পাথরের বেদীটি সরাতেই জোহার খুঁজে পায় ওর বোন ডায়ানার লাশ এবং আবেগে আপ্লুত হয়ে আমাকে বলে, “জানো, মৃতের সঙ্গে বাস করতে করতে আমি খুবই ক্লান্ত।
Published : 19 Aug 2023, 07:49 PM
রাতের নদী দূর থেকে বিষণ্ণ এক স্বর্গের মতো মনে হলেও কাছে গেলে দেখা যায় এর ভয়াবহ রূপ, ঘোলাটে আলো ও রাতের যাত্রীদের ঘুম জড়ানো মাতলামিপূর্ণ কোলাহলে তা পরিপূর্ণ।
শহর থেকে রওনা দিয়েছিলাম মফস্বলের দিকে। ফেরী পারাপারের সময় রাতের নদী এর অজস্র রূপ ও ক্লেদ দ্বারা আমাকে আলিঙ্গন করলো।
আমার কাছে রাত্রির সেই নদীকে মনে হচ্ছিলো বোদলেয়ারের ক্লেদজ কুসুম, অপরূপ পাপ ও ক্লেদের বৃন্ত থেকে উৎসারিত হয়ে আপন তমাসাচ্ছন্ন মহিমার অপরূপ সৌন্দর্যে ও মায়াবী আলোয় তা উদ্ভাসিত।
কোনো পূর্বাভাস কিংবা গ্রহণযোগ্য ও ভালো কোনো কারণ ছাড়াই আমি উদ্ভট এক বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। প্রথমেই ব'লে নিই এই কাহিনীর মূল নায়িকা হচ্ছে জোহারের বোন। জোহার, —যাকে আমি আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করেছি। সে ছিলো এক মহিমান্বিত তরুণী।
ফেরীর খাবারের ঘর তখন সরগরম ছিলো। ভাজা ইলিশ মাছের ঘ্রাণে আর শীতের ওমে তখন আসর জ'মে উঠেছিলো। বরাবরের মতোই আমি সে-সময় কুটিল ও অদ্ভুত সমস্ত ভাবনায় মগ্ন ছিলাম এবং ছিলাম দেবতাদের মতোই নিঃসঙ্গতাবোধে জর্জরিত। তাই হয়তো জোহারকে আবিষ্কার করাটা আমার জন্যে খুব স্বাভাবিকই ছিলো।
জোহারকে আমি প্রথমে ভেবেছি রিলকের কবিতার সেই মহিয়সী বেশ্যা, ধনী যুবকেরা যার ছোঁয়াতে তীব্র গরলে পাণ্ডুর হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পেরেছি জোহার একেবারে মাটির মেয়ে, কিন্তু তার কিছুক্ষণ পর আবার মনে হয়েছে জোহার হয়তোবা ভগবানের মতোই রহস্যময়।
আমি ছিলাম গোয়েন্দা বিভাগের একজন লোক, হয়তো সে-কারণেই জোহার আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিলো। জোহারের বোন পালিয়ে গিয়েছিলো আত্মহত্যা করবে ব'লে, জোহার চাইছিলো আমি যেনো তার বোনের লাশটি খুঁজে দিই। হয়তোবা কোনো এক জনমানবহীন বালুচরে তার বোনের লাশটি ঠুকরে খাচ্ছে শকুনের পাল অথবা হয়তো কোনো এক নর্দমার জলে তা পচছে।
জোহারের বোনের নাম ছিলো ডায়ানা আর এই ডায়ানা ছিলো জীবনের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ। অল্প সময়েই জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর গলায় ছুরি চালিয়ে দিয়ে সে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো। কিন্তু জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা অল্প সময়ের মধ্যেই কীভাবে লাভ করা যায়? জীবনের প্রতিটি সেকেণ্ডই কি নতুন স্বাদ, নতুন গন্ধ, নতুন বর্ণের মাধ্যমে আমাদেরকে নতুন এক উপলব্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে না?
কিন্তু ডায়ানার ভাবনা ছিলো অন্যরকম। সে সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের দর্শন প'ড়ে জীবনের তিনটি স্তর সম্পর্কে জেনেছিলো : ভোগী জীবন, নৈতিক জীবন আর ধর্মীয় জীবন। জীবনের এই তিনটি স্তর পেরুলে লাভ করা যায় জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা।
ভোগী জীবনে কোনো নৈতিকতা ও ধার্মিকতার লেশমাত্র থাকে না, মনের গোপন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করাই যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য সেখানে নীতি বা ধর্মীয় উপদেশমালার স্থান কোথায়? ডায়ানা এই পর্বে খুনখারাবি ও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। যেহেতু যৌনতার অনেক কলাকৌশল তাদের সমাজে নিষিদ্ধ এবং এগুলোর চর্চা ব্যক্তির মনের মধ্যে সামাজিক চাপের কারণে এক নারকীয় পাপবোধ ও মৃত্যুর মতো এক ধরনের বিষণ্ণতার সৃষ্টি করে তাই ডায়ানা গুপ্ত যৌনপ্রবৃত্তি ও যৌনবাসনার চর্চা শুরু করে। এ-পর্বে ডায়ানা একটা মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
আগেই বলেছি জোহার ও ডায়ানা ছিলো সহোদরা। জোহারের সংগোপন প্রেম ও কামনা ছিলো এপোলো-সদৃশ একটি বালকের প্রতি, যে কীনা জোহারের তুলনায় বয়সে দশ বছরের ছোটো। সেই বালকেরও হয়তো জোহারের দৈহিক লাবণ্যের প্রতি ছিলো তীব্র আকর্ষণ, কেননা সে প্রায়ই নানা ছুঁতোয় জোহারের ঘরে আসতো। কিন্তু জোহার জীবিত প্রণয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে, সে বালককে একান্ত নিজের ক'রে পেতে চায় এবং তাকে এমনভাবে অধিকৃত ও বশীভূত করতে চায় যেভাবে সিংহী অধিকৃত করে কোনো হরিণশাবককে। ডায়ানা ও জোহার দুই বোন মিলে বালক এপোলোর গলা কেটে ওকে হত্যা করে এবং জোহারের ঘরের একটা ট্রাংকের ভেতরে বালকের লাশ লুকিয়ে রাখা হয়। মূল পরিকল্পনাটা ছিলো জোহারেরই, সে এই মনস্তাত্বিক নিগূঢ় রহস্য বা নেক্রোফিলিয়ার পাঠ পায় উইলিয়াম ফকনারের 'এমিলির জন্যে গোলাপ' নামক ছোটগল্পটিতে।
ভোগী জীবনের পরে আসে নৈতিক জীবন। এ-পর্বে ব্যক্তি সামাজিকভাবে সজ্জন হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। ডায়ানা এ-পর্বে যেন হয়ে ওঠে অরণ্যের মায়াবী দেবী, সকল পশু ও মানবের প্রতি যার করুণা।
কিন্তু ধর্মীয় জীবনের সূচনা ঘটতেই চিত্রপট বদলে যেতে থাকে। এ-পর্বে ব্যক্তি বৃহত্তর ধর্মীয় স্বার্থে তার সকল মানবিক অনুভূতি, দয়া-মায়া, এবং সকল সামাজিক দায়িত্ববোধ বিসর্জন দেয়, যেমন আব্রাহাম ঈশ্বরের জন্যে উৎসর্গ করেছিলো তার পুত্র ইসহাককে। ডায়ানা এ-পর্বে একটি ধর্মীয় প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর মধ্য দিয়েই তার খেলা সমাপ্ত হয়।
ডায়ানার পিতা-মাতা ছিলো আরবের চন্দ্রদেবতার পূজারী আর এরা প্যাগানদের প্রতি এক ধরনের তীব্র বিদ্বেষবিষ এদের আত্মায় লালন করতো। ডায়ানা তাই শিকারের দেবীর পক্ষ হতে প্রতিশ্রুত সেই চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করে, কুড়ালের এক কোপে সে কেটে ফেলে তার পিতা-মাতার মাথা এবং পিতৃহত্যা ও মাতৃহত্যার মাধ্যমে কলঙ্কিত করে তার জীবনকে। আইন-শৃঙ্খলার রক্ষীবাহিনী হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পেয়ে শিকার করতে আসে ডায়ানাকে। কিন্তু ডায়ানার তো সম্পূর্ণ জীবনই ভোগ করা হয়ে গেছে, তাই সে আত্মহত্যা করবে ব'লে পালিয়ে যায় নির্জন এক স্থানে।
এখন জোহার আমার কাছে জানতে চাইছে: ডায়ানার আত্মহত্যার স্থানটি কোথায়?
সে আমাকে তাদের গ্রামে নিয়ে যায় আর ওই গ্রামে ঢুকতেই আমি দেখি এক অদ্ভুত জাগ্রতকালীন স্বপ্ন। আমার চিন্তাশক্তি ও গোয়েন্দাসুলভ অনুসন্ধিৎসাই হয়তো আমার অবচেতনে সমাধান করেছিলো পৌরাণিক সমস্যার।
জোহারকে জানাই আমি সন্ধান পেয়ে গেছি ডায়ানার লাশের। কোনো এক মন্দিরের পাথুরে বেদীর নিচে তা পচছে। মন্দিরের বর্ণনা দিতেই জোহার জানায়, “এটি ডায়ানার প্রাচীনতম এক মন্দির। হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাত দ্বারা এর ইতিহাস কলঙ্কিত।”
এই গ্রামের গায়া অরণ্যের গোলকধাঁধায় এই মন্দিরটি অবস্থিত এমনই এক জনশ্রুতি আছে। ডায়ানা হয়তো নিজেকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছে পৌরাণিক মহিমায়।
ধ্রুবতারাকে নিশানা ধ'রে আমরা ওই মন্দিরে পৌঁছে যাই। কিন্তু মন্দিরের ভেতরে ঢুকতেই অপূর্ব এক সুঘ্রাণ আমাদেরকে বিভ্রান্ত ও হতবিহ্বল ক'রে তোলে। কিন্তু আমি জানি লাশের গন্ধ কখনো কখনো জলাভূমির গন্ধ এবং আরণ্যক পুষ্প-বৃক্ষ-লতার গন্ধের সাথে মিলে-মিশে এমন রূপ নিতে পারে। এমনটিই আমি পড়েছিলাম টমাস মানের 'কালো রাজহাঁস' উপন্যাসে।
পাথরের বেদীটি সরাতেই জোহার খুঁজে পায় ওর বোন ডায়ানার লাশ এবং আবেগে আপ্লুত হয়ে আমাকে বলে, “জানো, মৃতের সঙ্গে বাস করতে করতে আমি খুবই ক্লান্ত। তোমার মধ্যেই আমি আবিষ্কার করেছি আমার জীবনের দ্বিতীয় এপোলোকে, যে কীনা গ্রীক ওই দেবতার মতোনই অপূর্ব সুন্দর। তুমি কি হবে আমার প্রেমিক?”
আমি জোহারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই।
জোহার তখন আমার দুই চোখের মণি ছিঁড়ে তাকে দিয়ে দিতে বলে আর আমি আতঙ্কে শিউরে উঠি। তাকে দেখিয়ে দিই আকাশের দু'টি উজ্জ্বল নক্ষত্র সিরিয়াস ও ক্যানোপাসকে। ওগুলোই আমার চোখ। এপোলোর চোখ।
জোহার অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠে।
আজ অনেক বছর পরে ইজিয়ান সমুদ্রের ধারে ব'সে আমার মনে পড়ছে জোহারের ওই হাসির কথা। মনে পড়ছে স্বয়ং জোহারের কথা। ডায়ানার কথা। এপোলোর কথা।
ইজিয়ানের তীরে বালুবেলায় শুয়ে প্রাচীন মিশরীয় বাঁশি বাজাচ্ছি আমি, যে-শিল্প আমি শিখেছি বেবুনমুখো দেবতা থথের কাছ থেকে।