দিনের শেষে দেখা যায়, তথাকথিত 'প্রগতিশীল' অমুসলিম এবং শিকড়চ্যুত ও অনুকরণপ্রিয় 'গুড মুসলিম'রা যতটা 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী', তার চেয়ে বেশি 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবিবাদী'।
Published : 09 Apr 2024, 07:23 PM
সামাজিক পরিসরে প্রায়ই একটি বাক্যবন্ধ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 'মনের জানালা খোলা রাখা'। অর্থাৎ, সোজা কথায় : 'মুক্ত মন'। বস্তুত, এই শব্দবন্ধটিও বহুল ব্যবহৃত। এবং, 'মুক্ত মন' শব্দবন্ধটির সঙ্গে 'প্রগতিশীল' শব্দটিকেও অবিচ্ছেদ্য করে দেখানোর প্রয়াস বেশ চর্চিত। দুটোর মধ্যে গভীর ও নিকট সম্পর্ক আছে কি না সেটা পরের বিষয়। কিন্তু, প্রশ্নটা হ'ল এই যে, যারা এই 'নৈকট্য' আবিষ্কার করেছেন তাদের যাপিত জীবনে তার ছায়া কি সত্যিই দৃশ্যমান ? 'মন' যদি একটি 'ঘর' সদৃশ হয় তাহলে সেই ঘরের জানালাগুলো খোলা থাকার অর্থ তার মাধ্যমে স্বচ্ছ আলো ও নির্মল বাতাসের অবাধ প্রবেশ। 'আলো' ও 'বাতাস'-এর কোনও শ্রেণিকরণ বা গোত্র বিভাজন হয় কী? কিন্তু, যারা 'মুক্ত মন' নিয়ে অত্যন্ত সরব, গভীর পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ওই 'অপরূপ কর্ম'টি করে থাকেন! অর্থাৎ, 'মুক্ত মন' অনিবার্যভাবে যে 'মুক্ত চিন্তা'র জন্ম দিতে সক্ষম, দেখা যায় যে, সেই 'মুক্ত চিন্তা'ও বহু পাঁকে পূর্ণ !
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। 'মুক্ত মন'-এর সঙ্গে 'প্রগতিশীলতা'র সম্পর্ক কোনও ঐকিক নিয়মে অবিচ্ছেদ্য না-হলেও এটা স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে, যিনি 'মুক্তমনা' হবেন তিনি 'প্রগতিশীল'ও হবেন। কিন্তু, এখানেও যে সমস্যাটা ঘনিয়ে ওঠে তা হ'ল, 'প্রগতিশীলতা'রও একরৈখিক বয়ান নির্মাণ। অর্থাৎ, এখানেও সেই 'শ্রেণিকরণ' করার প্রবণতা। এটারও কারণ ওই, যথার্থ 'মুক্ত মন'টি আয়ত্ত করতে না পারা। 'খাপ' বা 'খোপ' উত্তীর্ণতাই তো 'মুক্ত মন'-এর অন্তর্গত নির্যাস, যা তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তিদের মধ্যে অদৃশ্য ! অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত চিন্তার শৈলী না বদলাবে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বচ্ছতা আসবে ততক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভ্রান্ত চর্চাও চলতেই থাকবে ।
চোখ ও কান খোলা থাকলে এবং বিশ্লেষণ করে দেখতে পারলে স্পষ্টই বোঝা যাবে যে, সমাজ পরিসরে যাদের আমরা উদার, মুক্তমনা, প্রগতিশীল ভেবে থাকি, তাদের অধিকাংশেরই উদারতা ও প্রগতিশীলতা বিচিত্র ধরনের। তাদের কথিত উদারতা ও প্রগতিশীলতার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে মিশে থাকে সংকীর্ণতাও। মুসলিমদের প্রতি তাদের সহানুভূতি মিথ্যে নয়। কিন্তু, ইসলামবিদ্বেষের দুটি রূপ আছে--স্থূল ও সূক্ষ্ম। তাদের দৃঢ় অবস্থান দ্বিতীয়টিতে। অর্থাৎ, তারা সূক্ষ্ম ইসলামবিদ্বেষ মনে লালন করেন বলে মুসলিমদের কল্পনা করেন এভাবে : মুসলিমরা তাদের প্রাপ্য মানবাধিকার পাক, কিন্তু তারা যেন ইসলাম থেকে দূরে থাকে! অর্থাৎ, এই অলীক কল্পনাটির অর্থ হ'ল, মাছকে আঁশ ছাড়া অথবা জল ছাড়া ভাবা! বুদ্ধিভ্রষ্ট না হলে এই আজব কল্পনা সম্ভব নয় ! স্থূল ইসলামবিদ্বেষীরা মাছের অস্তিত্বই মানতে নারাজ। কিন্তু, এরা মাছের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও আঁশ অথবা জল ছাড়া মাছের যে কল্পনাটা করেন তার সঙ্গে ওই স্থূলতার কোনও পার্থক্য আছে কী? মজার বিষয় হ'ল, এরা যথেষ্ট জ্ঞানী মানুষ হলেও ইসলাম সম্পর্কে এদের জ্ঞান অত্যন্ত ভাসাভাসা, যাকে কার্যত অজ্ঞতাই বলা চলে! বলাই বাহুল্য, অজ্ঞতা আর বিদ্বেষ হাত ধরাধরি করে চলে!
বহুল উচ্চারিত মূলস্রোতে নিয়ে আসার যে ব্যগ্রতাকে 'প্রগতিবাদ' হিসেবে চিহ্নিত করার নিদারুণ প্রয়াস তা আসলে নিতান্তই একটা ভেক মাত্র ! মুসলিমদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য! কিন্তু, সেটা তো আর বলা যায় না! তাই 'মূলস্রোত', 'প্রগতি' ইত্যাদি হরেক 'মনোলোভা গাজর' সামনে রাখা হয়! 'স্থূল-ইসলামবিদ্বেষী'দের থেকে এরা মারাত্মক! কারণ, 'বন্ধুর ছদ্মবেশ' বলে একটা কথা আছে! এবং, 'মোগাম্বো' কিসে 'খুশ' হবে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না!
দিনের শেষে দেখা যায়, তথাকথিত 'প্রগতিশীল' অমুসলিম এবং শিকড়চ্যুত ও অনুকরণপ্রিয় 'গুড মুসলিম'রা যতটা 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী', তার চেয়ে বেশি 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবিবাদী'। প্রকৃতপক্ষে, কোনও 'বাদ' যখন উদার, স্বচ্ছ, ও সহিষ্ণু না থাকে তখনই 'বিবাদ' এসে হাজির হয়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের' প্রশ্নে 'হিজাব' নিয়ে যখন তারা 'ধরাশায়ী' হয়ে পড়লেন, যেহেতু পূর্বাহ্নেই জোরেশোরে আত্মপ্রচার করে রেখেছেন যে, তারা 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী', তখন তারা শুরু করলেন এই 'উদ্ভট' প্রচার--'হিজাব তো মুসলিম নারী পরতে বাধ্য হয়!' এই প্রচারপর্বে এসে তারা আর নিছক 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী' রইলেন না, হয়ে পড়লেন কলহপ্রিয় 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবিবাদী'! এবং, স্বভাবতই এসে পড়ল অনেক প্রশ্ন। প্রথমত, তারা কি মুসলিম ঘরে ঘরে গিয়ে এই মর্মে সমীক্ষা করে দেখেছেন যে, এই বিশেষ পোশাকটি মুসলিম নারীকে পরতে 'বাধ্য' করা হয় ? দ্বিতীয়ত, যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয় যে, 'বাধ্য'ই করা হয়, তাহলেও প্রশ্ন উঠবে, তাতে তাদের কী যায় আসে? সেটাও তো একটি পরিবারের একান্ত নিজস্ব বিষয়। একটি পরিবার কীভাবে পরিচালিত হবে সেটা কি তারা ঠিক করে দেবেন? তাহলে তাদের পারিবারিক জীবনশৈলী নিয়েও যদি কেউ 'নিদান' হাঁকতে শুরু করে সেটা কি তারা মেনে নেবেন? তৃতীয়ত, এখানে একটা 'যোগ্যতা' বা 'অধিকারের' প্রশ্নও ওঠে। কেউ যখন কারোর 'সাতেও থাকে না পাঁচেও থাকে না' তখন সহসা একদিন ধূমকেতুর মতো উদিত হয়ে তার সম্পর্কে কিছু বলার 'যোগ্যতা' বা 'অধিকার'ও কি জন্মাতে পারে? এবার 'বাধ্যতা' শব্দটির তাৎপর্য ও পরিসর বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। বস্তুত, এই শব্দটির সঙ্গে 'প্রয়োজন' শব্দটির একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। আদতে 'বাধ্যতা' সর্বত্র আছে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী 'খোকার ইচ্ছে' কবিতায় দেখিয়েছেন, কীভাবে 'খোকার' সব ইচ্ছেকে 'অবদমিত' করে বড়দের সব আগ্রাসী ইচ্ছেপূরণে তাকে 'বাধ্য' করা হয়! ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি তৈরির ইচ্ছেপ্রকল্পে মনপ্রাণ সঁপে দিতে ছেলেমেয়েদের 'বাধ্য' করা হয়! এবং, 'বড়দের' তরফে অদ্ভুতভাবে এই 'বাধ্যতাগুলির' সঙ্গে ওই 'প্রয়োজন' শব্দটির উল্লেখই করা হয়ে থাকে। গ্যাসের দাম, তেলের দাম ইত্যাদি অগ্নিমূল্য। কিন্তু, সেজন্য কি লোকজন গাড়ি চালানো বা রান্নাবান্না বন্ধ করে দিয়েছে? এখানে তর্ক উঠবে, একদিন তো দাম কমবে, ততদিন কী আর করা যাবে! অর্থাৎ, বাধ্যতা ও প্রয়োজন। অন্যদিকে যে 'কারণগুলির' জন্যে 'হিজাব' একটি 'প্রয়োজন' হিসেবে গণ্য হচ্ছে সেই 'কারণগুলি' বিলুপ্ত হলে 'হিজাব' পরারও নিশ্চয় তখন আর 'প্রয়োজন' হবে না! এখানে বলে রাখা ভাল, গ্যাস বা তেলের দাম কখনও কমলেও ওই 'কারণগুলি' সমাজ থেকে সম্ভবত কোনও দিনই দূর হবে না, অতএব 'হিজাবও অপরিহার্য' বলেই সবসময় গণ্য হবে। এভাবেই দেখা যায়, 'বাধ্যতা' ও 'প্রয়োজন'-এর মধ্যে খুব নিকট সম্পর্ক বিদ্যমান। যদিও শেষকথা হচ্ছে, 'হিজাব'-এর সঙ্গে 'বাধ্যতা'র কোনও সম্পর্কই নেই। সম্পূর্ণ অলীক কল্পনা। কারণ, একটি মুসলিম পরিবারে ধর্মীয় মূল্যবোধ কতটা অনুসৃত হয় তার সঙ্গেই একটি মুসলিম নারীর 'হিজাব' পরিধান সম্পৃক্ত। সেই নিরিখেই তাই 'ভিন্ন দৃশ্য'ও দুর্লভ নয়। আসলে 'গুড মুসলিমরা' মনে করে করেন যে, 'প্রগতিশীল' হওয়ার জন্য 'ধর্মের বাঁধনমুক্ত' হওয়া জরুরি ! অর্থাৎ, তাদের ধারণা মোতাবেক ধার্মিক মুসলমানরা 'প্রগতিশীল' নন। কথা হচ্ছে, 'প্রগতিশীল' কাকে বলে তার মাপকাঠি কোনও অকাট্য বিষয় নয়। অধার্মিক, বকধার্মিক এরা একটা মাপকাঠি দিলে ধার্মিকরাও অপর একটা মাপকাঠি দিতে পারেন। এবং, সেটা ধার্মিকদের প্রদত্ত বলেই পরিত্যাজ্য হতে পারে না।
মা শিশুকে বকলে বা শাস্তি দিলেও শিশু মায়ের কোলেই মুখ লুকাতে যায়, মায়ের আঁচলের ঘ্রাণ নিতেই সে ব্যগ্র থাকে। এর কারণ হ'ল, অবোধ শিশুও বেশ ভালভাবে বুঝতে পারে যে, মায়ের মতো তার 'আপন' আর কেউ নেই। দৃষ্টান্তটি এজন্যেই দেওয়া যে, মুসলিম সমাজের কিছু 'শিক্ষিত' মানুষের মধ্যে নিজের সমাজের মানুষের কঠোর সমালোচনার একটি সদা-ব্যাকুল প্রবণতা দেখা যায়। এ-ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ সংকোচ বা দ্বিধামুক্ত। 'সমালোচনার হেতু' থাকলেও একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেই 'সমালোচনাগুলো' যতটা মুসলিমদের 'সংশোধনের' অভিপ্রায়ে, তার চেয়ে বেশি হ'ল, নিজেকে 'অসাধারণ প্রগতিশীল' প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়! এই 'রোগটা' সমাজ পরিসরে বিরাজমান উপরিউক্ত 'ছদ্ম-প্রগতিশীল'দের 'সঙ্গসুধা'র ফল আর তাদের 'প্রিয়পাত্র' থাকার তীব্র তাড়না থেকে উৎপন্ন! সারাক্ষণ মুসলিমদের 'পিণ্ডি' চটকে যাওয়া এইসব 'শিক্ষিত মধ্যবিত্ত' মুসলিমরা আখেরে কিন্তু না ঘরকা না ঘাটকা গোছের! আপন সমাজেও তারা 'কল্কে' পান না, আর যাদের কাছে পাচ্ছেন বলে ভাবেন সেটা আসলে একটা 'মায়ামরীচিকা' মাত্র! কারণ, আত্মমর্যাদাহীন, চাটুকার মানুষকে সামনে যতই কেউ 'বাহবা' দিক, আড়ালে কিন্তু তারা হাসির পাত্র!
একজন শিক্ষিত ও সচেতন মুসলিম সাধারণ মুসলিম সমাজের কিছু বিষয় যদি সমালোচনার যোগ্য মনে করেন তাহলে তার হৃদয়ে আগে 'সংশোধনের অনাবিল আকাঙ্ক্ষা' ও 'মরমী প্রচেষ্টা' থাকা বাঞ্ছনীয়। ভেবে দেখতে হবে যে, মুসলিম সমাজের 'ভাল'র জন্যেই বলা হলেও কেন তারা অমুক অমুক কথাটা শুনছে না বা শুনল না। বস্তুত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই সমালোচকরা নিজের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, বিচ্ছিন্নতার বোধে, এমনকি সাধারণ মুসলিমদের প্রতি 'ঘৃণার অনুভূতি' নিয়ে বসবাস করেন। একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। সাধারণ মুসলিমরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এটাই বিশ্বাস করে যে, তাদের সঙ্গে ওই সমালোচকরা 'একাত্মতা' অনুভব করেন না। মুসলিম সমাজের প্রতি তাদের 'মমত্ববোধ' আছে বলে সাধারণ মুসলিমরা 'অনুভব'ও করে না। 'আমি তোমাদেরই লোক' এই কথাটা কেবল মৌখিকভাবে নয়, নিজের আচরণ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার 'দায়' অস্বীকার করা যায় না। এইখানেই মায়ের উদাহরণটি প্রযোজ্য। মা শিশুকে বকলে বা মারলেও পরক্ষণেই শিশু আবার মায়ের কাছেই ছুটে যায়। কারণ, মায়ের নিবিড় 'মমতা'র আশ্রয়টিকে সে ভাল করেই চেনে। উল্লেখ্য, কথিত 'মহান সমালোচকদের' মধ্যে 'সহমর্মিতা'র গুণ না-থাকার ফলেই সাধারণ মুসলিমদের সম্পর্কে তারা যেসব 'মূল্যায়ন' করেন সেসব ভুলে ভরা! অতএব, 'সমালোচনা'র আগে 'আত্মসমালোচনা' যে জরুরি এই কথাটা ওই 'মহান সমালোচকরা' বুঝলেই মঙ্গল!