আল মাহমুদ: মৃত্তিকা-মননের সৌরভসিক্ত কবি

আমরা ক্রমাগত আবিষ্কার পুনরাবিষ্কার করতে থাকব তাঁর মহতী কাব্যসম্ভারের লীলাসৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যকে।

হাসান হাফিজহাসান হাফিজ
Published : 15 Feb 2023, 10:59 AM
Updated : 15 Feb 2023, 10:59 AM

ভূমিপুত্র ছিলেন এই কবি। মৃত্তিকার ঘ্রাণ, মননের সৌরভসিক্ত তাঁর কবিতাপুঞ্জ। লোকজীবনের নানা দিক তিনি অঙ্কন করেছেন শৈল্পিক দক্ষতায়। সে এক অভিনব নান্দনিকতা। এই স্রষ্টার নাম কবি আল মাহমুদ। সমকালকে অতিক্রম করে পৌঁছে গেছেন অনাগত কালে। যত দিন যাবে, এই সত্যের দীপ্তি তত বিচ্ছুরিত হবে। আমরা ক্রমাগত আবিষ্কার পুনরাবিষ্কার করতে থাকব তাঁর মহতী কাব্যসম্ভারের লীলাসৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যকে। নিষ্ঠ অনুসন্ধানে খুঁজে পাব বাংলাদেশের আত্মা, ঐতিহ্য, ঋদ্ধ সংস্কৃতি এবং স্বাতন্ত্র্যকে। পোশাকী নাম মূর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এই কবির ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই।

সমকালীন বাংলা কবিতার শক্তিমান কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে (১৯২৪-২০১৮) একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলাদেশে কাদের কবিতা আপনার ভালো লাগে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আল মাহমুদ। অসম্ভব ভালো কবি তিনি। যদিও তাঁর সঙ্গে আমার মত মেলে না। তাতে কী, ‘একবার পাখিদের ভাষা যদি শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর’ এই চরণ যিনি লিখতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই অত্যন্ত মূল্যবান কবি। তাঁর মতামত যা খুশি তাই হোক, সেসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকও ভালো কবি ছিলেন। এছাড়া অনেক আগে বাংলা একাডেমিতে বসে একটা বাচ্চা ছেলের কবিতা শুনেছিলাম। অল্প বয়সে মারা গেছে সে। আবুল হাসান। খুবই ভালো কবি। ওর কবিতা আমার ভালো লাগে। ”

কবি আল মাহমুদের একটি সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ ঈষৎ উল্লেখ করতে চাই এক্ষণে। সেই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বাংলাদেশের কবি ব্রাত্য রাইসু এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবি জয় গোস্বামী।

“রাইসু : মাহমুদ ভাই কি এখন আর স্মরণ করতে পারেন কিনা কীভাবে কবিতা লিখতে শুরু করছিলেন? বা জয়দা?

মাহমুদ: আমি খানিকটা স্মরণ করতে পারবো বোধহয়। কারণ আমি ইশকুলেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম। স্কুলে যখন পড়ি। লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখতাম আমি। আমাদের বাড়িতে, যদিও খুব রক্ষণশীল ধর্মীয় পরিবার, কবিতার একটা জায়গা ছিল। কারণ আমার দাদা কবিতা লিখতেন। তাঁর নাম ছিল আবদুল ওহাব মীর। তাঁর নানা শখ ছিল। লড়াইয়ের মুরগি পুষতেন তিনি, লড়াইয়ের মুরগী। আসলি রাতা। আর কবিতা জারী গান লিখতেন। সারী গান করতেন। যেমন একটা জারী গানের ধুয়া হলো এরকম, ‘পত্র পাইয়া হানিফায়, পত্র পাইয়া হানিফায় শূন্যে দিল উড়া, দুই ভাই মইরা গেল কবুতরের জোড়া।’ এটা একটা ধুয়া। ঘুরে ঘুরে এসে এটা বলতেন। পায়ের মধ্যে ঘুঙুর বাঁধা থাকত। এই পরিবেশে আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম।

রাইসু: জয়দা, মাহমুদ ভাইয়ের কবিতা কেমন লাগে আপনার?

জয়: আমার মনে হয় যে বাংলায় চিরকালের জন্যে যে কবিতা থেকে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি সেই কবিতা উনি লিখেছেন। আমি অল্প কথায় উচ্ছ্বাস ব্যতীত বলতে চেষ্টা করছি। এবং ওঁর কবিতা আশ্চর্য হয়ে যাওয়ার মতন, যে কী করে এমন হয় যে একই সঙ্গে ব্যক্তিগত প্রেমের কবিতার মধ্যে সমগ্র দেশকাল এসে মিশছে। একেবারেই ব্যক্তিগত প্রেমের কবিতা। কিন্তু তার মধ্যে এসে সমস্ত মুহুর্মুহু যাতায়াত করছে। তা একবার ইতিহাসে যাচ্ছে। একবার কালোত্তরে চলে যাচ্ছে, আবার সে একেবারে শরীরে ফিরে আসছে। তানের মত। মানে একটা তান যখন চলে, বড় তান যখন চলে, ধরুন, সেতারে বা সরোদে একটা বড় তান, সেটা তিনটা অকটেভ জুড়ে চলতে থাকে। মধ্য সপ্তক থেকে শুরু হর, একটা নারীকে নিয়ে কবিতা শুরু হলো। ধরুন সেটি মধ্য সপ্তক, তারপর দ্রুত তা চলে এল তার সপ্তকে, আবার চলে গেল মন্দ্র সপ্তকে। এই যে যাতায়াত--একবার দেশকাল, একবার শরীর, একবার প্রেম, বাসনা এসমস্ত কিছু মিলেমিশে একটা জাতির ইতিহাস-- এ সমস্ত কিছুৃ অথচ সে কবিতাগুলো হয়তো লেখা হচ্ছে ধরা যাক ১৪ লাইনের মধ্যে। কুড়ি লাইনের মধ্যে। পুরো জিনিসটার জন্যে কিন্তু, আমার কবিতা লেখার জন্য বড় আয়োজন হয়, দীর্ঘ কবিতা লেখার চেষ্টা করি। খুব ছোট জায়গার মধ্যে, একটি দুটো লাইনের মধ্যে উনি সমস্ত জিনিসটাকে ধরেন। হঠাৎ এক জায়গায় ‘ফসলের সুষম বণ্টন’ টাকে নিয়ে এলেন এমন একটা কবিতার মধ্যে, আবার পুরাণের মধ্যে ফিরে গেলেন, ব্যক্তিগত, যে, ‘পৌরুষ আবৃত করে জলাপাইয়ের পাতাও থাকবে না’ ওর মধ্যে চলে গেলেন উনি।

আবার তার মধ্যে আমাদের যে রিচ্যুয়ালগুলো, আমাদের যে এই প্রথা, বধূবরণের বিভিন্ন প্রথা বা ইত্যাদি এইসব জিনিসগুলোকে মিলিয়ে দিচ্ছেন, এমন করে মেলাচ্ছেন যে সেইটা কিন্তু একটা চিরকালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এইটা একটা মস্ত বড় কাজ। এরকম একজন কবির সামনে বসে থাকতে পারা ভাগ্য!”

এবার একটু অন্য দিকে ফেরা যাক।

‘কালের কলস’ কবি আল মাহমুদের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৭১ বঙ্গাব্দে। দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয় কলকাতার বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় মননশীল প্রাবন্ধিক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ এই গ্রন্থ এবং পরবর্তীকালে আল মাহমুদের লেখা কবিতা সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘পূর্ববাংলার সাহিত্য: কবিতা’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে (১০ জুলাই ১৯৭১)। গোলাম মুরশিদ লেখেন: “আল মাহমুদের ভাষা একান্তভাবে তাঁর নিজস্ব। যে মগ্নচৈতন্য থেকে ভোরের সহজ আলোর মতো তাঁর অনুভূতি ঝরে পড়ে, তারই উপযোগী ভাষা তাঁর আয়ত্তাধীন। আলো-আঁধারী ভাষায়, আভাসে ইঙ্গিতে তিনি তাঁর হৃদয়ের কথা আধখানা ব্যক্ত করেন,বাকি আধখানা পূরণ করে নিতে হয় পাঠককে। পল্লীর শব্দ ও প্রবাদ প্রবচনকে আধুনিক কোনো কবি সম্ভবত এমন নিপুণ ও শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করেন নি। পল্লীর উপাদান থেকে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর উপমা ও চিত্রকল্প। প্রকৃতপক্ষে, তিনি কাব্যের ভাষাক্ষেত্রে এক অপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছেন। জসীম উদ্দীন যেখানে লোকসাহিত্যের উপাদানের উপর তাঁর কুটির তৈরি করেন,আল মাহমুদ সেখানে আধুনিক এক প্রাসাদের কারুকার্যে লৌকিক উপাদান ব্যবহার করেন। কেননা, আল মাহমুদ অত্যন্ত সংবেদনশীল, সচেতন ও বিদগ্ধ শিল্পী, তাঁর উপলব্ধির গভীরতা জসীম উদ্দীনের তুলনায় অতলস্পর্শী। তদুপরি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত,স্বরবৃত্ত-- ছন্দের এই ত্রিবিধ চলনেই বর্তমান কবির স্বচ্ছন্দ বিহার অনেকের কাছেই ঈর্ষার বস্তু হতে পারে।”

মনস্ক কাব্যপাঠকমাত্রেই জানেন, ‘সোনালি কাবিন’ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৩) কাব্যগ্রন্থে আমরা আবিষ্কার করি অন্য এক আল মাহমুদকে। হৃদয়ছোঁয়া কবিতাপুঞ্জ আমাদের নিয়ে যায় রহস্যমন্দ্রিত এক ভাবনাজগতে, আশ্চর্য শিহরণ, দ্যুতি ও বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এই গ্রন্থের কবিতাবলি। পাঠক ঋদ্ধ ও চমকিত হন, পরিস্রুত আবেগে দোলায়িত হন অনায়াসেই। এ যেন আনন্দে আবেগে মুগ্ধতায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মত ঘটনা। বিশিষ্ট কবি সমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলছেন ‘সোনালি কাবিন’ প্রসঙ্গে--

“সোনালি কাবিন এই দীর্ঘ কবিতার মধ্যে আছে প্রতীকী ভাষণ; নিখুঁত বর্ণনা; আবেগস্পন্দিত স্তবক, বিচ্ছিন্ন সুন্দর লাইন। অতীতের ব্যবহার তিনি করেছেন অতীতের ভিত্তিতে, প্রতিটি পর্বের স্টাইলের মধ্যে যাপন করেছেন, ফলে অতীত হয়ে উঠেছে এক ধরনের বর্তমান। বর্তমান: অতীতকে ইমারতের মতোন গড়ে তোলার জন্য তিনি এক চরিত্র ব্যবহার করেছেন বাঙালি মনোস্বভাবের প্রতিনিধি হিসাবে। ঐ ব্যক্তি বাঙালি, কবি, আবহমান মানুষ, ইতিহাসের মধ্যে হৃদয়ের ইতিহাস গেঁথে দিয়েছেন, জনপদ, শস্য, হৃদয় সবই এক মহাসত্যের বিভিন্ন দিক। আর শব্দ আবহমান, চিরকালীন এবং লোকজ। আল মাহমুদের কৃতিত্ব এখানেই।” [ দৈনিক বাংলা, ২২ জুলাই ১৯৭৩]

মনস্বী কবি সমালোচক মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ও অবিস্মরণীয় এই কবিপ্রতিভাকে সানন্দে শনাক্ত ও অভিনন্দিত করেন তার কাব্যযাত্রার গোড়ার দিকেই। লোকবাংলার কবি আল মাহমুদ সম্পর্কে তিনি লেখেন, “আঞ্চলিক ভাষার শব্দ-সম্ভার এবং বাকরীতি আল মাহমুদের কবিতায় ব্যবহৃত এবং পরিশীলিত মনের স্পর্শে সেগুলো গ্রামীণ হয়েও ব্যবহার কৌশলে বাঙময়। ঐতিহ্যের অনুসারী, বিশেষত তাঁর সনেট আঙ্গিকের কবিতায় প্রচলিত রীতি-ভঙ্গির অনুসরণ লক্ষ্যযোগ্য।” [ উত্তরাধিকার: জানুয়ারি- মার্চ ১৯৭৪]

কবি আল মাহমুদ আমাদের অহঙ্কার। আমরা বার বার ফিরে যাব তাঁর কবিতার কাছে। অন্যান্য রচনার সমীপে। এই কাজ করতে হবে আমাদের আত্মিক সমৃদ্ধি অর্জনের নিমিত্ত, নিজেদের স্বার্থেই।