গতি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে না। সবচেয়ে বড় কথা, উদাহরণ উপস্থাপনার ভঙ্গি এতই আকর্ষণীয় যে, অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যেন! যেমন-স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, পঞ্চাশ বছর পরে এখন প্রায় তিনগুণের কাছাকাছি। তখন রুদেবিশ শেকাবের নিন্নোক্ত বর্ণনার তিক্ত সত্যতা মিলে যায় খুব সহজেই। বলা হচ্ছে, পবিত্র গ্রন্থগুলোর মতে, ঈশ্বর প্রত্যেক জাতিকে একটি করে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন। আমাদের ভাগ্যে পড়ে প্রজনন-ক্ষমতা। আমাদের পুরুষদের শুক্র উর্বর ছিল। আমাদের নারীদের গর্ভাশয় ছিল টেকসই।...নবজাতকের নাড়ি শুকানোর আগে স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের গর্ভবতী করতেন। প্রতিবার মিলনে পুরুষ নারীর গর্ভে একটি, দুটি বা তিনটি এবং কখনো চারটি বা ততধিক সন্তান অঙ্কুরিত করতেন। জন্মনিরোধের কোনো ব্যবস্থাই আমাদের পুরুষদের ওপর কাজ করত না। (পৃষ্ঠা-১৯-২০)

দুই খণ্ডে বিভক্ত উপন্যাসের প্রথম খণ্ডে নারী চরিত্র লোটাস আমাদের অচেনা কেউ নয়। তারও ব্যর্থ প্রেম, সেই সঙ্গে পরিবারের অবহেলা, প্রেমিকের প্রতারণার কারণে আত্মহত্যা বা আত্মমুক্তি লাভের হৃদয়বিদারক বিসর্জনের চিত্র আমাদের সমাজে দুর্লক্ষ্য নয়। দ্বিতীয় খণ্ডে দেখা পাওয়া গেল লুনাভা মিনির। জন্মের পর থেকে জীবনে যে নারীর কথা সে ভেবেছে লুনাভাকে দেখার পর, তার মধ্যে সেই স্বপ্নের নারীকে খুঁজে পায় রুদেবিশ শেকাব। কিন্তু প্রার্থিত নারী তার আয়ত্তে আসে না। বহু চেষ্টার পর সে ততদিনে বুঝে গেছে, যে মরে তার চোখে মৃত্যুফাঁদ পড়ে না! জানা গেল, ওরা দুজন দুই ধর্মের অনুসারী। অর্থাৎ, তাদের প্রেমের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। উপন্যাসে বিষয়টি ব্যাখ্যার বিস্তৃত বিবরণ সব সময়ের মতো লেখকের ব্যতিক্রমী চিন্তার উদ্রেক করে। (১১৪-১১৬) সবশেষে, ঔপন্যাসিক হারুন আল রশিদের ভাষ্যে স্পষ্ট নয়, ব্যর্থতায় ঈর্ষায় দানবে পরিণত হওয়া রুদেবিশ শেকাবের মৃত্যু কেমন করে হয়েছিল! তার এ শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিই উপন্যাসের রচয়িতার সাফল্যকে সুষমামণ্ডিত করেছে এবং অনেকের তুলনায় ব্যতিক্রম শব্দটি তার শিরে যুক্ত করেছে। লেখককে ধন্যবাদ, মনে রাখার মতো একটি সুখপাঠ্য উপন্যাস বাংলাসাহিত্যে তিনি সংযোজন করেছেন। প্রচল নয় এমন ব্যতিক্রমী নামের উপন্যাস ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ কাহিনি প্রেমে ব্যর্থতারই আর একটি অভিনব কাহিনি। যে রচনার শেষে পৃথিবীর সেই চিরন্তন ভালোবাসার কথাটাই লেখক পুনর্ব্যক্ত করছেন, ‘আর ভালোবাসুন। প্রেম করুন। কারণ প্রেম ছাড়া অন্য যে কোনো অনুভূতি অস্থায়ী। স্বর্গে প্রেমের অনুভূতি ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতির স্থান নেই।’ সামগ্রিক এ সত্য প্রকাশে রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন না হয় ব্যর্থ হলো, ক্ষতি কী! দেওয়ান আতিকুর রহমানের নান্দনিক প্রচ্ছদে ঝকঝকে ছাপা ও আঁটসাঁট বাঁধাই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে সৃজন। প্রকাশকাল মাঘ ১৪২৯, জানুয়ারি ২০২৩। মূল্য ৪৫০ টাকা।