প্রবুদ্ধসুন্দর করের কবিতা ও ভিন্নরকম বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রমণ

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই মৌলিক ইতিহাস আমি বানিয়ে লিখলাম কী করে?

সেঁজুতি জাহানসেঁজুতি জাহান
Published : 23 Jan 2023, 05:29 AM
Updated : 23 Jan 2023, 05:29 AM

'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'র ওপর একটি প্রশ্ন আমরা সম্ভবত ক্লাস সেভেন বা এইটে শিখেছিলাম।খুব মনে পড়ে পরীক্ষার খাতায় এই প্রশ্নের উত্তরটি আমি সম্পূর্ণ বানিয়ে লিখেছিলাম। কিচ্ছু হয়নি। মা একই স্কুলের শিক্ষক হবার সুবাদে তিনি সমাজবিজ্ঞান শিক্ষকের কাছ থেকে আমার সেই অভিশপ্ত খাতাটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। দেখে এসে বেদম রাগ! বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই ফান্ডামেন্টাল ইতিহাস আমি বানিয়ে লিখলাম কী করে?

প্রশ্নটি আসলে আমি শিখে যাইনি। তাই বানিয়ে লেখা।

জ্ঞান বা ইতিহাসের যে বিষয়ে কম জানা থাকে সে বিষয়ে মানুষ নিজের কারিশমার দারস্থ হয়, সৃষ্টি করে মিথ এবং এটাই হয়ে আসছে।

এই ঘটনার পরে আমি 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' সম্পর্কে ভালোভাবে শিখি।

মনের অবচেতনেই এখন 'আগরতলা' নামটি শুনলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্রমূলক মামলাটির কথা মনে পড়তে থাকে, সাথে আমার এই পরীক্ষার ইতিহাসটিও।

সেই আগরতলায়, অর্থাৎ ত্রিপুরার রাজধানীতে জন্মগ্রহণ করেন কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর। আফসোস, তাঁকে পড়তে গিয়ে 'আগরতলা' এসে যায় আর মানসপটে নিজের এমন কৃতির কথা মনে পড়ে যায়।

ভদ্রলোক শিক্ষক ছিলেন এবং একজন সফল শিক্ষকের পুত্র ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজে কেমন ছিলেন জানি না, তবে কবি হিসেবে যে কড়া কবি ছিলেন তা তাঁকে একটু স্থৈর্যের সঙ্গে পাঠ করলেই বোঝা যায়।

'জাতি', 'জাতীয় চেতনা', 'জাতীয়তাবাদ' নাকি একটি 'নেশন'?

ভারতবর্ষ বা আগরতলাকে ঠিক কোন বৈশিষ্ট্যে ও সংজ্ঞায় ফেলা যায় এমন অমীমাংসিত রাজনৈতিক অবস্থানে বসে থেকে গভীর ভাবনা ভাবতে থাকেন কবি।

যেখানে রবীন্দ্রনাথ ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্তের বরাত দিয়ে বলছেন—"মানুষ জাতির, ভাষার, ধর্মমতের বা নদী পর্বতের দাস নহে। অনেকগুলি সংযতমনা ও ভাবোত্তপ্ত হৃদয় মনুষ্যের মহাসংঘ যে একটি সচেতন চারিত্র সৃজন করে তাহাই নেশন। সাধারণের মঙ্গলের জন্য ব্যক্তিবিশেষের ত্যাগ স্বীকারের দ্বারা এই চারিত্র-চিত্র যতক্ষণ নিজের বল সপ্রমাণ করে ততক্ষণ তাহাকে সাচ্চা বলিয়া জানা যায় এবং ততক্ষণ তাহার টিকিয়া থাকিবার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।"

(নেশন কী)

ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা গোটা ভারতবর্ষে আদৌ কি কোনো একটি মীমাংসিত নেশন? তাহলে তার কেমন চরিত্র?

'এখন তো আগরতলা খচ্চরে ভরে গেছে'

কবির 'গাইড' কবিতার এই পঙক্তিটি একেবারে মনে গেঁথে আছে। বরং বলা যায় ছুটছেই না। সেই আগরতলার গৌরব এখন আর নাই। যেটা একসময় ছিল। রাজবাড়ি, উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ হয়ে গেছে বিধানসভা ভবন, রাজার ঘোড়ার আস্তাবল হয়ে গেছে স্পোর্টস কমপ্লেক্স। 

সামন্ত সমাজব্যবস্থাকে হত্যা করে আমরা গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক খচ্চর আমদানি করেছি, বা নিজেরাই কেমন বাহারি খচ্চর হয়ে গেছি। এই খচ্চরের কোনো নির্দিষ্ট চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য নাই। মানুষ এর জন্য নিজেদের সংকরায়নকে দায়ী করে নিজেরা ফাঁকে থাকে।

অথচ, উন্নত রাষ্ট্র বলতে যেসব দেশকে বোঝায় সেগুলোতেও কিন্তু সংকরায়ন ঘটেছে। তারপরও তারা 'নেশন' এ সংঘবদ্ধ হতে পেরেছে। জাতীয় একটি চরিত্র তাদের আছে।

রবীন্দ্রনাথ জাতিমিশ্রণ সম্পর্কে তাঁর 'নেশন কী' প্রবন্ধে বলছেন,

'জাতিমিশ্রণ হয় নাই য়ুরোপে এমন দেশ নাই। ইংলাণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি কোথাও বিশুদ্ধ জাতি খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, এ কথা সকলেই জানেন। কে টিউটন, কে কেন্ট, এখন তাহার মীমাংসা করা অসম্ভব। রাষ্ট্রনীতিতন্ত্রে জাতিবিশুদ্ধির কোনো খোঁজ রাখে না। রাষ্ট্রতন্ত্রের বিধানে যে জাতি এক ছিল তাহারা ভিন্ন হইয়াছে, যাহারা ভিন্ন ছিল তাহারা এক হইয়াছে।'

অথচ এই ভারতবর্ষের বিশেষত বাংলার একটি নির্দিষ্ট চরিত্র আজও গজায়নি।

ঘোড়া, ব্যাঙ, কুকুর ময়ূরসহ নানা জীববৈচিত্রের বিচিত্র প্রাণীর প্রাকৃতিক সহাবস্থানের মতো বিচিত্র শ্রেণি পেশা আর চরিত্র বৈশিষ্ট্যের মানুষ ছিল এক সময়, যা ধ্বংস হয়ে আজ কেবল এক শ্রেণির খচ্চরের আবাসে পরিণত হয়েছে। নিজেকে মহাত্মা করে তোলার জন্য যে কবি 'অপর'-এর মাঝে খচ্চর আবিষ্কার করছেন -- ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। বরং কালের হাওয়ার যে একটা নেতিবাচক প্রভাব আছে, যা সমকাল, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সিলসিলার মধ্যেও অ্যাক্ট করে সেই অ্যাক্টিভিটির কবল থেকে যে কবি নিজেও মুক্ত নন, সেই সরল স্বীকারোক্তি তিনি 'সংকর' কবিতায় দিয়েছেন।

'সংকর' কবিতায়ও রয়েছে খচ্চর। তবে এ খচ্চরকে বড়ো অভিমানী বলে মনে হয়।

যেমন:

'বাবা, বেগবান অশ্ব

মা, উদ্ভট সংসারের ভারবাহী গাধা

আমি খচ্চর, বাংলাকবিতা লিখি।'

কবির এই নির্মাণ,দর্শন এবং

'পরিচয়' রেটোরিক্যালিই শক্তিশালী। 

'আগরতলা' নিয়ে কবির আরও কিছু ক্ষোভ ধরা পড়ে 'রাজধানী’ কবিতায় :

'প্রতিটি রাজধানীই খুনি ম্যাকবেথ, যে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে না

একদিন মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসবে বার্নাম অরণ্য

রাজণ্য আমল থেকে আজ অব্দিও আগরতলার হাতেও কি রক্ত লেগে নেই?

অন্ধকার হা-মুখ টানেল নিয়ে পাহাড় ক্রমশ সরে আসছে এই শহরের দিকে।'

এর মানে কী?

আগরতলার হাতে কবি কীসের রক্ত দেখতে পান? এর ব্যাখ্যা একেবারেই কবির প্রত্নতাত্ত্বিক জীবন ঘনিষ্ঠ। 

নিজের জন্মভূমি আগরতলাকে নিয়ে, এমনকি নিজের জন্মটিকে নিয়ে কবি প্রবুদ্ধসুন্দরের মাঝে ব্যাপক নৈরাশ্য, ক্ষোভ, হতাশা চাকার মতো ঘুরছে। নিজের ব্যাপারে তিনি নিজেই বলছেন:

'মা-বাবার অধম সন্তান আমি।...

জন্মমুহূর্ত থেকেই মা ও বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছি। মা আমাকে নির্ভুল বাংলা বানান লিখতে শিখিয়েছিলেন স্কুলে যাওয়ার আগেই। বাবার নখের যোগ্যতা আমার নেই।' (সাক্ষাৎকার, নীহারিকা)

এমন কথা কবিতায়ও বলেছেন। যেমন:

"ভাদুঘর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভৈরববাজার/শুনেছি, বাবার দৌড় এটুকুই ছিল।

আমি ঢাকা অব্দি গেছি/বাবাকে পেরিয়ে যাওয়ার উদাহরণ/এ জীবনে আর কিছু নেই।" (উদাহরণ)

বাবার তথাকথিত সামাজিক সফলতার কাছে প্রবুদ্ধসুন্দর নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছেন। কৃতজ্ঞতাবোধের ক্ষেত্রে কবির বিনয় স্বর্গীয় মাহাত্ম্যে মহীয়ান।  কিন্তু আজ আমরা তাঁর বাবার খবর জানতে আগ্রহী হচ্ছি প্রবুদ্ধের সূত্র ধরেই। আমরা তাঁর বাবার মতো নির্ঝঞ্ঝাট প্রাজ্ঞ ও সফল মানুষকে তো কেউ চিনি না, চিনি প্রবুদ্ধসুন্দর করের বাবা হিসেবেই। তাঁর কবিতার বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিই এই পরিচয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। 

ফলে কে বলে কবিদের ইন্টেলেকচুয়াল কন্ট্রিবিউশন নাই?

উৎপলকুমার বসু বলেছিলেন, "কোনো কবির কবিতাকে বুঝতে গেলে সেই সময়ের সোশ্যাল, পলিটিক্যাল, ইকোনোমিক অর্ডারকে বুঝতে হয়।"

আবার এভাবেও বলা যায় কোনো কবির কবিতা বুঝলেই সময়ের সোশ্যাল, কালচারাল, পলিটিক্যাল, ইকোনমিক অর্ডারকে বোঝা সম্ভব। অন্তত প্রবুদ্ধসুন্দরের কথা এ বেলায় খুবই সত্য।

'অস্ত্র' কবিতায় কবি একটি কুলাঙ্গার সময়ের গায়ে পেশাব করার জন্য বৃক্কের যত্ন নিতে বলছেন। 

'বৃক্ক সচল রাখুন

ভুলে যাবেন না, অনেক কিছুর উপরেই পেচ্ছাপ করে যেতে হবে আমাদের।' এই 'আমরা' কারা? 

রাষ্ট্রের মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত নিপীড়িত  জনমানুষ। যাদের বিত্ত গিয়ে ঠেকেছে রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার শিখরে।

অবদমনের রাজ্যে কেবল হতাশার চাবুক সৃষ্টিশীল মনকে অনবরত বিক্ষত করে। অভিমানে রুষ্ট থাকে জবান। 'অস্ত্র' কবিতায় কবি বলছেন,

'আমাদের কোনো অস্ত্র নেই, সংগঠন নেই, ম্যানিফেস্টো নেই, কর্মসূচি নেই

বৃক্ক, আমাদের একমাত্র অস্ত্র।'

কবিতায় কী ভয়াবহ ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন! যেকোনো মূল্যে বৃক্ককে সচল রাখার কারণ হিসেবে কবি যা হাজির করলেন তা একেবারেই বাস্তব-ঘনিষ্ঠ।

রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে এই ইঙ্গিতের মহিমাকে খুব গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে,

'অর্থবিশিষ্ট শব্দের সাহায্যে যে-সকল কথা বুঝিতে দেরি হয় বা বুঝা যায় না, তাহাদের জন্য ভাষা বহুতর ইঙ্গিত-বাক্যের আশ্রয় লইয়াছে।' (ভাষার ইঙ্গিত)

প্রবুদ্ধসুন্দর করের 'অস্ত্র' কবিতাটি একেবারে সাদামাটা বাক্য ও শব্দ দিয়ে সৃষ্টি। কিন্তু এইসব সিম্পল শব্দচয়নের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ-কথিত 'বহুতর ইঙ্গিত-বাক্য' কবিতাটিকে নিয়ে গেছে এক অব্যক্ত যন্ত্রণার গুহার অন্ধকারে। ফরমায়েসি সভ্যতার প্রতি অভিমান ঠিকরে পড়ছে শব্দের প্রতি স্বরে স্বরে। অন্যভাবে যদি বলি কবি এখানে আমাদেরকে গোপনে অন্যায্যতার বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান দানও করেছেন। আপাত ব্যর্থতাবোধ সমৃদ্ধ মানব জন্মের এই মীমাংসাঘন উপদেশ পাঠক মাত্রই শিরোধার্য করবেন। এমন উপদেশমূলক কবিতাচার আমরা তাঁর বিখ্যাত 'শায়ার পকেট' কবিতায় পাই।

যেমন:

"শায়ার সেই গোপন পকেটের মতোই, ক্রোধকেও আমাদের গোপনে লুকিয়ে রাখা উচিত, যাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার আগের মুহূর্তে এর সঠিক ব্যবহার করা যায়।"

কবি প্রবুদ্ধসুন্দর যখন আগরতলায় বসে বাংলা কবিতা লিখছেন তখন সেটা ঢাকার কবিতা হয়ে যাচ্ছে। সহজাত বোধগুলো যে কেন্দ্র, প্রান্ত বা সর্বপ্রকার সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছে সেটা কবির 'ফুলার রোড' কবিতা পড়েই বোঝা যায়।

কবি বলছেন:

'যেকোনো শহরে গিয়ে আমি প্রথমেই খুঁজে ফিরি/গাছের ছায়ার নীচে প্রেমিক ও প্রেমিকাবহুল/সবুজ ঘাসের সেই তীব্র তীর্থস্থান।

চুম্বনদৃশ্য দেখতে হলে ফুলার রোডের দিকে যাওয়া যেতে পারে...

যে শহরে প্রেম ও চুম্বন নেই অর্শ কিংবা ভগন্দরে ভোগে/সেই শহরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকুল

আমাদের বিবাহপ্রথাও রাজাকার অধ্যুষিত/মৌলবাদী এক সহিংস শিবির/প্রেম আর চুম্বনের প্রতি জাতীয়তাবাদী পার্টি/ন্যাপ কিংবা আওয়ামি লিগেরও সমর্থন নেই/তাদের নজর দাঙ্গা, গৃহযুদ্ধ আর মৃত্যুর রাজনীতির দিকে।'

প্রেমহীনতার রাজনীতি দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিয়ে কিংবা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠনগুলোতে প্রেম ও নৈতিকতা অনুপস্থিত। একটি সাক্ষাৎকারে কবি প্রবুদ্ধসুন্দর বলছেন, 'রাজনীতি আমার অন্বিষ্ট নয়।... যে-কোনো সৃষ্টিশীল মানুষই রাজনীতি নিয়ে অতিসচেতন।' (নীহারিকা)'ফুলার রোড' কবিতায় আমরা কবির সেই অতিসচেতনতাই দেখলাম। ফুলার রোডে বা যেকোনো স্থানে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম ও চুম্বনকে ধর্মীয় আইন দেখিয়ে অনৈতিক বা অবৈধ ঘোষণা করলেও ধর্মসহ যেকোনো সভ্যতায় হত্যা, গুম ও অকল্যাণমূলক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও সেগুলোর সর্বাত্মক প্রাক্টিস আমরা দেখতে পাই। আমার এতোক্ষণের আলোচনায় মনে হতে পারে তবে কি প্রবুদ্ধসুন্দর একজন ক্ষুব্ধ কবি? কিন্তু এ কথা কী করে বলি? ফিসফাস’ কবিতায় প্রবুদ্ধ লিখেছিলেন, “বৃষ্টিস্নাত আষাঢ়ের প্রথম দিবসে, নীল গোধূলিসন্ধির /মেয়েদের ফিসফাস শোনা যায়; পরস্পর বলাবলি করে/—আয় সই, এই সান্ধ্য আলোছায়াকে আমরা প্রবুদ্ধসুন্দর বলে ডাকি/এই নেশার্ত জ্যোৎস্নার জ্যোৎস্নার্ত নেশার নাম রাখি প্রবুদ্ধসুন্দর”। প্রবুদ্ধসুন্দর অর্থাৎ জ্ঞানের সৌন্দর্যে যে নারীরা বিমোহিত তারা তো আজকের নারী নন। উর্দু কবি গালিব বলছেন,'কেমন করে কাটবে বর্ষার অন্ধকার রাত্রিগুলি;/ আমার চোখ যে তারা গুণতেই অভ্যস্ত হয়ে আছে, হায়।' (আবু সয়ীদ আইয়ুব অনূদিত গালিবের গজল থেকে)

যে চোখ শুধু জল বা কামার্ত অন্ধকারের ভাষায় অভ্যস্ত নয়, চায় প্রজ্ঞার কেশর। নারীর এই চাহিদার রূপ যে কবি সৃষ্টি করতে পারেন, তাঁকে প্রেমহীন ক্ষোভ আর রাগের কবি বলা রীতিমতো অন্যায়। এ ছাড়া তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'দরজা'য় এক মিহি ও মনোরম প্রেমের চিহ্ন দেখতে পাই। কবি মনে করেন, যে ছেড়ে চলে যেতে চায় তাকে বাধা দিতে নেই, কেননা আঁকড়ে ধরার মাঝে অবলীলা নেই, থাকে জবরদস্তি, থাকে অপ্রেম। ছেড়ে দিলে নিজেই ফিরে আসে এবং তখন তাকে বলতে হয়,'দরজা ভেজানো থাকবে টোকা দেওয়ার দরকার নেই। আলতো ঠেলে দিলেই কপাট খুলে যাবে।'' পৃথিবীর তিন ভাগ বিষ আর এক ভাগ বিষাদ'প্রাপ্ত এমন বিদগ্ধ কবি কিন্তু দুর্দান্ত সব কাম-শব্দ সৃষ্টি করেছেন। 'সম্প্রচারিত ১৩টি লাইন' কবিতায় যেমন:'যৌনতা অন্ধ্রের মাছ, তারও আছে বর্ষাধস, স্পেশাল এসকর্টপানপাত্র উপচে ওঠে বন্ধুদের গেঁজে ওঠা ফেনিল ঈর্ষায় চুমুক দিয়েই বুঝি, স্ক্যান্ডাল আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না'। এখানে 'যৌনতা অন্ধ্রের মাছ', 'চুমুক দিয়েই বুঝি' শব্দ-গুচ্ছকে বিশুদ্ধ শৃঙ্গার রসের উপকরণ বলা অনুচিত হবে না। নব্বইয়ের দশকের কবিদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে নব্বইয়ের আর এক বিক্ষুব্ধ কবি মাদুল হাসান যে বলেছিলেন 'নব্বই দশকের কবিকুল সারা পৃথিবীতে যা যা দেখেছে, সঙ্গে সঙ্গে তা-ই হতে চেয়েছে!' আমার মনে হয় প্রবুদ্ধসুন্দর কর সম্পর্কে এ কথা খাটে না। পৃথিবীতে যা কিছু অন্যায্য তার কড়া সমালোচনা করেছেন কবি। প্রবুদ্ধসুন্দর মনে হয় প্রতিষ্ঠার এই প্রতিযোগিতা-মুখর পৃথিবীর প্রায় কোনো কিছুই হতে চাননি।' এ জীবনে কারো কারো কথা রাখতে পারিনি। বাবা বলতেন, অকৃতজ্ঞকে ক্ষমা করে দিবি। কিন্তু কৃতঘ্নকে ঝাঁটা মেরে তাড়াবি। পারিনি। কথাসাহিত্যিক অরুণোদয় সাহা বলতেন, অ্যাক্ট করবে, রিঅ্যাক্ট করবে না। পারিনি। কবির এই সহজ স্বীকারোক্তি তাই প্রমাণ করে। সর্বোপরি বলতে চাই, জীবিত সকল সফল বা অসফল কবিকে তরুণ কবি বলা যায়। মৃত কবি যেন বয়োজ্যেষ্ঠ প্রাজ্ঞজন। সেই অর্থে সুকান্ত ভট্টাচার্যও প্রবীণ কবি। প্রবুদ্ধসুন্দর করের মতো কবিকে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে হারিয়ে বাংলা সাহিত্য একজন তরুণ কবির কালোত্তীর্ণ হবার হিসাবের খাতা খুলতে সক্ষম হয়েছে।