তোফাজ্জল হোসেনের তরুণ বয়সেই তাঁর নৈকট্য লাভের আমার সুযোগ ঘটেছিল। তখন আমিও কিশোর তারুণ্যে পা দিয়েছি মাত্র।
Published : 05 Dec 2023, 04:22 PM
এক.
কিছু মানুষ আছেন--যাঁরা নীরবে নিজের সংসার, আত্মীয়স্বজনের জন্য যেমন নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করেন--একই ধারায় দেশের মানুষের জন্যেও প্রায়শ ভালোবাসা জানাতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। দেশের সঙ্কটে এঁরা নিজের সাধ্যমত সংকট সমাধানে এগিয়ে যান। থাকেন প্রচারবিমুখ। কিছু একটা কাজ সমাধা করে নিজে অপার আনন্দ লাভ করেন। কাজের সঙ্গীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে উৎসাহিত করেন, তাদের কাজের প্রশংসা করেন। তরুণ নাগরিকদের নানারকম কাজে উৎসাহ দেন। সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার পথের সন্ধান দেন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই ধরনের মানুষ আছেন, আর এঁরা আছেন বলেই সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার প্রেরণা লাভ করে।
শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু প্রচারবিমুখ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁদেরই একজন তোফাজ্জল হোসেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় ১৯৫৬ সালে, দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে। সদ্য মফস্বল শহর চাঁদপুর থেকে আসা এক কিশোর তরুণ আমি। চারুকলায় ভর্তি হয়েছি মাত্র। ইত্তেফাক অফিসে যাতায়াত ছিল কচি-কাঁচার আসর ও কচি-কাঁচার মেলার কারণে। দৈনিক ইত্তেফাক তখন দারুণ জনপ্রিয় দৈনিক। সপ্তাহে একদিন শিশু-কিশোরদের পাতা--কচি-কাঁচার আসর ছাপা হতো। সেই পাতায় ছড়া-কবিতা লিখতাম, সঙ্গে ছবি এঁকেও দিতাম।
দাদাভাই--রোকনুজ্জামান খান--ছিলেন পরিচালক। আসরের তরুণ ও কিশোর লেখকদের উদ্যোগে কয়েকজন খ্যাতিমান লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিসেবী ব্যক্তিত্বের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালের ৫ অক্টোবর গঠিত হয় কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা। মেলারও পরিচালক হলেন একই ব্যক্তি, যিনি আসরের পরিচালক রোকনুজ্জামান খান। অনেকেরই ধারণা ছিল, কচি-কাঁচার মেলাও ইত্তেফাকের শিশু-কিশোর সংগঠন। আসরের নামের সঙ্গে মিল থাকার কারণেই এই বিভ্রমের কারণ। দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) সংগঠনের ‘কচি-কাঁচার’ নামটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং কচি-কাঁচার মেলা সংগঠনটি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সংবাদ প্রচারের সহযোগিতাসহ সংগঠনের কার্যালয়ের জন্য এবং ছোট্ট একটি পাঠাগার গড়ে তোলার জন্য দুটো ঘর বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। আমি এখানে সম্পাদকের কথা বলছি না। অন্য একজন তোফাজ্জল হোসেনের কথা বলছি।
তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল--এই কচি-কাঁচার আসর ও কচি-কাঁচার মেলার কারণে। ইত্তেফাক অফিসে ঢুকলেই প্রথম যে ঘরটি পড়তো, সেখানেই একটা টেবিলে তোফাজ্জল হোসেন বসতেন। একই টেবিলে বসতেন নেয়ামাল বাসির। তিনি উর্দু গল্পের অনুবাদ করে সেই সময়েই বেশ পরিচিতি লাভ করেছেন। এরা দু’জনেই ইত্তেফাকের সহ-সম্পাদক। ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় পাতায় সহ-সম্পাদকের লেখা ছাপা হতো। কখনো লেখকদের নামে, কখনো নামহীন। নির্ভর করতো বিষয়ের ওপর। সহ-সম্পাদকদের ঘর ডিঙিয়ে দাদাভাই রোকনুজ্জামানের কাছে যেতে হতো। একদিন তোফাজ্জল হোসেন আমাকে থামালেন।
--এই যে তরুণ। একটু থামো, সামনের চেয়ারটায় বসো। দাদাভাই এখনো আসেন নাই, তোমাদের এই তরুণ কিশোরদের দেখে খুউব ভালো লাগছে। আমাদের রোকনুজ্জামান খান তোমাদের নিয়ে কচি-কাঁচার মেলা গড়ে তুলেছে। ‘দাদাভাই’ নামটাও চমৎকার। এক সময় রোকনুজ্জামান খান, আবদুল্লাহ আল মুতী, মিজানুর রহমান (ইত্তেফাকের সাংবাদিক ও সময়ে সময়ে আলোকচিত্রী)সহ তোমাদের কচি-কাঁচার অভিভাবকরা বেশিরভাগই মুকুল ফৌজের সদস্য ছিলেন। আমিও মুকুল ফৌজ করতাম সেই প্রথম থেকেই এবং এখনো মুকুল ফৌজের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। শুনেছি তুমি চারুকলার ছাত্র--খুউব ভালো। তোমাদের শিক্ষক শিল্পী কামরুল হাসান আমাদের মুকুল ফৌজের সর্বাধিনায়ক। সেই কলকাতার পার্ক সার্কাস মাঠ থেকেই তিনি মুকুল ফৌজের শিশু-কিশোরদের পিটি প্যারেড করার চর্চা ইত্যাদি খুব যত্ন নিয়ে শেখাতেন। কামরুল হাসানের নেতৃত্বে শিশু-কিশোরদের দেহ-মন ভালো রাখার জন্য নানা রকম ‘প্যারেড’ ও খেলাধুলা সবার কাছেই ছিল আনন্দের।
এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলে তিনি থামলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন,
--বিরক্ত হচ্ছো না তো?
--না না, আপনি বলেন। আমি অনেক কিছু জানতে পারছি।
--তুমি কী জানতে পারছ, তা জানি না--তোমার মতো তরুণ বয়সে আমরাও অনেক আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে মুকুল ফৌজ করেছি। তোমাদেরও সে রকম উৎসাহ দেখে আমার ভালো লাগছে। তাই তোমাকে পেয়ে পুরনো দিনের গল্প করছি। সংগঠন করতে যেয়ে সমবয়সী অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হবে--পরস্পর একে অন্যকে জানবে। অনেক গুণী ও খ্যাতিমান মানুষের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাবে। তোমার আগ্রহ ও কৌতূহল থাকলে ভবিষ্যতের জন্য অনেক কিছু অর্জন করতে পারবে।
একটু পরই দাদাভাই চলে এলে তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে গল্প করা সেদিনের জন্য থামাতে হলো। এভাবেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত। প্রথম দিনেই তাঁকে আমার ভালো লেগে গেল। তাঁর আন্তরিক আলাপচারিতা ও নানা রকম গল্প। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন তোফাজ্জল ভাই এবং সুযোগ পেলেই তাঁর সঙ্গে গল্পে মেতে উঠি। এখন আমি একা নই। শাহাদত চৌধুরী এবং মাঝে মধ্যে মাহবুব তালুকদার বা সৈয়দ শাহজাহান। আমরা তখন এক ঝাঁক তরুণ--কচি-কাঁচার আসর ও কচি-কাঁচার মেলা মাতিয়ে রেখেছি। তোফাজ্জল ভাইরা বলতেন দাদাভাইয়ের সৈনিক। দৈনিক ইত্তেফাক তখন সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। সারাদেশে প্রচুর পাঠক ও গ্রাহক। নামকরা অনেক সাংবাদিক ও লেখকের যাতায়াত ঘটে পত্রিকা অফিসে।
এই পত্রিকাকে ঘিরে কাজ করেন দেশের বিশিষ্ট সব সাংবাদিকরা। সিরাজুদ্দীন হোসেন--নিউজ এডিটর। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন--নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, রেজা মুহম্মাদ আসফউদ্দৌলা, খন্দকার আবু তালেব, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুল, আবদুল ওয়াদুদ পাটোয়ারী, ভবেশ রায়, মোতাহার হোসেন সিদ্দিকী, আবদুল আউয়াল, কবি আল মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তিত্ব। তোফাজ্জল হোসেন, নেয়ামাল বাসির, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ও মিজানুর রহমানের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আমরা নবীন ও তরুণরা কচি-কাঁচার মেলা ও আসরের সুবাদে উপরি-উক্ত ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসে অনেক কিছু জানতে পারছি এবং তাদের স্নেহধন্য হয়ে চিন্তা ও চেতনায় উৎসাহ পাচ্ছি।
তোফাজ্জল হোসেন একদিন গল্প করলেন--‘ব্রতচারী’র উদ্ভাবক ও সংগঠক গুরুসদয় দত্তের বিষয়ে। ব্রতচারীর চর্চা কীভাবে শিশু-কিশোরদের এমনকি যে কোনো বয়সের মানুষকে দেশ ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। এবং নিজকে সংস্কৃতিবান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে উপযুক্ত ভ‚মিকা রাখে। সেদিন শ্রোতা ছিলাম আমি ও শাহাদত চৌধুরী। শাহাদত তোফাজ্জল ভাইকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। তার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে জানালেন--গুরুসদয় দত্ত ব্রিটিশ শাসিত ভারতে সিলেট জেলায় জন্মেছিলেন ১৮৮২ সালে। লেখাপড়ায় মেধাবী ছাত্র স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব সময় প্রথম স্থান দখল করেছেন। উচ্চতর শিক্ষার জন্যে বিলেতে গিয়ে আইসিএস পরীক্ষায় মেধা তালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেন। কারণ সর্বভারতীয় পর্যায়ে বাংলার ছেলেদের মেধা তালিকায় স্থান লাভ করা সে সময়ে খুব কঠিন ছিল। গুরুসদয় দত্ত উচ্চতর সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করলেও বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিশেষ করে লোকসংস্কৃতির প্রতি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সমগ্র ভারতকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার স্বাধীনতা আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে। গুরুসদয় দত্ত ব্রিটিশ সরকারের আইসিএস তথা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়া সত্তে¡ও মনে প্রাণে ছিলেন স্বাধীনতাকামী ও দেশপ্রেমী। খাঁটি বাঙালি হিসেবে নিজকে ও অন্যান্যদের আত্ম-উপলব্ধির জন্য সত্যনিষ্ঠা, সংযম, মাতৃভাষা প্রীতি, স্বাস্থ্য জ্ঞান ও মনেপ্রাণে প্রফুল্ল থাকার অধ্যবসায় গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
তাঁর এই আন্দোলনই ব্রতচারী আন্দোলন নামে লোকনৃত্য ও লোকসংগীত চর্চার মাধ্যমে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তোমাদের শিক্ষক শিল্পী কামরুল হাসান সরাসরি গুরুসদয় দত্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অত্যন্ত নিষ্ঠা নিয়ে ব্রতচারীতে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই মুকুল ফৌজে আমরা ‘ব্রতচারী’ শিক্ষাকে শিশু-কিশোরদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। কামরুল ভাইয়ের ঢোলের বোলে আকৃষ্ট হয়ে মুকুল ফৌজের শিশু-কিশোররা আনন্দে নাচতে নাচতে মাঠে চলে আসত। ঢোলের বাজনার তালে তালে নেচে গেয়ে শিশু-কিশোররা ব্রতচারী শিখে নিত। কচি-কাঁচার পরিচালক তোমাদের দাদাভাই রোকনুজ্জামানও ব্রতচারী শিখেছেন। তিনি চমৎকার ঢোল বাজাতে পারেন। ব্রতচারীর মৌল উদ্দেশ্য তিন লাইনের একটি গানের মাধ্যমে ‘ব্রত’ হিসেবে আমরা গাইতাম।
ষোল আনা বাঙালি হ’
বিশ্বমানব হবি যদি
শাশ্বত বাঙালি হ’
দুই.
সম্ভবত ১৯৫৯ সালের কোনো এক সময় তোফাজ্জল হোসেন ভাই ইত্তেফাক ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। এরপর দীর্ঘকাল তাঁর সঙ্গে দেখা নাই। শুনেছি, দেশে বিদেশে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ও তথ্য সার্ভিসে কাজ করছেন। ষাটের দশকের (১৯৬১-৭০) মাঝামাঝির পরে তাঁকে ঢাকায় দু’একটি অনুষ্ঠানে দেখি। দু’একবার মুখোমুখি হলে আমি সালাম দেই, তিনি খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে কুশল জানতে চান। একদিন বাংলা একাডেমির একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে তাঁর পাশের চেয়ারটি খালি দেখে আমি এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম--এই খালি চেয়ারে কি একটু বসতে পারি?
--আরে হাশেম তুমি? বস বস। এখানে এতক্ষণ বসেছিল এনামুল হক। জাদুঘরের পরিচালক। তুমি নিশ্চয় চিন তাকে। কী একটা কাজে একাডেমির ভেতরে গেছেন। তিনি আসা পর্যন্ত তুমি বস। তুমি তো এখন ছবি আঁকায় বেশ খ্যাতি অর্জন করেছ। শুনেছি চারুকলার শিক্ষক এখন। কামরুল ভাই শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার নকশা কেন্দ্রে পরিচালক হয়েছেন। তাঁর ওখানে মাঝে মাঝে যাই। আমাদের মুকুল ফৌজ যথাযথ লোকের অভাবে আগের মতো অবস্থায় নেই। তবে তোমাদের কচি-কাঁচার মেলা যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে। সেদিন প্রেসক্লাবে দাদাভাই-এর সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ হলো। তিনি জানালেন দেশের প্রতি জেলা, মহকুমা, থানায় কচি-কাঁচার মেলার শাখা হয়েছে। প্রায় নাকি ৩০০ শাখা, শুনে খুব ভালো লাগল। এমন সময় এনামুল হক সাহেব চলে আসায় আমি উঠে দাঁড়ালাম। তোফাজ্জল ভাই বললেন--আমার অফিসে আস একদিন। বিকেল ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে এসো। তখন ব্যস্ততা কম থাকে। প্রেস ক্লাবের ঠিক উল্টোদিকে, রাস্তার উত্তর পাশে। যে বাড়িটা বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর বোসের বাড়ি (বিজ্ঞানী সত্যেন বসু) ছিল। সেটা এখন অনেক বাড়ানো হয়েছে। একটা বিশাল লাইব্রেরি আমি গড়ে তুলেছি।
কয়েকদিন পরই গিয়ে হাজির হলাম। বই, লাইব্রেরির প্রতি আমার ভালোবাসা সেই শৈশব-কৈশোর থেকেই। চারুকলায় পড়ার সময় দিনের অনেক সময় নিয়ে ঢাকার অনেক লাইব্রেরি ও পাঠাগারে নিজের পছন্দমতো বই খুঁজে পড়তাম। খুব বেশি যাতায়াত ছিল ইউএসআইএস-এর লাইব্রেরিতে, যেটি সেগুন বাগান রোডে ঢুকতেই ডানপাশে পড়ে। তৎকালীন জিন্নাহ এভিনিউতে (বর্তমানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) ভারতীয় তথ্য কেন্দ্রের পাঠাগারটিও আমার জন্য ছিল এক আনন্দ ভুবন। বাংলা সাহিত্যের পশ্চিমবঙ্গীয় সব দিকপাল লেখকদের বইতে ঠাসা ছিল লাইব্রেরির আলমিরা। এ ছাড়াও পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য জার্নাল। আর একটি আকর্ষণীয় বিষয় ছিল নানা বিষয়ে ‘শর্ট ফিল্ম’ ও খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকারদের পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি দেখা।
তোফাজ্জল হোসেন লাইব্রেরির জন্য দেশি-বিদেশি বহু মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহ করেছেন। তিনি যেখানটায় একটা ফুল সেক্রেটারিয়েট টেবিল নিয়ে অফিসে বসেন--তার পেছনে ডানপাশে ও বামপাশে খানিকটা দেয়াল ফাঁকা। ডানপাশের দেয়ালে ঝুলছে শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা বাংলা নিসর্গের চমৎকার একটি জলরং ছবি। ষাটের দশকে (১৯৬৫-১৯৬৭) কামরুল হাসান তাঁর স্বভাবসুলভ দ্রুত তুলি সঞ্চালনে বেশ কিছু নিসর্গ-চিত্র এঁকেছিলেন। ছবিতে সবুজ ধানখেত, পাশে নদী, নদীতে নৌকা, দূরে নদী বাঁক নিয়ে সুদূরে চলে গিয়েছে। নীল আকাশে কিছু সাদা পুঞ্জ মেঘ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছবিটি গ্রামবাংলার ‘শরৎ ঋতুকালের’। মুগ্ধ হয়ে আমি ছবিটি দেখছিলাম। আমার মনের ভাব লক্ষ করেই তোফাজ্জল হোসেন বলে ওঠেন
--তোমার ভালো লেগেছে ছবিটা?
--খুউবই সুন্দর ছবি।
তারপর একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বললেন--শিল্পী কামরুল হাসান আমাদের মুকুল ফৌজের সর্বাধিনায়ক। আমার সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা সেই তরুণ বয়স থেকে। এই লাইব্রেরি ও অফিসটা একটু গুছিয়ে নিয়ে একদিন গিয়ে হাজির হলাম তাঁর ‘নকশা কেন্দ্রের’ অফিসে। কুশল বিনিময় ও অন্যান্য কিছু গল্প করার পর জানালাম--কামরুল ভাই, একটি বিশেষ কাজে এসেছি আপনার কাছে। আমার অফিসের জন্য আপনার একটা ছবি সংগ্রহ করব। খুলে বললাম--অফিসে ছবি টাঙানোর জন্য কোনো বাজেট নেই--এটা আপনি ভালো করেই জানেন। কোনো সরকারি অফিসেই নেই। লাইব্রেরির জন্য বই কেনা, অফিসের আসবাবপত্র তৈরির খরচ মিটিয়ে আমি কিছু টাকা বাঁচিয়েছি। মনে মনে আমার উদ্দেশ্যই ছিল আপনার একটি ছবি কিনব। কামরুল ভাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, হাসলেন।
--বলো কি হে? এ তো বিরল ঘটনা। তোমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনুমতি দিলো? সরকারি কোনো অফিসের জন্য চিত্রকলা সংগ্রহের কোনো সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। সেখানে তুমি আসবাবপত্রের টাকা বাঁচিয়ে ছবির পিছনে খরচ করছ--আগে এমনটা ভাবতেই পারিনি। তারপর কামরুল ভাই দেখালেনÑতাঁর আঁকা ছবির স্ত‚প। বিভিন্ন আকারের ছবি। আকার অনুযায়ী তাঁর অফিস বা স্টুডিওর দেয়াল ঘেঁষে আঁকা ছবি ও ড্রইংয়ের স্ত‚প। আমাকে বললেন, তুমি এই ছবির স্ত‚প খুঁজে তোমার পছন্দমতো ছবি নিয়ে নাও। সেই ছবিই এইটি।
তোফাজ্জল ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন--বলো ছবিটাকে আমি পছন্দ করেছি তোমার কাছে কেমন লাগছে। আমি জানালাম--খুবই সুন্দর ছবি--আপনার অফিসের জন্য মূল্যবান এক সম্পদ। তোফাজ্জল হোসেন বেশ খুশি হয়ে এবং একটু নড়েচড়ে বসে বললেন--এবার আসল কথায় আসি। আমার পেছনে বামদিকের দেয়ালটি অনেক ফাঁকা। অফিসের কয়েকজন বুড়িগঙ্গা নদীর একটা সুন্দর আলোকচিত্র নিয়ে এসেছিল এই ফাঁকা দেয়ালে টাঙানোর জন্য। আমি বলেছি এটা অন্যত্র টাঙাবো। ছবিটা তুলেছে রশীদ তালুকদার--সংবাদের আলোকচিত্রী। আর এই খালি জায়গায় একজন শিল্পীর ছবিই টাঙাবো। সেদিন কামরুল ভাই বলেছিলেন--দু’তিনটা ছবি নিয়ে যাও। কিন্তু আমি আনিনি। কামরুল ভাইয়ের ছবির যে মূল্য, তা আমি একটি ছবি এনেও ঠিকমতো মূল্য দিতে পারিনি। যা হোক আমিনুল আমার বন্ধু (শিল্পী আমিনুল ইসলাম)। আমাদের আড্ডার নিয়মিত সঙ্গী। সেই তারুণ্যে আমাদের সব সদস্যই বর্তমানে কম-বেশি খ্যাতিমান ব্যক্তি। কেউ লেখক, কেউ সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আড্ডার সদস্যদের নাম বললে বুঝতে পারবে। এঁরা হলো--আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, নেয়ামাল বাসির, আমিনুল ইসলাম (চিত্রশিল্পী) আলি রহিম, মশিউর রহমান এমনি আরো কিছু। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে আমরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। আমরা ছিলাম ভাষা আন্দোলনকারী এবং দেশে সাংস্কৃতিক চেতনা ও প্রগতিশীল রাজনীতি চর্চার প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে যুক্ত থেকে মুসলিম লীগ বিরোধী মোর্চা তৈরি করার কর্মী। বলা যায়, আমাদের বন্ধুরা অনেকেই ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। শিল্পীদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম ও মুর্তজা বশীর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।
কামরুল হাসান, জয়নুল আবেদিন এঁরাও প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে মিলেমিশেই কাজ করতেন। ১৯৫০ সালের দিকে কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র বিজন চৌধুরী ও দেবদাস চক্রবর্তী কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের কারণেই কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে জেল-জুলুমের ভয়ে ঢাকায় এসে চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ শিল্পী জয়নুল আবেদিনের শরণাপন্ন হন। জয়নুল আবেদিন দু’জনকেই ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি করে নেন। বিজন চৌধুরী আমিনুলের বাড়িতেই কয়েক বছর ছিলেন। আলাউদ্দিন আল আজাদও আমিনুল ইসলামের সঙ্গে থেকেছেন অনেকদিন তাদের ছাত্রজীবনে। আলাউদ্দিন আল আজাদের বিখ্যাত উপন্যাস ‘২৩ নং তৈলচিত্র’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে যে চিত্রশিল্পী, তা আমিনুলকে ভেবেই রচিত হয়েছে। এবার কাজের কথায় আসা যাক। আমিনুলের কাছেই শুনেছি, তুমি জলরঙে খুব ভালো ছবি আঁক। আমার পেছনের দেয়ালে খালি জায়গার জন্যে তোমার দু’টি জলরং ছবি আমি কিনে নেব। অফিসের খাতে কিছু অর্থ বাঁচিয়ে রেখেছি। তুমি ভাই দু’টি ছবি নিয়ে আস।
এমন একটি প্রস্তাবে আমি দারুণভাবে উদ্দীপ্ত হই। আনন্দ প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাইনি। একজন তোফাজ্জল হোসেন শিল্পী হিসেবে আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন! আমার শিক্ষক বরেণ্য শিল্পী কামরুল হাসানের পাশে আমার ছবি টাঙিয়ে রাখবেন! এতখানি সম্মানের জন্য তিনি আমাকেই উপযুক্ত মনে করেছেন! আমি সেদিন আনন্দে বিস্ময়ে অভিভূত।
কিছুদিনের মধ্যেই ছবি দুটো নিয়ে হাজির হলাম তোফাজ্জল হোসেনের অফিসে। ছবি দেখে আমার শিল্পগুণের অনেক প্রশংসা করলেন। এবং বললেন--হাশেম, অকপটে ছবি দুটোর মূল্য বল। আমি জানালাম। তিনি তাঁর অফিসের এক কর্মকর্তাকে ডেকে নিচু স্বরে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর জানালেন--হাশেম, খুব দুঃখিত আমার ক্যাশে যে টাকা আছে তা দিয়ে তোমার একটা ছবি এখন নিচ্ছি। আরেকটা কষ্ট করে তোমার কাছেই নিয়ে রাখ। কিছুদিনের মধ্যে টাকা সংগ্রহ হলে নিয়ে নেব।
সেদিন আমি খানিকটা আবেগতাড়িতই ছিলাম। বললাম--টাকা আপনি যেটা সম্ভব, সেটাই দিন। ছবি দুটোই আপনার অফিসে টাঙিয়ে রাখুন। আমার কথা শুনে তোফাজ্জল হোসেন আমাকে যা বললেন আমি আরেকবার বিস্মিত। তিনি জানালেন আমার কাছে বর্তমানে যে টাকা আছে, তা দিয়ে দুটো ছবি নিলে মূল্য অনেক কমে যাবে। শিল্পীর পেশাকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই, তাই মূল্যকে আমি যথাযথই রাখতে চাই। তোমার ২য় ছবিটি আশা করি মাস দুয়েকের মধ্যেই নিতে পারব।
এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি সেদিন তোফাজ্জল ভাইকে বললাম-- আপনি আমার ছবি সংগ্রহ করেছেন, এটা আমার কাছে বিশাল ব্যাপার। ছবিটি আমার শিক্ষক কামরুল হাসানের মতো শিল্পীর পাশে থাকবে সেটা আমার সৌভাগ্য ও আনন্দের বিষয়।
তিন.
এরপর দীর্ঘদিন তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগ ছিল না। তবে মাঝে মধ্যে পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা চোখে পড়ত। তারুণ্য থেকেই পেশায় সাংবাদিক। কবিতা ও নানান বিষয়ে লেখালেখির অভ্যাস তখন থেকেই। ১৯৫২-৫৩ সালে যখন জগন্নাথ কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, তখন তাঁর একটি গান অনেকেরই চোখে পড়ে। বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারির পর ভাষা শহিদদের স্মরণে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। যার সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। সংকলনের নাম ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’। এই সংকলনেই প্রথম প্রকাশিত হয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কালজয়ী সেই কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি।’ পরে সুর দেওয়া এই গান বাঙালির মুখে মুখে এক চিরকালীন গান। তোফাজ্জল হোসেন এই সংকলনের জন্য যে গানটি লিখেছিলেন, তার প্রথম কয়েকটি লাইন--
রক্তশপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি
একুশে ফেব্রুয়ারী
দৃঢ় দুই হাতে রক্তপতাকা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরি
একুশে ফেব্রুয়ারী
তোমারে স্মরণ করি
... ... ...
রক্তে রক্তে লাল হয়ে গেল সেদিন মাটির বুক
আকাশের দিকে দৃঢ় হাত তুলে জনতারা উন্মুখ
দুঃশাসনের পেষণ রুধিতে হল দৃঢ় উৎসুক
লক্ষ জনতা একাকার হল মিছিলের পথ ধরি
‘একুশে ফেব্রæয়ারী’ সংকলনে ফেব্রæয়ারি বানানটি দীর্ঘ-ঈ কার দিয়ে লেখা হয়েছিল। এই সংকলনে যাঁদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, তাঁরা বেশিরভাগই ছিলেন পরস্পর বন্ধু, বয়সে তরুণ ও গতানুগতিক ক‚পমণ্ড‚কতা, সাম্প্রদায়িকতা রুখে দিয়ে দেশ ও সমাজে সুস্থ সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্যচর্চার একটি প্রগতিশীল ক্ষেত্র তৈরির এক একজন সাহসী যোদ্ধা। তাঁদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেই বিষয়টি যথাযথভাবেই প্রতীয়মান হয়। সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আনিসুজ্জামান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আনিস চৌধুরী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেনসহ আরও কিছু লেখক ও বুদ্ধিজীবী। শিল্পী আমিনুল ইসলাম প্রচ্ছদটি এঁকেছিলেন। পরবর্তীকালে আমরা দেখি পাকিস্তানি আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি ও শিল্পকলা চর্চার যে প্রগতিবাদী ‘শক্ত ভিত’ তৈরি হয়েছে, তার সিংহভাগেরই উদ্যমী উদ্যোগ সেই ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের মেধাবী লেখক, শিল্পী ও কবিদের। এঁদের কয়েকজন ছিলেন সবচেয়ে সংগ্রামী, আবার কেউ কেউ ছিলেন নিভৃতচারী। তোফাজ্জল হোসেন ছিলেন নিভৃতচারী, কিন্তু সৎ, নিষ্ঠাবান এবং মানবকল্যাণে ব্রতী।
তোফাজ্জল হোসেনের তরুণ বয়সেই তাঁর নৈকট্য লাভের আমার সুযোগ ঘটেছিল। তখন আমিও কিশোর তারুণ্যে পা দিয়েছি মাত্র। আমার সেই স্মৃতিকথা আগেই উল্লেখ করেছি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়ে। ইত্তেফাকের সাংবাদিকতা ছেড়ে তিনি বিভিন্ন পদে দীর্ঘদিন অনেক জাতীয় দায়িত্ব পালন করেন। মাঝে মধ্যে কদাচিৎ তাঁর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যেত প্রেস ক্লাবে, বাংলা একাডেমিতে কিংবা কোনো সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে। কুশল বিনিময় ও সামান্য আলাপচারিতা তখন হতো।
অনেক দিন পর সাল তারিখ মনে নেই, ‘ভোরের কাগজ’ দৈনিকের অফিসে তোফাজ্জল হোসেন-এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আবেদ খান তখন ভোরের কাগজের সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনার এক বছর পূর্তিতে ভোরের কাগজের লেখক, প্রতিবেদক, পরিচালনা বোর্ডের সদস্যরা এবং সাংবাদিকদের মিলন উৎসবের আয়োজনে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন, আমিও হাজির। আমি তখন ভোরের কাগজের শেষ পৃষ্ঠায় প্রত্যেক শনিবার ‘ড্রইং কথা স্কেচ কথা’ শিরোনামে একটা প্রতিবেদন লিখতাম। নিয়মিতভাবে প্রায় তিন বছর ধরে এই প্রতিবেদন লিখেছি, সঙ্গে আমার আঁকা একটি ড্রইং বা স্কেচ ছাপা হতো। আমার অসংখ্য ড্রইং স্কেচের মধ্যে বেশ কিছু ড্রইং বা স্কেচের পেছনে অনেক কথা আছে। আমার সেই ভাবনাগুলোই প্রতিবেদন হিসেবে আমি লিখতাম।
তোফাজ্জল হোসেন সাহেব সামান্য কুশল বিনিময় ও নিজেদের খবরা-খবর জেনে নিয়েই বললেন--আরে হাশেম, ভোরের কাগজে তোমার ‘ড্রইং কথা স্কেচ কথা’ খুব ভালো লাগছে। বরাবরই তুমি ভালো ছবি আঁক, কিন্তু তোমার লেখার হাতও শক্তিশালী। একেবারে ‘ঝানু’ লেখক সাংবাদিকের মতো। থামবে না। চালিয়ে যাও। অনেক হয়ে গেলে বই করে ফেলতে পার।
আমি বললাম--আপনার লেখাও মাঝে মধ্যে পড়েছি, এই ভোরের কাগজেই। তিনি জানালেন
--দেখ, আমি কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই লিখে চলেছি। কেউ কেউ পড়ে মন্তব্যও করে। লেখাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। দু’একটা বেরিয়েছিল। যথাযথভাবে বই প্রকাশ করার জন্যে আমার ছেলে তারিক সুজাত সব গুছাচ্ছে। আচ্ছা তুমি তারিককে চিনো তো?
--চিনি। তারিক সুজাত আপনার ছেলে, তাও জানি।
তারিক সুজাত একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার বাবা আর আমার আলাপচারিতা উপভোগ করছেন। বললাম--
--তারিক সুজাত তরুণ হলেও উজ্জ্বল একজন কবি, শিল্প সাহিত্য ক্ষেত্রে রুচিশীল সংগঠক আর তার প্রকাশনা জার্নিম্যান নানান কারণেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। আপনার বৌমা মিমি, ওর সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে। মিমিও সংস্কৃতিবান ও গুণী মানুষ।
বাবা-মায়েরা সন্তানের প্রশংসা শুনলে অপার আনন্দ লাভ করেন। নিজেদের ধন্য মনে করেন। তোফাজ্জল হোসেনও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর চোখে সেই আনন্দের এক চমৎকার আভা ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন।
২০১৫ সালে ৫ ডিসেম্বর, তোফাজ্জল হোসেন বার্ধক্যজনিত কিছু শারীরিক কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩৫ সালের ৯ অক্টোবর। মৃত্যুর পরদিন ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে কবি-লেখক, সাংবাদিক ও ভাষাসৈনিক তোফাজ্জল হোসেনকে জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়, সেখানে তাৎক্ষণিক একটি স্মরণসভা হয়েছিল। সেই স্মরণসভায় দেশের খ্যাতিমান লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতির মানুষ তথা শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রাজ্ঞজনের এক চমৎকার সমাবেশ ঘটেছিল। এঁরা অনেকেই তাঁর বন্ধু স্থানীয়, সহপাঠী ও গুণগ্রাহী মেধাবী ব্যক্তিবর্গ। কবি তারিক সুজাত স্মরণসভার আলোচনা ও শ্রদ্ধাঞ্জলিগুলো সংকলিত করে পরবর্তী সময়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। সেই পুস্তিকার নাম সময়ের সিঁড়ি বেয়ে।
যাঁদের স্মৃতিচারণ সংকলনে সন্নিবেশিত হয়েছে তাঁরা হলেন--হাসানুল হক ইনু, তথ্যমন্ত্রী; সৈয়দ শামসুল হক -সব্যসাচী লেখক; কামাল লোহানী, সাংবাদিক, ভাষাসৈনিক; আবদুর রহিম সাংবাদিক, সাবেক পিআইও, তথ্য অধিদপ্তর; অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান প্রফেসর এমেরিটাস; কর্নেল শওকত আলী এমপি ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার; ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, আবু সালেহ সাংবাদিক, শিল্পী হাশেম খান, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব; ইকবাল বাহার চৌধুরী, সাংবাদিক; মফিদুল হক, লেখক-গবেষক; ফকির আলমগীর, গণসংগীত শিল্পী; কাজী রোজী, এমপি ও কবি; কামাল চৌধুরী, কবি ও সচিব; আসাদ মান্নান, কবি ও মহাপরিচালক বিটিভি; গাজী মাজহারুল আনোয়ার, ভ্রাতুষ্পুত্র, গীতিকার ও চলচ্চিত্রকার; অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, ভাইস চ্যান্সেলর, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি; শাহ আলমগীর, মহাপরিচালক, পিআইবি; ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ড. মুহাম্মদ সামাদ, কবি ও সভাপতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, তারিক সুজাত, কবি ও পুত্র এবং গোলাম কুদ্দুছ, সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
সংকলনে (পুস্তিকা বলাই শ্রেয়। কারণ কলেবর ছোটো ও সংক্ষিপ্ত) তোফাজ্জল হোসেনের জীবনযাপনের বিভিন্ন পর্যায়ের পঞ্চান্নটি আলোকচিত্র ছাপা হয়েছে। চিত্রগুলোর মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে তাঁর নিবিড় পদচারণা; সামাজিক ও জাতীয় অনেক ক্ষেত্রে তাঁর অবদান। সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ১২টি বইয়ের নাম, প্রচ্ছদপটের ছবি, প্রকাশনার কাল ও প্রকাশকের নাম ইত্যাদি। একটি মাত্র বই নাম ‘লিন্ডন জনসন’ প্রকাশিত হয়েছিল--১৯৬৪ সালে। বাকি ১১টি বই ২০০৩ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রকাশিত হলেও তিনি বেশিরভাগই লিখেছেন বেশ অনেক আগে। বইগুলোর নাম এখানে উল্লেখ করছি।
১। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও আগামী পৃথিবী, প্রকাশকাল- ২০০৩
২। কাশ্মীর : ইতিহাস কথা কয়, প্রকাশকাল- ২০০৩
৩। হৃদয় রক্তরাগে, প্রকাশকাল- ২০০২
৪। একুশ ভুবনময়, প্রকাশকাল-২০০৫
৫। বিপন্ন পৃথিবী বিপন্ন জনপদ, প্রকাশকাল- ২০০৩
৬। শিশু : বিশ্ব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট, প্রকাশকাল- ২০০৩
৭। নতুন যুগের ভোরে- প্রকাশকাল- ২০০৮
৮। জাতিসংঘ প্রকাশকাল- ২০০৭
৯। সাফল্যের সন্ধানে-- প্রকাশকাল- ২০০৭
১০। কবিতাসমগ্র-- প্রকাশকাল- ২০০৯
১১। লিন্ডন জনসন-- প্রকাশকাল- ১৯৬৪
১২। প্রগতিশীল রুশ ও উর্দু কবিতা-- প্রকাশকাল- ২০১১
সবগুলো বই-ই প্রকাশ করেছেন ওসমান গনি, তার আগামী প্রকাশনী থেকে। পরবর্তীকালে সুশোভিতভাবে নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয় জার্নিম্যান বুক্স থেকে।
একটা কথা অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি--তোফাজ্জল হোসেনের সাহিত্য কৃতি নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা বা ইত্যাকার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার উপযুক্ততা আমার নেই। তবে আমি বই পড়ি, প্রায় সবরকম বিষয়েই গ্রন্থ পাঠে আমার আগ্রহের কমতি নেই। তোফাজ্জল হোসেনের বইগুলো সবই আমার হাতে এসেছে তাঁর মৃত্যুর পর। তারিক সুজাত বইগুলো আমাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। তারিক সুজাত জানালেন, বাবাকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। বাবার বন্ধু, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী এবং কর্মজীবনের সুহৃদরা বাংলাদেশের গুণী ও মেধাবী ব্যক্তিত্ব, কেউ রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক, সাংবাদিক, সমাজ বিবর্তনের নেতা, সংস্কৃতি জগতের খ্যাতিমানরা এবং ভাষাসৈনিকরা আজ অনেকেই প্রয়াত। প্রয়াতরা অনেকেই বাবার সম্পর্কে তাঁর সাহিত্যকর্ম, তাঁর চিন্তা ও মানবকল্যাণ বিষয়ে গবেষণা নিয়ে মাঝে মধ্যে লিখেছেন। আমি সাধ্যমত সেগুলো সংগ্রহ করার প্রয়াস চালাচ্ছি। কিছু এর মধ্যে হাতে এসে গেছে। আর এখনো বাবার সুহৃদরা যাঁরা আছেন--তাঁদের অনুরোধ জানাচ্ছি--বাবার সম্পর্কে তাঁদের উপলব্ধি, মূল্যায়ন, সাহিত্যচর্চা ও স্মৃতিচারণসহ ইত্যকার বিষয়ে লেখার জন্যে।
তারিক সুজাতের অনুরোধেই ভাষাসৈনিক দেশপ্রেমিক তথা মানবতা প্রতিষ্ঠার একজন যোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেনকে নিয়ে আমার এই সামান্য স্মৃতিচারণ। সেই তারুণ্যে এক কৌতূহলী কিশোরকে গুণী মানুষটি উৎসাহ জুগিয়েছিলেন, স্নেহ ও উদারতার পরশে ধন্য করেছিলেন। আমি সেই কিশোর, তাঁর প্রেরণার কথা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও স্মৃতিগুলো মলিন হয়নি।
তোফাজ্জল হোসেনের রচনা সম্ভার বিষয়ে সম্প্রতি একটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ সমৃদ্ধ পর্যালোচনা পাঠের সুযোগ আমার হয়েছে। অত্যন্ত আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়ে বিশিষ্ট লেখক ও শুদ্ধ সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম প্রবক্তা অধ্যাপক শফি আহমেদ ‘কবি ও ভাষা সংগ্রামী’ শিরোনামে নিবন্ধটি রচনা করেন। প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমির সৃষ্টিশীল সাহিত্যপত্র-- উত্তরাধিকার মার্চ ২০২২ সংখ্যায়। এই সময়ে এবং কয়েক মাস আগে থেকেই আমি তোফাজ্জল হোসেনের গ্রন্থগুলো নেড়েচেড়ে দেখেছি। মাঝে মাঝে পড়েছি, শুধু চোখ বুলিয়ে গিয়েছি এমনতো নয়ই, বরং বেশ কিছু গ্রন্থ আমাকে বিস্ময়াবিষ্ট করে তুলেছে। আগ্রহ নিয়ে একটি দু’টি করে চারটি গ্রন্থই বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে পড়েছি। গ্রন্থ চারটির বিষয় আমার কৌতূহল বাড়িয়েছে, আপাত দৃষ্টিতে চারটি গ্রন্থের বিষয় ভিন্ন ভিন্ন হলেও আমার কাছে মনে হয়েছে এক একটি বই আরেকটি বইয়ের পরিপূরক। এই চারটি গ্রন্থ হলো-- ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও আগামী পৃথিবী’, ‘বিপন্ন পৃথিবী বিপন্ন জনপদ’, ‘শিশু : বিশ্ব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’ ও ‘জাতিসংঘ’।
কাকতালীয় ঘটনা হলেও উল্লেখ করতে চাইছি অধ্যাপক শফি আহমেদ তার নির্দিষ্ট নিবন্ধে তোফাজ্জল হোসেনের সামগ্রিক সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে আমার উল্লিখিত চারটি গ্রন্থ নিয়েই বিশদভাবে পর্যালোচনা করেছেন এবং নানান দৃষ্টিকোণ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা সাপেক্ষে মূল্যায়ন করে গ্রন্থগুলোর গ্রহণযোগ্যতার উপযুক্ততাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। শফি আহমেদের মতামতের সঙ্গে আমার ভাবনাগুলো মিলে যাওয়াতে আমি আনন্দিত নিঃসন্দেহে। তারপরেও তোফাজ্জল হোসেনের রচনায় বিশ্বের নিরাপত্তা বিষয়ক ভাবনা থেকেই উৎসারিত হয়েছে বাংলাদেশের শিশুদের প্রতি অবহেলা অযত্ন ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সমস্যা ও অন্তরায়গুলো। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল ও দারিদ্র্যসীমার নিচের দেশগুলোতেও শিশুরা নানাভাবে যথাযথ অধিকার থেকে বঞ্চিত যথাযথ পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব, চিকিৎসা ও শিক্ষার অভাবে বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠলে তাদের হাতে পড়ে পৃথিবীর জনপদগুলো বিপন্ন হতে বাধ্য।
বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে পৃথিবীর ও বিশ্ব সভ্যতার যে বিবর্তন ও পরিবর্তন ঘটে চলেছে, তাতে মানুষ যতই উল্লসিত হোক, জীবনযাত্রায় নানানমুখী গতি সঞ্চার হয়ে যে স্বস্তি, বিলাসবহুল ও ভোগের আনন্দে বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষ নিমজ্জমান। আর এমন আধুনিক বিশ্বের জন্য মানুষ যে হারে প্রকৌশলগত যন্ত্রদানবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে কলকারখানার বিপুল বিস্তার ঘটিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতাকে নষ্ট করে চলেছে--তার প্রতি দীর্ঘদিন ধরে ছিল উদাসীন, অসচেতন। ফলে বিশ্ব আজ বিপন্ন, জনপদ বিপন্ন। বিপর্যয়েরও প্রতিরোধ ও বিপন্নতা থেকে উদ্ধার পেতে পারে--মানুষের সুশিক্ষা ও সতেনতার মাধ্যমে। তোফাজ্জল হোসেনের গ্রন্থ শিশু : বিশ্ব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট--এর সঙ্গে একটা নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে বিপন্ন পৃথিবী বিপন্ন জনপদ গ্রন্থের বিষয়ের সঙ্গে। একইভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও আগামী পৃথিবী গ্রন্থের সারবস্তুর সঙ্গে।
বিপন্ন পৃথিবী বিপন্ন জনপদ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের শুরুতেই যে গ্রন্থ নির্যাস রয়েছে--তার প্রথমাংশের বক্তব্যে যেন উপরিউক্ত তিনটি গ্রন্থের মৌলিক বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাকেই বিবৃত করেছেন। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি ইংরেজি বর্ণমালার P যুক্ত তিনটি শব্দ Pollution (দূষণ) Poverty (দারিদ্র্য) এবং Population (জনপুঞ্জ) একুশ শতকে এসে মানব সভ্যতার অস্তিত্বের আসনে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই তিন দুর্ভোগ মিলেমিশে সমগ্র পৃথিবীকে এমন এক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে-- যেখানে সমস্ত মানবিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয়ে পড়েছে অসার--অর্থহীন, যেখানে প্রাণ-প্রবাহ দুলছে বিপর্যয়ের দোদুল-দোলায়।”
... যে তিনটি অনুষঙ্গ মানব সমাজকে এই কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সে অনুষঙ্গও সৃষ্টি করেছে মানুষেরাই। মানুষ তার জীবন-জীবিকার জন্য, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-বিলাসিতার জন্য এবং অন্তহীন অজ্ঞানতার জন্য... এ সমস্যার জন্ম দিয়েছে এবং দিনে দিনে প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে এখন অস্তিত্বের ওপর হুমকি সৃষ্টি করেছে।
সুতরাং জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-কলায় বিকশিত বিশ্বমানবকে এখন ভাবতে হবে--সংকীর্ণ আত্মচিন্তা, গোষ্ঠীস্বার্থ ও রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয়ে আমরা কি আপন বৃত্তে বন্দি থাকব এবং নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করব? নাকি, লব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রয়োগ করে বিশ্বজনীন সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ-সংকট কাটিয়ে উঠব?
... মানুষের অস্তিত্ব-বিরোধী এই তিন দুর্ভোগ--দূষণ, দারিদ্র্য ও জনপুঞ্জের আলাদা আলাদা মাত্রা যেমন আছে, ঠিক তেমনি তিনটির রয়েছে মিলিত মাত্রা, যার বিধ্বংসী-ক্ষমতা কল্পনাতীত। সুতরাং বলা যায়, মানব-অস্তিত্বের এই তিন শব্দকে খণ্ডিতভাবে মোকাবিলা করে সাফল্য লাভের সম্ভাবনা নেই।”
একজন তোফাজ্জল হোসেন; তাঁর অন্যান্য রচনা বিবেচনায় রেখেই যে চারটি বইকে বিশেষায়িত হিসেবে আমি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছি-- দেশ, মানবকল্যাণ তথা সমগ্র বিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে তার অন্তরের গভীর দৃষ্টিভঙ্গিতে, তাঁর মেধা ও অনুসন্ধিৎসু শ্রম প্রয়োগ করে অসামান্য মূল্যবান শিল্প সম্বন্ধ-সাহিত্য জাতিকে উপহার দিয়েছেন।
একজন তোফাজ্জল হোসেন যাঁকে নিঃসন্দেহে বলতে পারি--তিনি সমাজ সচেতন কবি-লেখক, সমাজ বৈজ্ঞানিক, মেধায় উজ্জ্বল গবেষক, দেশপ্রেমিক, বিশ্বকে বাঁচাতে মানবকল্যাণ ব্রতী একজন চিন্তক।
একজন তোফাজ্জল হোসেনের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।