Published : 27 Aug 2022, 05:39 PM
চিলিয়ান কবি পাবলো নেরুদা মনে করতেন, কবিতা Social act--যদিও তাঁর অসংখ্য প্রেমের কবিতা রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য’ যেন দ্বিবিধ সত্তা। এপার-ওপার বাংলার জনসংস্কৃতিতে নজরুলের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাঁর মতো অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেখক খুব কমই ছিলেন। তাঁর চার ছেলের নাম রেখেছেন মুসলিম ও হিন্দুর ঐতিহ্যের মিশ্রণে। মসজিদ-মাদরাসায় বাজে নজরুলের ইসলামি গান ও গজল। হিন্দুদের অনুষ্ঠানে বাজে নজরুলের শ্যামাগীতি। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ বাঙালি মুসলিমানের ধর্মীয় ঈদ উদযাপনের মূলমন্ত্র। তাঁর রচিত ‘চল চল উর্ধ্বে গগনে বাজে মাতল’ বাংলাদেশের গণসংগীত।
প্রগতি ও গণতন্ত্রের কবি হুইটম্যান। নজরুলও তাই। O Captain! My Captain! কবিতার মতো লং ফ্রি-ভার্সে কবিতা লিখেছেন হুইটম্যান। তিনিই লং-ফ্রিভার্স কবিতা চালু করেন। নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতার মতো মুক্তক ছন্দের অনেক কবিতা জনপ্রিয়। হুইটম্যানকে আমেরিকার জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। নজরুল সাম্যবাদকে জীবনযন্ত্রণার অভিজ্ঞতায় প্রোথিত করেছেন এবং কবিতাকে প্রকৃত মানবতাবাদীর দিকে নিয়ে গেছেন।
চুরুলিয়ায় জন্মেছিলেন তিনি। আশে-পাশের খেটে-খাওয়া মানুষের সংগ্রাম দেখেছেন তিনি। জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনিও এ শ্রেণিরই। তাকেও কঠিন জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার বিপ্লব, তুর্কির নবজাগরণ তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে মনে করা হয়। ফলে, বাস্তবতার সঙ্গে নিজস্ব অভিজ্ঞতা মিলিয়ে মানবতাবাদের শেকড়ের কাছাকাছি যেতে পেরেছেন। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে বেরিয়ে এসেছেন। শোষণ ও বঞ্চনার প্রতি ভয়ঙ্কর ও নির্মম আঘাত হেনেছেন। অনেকসময় ধর্ম-বর্ণের নানা ভ্রান্তনীতির জন্য মানবতাকে পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এখানেও তিনি আঘাত করেছেন। সাম্প্রদায়িকতার দাঁত ভা্ঙা জবাব দিয়েছেন। নিজের চার সন্তানের নাম হিন্দু-মুসলিমের ঐতিহ্যের মিশ্রণে রেখেছেন--কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। বলেছেন, ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান/ মুসলিম তার নয়ণ-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ’।
মানবতাবাদী কবির প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে সমাজের বিরাজমান নানান অসঙ্গতি, অবিচার, অন্যায়, অনাচার ও বৈষম্যের প্রতিবাদ করা, মূলে আঘাত করা। সমাজে ঘাপটি-মেরে-থাকা অমানুষদের প্রতি ক্ষোভ ও বিদ্রোহ উগরে দিয়েছেন তিনি, ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় কাজ বা পদক্ষেপের প্রতি রুখে দাঁড়িয়েছেন। এজন্য একাধিকবার জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন তিনি।
তাঁর পাঁচটি গ্রন্থ-- যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, চন্দ্রবিন্দ-- বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের এ পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। পাঁচটি গ্রন্থ ছাড়াও অগ্নিবীণা, ফণিমনসা, সঞ্চিতা, সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল প্রভৃতি বই ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়েছিল। বিশ্বসাহিত্যেও বই বাজেয়াপ্ত ঘটনা আছে। গ্রিক ও লাতিনদের জন্য ‘বাইবেল’ নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে সম্রাট জাস্টানিয়ান বই নিষিদ্ধকরণ নীতির প্রবর্তন শুরু করেন। শিল্প-সংস্কৃতির তীর্থস্থান ফ্রান্সেই বই নিষিদ্ধ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ‘ডিভাইনা কমেডিয়া’র মতো সাহিত্যরচনা। নিষিদ্ধ হয়েছে রুশোর বই। রাজরোষে পড়ে নিষিদ্ধ হন বালজাক ও এমিল জোলার মতো লেখকরা। ১৮৫০ সালে নিষিদ্ধ করা হয় ভিক্টর হুগোর বই। কবি বোদলেয়ারের ‘লে ফ্লর দ্য মল’ নিষিদ্ধ করা হয়।
আগ্নেয়গিরির মতো প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন শাসকের প্রতি, সমাজের ভ্রান্তনীতির প্রতি। তিনি মানবতার পক্ষে আসলেন “ধূমকেতু’’ হয়ে। ঘোষণা দিলেন :
‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
সাত-সাতশো নরক-জ্বালা জলে মম ললাটে,
মম ধূম-কুণ্ডলী করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে।
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ,
আমি স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার--
আর মর্তে সাহারা-গোবি-ছাপ,
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ!’
(ধূমকেতু )
বিংশ শতাব্দীর মানবতার জন্য জোরালতম উচ্চারণ ‘আমি সাম্যের গান গাই’। কুলি-মজুর ও শ্রমিক শ্রেণির প্রতি দেখালেন গভীর সহমর্মিতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা। শোষণ-মুক্তির আহবান জানান। বাংলাসাহিত্যে তিনিই প্রথম সাম্যের গান গেয়েছেন, নির্যাতিত মানুষের পক্ষ নিয়েছেন। মূলনীতি হিসাবে প্রচার করেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান (মানুষ)’। আবার ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় বলেন :
‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হ’য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-মুসলিম-ক্রীশ্চান!’
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘‘মানুষ জাতি’’ কবিতায়--‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে/সে জাতির নাম মানুষ জাতি;/...কালো আর ধলো বাহিরে কেবল/ভিতরে সবারই সমান রাঙা’। ঠিক একইরকম ধ্বনিত হয়েছে নজরুলের কণ্ঠেও--‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি (মানুষ)’। তথাকথিত ‘দেবতা’কে না-খুঁজে মানুষের সেবা করলেই দেবতা-দর্শন করা যাবে বলে নজরুল মনে করেন :
'তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকলের দেবতার।
কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি-কঙ্কালে?'
(সাম্যবাদী)
বহুমুখী প্রতিভা ছিলেন নজরুল। কবি, গীতিকার, গণমুখী সাংবাদিক। মানবতার পক্ষে এত শব্দ বিশ্বের কোনো সাহিত্যিক (এমনকি রাজবীতিবিদ বা সংগঠক) ব্যবহার বা প্রয়োগ করেছেন কিনা জানি না। বিশ্ব মানবতার জোরালো কণ্ঠস্বর তিনি। শোষণ ও সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে এক সৃষ্টিশীল সত্তা। লেলিন ‘দ্যা গ্রেট ফর সোভিয়েত’ বলা হয়।
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’
(কাণ্ডারী হুশিয়ার!)