রবীন্দ্রসংগীতে তথাকথিত ‘অরাবীন্দ্রিক’ শব্দের শক্তি ও সুষমা

একজন শব্দশিল্পীর উচিত সকল সংস্কার ও পূর্বধারণার ঊর্ধ্বে উঠে ভাষার সবটুকু শক্তি ও সম্ভাবনাকে নিংড়ে নেওয়া,

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 7 May 2023, 06:14 PM
Updated : 7 May 2023, 06:14 PM

বাংলা ভাষায় ‘রাবীন্দ্রিক’ এবং তার বিপরীতে ‘অরাবীন্দ্রিক’ শব্দদুটোর বহুল প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এতটাই যে, এই ‘রাবীন্দ্রিক’ শব্দটির একটি সংজ্ঞার্থই প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে। ফলত শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গেসঙ্গে আমাদের মানসলোকে একটি শুদ্ধ, শালীন, প্রমিত, পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত ছবি ভেসে ওঠে। অথচ মজার বিষয়, রবীন্দ্রনাথ নিজেই কিন্তু এই তথাকথিত রাবীন্দ্রিকতার সংজ্ঞা মেনে চলেননি সবসময়, অন্তত ভাষার ক্ষেত্রে। আর এটি সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় তাঁর গানের বাণীতে। বর্তমান নিবন্ধটি এমন কৌতূহলোদ্দীপক একটি বিষয়ের ওপরই কিঞ্চিৎ আলোকপাতের একটি প্রাথমিক প্রয়াসমাত্র। এই উদ্দেশ্যে আমি তাঁর সুবিখ্যাত গানের সংকলন ‘গীতবিতান’ এর পূজা, প্রেম ও প্রকৃতি পর্ব থেকে বেশ কিছু শব্দ, শব্দবন্ধ ও বাক্যাংশের উল্লেখ করব এখানে, যা আমার এহেন মন্তব্যের যাথার্থ্য প্রমাণে সহায়ক হবে বলে মনে করি।

পূজাপর্বের একেবারে প্রথম গান ‘কান্নাহাসির দোল-দোলানো’তেই আমরা একটি অপ্রচলিত শব্দ, ‘আলা’র দেখা পেয়ে যাই, যেটিকে আমরা পরে তাঁর আরও ক’টি গানে, যেমন ‘বলি ও আমার গোলাপবালা’, ‘আমার অভিমানের বদলে’ ইত্যাদিতেও দেখতে পাব। আলোকিত, উদ্ভাসিত অর্থে এই শব্দটির এমন প্রয়োগ সচরাচর দেখা যায় না বললেই চলে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এর প্রয়োগে কুণ্ঠিত ছিলেন না মোটেও। এর কয়েকটি গান পরেই ‘ঝরনাতলার নির্জনে’ আমরা একখানি ‘কলস’ এর সন্ধান পাই, যে-শব্দটিকেও ঠিক ‘রাবীন্দ্রিক’ আখ্যা দেবেন না কেউ, কিন্তু এই নিতান্ত আটপৌরে শব্দটিকেই রবীন্দ্রনাথ ঘুরেফিরে ব্যবহার করেছেন তাঁর আরও অনেক গানে। তেমনি আরেকটি অত্যন্ত ঘরোয়া, সাংসারিক শব্দ ‘ঢাকনা’ খুলে যেতে দেখি আমরা তাঁর বহুলপরিচিত গান ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না’য়। গোটা বাংলাগানের ইতিহাসে আর কোথাও কখনও এহেন এক ‘অরাবীন্দ্রিক’ শব্দের এমন মোক্ষম প্রয়োগ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এই পূজাপর্যায়েরই ‘অসীম ধন তো আছে তোমার’ গানের দ্বিতীয় চরণেই দেখি তিনি বণ্টন অর্থে অবলীলায় ব্যবহার করেন আরেকটি গার্হস্থ্য শব্দ: বেঁটে। তেমনি, ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে’ গানটির একেবারে শেষ দিকে ব্যবহৃত ‘ভুখের পরে’র মতো শব্দবন্ধ প্রয়োগ করতেও বুকের পাটা লাগে বই কি! আমরা অনেকেই যথাযথ পটভূমিটুকু না জেনেই পূর্ণিমাকালে ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’ গানটি গাইতে খুব পছন্দ করি, কিন্তু কজনে খেয়াল করি যে এই গানে রবীন্দ্রনাথ ‘ধুতে হবে, মুছতে হবে’র মতো দুটো প্রাত্যহিক গেরস্থালিকর্মকে কী এক অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে যান! ক্ষালন ও প্রক্ষালনের বিষয়টি অবশ্য তাঁর গানে ফিরে ফিরেই এসেছে; যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, ‘আজ আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও’, ‘তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে’ গানদুটির কথা।

‘দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে’ গানটির কথা ভাবলেই একধরনের ভক্তি ও সম্ভ্রমের উদয় হয় আমাদের মনে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার বিন্দুমাত্র ধার না ধেরে তথাকথিত সুশীল শব্দ ‘মুঠো’র বদলে ‘তোমার মুঠা কেন ভরিনে’র মতো লাইন লিখতেও দ্বিধা করেননি এতে। ঠিক একইভাবে ‘নয় এ মধুর খেলা’র মতো সুমধুর এক সংগীতে তিনি আচমকা কী দারুণ ধাক্কাই না মারেন আমাদের, ‘সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা’ দিয়ে। তেমনি তুলনামূলকভাবে একটু কম পরিচিত গান ‘তুই কেবল থাকিস সরে সরে’তে ঠাকুর প্রমিত ক্রিয়াপদ ‘এগিয়ে’র পরিবর্তে অপ্রচলিত ‘আগিয়ে’ ব্যবহারেও পিছপা হন না। একইভাবে, ‘আমার নয়ন তব নয়নের নিবিড় ছায়ায়’ গানে আর্ত না লিখে ‘আতুর’ আর দৃষ্টির পরিবর্তে ‘দিঠি’ লিখতে তাঁর কোনো সংকোচই হয়নি। এরকম উদাহরণ আরও রয়েছে। যেমন, দুখেরে করি না ডর (পুষ্পবনে পুষ্প নাহি), পুজার থাল রে (ওরে কি শুনেছিস ঘুমের ঘোরে), সবাই তোমায় তাই পুছে (কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও), আঘাত করে নিলে জিনে ইত্যাদি। নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা ‘আলা’র মতোই আরেকটি দারুণ মৌলিক ও বুদ্ধিদীপ্ত শব্দপ্রয়োগ আমরা লক্ষ করি তাঁর ‘অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক’ গানের এই Pun-আশ্রিত পংক্তিটিতে: আধেক দেখা করে আমায় আঁধা।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানগুলোতে এজাতীয় সাধু, কথ্য, আঞ্চলিক ও আটপৌরে শব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি একদমই অচেনা, অচলিত শব্দপ্রয়োগেও সমান নিঃশঙ্ক ছিলেন। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। নিয়ড়ে নাই (আরো চাই যে, আরো চাই গো- আরো যে চাই।); ধটি, রঙিন আঙিয়া, নাচিছ বাছনি (তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া); করুণ বল্লিকা (আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি); সোঙরি সে মুখশশী (বাঁশরি বাজাতে চাহি বাঁশরি বাজিল কই); ভিজিবে নিচোল (নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে); দিব নিছনি (আমার মন মানে না- দিনরজনী) ইত্যাদি। এই শব্দসমূহের (নিয়ড়ে= নিকটে; বল্লিকা= লতা; ধটি, আঙিয়া= একপ্রকার পরিধেয়; বাছনি= বাছা শব্দের রূপান্তর; সোঙরি= স্মরণ করি; নিচোল= ঘাগরা; নিছনি = মোছানো, অর্ঘ্য) অর্থ আমার নিজেরই সঠিক জানা ছিল না এই নিবন্ধটি লেখার আগ পর্যন্ত। এছাড়া, নেচেকুঁদে (সবাই যারে সব দিতেছে), বড়াই (বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই), ‘ঘাঁটাঘাঁটি’র মতো নিতান্ত কথ্যবুলি (ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি); পাঁচনি, (তোমার কটি-তটের ধটি কে দিল রাঙিয়া), ‘পাঁজি’র মতো লোকজ শব্দ (আগে চল্ আগে চল্ ভাই), এমনকি ‘হতভাগিনী’র (সে যে পাশে এসে বসেছিল তবু জাগিনি) মতো একেবারেই অপাংক্তেয় ও আটপৌরে একটি শব্দকেও কী দারুণ দ্যোতনাতেই না উদ্ভাসিত করে তুলতে পারেন তিনি!

নজরুলের সঙ্গে রক্ত অর্থে ফারসি শব্দ ‘খুন’ ব্যবহার করা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যত তর্কই থাকুক না কেন, তাঁর গানের বাণীতে আরবি, ফারসি শব্দের প্রয়োগে তিনি কিন্তু বেশ উদারই ছিলেন। এক ‘শরম’ শব্দটিকে যে তিনি কত গানে কতভাবে ব্যবহার করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। আরবি ‘তুফান’ শব্দটির প্রতিও ছিল তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। এছাড়া, তরবারি, পেয়ালা, লাগাম, বালাই, আরাম, রাস্তা, পিয়ো ইত্যাদি আরবি-ফারসি শব্দ তিনি খুব জুতসই ভাবেই ব্যবহার করেছেন তাঁর বিভিন্ন গানে। এখানে ‘পেয়ালা’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে আমার একটি ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করি। ‘বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা’ ও ‘শেষ পেয়ালা চোখের জলে’ (আমার শেষ রাগিনীর প্রথম ধুয়ো ধরবি রে কে তুই) এই দুটো গানের ক্ষেত্রে শব্দটির প্রয়োগ সরাসরি ও সাদামাটা হলেও আরেকটি বিখ্যাত গান, ‘তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে’র বেলায় কিন্তু তিনি সেটিকে কিঞ্চিৎ খেলিয়ে ব্যবহার করেছেন এই বলে যে, ‘রঙিন রসে প্যালা ভরে নাই।’ এটি সম্ভবত তিনি গানের যথাযথ সুর, তাল রক্ষার্থেই করেছেন, কিন্তু তার প্রয়োগটি ‘রঙিন রসে’র পটভূমিতে কী মোক্ষমভাবেই না মানিয়ে গেছে দেখুন! এরকমই আরও কিছু গানের কথা উল্লেখ করা যায় রবীন্দ্রনাথ যেখানে খুব সফলভাবেই শব্দ নিয়ে এরকম নির্ভীক নিরীক্ষা করেছেন। সেগুলো হচ্ছে: ‘বাতাস তারে উড়িয়ে নে যায়’ (যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে); ‘মুখানি দেখিতে চায়’ (বল্ গোলাপ মোরে বল্); ‘তবে মুখানি তুলিয়ে চাও, সুধীরে মুখানি তুলিয়ে চাও (বলি ও আমার গোলাপবালা); দেহো আনি (ধীরে ধীরে ধীরে বউ ওগো উতল হাওয়া), দেহো আলো (অন্ধজনে দেহো আলো); নুকোতে গিয়ে হাসি (ও কেন চুরি করে চায়।) ইত্যাদি।

সবশেষে, রবীন্দ্রনাথের গানে ব্যবহৃত কয়েকটি বিশেষ ধরনের বাংলা বচন ও বাক্ভঙ্গির উল্লেখ করতে চাই যেগুলোকে অন্তত গানের বাণীতে ব্যবহারের কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাববেন না, অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁর কব্জির জোরে সেগুলো শুধু প্রয়োগই করেন না, তা থেকে ভাষার সর্বোচ্চ ব্যঞ্জনাটুকুও আদায় করে নেন। যেমন ধরুন, ‘আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো’ গানটিতে ব্যবহৃত ‘তোমার হাতে আমার ঘোড়া লাগাম-পরানো’ চিত্রকল্পটির কথা, যা প্রায় অসম্ভব ও অভাবনীয় একটি প্রয়োগ, অথচ অর্থের বিবেচনায় এর চেয়ে অমোঘ প্রকাশ আর কীই বা হতে পারতো! এই একই গানের ‘এমন করে গায়ে প’ড়ে সাগর তরানো’ পংক্তিটির ‘গায়ে প’ড়ে’ শব্দবন্ধটিও একইরকম মৌলিক ও সাহসী প্রয়োগের আরেকখানি দৃষ্টান্ত। এইধরনের আরও দুটি উদাহরণ : ‘একি আনন্দময় নৃত্য অভয় বলিহারি যাই’ (ওরে, আগুন আমার ভাই) এবং ‘ওই আছে রসাতল ভাই’ (আগে চল্, আগে চল্ ভাই!)। গানের শরীরে এই ‘বলিহারি’, ‘রসাতল’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করতে যেকোনো গীতিকারই দু’বার ভাববেন। তেমনি পাঠক-শ্রোতার ভর্ৎসনার ভয় করলে রবীন্দ্রনাথ কখনোই তাঁর ‘সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই’ গানে ‘বুকে বাজে তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে’ পংক্তিটি রচনা করতে পারতেন না। তেমনি সম্ভব হতো না আমাদের জাতীয় সংগীতের মতো এমন একটি ভাবগম্ভীর, আবেগঘন গানের শেষদিকে আচমকা এই ‘গরিবের ধন’ আর ‘গলার ফাঁসি’ বুলিদুটোর ব্যবহারও।

পরিশেষে বলি, আমার এই নিবন্ধটি রচনার উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথ কতবড় গীতিকার কিংবা ভাষাশিল্পী ছিলেন সেটা প্রমাণ করা নয় মোটেও, কেননা এর জন্য এই অধমের স্বীকৃতির প্রয়োজন পড়ে না তাঁর। আমি বরং এর মাধ্যমে সাধারণভাবে সবধরনের লেখক ও বিশেষভাবে গান-লিখিয়েদের কাছে একটি সত্যকেই তুলে ধরতে চাইছি যে, একজন সত্যিকার সৃজনশীল লেখকের শব্দবিষয়ে কোনোপ্রকার ছুঁৎমার্গই থাকা উচিত নয়, কেননা শব্দের তথা ভাষার সম্ভাবনা কার্যত অসীম ও অফুরন্ত। একজন শব্দশিল্পীর উচিত সকল সংস্কার ও পূর্বধারণার ঊর্ধ্বে উঠে ভাষার সবটুকু শক্তি ও সম্ভাবনাকে নিংড়ে নেওয়া, শিশুর কৌতূহলে তাকে নিয়ে খেলতে পারা, নানাভাবে ভাঙচুর ও নিরন্তর নিরীক্ষা করা এবং অতঃপর কুশলী জাদুকরের মতো তার রুমালের ভেতর থেকে সম্পূর্ণ নতুন, নিজস্ব ও অভাবিতপূর্ব কোনো ভাষিক সত্তাকে বার করে আনা। রবীন্দ্রনাথ সেই কাজটিই করে দেখিয়েছেন আমাদের তাঁর এইসব অমর ও অজর ‘গানের ভিতর দিয়ে।’