অধিকাংশ লেখকই নানা বিষয়ের ওপর লেখেন কিন্তু নিজেকে বিষয় করে নিজের জন্য লেখা সত্যিই কি কঠিন নয়!
Published : 02 Apr 2024, 01:36 PM
সেই কবেকার, কত বছর আগেকার কথা! কিন্তু এখনও কতই-না প্রাসঙ্গিক, কতই-না অনুসরণীয়, কতই-না প্রতিভাসিত! ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের প্রথম দিনে, নিজের একটি বইয়ের ভূমিকায় তিনি বললেন, ‘‘আমি নিজেই বইটির বিষয়।’’ আরও বললেন, বইটি লেখা হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মনে রেখে, যেন তা কাজে আসে সবার: যখন তিনি আর এ জগতে থাকবেন না তখন যেন তারা লেখাগুলো পড়ে তাঁর কিছু ব্যক্তিগত স্বভাবের কতিপয় বৈশিষ্ট্য ও মেজাজ, এবং রসবোধকে আবারও অনুধাবন করতে পারেন, আর হ্যাঁ, যেন তাঁর স্মৃতিতর্পণ করতে পারেন তারা। অর্থাৎ স্মৃতি হতে চান তিনি, স্মরিত হতে চান! মনে আসন নিতে চান-- লিখে, আর তা প্রকাশ করে। কী অসাধারণ উদ্ভাসন রয়েছে এই কথাটিতে! তাঁর লেখা যেন হয়ে উঠতে পারে স্মৃতির সাঁকো। লেখা যেন হয় তাঁর আর্কাইভ। যখন তিনি থাকবেন না, তখন লেখাগুলোই যেন তাঁকে উপস্থিত করিয়ে দেয়, মনে করিয়ে দেয় যে এমন একজন মানুষ ছিল, যে তাঁর নিজের মতোই জীবনযাপন করে গেছেন, স্মৃতিচূর্ণ হয়ে থাকতে চেয়েছেন চারপাশে, হৃদয়ের মাঠেঘাটে, পথেপ্রান্তরে। এ যেন উপস্থিতি আর অনুপস্থিতির এক সংবিৎ। উত্তরশারীরিক বর্তমানতার এক সূত্রের কথা বলছেন তিনি যা মানুষের এক ধরনের অমরত্বের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করে।
নিজেই নিজের রচনার বিষয় হওয়া, নিজেই নিজের বিষয় হওয়া খুব কঠিন কাজ। মঁতেন সেটাই হয়েছিলেন। তিনি লিখে গেছেন নিজকে, অর্থাৎ, সবকিছু জেনেশুনে নিয়ে নিজের দানাবাঁধা অনুভব ও স্বকীয় অনুধ্যানকে লেখায় পরিণত করেছেন তিনি। নিজ তালুকের দেখভালের কৃত্যাদি (negotium:business) থেকে মুক্ত হয়ে অবকাশ (otium: leisure) থেকে শিক্ষাগ্রহণের ব্রত নিয়েছিলেন তিনি। প্রাচীন সম্ভ্রান্ত রোমকদের মতো, অবকাশপ্রৈতি বা অবকাশবাসনার তাৎপর্য তো নিশ্চয় আছে, এ তো আর কর্মহীন শারীরিক দিনযাপন নয়, নয় অভলোমোভের মতো সারাদিন এক ঘরে শুয়ে থাকা, এ হল স্বাভাবিক ও শর্তাধীন পেশা থেকে মুক্ত হয়ে নিরবচ্ছিন্ন ও গভীর জ্ঞানচর্চায় অবগাহন করা, শিল্পিত ও আত্মবেদী হওয়া। বাহ্যিক বৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে অন্তরের বৃত্তিকে পরিগ্রহণ করা। ‘‘অলসতা’’ নামক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, যে সর্বত্রই থাকে সে বস্তুত কোথাও থাকে না। রূপক করে বলেছেন, নিজের মনকে জানার শ্রেষ্ঠ উপায় হল অলসতায় ডুবে যাওয়া। লেখকসত্তার স্ফটিকায়নের জন্য এর চেয়ে অনন্য কথা আর হতে পারে না। যদিও অলস মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন ওই লেখাতেই। অবকাশ যে নিছক অর্থহীন সময়যাপন নয়, জীবনের শিল্প, তার দার্শনিক মজাটি যেন তিনি উপহার দেন এই কথায়।
তিনি তাঁর শাতো-য়, লাতিন ভাষায় নানা ধরনের বাণী উৎকীর্ণ করে রাখতেন। তাঁর পাঠাগারের দেয়ালে এবং থামে প্রায় ষাটটি গ্রিক ও লাতিনবাণী উৎকীর্ণ ছিল। কিন্তু এর পরপরই তিনি এক দোলায়িত বিষাদবায়ুতে আক্রান্ত হলেন, তাঁর সত্তা যেন হয়ে উঠল এক লাগামহীন ঘোড়া--অস্থির আর লক্ষ্যহীন আর বেপোরোয়া। সুতরাং অবকাশপ্রৈতি সুখ আনল না তাঁর জীবনে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্যই তিনি লিখতে শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত ‘‘এসেইজ’’। কিন্তু যেহেতু তিনি ছিলেন না কোনো পেশাগত লেখক বা রাজনীতিক বা সমরনায়ক, তাই তাঁর ছিল না লেখার কোনো উদ্দিষ্ট বিষয়, এজন্যই তিনি নিজেকেই লিখতে শুরু করলেন। নিজেই নিজ লেখার বিষয়। নিজেই উদ্দেশ্য নিজেই বিধেয়। লেখার ইতিহাসে এ এক অনন্য সূত্র, নতুন এক দিগন্ত-উন্মোচন। প্রকৃত লেখককে অবশেষে নিজেকেই লিখতে হয়। নানা জনের কথার অবতারণার পর ঠিকঠিক নিজের কথাটি বলা, নিজের শৈলীকে প্রতিষ্ঠা করা। লেখার বিষয় যদি হয় আত্মতা, তবে তার আর বিষয়ের অভাব হয় না, আত্মতাই খুঁজে নেয় অপরকে। আত্মতাই তখন বিষয় ঠিক করে দেয়, অথবা আত্মতা নিজেই তো হয়ে উঠতে পারে মোক্ষম বিষয়।
জীবনের দৃষ্টিভঙ্গীতেও ছিলেন পরিবর্তনশীল, এবং আভাসিত, এবং নমনীয়: প্রথমে নাস্তিক, তার পর সংশয়ী, তার পর এপিকুরীয়। এটা হয়তো হয়েছে, তাঁরই কথায়, অলসতা মনে যে অস্থিরতার জন্ম দেয় তার জন্যই। মনের এই চপলমতিত্বকে তিনি তুলনা করেছেন লাগামচ্যূত অশ্বের সঙ্গে।
মৃত্যু সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা জানি না মৃত্যু কোথায় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, আর এজন্যই, সবখানেই, সবসময়ই আমরা তার অপেক্ষায় থাকতে পারি। মৃত্যুর অনুশীলন করা মানে স্বাধীনতার অনুশীলন করা। যে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে শিখেছে সে দাসত্বকে অস্বীকার করতে শিখেছে। মৃত্যুবরণ করতে জানা মানে অধীনতা ও আবদ্ধতা থেকে মুক্তি। জীবনকে হারানোর মধ্যে কোনো পাপ নেই এটা যে ঠিকঠাক জানে, জীবনও তার জন্য কোনো পাপের কিছু হয়ে ওঠে না। সুতরাং বয়ে নিয়ে চলো জীবনকে, মৃত্যুর বরফশকটে।
অধিকাংশ লেখকই নানা বিষয়ের ওপর লেখেন কিন্তু নিজেকে বিষয় করে নিজের জন্য লেখা সত্যিই কি কঠিন নয়! লেখক কোনো বিষয় হয়ে ওঠেন না, শুধু বিষয়ের অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সারাক্ষণ। মঁতেন নানাজনের কাছ থেকে অনেককিছু নিয়ে অনুষঙ্গ সাজান, কিন্তু লেখাটা লেখেন নিজের জন্য নিজের মতো করে, যেন অনুষঙ্গ বিশেষ নয়, লেখাটিই তাঁর বিষয় ও বিশেষ। নিজেই লেখক নিজেই পাঠক। একজন লেখকের জন্য এর চেয়ে বড়ো কোনো আত্মমান হওয়ার সুযোগ আছে কি!