এখানে পা রাখার পর খুব কম সময়ের মধ্যেই দেশটাকে আর মানুষগুলোকে আমার দারুণ ভাল লেগে যায় এবং আমার কেমন যেন নিজের বাড়িতে থাকার একটা অনুভূতি হতে থাকে।
Published : 16 Nov 2023, 10:56 AM
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার আরবেলিয়া গ্রামে শাক্ত ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্য পরিবারে ১৮৮৭ সালে জন্ম নরেন্দ্রনাথের যিনি পরে এম এন রায় হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সমধিক পরিচিতি উদার মানবতাবাদের (radical humanism) তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা হিসেবে। বিপ্লবী জীবনে তাঁকে বহু ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি প্রয়াত হন এই মনিষী।
মেক্সিকো সফর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এক অর্থে তার রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও মানবেন্দ্রনাথের মেক্সিকো-সফর বড় ধরনের বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর স্মৃতিকথা Memoirs ১৯৬৪ সালে দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। ৬২৮ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ স্মৃতিকথার শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মেক্সিকো বাসের রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল স্মৃতি। মূল গ্রন্থের ৫ম অধ্যায় থেকে ২৯ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সেই স্মৃতিচারণ। স্মৃতিকথার এই নির্বাচিত অংশ কলামিস্ট অনুবাদক প্রিসিলা রাজ-এর অনুবাদে ধারাবাহিকভাবে বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আজ থাকছে মেক্সিকো সফরের চতুর্থ পর্ব। এই অনুবাদে মূল বইয়ের পর্ব-বিন্যাস অনুসরণ ও উল্লেখ করা হয়েছে।
৮
মেক্সিকোয় আমি কাউকে চিনতাম না। এখানে পা দেওয়ার আগে কারো সঙ্গে যোগাযোগও করিনি আমি। এখানে পা রাখার পর খুব কম সময়ের মধ্যেই দেশটাকে আর মানুষগুলোকে আমার দারুণ ভাল লেগে যায় এবং আমার কেমন যেন নিজের বাড়িতে থাকার একটা অনুভূতি হতে থাকে। অথচ এমন না যে এখানে আমি খুব পরিকল্পনা করে এসেছিলাম। মার্কিনি কোনো জেলে পচা এবং তারপর ভারতে স্থানান্তরিত হয়ে সেখানে আরো বড় শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। ফলে আমাকে আমেরিকা ছাড়তে হয়েছিল। আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো তখন আমার সামনে দু’টি পথ খোলা ছিল। হয় কানাডা নয়তো মেক্সিকো, যে কোনো একটা দেশ বেছে নিতে হতো। কানাডায় গেলে ব্রিটিশ আইনের লম্বা হাতের তলায় থাকতে হতো। সুতরাং বাধ্য হয়েই মেক্সিকোকে বাছতে হয়েছিল। ত্বরিৎ গতিতে আমেরিকা ছাড়তে হয়েছিল।
কিন্তু ওখানে পৌঁছে আমি কিন্তু অসহায় বোধ করিনি। পরিবেশের মধ্যেই কিছু একটা ছিল। সেই কিছুটা যে কী তার একটা মূর্ত রূপ খোঁজার অভিযানের সূচনাবিন্দু ছিল জেনারেল আলবারাদোর কাছে পরিচয়সূচক চিঠিটি। জেনারেল যে দুর্গম ইউকাতান প্রদেশের গভর্নর সেটা আমি জানতাম। কিন্তু যেটা জানা ছিল না তা হচ্ছে মেক্সিকো সিটি থেকে সেখানে যাওয়া বস্তুতপক্ষে অসম্ভব। কোনো রেলসংযোগ ছিল না। প্রায় হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত সেই প্রদেশে যাওয়ার জন্য স্থলপথে যাত্রা করা যায় তবে যাত্রার শেষভাগে পড়বে তাবাস্কো ও চিয়াপাস নামের দুটি বিরাট প্রদেশ। দুটোই বনভূমি, জলাজঙ্গল ও পাহাড় দ্বারা আকীর্ণ। সাধারণত মেক্সিকো উপসাগর পেরিয়ে জলপথে সেখানে যাতায়াত করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ জাহাজই মার্কিনী যেগুলো মেক্সিকোর বেরাক্রুস বন্দর থেকে ছেড়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উপসাগরীয় বন্দর বা হাভানায় ভেড়ে। এসব স্থান আমার জন্য অবশ্য পরিত্যাজ্য। কিছু মেক্সিকান জাহাজ অবশ্য যায় কিন্তু প্রায় সবই ছোট, সাগরে চলাচলের উপযুক্ত নয়। এগুলোতে কালেভদ্রে যাত্রী পরিবহন করা হতো।
এসব কারণে জেনারেল আলবারাদোর প্রদেশে গিয়ে তাঁকে পরিচয়সূচক চিঠিটি দেওয়া আর তাঁর সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিদর্শনের পরিকল্পনা আমায় ত্যাগ করতে হলো। বিষয়টি আমার জন্য যথেষ্ট হতাশাব্যঞ্জক ছিল। এসব অর্থনৈতিক তত্ত্ব সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে আমার সচেতন বোধকে তখনও তেমন নাড়া দিতে না পারলেও আমার কল্পনায় এক ধরনের আবেদন সৃষ্টি করেছিল। ফলে হাতেকলমে সেগুলোর প্রয়োগ দেখতে স্বাভাবিকভাবেই খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। পরবর্তীকালে অবশ্য ঠিকই উপলব্ধি করেছিলাম মার্কিনী ইউটোপীয়দের এলডোরাডোয় না যেতে পারাটা আমার জন্য ভাল হয়েছিল। গেলে ওখানে একরাশ নিরাশা ছাড়া আর কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করত না।
ইউকাতানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ব্যাপারটা আসলে তেমন কিছু ছিল না। প্রদেশটির মোট কৃষি উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশই ছিল সিসাল আঁশ ১ যা শতভাগ সরকার কর্তৃক রপ্তানি হতো। এটাই ছিল ইউকাতানের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে এটা ছিল আসলে ওই ব্যবসায়ে বিনিয়োগকৃত মার্কিনি পুঁজির একচেটিয়া ব্যবসা। যেহেতু পুঁজিটা বিনিয়োগ হতো রাষ্ট্রের মাধ্যমে সেহেতু এটা ছিল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এবং সেটা মূলগতভাবে একচেটিয়া ব্যবসা। সেসময় এই ব্যবস্থা আমার খুব একটা পছন্দ ছিল না, কেননা খুব বেশি হলে এটাকে সংস্কারবাদী পদক্ষেপ বলা যেত।
সেটা এমন এক সময় ছিল যখন বলশেভিকরা রাশিয়ায় ক্ষমতা দখল করেছে এবং তার একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনি আটলান্টিকের এপারেও এসে পৌঁছেছে। এর ফলে সব বামপন্থী সমাজতান্ত্রিকরা যারপরনাই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। এমন একটা আবহ তৈরি হয়েছিল যা থেকে তাদের মধ্যে বিরাট প্রত্যাশার জন্ম হয়েছিল। এরা সব ছিল ভবিষ্যৎ কমিউনিস্টের দল। সেই আবহের বৈদ্যুতিক আবেশ আমাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। আমার ক্ষেত্রে এটা অবশ্য বিপ্লবী জ্বরের কয়েক ডিগ্রি বৃদ্ধি মাত্র ছিল না। আমার রাজনৈতিক বিবর্তনে এটা পূর্ণ রূপান্তরের নিয়ামকের ভূমিকা নিয়েছিল। পাঁড় জাতীয়তাবাদী থেকে এক লাফে কমিউনিস্টে পরিণত করেছিল আমাকে। নয়া ধর্মান্তরিতের অনিবার্য চরিত্র অন্ধ মৌলবাদ। সংস্কারবাদ তার কাছে বিষবৎ পরিত্যাজ্য।
এই দুরন্ত অগ্রগতি যে আসলে ওপর-ওপর তা আমি পরবর্তীকালে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। তবে এ কথা সত্য যে কোনো সুবিধা হস্তগত করার ভাবনা থেকে এটা ঘটেনি। রাশিয়ার যাওয়ার কোনো ভাবনাই তখন আমার ছিল না। বস্তুত বিপ্লবে বিশ্বাসের এই চেতনা জাহির করার মাধ্যমে মনের মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তির আবেগ সৃষ্টি হতো। সংস্কৃতিগতভাবে আমি তখনও জাতীয়তাবাদীই ছিলাম। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মৃত্যু হওয়া বড় কঠিন। সমাজতন্ত্র আমার পছন্দের ছিল এর মধ্যেকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অনুষঙ্গের জন্য। আনন্দমঠ ২ থেকে অনুপ্রাণিত যারা তাদের জন্য সমাজতন্ত্রের ইউটোপীয় বা মানবিক দিকগুলো অচেনা কিছু নয়। ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আমার মূল্যবোধের কাঠামো কিংবা সেসময় আমি যে দর্শনে বিশ্বাসী ছিলাম তার ভেতরে সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শের আত্মীকরণ কঠিন কিছু ছিল না। বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অন্তর্গত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মূল্যবোধ কমিউনিজমের মধ্যে আরো জোরদার হয়েছে। এর ফলে পথিমধ্যেকার এই বাড়িতে আমার অবস্থান হয়েছিল খুব স্বল্প সময়ের জন্য। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদ থেকে কমিউনিজমে পাড়ি দেওয়ার পথটা বস্তুত অনতিদীর্ঘ। কেবল আমারই যে এই মানসিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা নয়, আরো অনেকেরই এই অলৌকিক রূপান্তর ঘটেছিল, এবং তারা অবধারিতভাবে কমিউনিজমের বিকৃতি ঘটিয়েছিল। সেই পথে আমি নিজেও অনেকদূর হেঁটে গিয়েছিলাম। কিন্তু এর প্রাণঘাতী গর্তগুলো খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই চোখে পড়েছিল আমার। মাঝপথে থেমে দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম। আবিষ্কার করেছিলাম নতুন বিশ্বাসের ভ্রান্তিগুলোকে। কিন্তু সেটা ঘটেছিল সিকি শতাব্দীব্যাপী যাত্রার শেষভাগে এসে, যার শুরু হয়েছিল মেক্সিকোতে।
দুর্গম যাত্রাপথ, সেইসঙ্গে রুশদেশে বিপ্লবের প্রতিধ্বনি দ্বারা সৃষ্ট বিপুল উত্তেজনার ইউকাতানের এল দোরাদোয় আমার আর যাওয়া হলো না। মেক্সিকোর রাজধানীতে থেকেই নতুন নোঙর খুঁজতে শুরু করি। জেনারেল আলবারাদোকে কীভাবে আমার পরিচয়সূচক চিঠিটি দিতে পারি সে ব্যাপারে আলাপ করার জন্য ইতিমধ্যে আমি সেদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। ঘটনাক্রমে ইনি আবার প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির জামাতাও বটে। এই সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা থেকে মেক্সিকান চরিত্রের একটা মধুর দিকও উন্মোচিত হলো আমার কাছে। মন্ত্রীপরিষদের কোনো সদস্যের অধীনস্থ কারো সম্পর্কে খোঁজ নিতে অচেনা-অজানা কোনো বিদেশীকে সাক্ষাৎ প্রদান - এ শুধু মেক্সিকোতেই সম্ভব।
আফিনিস্তেরিও দে লা গেররায় (যুদ্ধ মন্ত্রণালয়) গেলাম। মন্ত্রণালয়কে এই নামেই খোলাখুলিভাবে ডাকা হতো। মেক্সিকানরা ভন্ডামি করে না। সরকার যুদ্ধ করার জন্য সেনাবাহিনী পোষে। সরকারের যে বিভাগ তা পরিচালনা করে তার নাম অতএব যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ই হবে। কোদালকে কোদালই বলতে পছন্দ করে মেক্সিকানরা। সকল সাড়ম্বর বিনয় অবলম্বন করে আমাকে অভ্যর্থনা জানানো হলো। সশস্ত্র প্রহরীর দল আমাকে লাল গালিচা সাজানো করিডোর পেরিয়ে মন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে চলল। মন্ত্রীমশাই পূর্ণ আনুষ্ঠানিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে সাড়ম্বরে সাক্ষাৎপ্রার্থীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও বটে। কিছুটা মোটা বেঁটেখাটো একজন মানুষের নিজের চেয়ে লম্বা তলোয়ার নিয়ে পূর্ণ মর্যাদা সহকারে সজ্জিত হওয়ার চিত্রটি স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা হলেও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু তাঁর মিত্রতাব্যঞ্জক হাসি ও উষ্ণ করমর্দন অচিরেই আমার ভয় দূর করে দিল। তিনি আমাকে সাটিনে মোড়ানো গিল্টি করা চেয়ারের দিকে এগিয়ে নিলেন। সোনালী ও সবুজে মোড়ানো সুপরিসর কক্ষটির চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিই। সবিনয়ে জানতে চাইলাম, আমি কি জেনারেল আলবারাদোকে চিঠিটি দেখাতে পারি? সিল করা চিঠিটা আমার সাথেই ছিল। মন্ত্রী অম্লানবদনে খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা পড়ে ফেললেন। তাঁর মুখের সন্তোষের হাসিটা আমার চোখ এড়াল না। মন্ত্রী জানালেন জেনারেল আলবারাদো যে কোনো দিন রাজধানীতে আগমন করবেন এবং তাঁর আসার খবর আমাকে দেওয়া হবে। মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের উপলক্ষ শেষ হয়েছে বুঝে উঠে পড়লাম।
আমার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীও উঠে দাঁড়ালেন। মেক্সিকান ভদ্রলোক তারপর দুর্দান্ত ভঙ্গিতে ধ্রুপদী স্পেনীয় রীতির বিনয় ইশারায় আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। জানালেন যে, প্রস্থানের পূর্বে তিনি আমাকে এই মর্মে আশ্বস্ত করতে চান যে মেক্সিকো প্রজাতন্ত্রে আমি স্বাগত এবং নিরাপদ। ‘নিরাপদ’ শব্দটা আমাকে কিছুটা ধাক্কা দিলো। আমার মুখভাবে তিনি কিছু লক্ষ করে থাকবেন নিশ্চয়ই অথবা এমনও হতে পারে, আর সব কর্ষিত মেক্সিকানদের মতোই তিনিও নাটকীয় হতে চেয়েছিলেন। “আমার সম্মানিত সহকর্মী পররাষ্ট্র মন্ত্রী মহাশয় আপনার সম্পর্কে কিছু তথ্য অবগত হয়েছেন। তবে মহোদয়, সেটি কূটনৈতিক গোপনীয়তার বিষয় আমার পক্ষে যা প্রকাশ করা উচিত নয়। আমি কেবল এই বলে আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আপনি এমন এক দেশে পদার্পণ করেছেন যে দেশ ইদালগো ও হুয়ারেসের কাল থেকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে এসেছে। আপনি এখানে স্বাধীন ও নিরাপদ।” এই বলে তিনি প্রথমে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর প্রায় রাজকীয় সম্মান প্রদর্শনপূর্বক দরজার দিকে হেঁটে গেলেন। তাঁর অনুগমন করলাম আমি। অতি লম্বা খাপবন্ধ তলোয়ারটি লালগালিচার ওপর আঁচড় কেটে এগোচ্ছিল। মন্ত্রী মহাশয় দরজাটি খুলে দাঁড়ালেন, অতঃপর বিনয়াবনত হয়ে বিদায় জানালেন আমায়।
পুরো ব্যাপারটা কোনো কমিক অপেরা থেকে উঠে আসা দৃশ্য বলে মনে হলো। মন্ত্রীর দরজা দিয়ে বেরিয়ে করিডোর, তারপর রাস্তায়। এই নাটকীয় অভিজ্ঞতার পূর্ণ তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছিলাম আমি। ঘটনাটা আমার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। স্পষ্টত, যুবরাজ অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আমার সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং আগন্তুক বিদেশীর সেদেশে পদার্পণের সংবাদ তাঁর কানে কূটনৈতিক চ্যানেল মারফত পৌঁছেছিল। সর্বাধিনায়ককে রসিকতার ছলে যুবরাজ ডাকা হতো। রাষ্ট্রপতি কাররানসার কোনো ছেলে সন্তান ছিল না। পুরো ব্যাপারটায় আমাকে নিজের কাছেই বেশ আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি যেটা হলো তা হচ্ছে, আমাকে তাঁরা মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অনুভূতিটা জোরদার হওয়ার জন্য খুব বেশি সময় আমাকে অপেক্ষা করতে হলো না।
পরদিন রাজধানীর অন্যতম প্রধান দৈনিকের সম্পাদকের কাছ থেকে চিঠি এল। কথিত ছিল, দৈনিকটি সরকারের অঘোষিত মুখপত্র। চিঠিতে অত্যন্ত বিনয় সহকারে জানতে চাওয়া হয়েছে সম্পাদক মশাইয়ের কার্যালয়ে একবারটি যেতে আমার কোনো অসুবিধা আছে কিনা। চিঠিতে এমন অসৌজন্যপূর্ণ আমন্ত্রণের যথাবিহিত ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। আমি বর্তমানে এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত স্থানে অবস্থান করছি যেখানে সম্পাদক মহাশয় আসতে অপারগ।
গল্পের প্লটটা ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে বলে মনে হলো। খুবই কৌতূহলজনক একটা পরিস্থিতি। সামনেই আমার জন্য আরো চিত্তাকর্ষক ও উত্তেজনাকর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে বলে মনে হলো। এক সপ্তাহও হয়নি সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় পা দিয়েছি। একেবারেই আগন্তুক আমার একটি পরিচিত লোকও নেই এখানে। অথচ এরই মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে আমার মিত্ররা রয়েছেন বলে একটা ধারণা পেতে শুরু করেছি। যদি জন্ম থেকে অজ্ঞেয়বাদী না হতাম তাহলে এই ঘটনা ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাসকে আরো পোক্ত করে তুলত নিশ্চয়ই।
নির্ধারিত সময়ে আমি এল পুয়েবলো (জনতা) অফিসে পৌঁছে গেলাম। সম্পাদক ভদ্রলোক লম্বা ও ভারী চেহারার মানুষ। মধ্যবয়স পার হয়েছেন বেশ আগেই। বেশ গুরুগম্ভীর ও পিতৃসুলভ আচরণ। আমার বয়সী নাতি থাকতে পারে তাঁর। অব্যবহিত পূর্বের জাঁকালো সাক্ষাতের থেকে ভিন্ন মেজাজের এই সাক্ষাতে স্বাদ বদলের আমেজ পেলাম। তবে আগেরটা ছিল মন্ত্রীপরিষদ সদস্য ও দেশের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ আর ইনি একজন সাংবাদিক মাত্র। তবে গণতান্ত্রিক পরিবেশে দ্বিতীয় জনের প্রভাব বেশি হতেই পারে।
প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময় হলো। সেটার মধ্যে মেক্সিকানসুলভ বাড়াবাড়ি ছিল না। তবে সম্পাদক সাহেব আমার সঙ্গে নিজে গিয়ে দেখা করতে না পারায় আরেকবার ক্ষমা চাইলেন। “আপনি আমাদের দেশে অতিথি। মেক্সিকোর মানুষ আমরা অত্যন্ত অতিথিবৎসল। যদিও ওরা বলে আমরা পিছিয়ে পড়ার দল,” বললেন তিনি। তাঁর গলায় যত না তিক্ততা তার চেয়ে বেশি পরিহাস। তাঁর কথার সুর ধরেই উত্তর দিলাম আমি, “মহাশয়, একই নৌকার যাত্রী আমরা। ধবল জাতির উদ্ধত সাম্রাজ্যবাদ ঠিক একইভাবে আমাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য জারি রেখেছে।” বয়স্ক ভদ্রলোকের স্থিতধী মেজাজ তাঁর ওপর আস্থা জাগায়। ঠিক জানি না ব্যাপারটা কীভাবে হলো, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর আমি যখন পত্রিকার অফিস থেকে বেরোলাম তখন তিনি আমার পুরো গল্পটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমার ব্যাপারে তাঁর সহানুভূতি সুস্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারছিলাম। “আবার দেখা হবে আমাদের,” বললেন তিনি। “প্রায়ই দেখা হবে আমাদের। কিন্তু হোটেলটা ত্যাগ করা উচিত আপনার। জায়গাটা মোটেই নিরাপদ নয় আপনার জন্য।” তাঁর শেষের মন্তব্যটা আমার কৌতূহল উদ্রেক করে। কিন্তু তিনি আর কথা বাড়াননি। তাঁর উপস্থিতি এক ধরনের পিতৃসুলভ আবহ তৈরি করেছিল আমার জন্য এবং আমার ভেতরে তাঁর প্রতি ঠিক বাধ্যতা নয়, সম্মানবোধ জাগিয়ে তুলেছিল। বেরিয়ে যাওয়ার আগে উনি আমাকে একদিন তাঁর বাসায় নেমন্তন্ন করে রাখলেন এবং স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন বলে জানালেন। আমার জন্য উপযুক্ত থাকার জায়গাও খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। কয়েকদিনের মধ্যে হোটেল জেনেভা ছেড়ে শহরের অভিজাত এলাকা কলোনিয়া রোমায় একটা ছোট্ট বাসায় উঠে এলাম। ওদিকে হোটেল জেনেভায় অবস্থানের শেষ দিনগুলোয় আমার আবার একটা অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা হলো যার ফলে পুরানো কিছু সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার উপলক্ষ এসে গেল। একটা বিষয় লক্ষ করেছিলাম, হোটেলটায় সব অতিথি দুই ভাগে বিভক্ত। ওখানে আসলে দুটো ডাইনিং রুম ছিল। সাবধানে খোঁজখবর করে জানা গেল হোটেলে বেশ কিছু জার্মান অতিথি আছে। এদের অধিকাংশ দূরপ্রাচ্য বা মার্কিন দেশ থেকে এখানে এসেছিল। কিন্তু তারা এই হোটেলে আসার সঙ্গে সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হোটেলের ইংমার্কিন বোর্ডাররা জায়গাটা তাদের নিজেদের বলে মনে করত। তারা শত্রুপক্ষের কোনো আগন্তুককে বরদাস্ত করবে না। কিন্তু মেক্সিকো নিরপেক্ষ দেশ হওয়াতে জার্মানরাও তাদের ভূমি ছাড়তে নারাজ। হোটেলের কানাডীয় মালিক আবার ব্যবসার সঙ্গে নিজের দেশপ্রেমকে গুলিয়ে ফেলতে নারাজ। জার্মান অতিথিদের বহিষ্কার করলে ব্যবসা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশি ঝামেলাও হতে পারে। ভদ্রলোক তখন উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানের পথে হাঁটলেন। হোটেলটিকে কার্যত দুই ভাগে ভাগ করে ফেললেন। একেক ভাগ একেক যুদ্ধস্মান দলের জন্য বরাদ্দ করা হলো। ব্রিটিশ প্রজা হিসেবে আমার জায়গা হলো ইং-মার্কিন ভাগে। কিন্তু প্রথমদিন ডাইনিংয়ে গিয়ে যখন জানলাম ওরা স্থানীয় কোনো খাবার রাখে না তখন থেকে আমি গণডাইনিং রুমে যাওয়া বন্ধ করে ঘরেই খাবার আনিয়ে খেতাম। হোটেলের লাউঞ্জ বা ড্রইংরুমেও যেতাম না। আমার এই বিচ্ছিন্ন থাকার প্রবণতা অন্যদেরও চোখে পড়েছিল। আমার সঙ্গে অন্য অতিথিদের ব্যবহারও তাই শীতল ছিল। এমনকী হোটেল মালিক নিজেও আমাকে এড়িয়ে চলতেন।
যতদিন না মেক্সিকোকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম ততদিন আমার জন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা স্বস্তিকর ছিল না। ফলে একদিন দুপুরে খাওয়ার পর সকলে যখন স্পেনীয় দিবানিদ্রা সিয়েস্তায় মগ্ন আমার দরজায় মৃদু টোকার শব্দে যারপরনাই অবাক হলাম। দরজা খুললে বিস্ময় আরো বাড়ল। দেখি হোটেলের এক জার্মান বোর্ডার ফিসফিসিয়ে ঘরে ঢোকার অনুমতি চাইছেন। কিছু বলার আগেই উনি ঘরে ঢুকে পড়লেন। ঘরে ঢুকে পড়ার জন্য বারবার ক্ষমা চেয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমার সঙ্গে তাঁর জরুরি কথা আছে এবং এই সাক্ষাতের বিষয়টা কোনোভাবেই যেন হোটেলের অপরপক্ষের বোর্ডারদের কারো চোখে না পড়ে যায় সেজন্যই এত সতর্কতা। ভদ্রলোক যখন নিচুস্বরে নম্রভাবে কথা বলে চলেছেন তখন আমি তাঁকে “যমজ ডিমপোচের” একটা বলে চিনতে পারলাম। যথেষ্ট বেঁটে এই জার্মান ভদ্রলোক তাঁরই সাইজের আরেকজনের সঙ্গে হোটেলের জার্মান পারে থাকেন। প্রায় একই ধরনের পোশাক পরা ইনি আর তাঁর সঙ্গী যেন অবিচ্ছেদ্য। তাঁদের মাথায় নরম কাপড়ের হ্যাট দেখে কেন যেন আমার ডিমপোচের কথা মনে হয়। ইনি তো এখানে, সঙ্গীটি কোথায়? কয়েক মিনিট পরে দরজা খুলে তাঁকে বিদায় দেওয়ার সময় করিডোরের কোনায় পাহারারত সঙ্গীটির দিকে চোখ পড়ল।
বেশ ষড়যন্ত্রমূলক সাক্ষাতের এই ঘটনা দেশে থাকার সময় পুরানো দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। ডিমপোচ যে বার্তা নিয়ে এসেছিলেন তা হচ্ছে, জাভায় থাকতে যে দু’জন বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁরা এখন মেক্সিকোতে। তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলে খুশি হবেন। আমি কি অনুগ্রহ করে আজ সন্ধ্যার পর হাঁটতে হাঁটতে একটি নির্দিষ্ট রাস্তায় গিয়ে চলমান একটি গাড়িতে উঠতে আগ্রহী? অনেকটা যন্ত্রচালিতের মতো হ্যাঁ বলে দিলাম। ভদ্রলোককে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছিল। দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হতে চাচ্ছিলেন। যাই হোক, আমি তো কোনো গুরুগম্ভীর প্রতিশ্রুতি দেইনি যে আমাকে যেতেই হবে। যেতে পারি, না গেলেও চলে। কিন্তু গেলে ক্ষতি কী? মন্ত্রীর আশ্বাসবাণী মনে পড়ল যে, মেক্সিকোতে আমি নিরাপদ। মেক্সিকোর আতিথেয়তার একটা নমুনা হতে পারে ঘটনাটা। গেলে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা দেখছিলাম না। ফলে যাওয়াই মনস্থ করলাম। জাভার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ হচ্ছিল। তাঁরা কারা সেটাও বুঝতে পারছিলাম।
পরবর্তীকালে আমাকে অপহরণের জন্য ইংমার্কিন ষড়যন্ত্রের জাল বিছানোর বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছিল। ব্রিটিশ-আমেরিকান সিআইডির প্রধান ডেনহ্যাম “হিন্দু-জার্মান যড়যন্ত্রজাল” ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে সান ফ্রান্সিকোয় অবতরণ করেছিলেন। এ কাজে আমার এক পুরাতন সহযোগীকে ভারত থেকে বাইরে পাঠানো হয়েছিল। ইনি আবার সাংহাইতে অবস্থানকালে গ্রেপ্তার হন। মামলার সাক্ষ্য দিতে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হলে সে আদালতকে বলে, এই ষড়যন্ত্রের জাল সমগ্র দূরপ্রাচ্যে বিছানো এবং নাটের গুরু হচ্ছি আমি। খবরের কাগজ মারফত এই সংবাদ আমার কাছে পৌঁছেছিল। ভারতে থাকতে লোকটির সঙ্গে যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল ভেবে কিছুটা বেদনা বোধ করেছিলাম। দু’জন মিলে বেশ কিছু দুঃসাহসী “বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে” অংশও নিয়েছিলাম। লোকটার রসবোধ ছিল ভাল, ঘোর দুঃসময় ও বিপদেও যেটা কাজ করত। এককথায়, বিপ্লবী নিষ্ঠুরতা ও কৃচ্ছ্র নীতিবাগিশতার হাতে তার মানবচরিত্র পুরোপুরি খুন হয়ে যায়নি। তার মতো মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করবে এ আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু হয়েছে, এটাই ঘটনা। পনেরো বছর পর দেশে ফিরে জানতে পেরেছিলাম আরো অনেক বিপ্লবীর মতো সেও সন্ন্যাসী হয়েছে। তারপর থেকে তার মৃত্যু ঘটেছে।
সান ফ্রান্সিসকোয় বিচারপর্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেয়েছিলাম ডেনহ্যাম আমেরিকাতেই অবস্থান করছিল। ষড়যন্ত্রের নাটের গুরুর ঘেঁটি ধরে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জোর অভিপ্রায়ে খাপ পেতে বসেছিল সে। তারই প্রণোদনায় আমাকে অপহরণের জাল পাতা হয়েছিল। বস্তুত, আমি শুনেছিলাম এই উদ্দেশ্যে সে নিজেই মেক্সিকোতে এসেছিল।
পাদটীকা:
১.সিসাল ফাইবার (sisal fibre)। একধরনের উদ্ভিদ যা থেকে মোটা আঁশ পাওয়া যায়। আদি বাসস্থান মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশেও উৎপাদন শুরু হয়।
২. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস আনন্দমঠ।
(চলবে)