বুনো হাতি

মোহাম্মদ কাজী মামুনমোহাম্মদ কাজী মামুন
Published : 26 Jan 2023, 05:51 AM
Updated : 26 Jan 2023, 05:51 AM

আমি বারবার করে বলেছিলাম সেলিমকে, দরকার নেই; কিন্তু সে কিছুতেই শুনলো না। তার জাম্বো সাইজের জ্যাকেটটা দেখে একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলাম, “আহা! আমারও যদি থাকতো এমন একটা জিনিস!“

হালকাপাতলা গড়নের সেলিমকে অতিকায় হস্তির মত দেখাচ্ছিল। অথচ সে বছরও বসন্ত বসন্ত অনুভূতি হচ্ছিল শীতের সিজনে, আর ঋতুচক্র দৌঁড়ে দৌঁড়ে চলছিল, একটিকে দাঁড়ানোর সুযোগ না দিয়েই আরেকটি চলে আসছিল। সেই সময় কোন এক অমোঘ নিয়তিকে মেনেই মনে হয় সেলিম হাতিটাকে তার হুডসহ গায়ে চাপিয়েছিল, আর হাতিটার উপর চড়ে বসেছিল দোনলা বন্দুকটা। কাস্টমাররা যখন ঢুকতো ব্যাংকটাতে, তখন তাদের অভ্যর্থনা জানাত ঐ হাতি আর বন্দুকটাই, ভেতরের মানুষটা তখন কটন আর পলিয়েস্টারের আশ্রয়ে।

কোম্পানি থেকে এত বিশাল একটা হাতি মুক্তহস্তে দান করা হয়েছে, হতেই পারে না। ব্যাপারটা খোলসা করতে বললে ব্যকরণবিহীন স্বরের স্রোত ভেসে আসতে লাগলো সেলিমের বাক-যন্ত্র থেকে যা বেশীরভাগ সময়েই শীতঘুমে নিমজ্জিত থাকে। কোম্পানি থেকে তাকে ফোন দিয়েছিল জিনিসটি সময়মত নিয়ে আসতে। এর জন্য কোন দাম নির্ধারণ হয়েছে কিনা, বা, তার স্যালারি থেকে কেটে নেয়া হবে কিনা, কিছুই জানা নেই তার। তবে তাদের ইনচার্জকে ইতোমধ্যেই বলে দেয়া হয়েছে আরেকটি জ্যাকেটের কথা; গোডাউন নাকি ঠাসা মাল দিয়ে, সুতরাং, ম্যানেজ…।

সেলিমকে কড়া ধমক লাগিয়ে ভেবেছিলাম, এতেই কাজ হবে। তাছাড়া, চাইলেই কি আর ম্যানেজ করতে পারবে! বিশেষত কোম্পানির হিসেবনিকেশ এসব ক্ষেত্রে যখন খুবই কড়া! কিন্তু সপ্তাহখানেকের মধ্যেই বিশাল পলিপ্যাকে করে একটি সদ্যোজাত হাতি হাজির হল আমার টেবিলে। সারাদিন ছুঁয়ে না দেখলেও দিনশেষে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম জিনিসটা, সেলিমের কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না!

সেদিন শহরতলীর অফিসটা থেকে ফেরার পথে হঠাৎই কুল-কুল করে কুয়াশা নেমে এসেছিল আকাশ ভেঙে, আর দুপাশের রাস্তাঘাট রূপান্তরিত হয়েছিল শ্বেত-পুরীতে। উত্তেজিত বরফকণারা মুহূর্তের মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর সূঁচ বিঁধে যাচ্ছিল আমার সারা শরীরে। সুতরাং, পথিমধ্যেই শুভ মহরৎ ঘটে গিয়েছিল হাতি-জ্যাকেটটার। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আয়না-রিহার্সেল করতে করতে যেই না সেলিমের মুখখানা ভেসে উঠলো, এক ঝটকায় খুলে ফেলেছিলাম ওকে আর নিক্ষেপ করেছিলাম ওয়ার্ড্রোবের সব থেকে নীচের তলাটিতে যেখানে অকেজো জামাকাপড়গুলো দলবেঁধে হাজতবাস করতে থাকে যতক্ষণ না হাড়িপাতিলওয়ালারা এসে জামিন করিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই বাসায় ফিরে দেখি হাতিটা বেরিয়ে পড়েছে আর বাবার উপর চড়ে বসেছে। রাগ ফণা তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ‘অফিস থেকে কেউ তো আর দেখতে আসছে না বাসায়!’ টাইপের প্রবোধে ভুলে যেতে চাইলাম বিষয়টা।

কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য সে ফিরে এল নাচতে নাচতে। ভুলটা আমারই। কোন এক বেখেয়ালে সেলিমকে বলে ফেলছিলাম বাবার কথা, আর তার দুদিনের মাথাতেই আরো একটা হাতি চলে এল আমার টেবিলে। “গোডাউনে বেশী আছিল না, তয় যহন ইনচার্জরে খুইলা কইলাম বেফারডা… “- শুঁড়ের মতই মাথাটা পুরো নত করে বলছিল সেলিম। জানতাম এবারও নিতে হবে জিনিসটা, আর মানিব্যাগ বার করতে গেলেই সে বাঁধা দেবে।

আমি দ্বিতীয় হাতিটাকে আর বাসায় নিয়ে যাইনি, পথেই এক বৃদ্ধের হাতে তুলে দিয়েছিলাম যে আমার গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ধরে দাঁড়িয়েছিল আর কাঁপছিল! কিন্তু বুনোটা মনে হয় স্থির পণ করেছিল, যাবে না আমায় ছেড়ে! তাই বছর না ঘুরতেই সে ফিরে এল; তবে সশরীরে না, একটি হলুদ খামের মোড়কে বন্দী হয়ে। আমার টেবিলে রাখা হেডকোয়ার্টার থেকে প্রেরিত সেই চিঠিটাতে লেখা ছিল, ‘গানম্যান মোহাম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বরখাস্ত করা হল।‘

হাতিটা এখনো আছে আমার সাথে, ঐ যেমন আগেই বলছিলাম, হাতিটার সাথে যেন আমার এক অনন্তকালের গাঁটছড়া, বিশ্বভুবন ছাড়িয়ে যার লাটাই, ঘুরছে তো ঘুরছেই!