ভক্তিরসে মত্ত যখন

কিন্তু বৃক্ষ চলমান না হলেও যে এদের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কীট বা পক্ষি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সেটা সবারই জানা।

সেঁজুতি জাহানসেঁজুতি জাহান
Published : 28 Nov 2022, 03:29 PM
Updated : 28 Nov 2022, 03:29 PM

'মনরে কৃষিকাজ জানো না

এমন পতিত জমি রইলো পড়ে আবাদ করলে ফলতো সোনা'

'কে বোঝে মওলার আলেকবাজি

করছে রে কোরানের মানে 

যা আসে যার মনের বুঝি'

'আমার হাতে কালি মুখে কালি 

কালি মাখা মুখ দেখে মা 

পাড়ার লোকে হাসে খালি'

এখানে প্রথম তিন চরণ আঠারো শতকের রামপ্রসাদের। দ্বিতীয় তিন চরণ উনিশ শতকের লালনের। তৃতীয় তিন চরণ বিশ শতকের নজরুলের।

এই তথ্য অত্র অঞ্চলের কমবেশি প্রায় সবারই জানা। তবে লালনের গানের সুরটি রামপ্রসাদীয় নয় বলে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু প্রচলিত হয়ে গেছে বিধায় আমি প্রচলিত সুরের সূত্রটি গ্রহণ করেছি। রামপ্রসাদী সুরের প্রভাবে লালন যদি তাঁর গান নাও গেয়ে থাকেন এবং এই সুর সংযোগ যদি লালনপরবর্তী মানুষের কাজ হয়, তো সেক্ষেত্রেও বলবো রামপ্রসাদের শ্যামা সংগীতের ঘোরতর শক্তির কারণেই এই প্রভাবকে এড়ানো যায়নি। মানে মানুষের ভেতরে সুরটা ছিল। 

শিক্ষকতার সুবাদে গত কিছুদিন আগে ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের 'অপরিচিতা' পড়াচ্ছিলাম। এই ক্লাসের কিছুদিন পরেই ছাত্রদের পরীক্ষা। ফলে পড়ানো শেষ করে ছাত্রদের বললাম, 'ঠিক আছে, দেখা হবে পরীক্ষার হলে।'

ফট করে এক ছেলে দাঁড়িয়ে বলল, 'ম্যাম ক্লাসে তো আপনি অন্নপূর্ণা, আর পরীক্ষার হলে পুরাই কালী।'

কথাটা খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে। বাসায় ফিরে এবং এখনো কথাটা মাথায় ঘুরছে।

বছর কয়েক আগে আমার এলাকার এক বড়োভাই মৃত্যুঞ্জয়দার কণ্ঠে প্রথম নজরুলের 'হাতে কালি, মুখে কালি' শ্যামা সংগীতটি শুনলাম। এর আগেও এই সুরে রামপ্রসাদের গান শোনা হয়েছে। শুনেছি লালনকেও। কিন্তু তিনজকে একসঙ্গে এভাবে নিজের কানে এবং মনে আবিষ্কার করলাম আমার ছাত্রের ওই মন্তব্যটির পরে।

মানুষের মধ্যে এরকম ঘটনা প্রতিনিয়তই হয়। পরিচিত বা মুখস্থ অথচ আমল না করা অনেক বিষয়ই আমাদের চারপাশে ঘুরে ফিরে বেড়ায়। খেয়াল করি না। খেয়াল করি না বা আমলে আনি না দেখেই বিষয় কিংবা শাস্ত্রজ্ঞ কপিল কথিত 'তত্ত্ব'কে সবসময় খুঁজে পাই না।

সাংখ্যদর্শনে প্রতিপাদ্য বিষয়কে ‘তত্ত্ব’ নামে অভিহিত করা হয়। এর মূলে রয়েছে নিত্য প্রকৃতি ও নিত্য পুরুষ নামক দুটি তত্ত্ব।

সাংখ্য মতাদর্শীদের মতে, তত্ত্বের সংখ্যা পঁচিশ। এই পঁচিশটি তত্ত্বের যথার্থ জ্ঞানের মাধ্যমে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ হয়। মোক্ষলাভের মাধ্যমে প্রকৃতির তিন ভাগে বিভক্ত দুঃখ (আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক) দূর হয়।

এই মুহূর্তে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ভেতরে যে শ্রবণেন্দ্রিয় আছে তার তত্ত্বকে খুঁজবার চেষ্টা করা যাক খানিকটা।

রামপ্রসাদের শ্যামা সংগীত বাংলা ঐতিহ্যে বেশ বিখ্যাত। তাঁকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি ও গবেষণাও হয়েছে, হয়েছে লালনকে নিয়েও, নজরুলের শ্যামা সংগীত ও হামদ নাত নিয়ে তুলনামূলক অনেক আলোচনাই হয়েছে।

কিন্তু একটা ব্যাপার কি বোঝা গেছে পরপর তিনটি শতকে (কিংবা আরও পরে) একই সুরে এইসব মহাজনেরা সাধন ভজন করে গেলেন কী করে? এই সুরে কী এমন আছে?

সুরটা মর্মগ্রাহী সন্দেহ নেই। তবে এমন সুরে যেকোনো ভাববাদী কথাকে অনায়াসেই যে সুন্দর করে বসানো যায় এবং তা মানব মনে স্থান করে নিতে বাধ্য সে কথা মানতে নিশ্চয়ই কারো অমত থাকবে না।

রামপ্রসাদ বলছেন নিজের মনকে, লালন বলছেন গুরু সিরাজ সাঁইকে, নজরুল বলছেন কালী মাতাকে। একটা মহাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার যে যোগাযোগ বা যোগাযোগ-ব্যবস্থার যথাসম্ভব উন্নতি সাধনের চেষ্টা, এই ব্যাপারটা গানগুলোতে দেখা যায়।

গানগুলো আসলে ওইসব মানুষই। গাছ যেমন শাখা ছাড়ে পাতা ছাড়ে মানব মনও তেমন সুর ছাড়ে কথা ছাড়ে। কথা যেমন তাৎক্ষণিকভাবে উৎপাদিত হয় না, এর জন্য মানব 'ভাষা'র মধ্যে শব্দসম্ভারের একটা ইতিহাস থাকে, ঠিক তেমনি মানুষের ভেতরের সুর আর কথা প্রাকৃতিক নিয়তির মতোই মানুষকে ছাড়তে থাকে। কথাগুলো কখনো ফলবান হয়, কখনো পাতার সৌন্দর্যে প্রাণবাণ হয়।

গাছ যেমন সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে পরিণতির পথে ধাবিত হয়, মানুষ তেমনি ইন্দ্রিয় যোগে নানামাত্রিক পরিণতির দিকে যায়।

জীবাত্মা আর পরমাত্মার প্রেম যে সর্বোৎকৃষ্ট প্রেম এটা যেকোনো আধ্যাত্মিক মনই জানে। মানুষ যুগে যুগে এইসব প্রেমের পাগলামি করে আসছে।

রামপ্রসাদ, লালন বা নজরুলকে আমরা এই কাতারে প্রায় কাছাকাছি কারণেই রাখতে চাই। 

কাছাকাছিই রাখছি। মিশাচ্ছি না। কেননা ভাবসাধনায় এঁদের সকলেই বৃক্ষ হলেও প্রজাতি ভিন্ন। 

কিন্তু বৃক্ষ চলমান না হলেও যে এদের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কীট বা পক্ষি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সেটা সবারই জানা। রামপ্রসাদ, লালন এবং নজরুলের মধ্যেকার সেই যোগাযোগের মাধ্যমটি আসলে কে সেটা জানা জরুরি।

সংযোগের এই পাখিটির নাম দেয়া যেতে পারে সাংস্কৃতিক ইতিহাস। 'কুমারহট্ট' হল সেই পাখির আদিমাতা। যে জায়গাটিতে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নানাবিধ বিদ্যান্বেষী এসে জড়ো হতেন। যা ছিল হালিশহরের গঙ্গাতীরবর্তী প্রাচীন জনপদ। কুমারহট্ট নিয়ে কিংবদন্তির কোনো অভাব নেই। একসময় এখানে নাকি কুমারদের বিরাট বিরাট হাট বসত, গঙ্গার ঘাট থেকে হাঁড়ি-কলসি নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হত। সেজন্যই নাকি 'কুমারহাট' বা 'কুমারহট্ট' নাম হয়েছিল। আবার এখানে যেসব পণ্ডিতেরা দূর দূর দেশ থেকে এসে জ্ঞানচর্চা করতেন তাঁদের অধিকাংশই নাকি কুমার ছিলেন। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে হালিশহর নামটি প্রথম পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বিদ্যাচর্চার ফলে কুমারহট্ট-পণ্ডিতসমাজ একসময় নদীয়া জেলার নবদ্বীপের সমতুল্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। হালিশহরে 'চৈতন্য ডোবা' নামক জলাশয়ের ধারে বাস করতেন চৈতন্য মহাপ্রভুর দীক্ষাগুরু ঈশ্বর পুরী; এই জায়গার সামনের একটি মাঠে বর্তমানে গৌর-নিতাই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। এই সময় চৈতন্যদেবের প্রভাবে এখানে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম বেশ বিস্তারলাভ করেছিল। অষ্টাদশ শতকের প্রখ্যাত এবং আমাদের আলোচ্য সাধক রামপ্রসাদ সেনের বসবাস ছিল এই হালিশহরে। ফলে অবাস্তব নয়, শ্রীচৈতন্যের ভাবধারার সংগীতের প্রভাব রামপ্রসাদের মধ্যে পড়া।

সেসময় কুমারহট্টের প্রায় প্রত্যেক ঘরেই যে সংগীত চর্চা হত সে সম্পর্কে রামসুন্দর তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যের 'সুন্দরের বর্ধমান প্রবেশ' অংশে বর্ণনা দিচ্ছেন:

 ''প্রভাতে উদয়াদিত্য       সুন্দর প্রফুল্লচিত্ত

              প্রবেশিলা বীর সিংহদেশ

স্বচ্ছন্দ সকল লোক,   নাহি রাগ দুঃখ শোক,

           নাহি কোন অধর্মের লেশ।

দিব্য পরিচ্ছদ পরে,     গান বাদ্য ঘরে ঘরে

          তিলেক নাহিক তালভঙ্গ।"

কুমারহট্টের সংগীতের সমৃদ্ধি সম্পর্কে স্বামী প্রজ্ঞানন্দ তাঁর 'বাংলাদেশে রাগ সঙ্গীতের ধারা' প্রবন্ধে বলছেন--

"শ্রীচৈতন্য নিজে, স্বরূপ দামোদার, মুরারিগুপ্ত, মুকুন্দ দত্ত, রায় রামানন্দ প্রমুখ সকলেই ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শী।"

ফলে বোঝাই যাচ্ছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের এই ধারাটি রামপ্রসাদকে প্রভাবিত করেছিল। অন্তরাত্মায় তিনি কালী সাধনায় লিপ্ত ছিলেন, কিন্তু তার সুর-প্রকাশ ঘটেছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রভাবে।

নদীয়া এবং শ্রীচৈতন্য যে লালনের মানস জুড়ে প্রবহমান তা তো সবারই জানা। ফলে সুরটি তাঁর সাধনাতেও এসেছিল।

আর নজরুল যে সংগীত নিয়ে নিরীক্ষা পরীক্ষা এবং একক রাজত্বের একটি প্রকাশ্য চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সে বিষয়ও সবাই জানে। ফলে নজরুলের সংগীতে রামপ্রসাদী কালিসাধনা এবং উচ্চাঙ্গের এই সুর সংযোজনা তাঁর জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আমি তিন শতকের এমন তিনজন সংগীতজ্ঞকে আমার আজকের আলাপে নির্বাচন করেছি যাঁরা সংগীতকে কেবল পারফর্মিং আর্ট হিসেবে গ্রহণ করেননি। তাঁরা তিনজনই ছিলেন রীতিমত সাধক। তিনজনের মধ্যে নজরুলকে অপেক্ষাকৃত একটু বাজারি ধাঁচের মনে হলেও তিনি ছিলেন যুগের অনন্য সৃষ্টি। আমাদেরকে সবসময় সময়কে মাথায় রাখা লাগবে। শ্রীচৈতন্যের ভাবজগৎ ও উচ্চাঙ্গের ধারা রামপ্রসাদে একভাবে এসেছে, লালনে হুবহু সেভাবে আসেনি। কিন্তু সুরের দিক থেকে নজরুলের মধ্যে পুরোপুরি প্রভাব পড়েছে বলে মনে হলেও কথার মধ্যে আছে যুগের বাস্তবতা। 

রামপ্রসাদী কালী সাধনায় কোনো সামাজিক প্রতিবন্ধকতা নাই, আছে ব্যক্তি আলস্য। যেমন:

"কালী নামে দেওরে বেড়া, ফসলে তছরুপ হবে না "

কিন্তু নজরুলের কালী সাধনায় ব্যক্তিগত আলস্য নাই, আছে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। নজরুল বলছেন:

"যা লিখিস মা বনের পাতায় 

সাগর জলে আকাশ খাতায়, 

আমি সে লেখা তো পড়তে পারি 

মূর্খ বলে দিক্‌ না গালি মা, 

লোকে মূর্খ ব’লে দিক্‌ না গালি।।"

লালনের গানটিতে সুর নিয়ে বিতর্ক থাকলেও চৈতন্যের আধ্যাত্মবাদের প্রভাব এবং কাছাকাছি সুর পাওয়া যায়।

লালনও সাধনার পথে ব্যক্তিগত আলস্যের চেয়ে সামাজিক মত ও পথের ঘেরাটোপ নিয়ে বেশি চিন্তিত।

লালন প্রশ্নবাদী সাধক। প্রশ্ন তিনিই ভালো করতে পারেন, প্রশ্নের উত্তরটি যার কাছে পরিচ্ছন্ন থাকে।লালনের সুরে যে বয়ানটি পাই তা হল:

"একই কোরান পড়াশোনা

কেউ মৌলভি কেউ মাওলানা

দাহেরা হয় কতজনা

সে মানেনা শরার কাজি।।"

যেকোনো সাধনায় নির্ধারিত সুর থাকলে চিন্তায় সুবিধা হয়। তাই আমি আজকে আমাদের বাংলা সংগীতের তিন মহীরুহকে স্মরণ করছি আরও বেশি আত্মলিপ্ত হবার জন্য। আলোচিত তিনজনকে আমরা পড়বো, বুঝবো, শুনবো এবং নিজের চিন্তাকে গ্রহণযোগ্য করার মাধ্যমে 'তত্ত্ব'কে খুঁজে মোক্ষ লাভ করবো।

সবশেষে বলতে চাই যুগে যুগে সংগীতের মাধ্যমে প্রার্থনা বাড়ুক। মানুষের আত্মায় শান্তি নামুক।