Published : 27 Nov 2024, 11:37 AM
অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদের সঙ্গে আমার পরিচয় কর্মসূত্রে হলেও আমি তার সরাসরি ছাত্র হতে পারতাম যদি আমি ষাটের দশকের মাঝামাঝি পড়তাম ঢাকা কলেজে। আমি চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়লেও হয়তো হতে পারতাম তাঁর ছাত্র, যেমন হয়েছিল আমার স্ত্রী। তবে সরাসরি ছাত্র না হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে সহকর্মী হিসেবে দীর্ঘ দুদশক তাঁর সাহচর্য পেয়ে আমি নানাভাবে উপকৃত হয়েছি। গত কাল তিনি চলে গেলেন। সপ্তাহখানেক আগে আমি আর আমার স্ত্রী পারভীন তাঁকে দেখতে যাই হাসপাতালে। রাইলস টিউবে খাওয়ানো হচ্ছিলো। অস্ফুট স্বরে দু একটা কথা বললেন। এরপর আজ বিকেলে তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আবার দেখতে যাই। দেখি কর্মবীর মানুষটা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। বহু রাত জাগার পর হয়তো এরকমই ঘুমাতে হয়। বছর কয়েক আগে ক্যান্সার ধরা পড়লে তিনি কেমো থেরাপির কষ্টকর চিকিৎসা না নিয়ে সাধারণ নিয়মকানুন মেনে যতটুকু পারা যায় সুস্থ থাকতে চেষ্টা করছিলেন। এরপর কোনও রকম হৈচৈ হাহুতাশ না করে তাঁর চরিত্রের স্বভাবসুলভ স্থৈর্য বজায় রেখে মৃত্যুর মোকাবেলা করে গেলেন। কর্কট রোগ ছড়িয়ে পড়েছিলো হাড়ে এবং কিডনিতে। কিডনি অকেজো হওয়াতে শেষ দু চারদিন ডায়্যলিসিসও করা হল। কিন্তু জীবনঘাতী রোগ ধরা পড়ার পর থেকে মানসিক শারীরিক যন্ত্রণা তিনি সহ্য করলেন নিরবে একজন স্টোয়িক দার্শনিকের মতোই।
হারুন স্যারের চারিত্রিক দৃঢ়তা আমাকে বরাবর মুগ্ধ করেছে। এমন সৎ মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। আজ যখন চারপাশে তাকাই দেখি চুরিচামারি, ছিঁচকেমি, বদমাইশি আর মিথ্যাচারের ছড়াছড়ি। এরকম সময়ে হারুন স্যারের মত মানুষের চলে যাওয়া মানে ন্যায়নিষ্ঠার এক দুর্লভ আশ্রয় অদৃশ্য হওয়া। বিশ্বাস অটল হলে, নিজের মানবিক গুণ সযত্নে লালন করলে একজন মানুষ যেকোনো পেশায় সফল হতে পারে। আর এইসব গুণ তো হারুন সাহেব শিক্ষক হিসেব, হলের প্রভোস্ট হিসেবে, বাংলা একাডেমির মহা পরিচালক হিসেবে পুরোপুরিই পালন করেছিলেন। আমি যখন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি বিভাগে তাঁর সহকর্মী, তখন হারুন সাহেব সম্ভবত বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর মহাপরিচালকের দায়িত্ব শেষে গিয়ে যোগ দেন। সম্পূর্ণ তাঁরই উদ্যেগে আব্দুল মান্নান সৈয়দকে এক বছরের জন্য স্কলার ইন রেসিডেন্স করে নিয়ে আসেন নজরুল ইসলামের ওপর গবেষণার জন্য। কোনও প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে গুণি মানুষদের স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য ওই ধরণের পদ এবং সেই কাজের পুস্তকাকারে প্রকাশ সম্ভবত ওই প্রথম। ছাত্রদের তিনি কেমন অনুপ্রাণিত করতেন তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। তাঁরই ক্লাশের একজন ছাত্রীর ভেতর তিনি সাহিত্যের সম্ভাবনা দেখে তাকে দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের একটা বই ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়েই ক্ষান্ত হন না, একজন প্রকাশক জুটিয়ে সেই বই ছাপান এবং হুমায়ূনকে ডেকে ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে তাঁকে দিয়েই লঞ্চ করাবার ব্যবস্থা করেন। শিক্ষার্থী তো বটেই সহকর্মীদেরও তিনি নানভাবে উৎসাহিত করতেন। মনে পড়ে আমার অনূদিত ক্যাম্পবেলের মিথের শক্তি বইটার পান্ডুলিপি নিয়ে তিনি দু এক পাতায় চোখ বুলিয়েই কাকে ডেকে একটা রিভিউ করতে বললেন। এরপর সম্ভবত মাস দুয়েকের মধ্যেই বইটা বেরিয়ে গেল। এরকমই ছিলেন হারুন স্যার। তাঁর সময় বাংলা একাডেমি থেকে নানা ধরণের অভিধান বের হয় কিংবা দীর্ঘদিনের আউটঅফপ্রিন্ট বইগুলো আবার ছাপা হয়। আবার বহুকালের জমে যাওয়া বই তাঁকে নামমাত্র মূল্যে ছেড়ে দিয়ে একাডেমির গুদামও সাফ করতে দেখেছি। বাংলা একাডেমিতে তিনি তরুণ লেখক প্রকল্প প্রবর্তনের মাধ্যমে তরুনদের সাহিত্য চর্চায় অনুপ্রাণিত করেন।
হারুন স্যারের সততা, চারিত্রিক বল, কর্মস্পৃহা নিশ্চয় তাঁর এক গভীর আধ্যাত্মিক বিশ্বাস থেকেই উৎসারিত হয়েছিল। মিরপুরের একজন “আনটিপিক্যাল” পীর সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌনপুরির প্রতি ছিল তাঁর অগাধ আস্থা। আনটিপিক্যাল বলছি কারণ তাঁর আয়ের মূল উৎস ছিল বিদেশি পত্র পত্রিকার এজেন্সি। শুনেছি বৃদ্ধ বয়সেও নাকি তিনি মোটর সাইকেল চালিয়ে মিরপুর থেকে মতিঝিলে গিয়ে তাঁর অফিস করতেন। পীর সাহেবের তিরোধানের পর তাঁর চিন্তাভাবনাকে সংলাপের আকারে হারুন সাহেব সাবলীল বাংলাভাষায় বেশ ঢাউশ আকারে প্রকাশ করেন এবং বইটা বেশ পাঠকপ্রিয়ও হয়। সুফী মতবাদের ধাঁচে হারুন স্যার আরও কিছু সুপাঠ্য রচনা প্রকাশ করেন। ইংরেজি বাংলা উভয় ভাষায় তাঁর চমৎকার দখল ছিল বলে তিনি দুভাষাতেই বেশ কিছু অনুবাদও করেছেন। আব্দুল মান্নান সৈয়দের এবং আরও কিছু নবীন কবির কবিতার বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে। গত বছর অনুবাদে বাংলা একাডেমি পরিচালিত আবু রুশদ মতিনুদ্দিন সাহিত্য পুরস্কারও পেলেন। আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন এককভাবে একটি উন্নত মানের ইংরেজি-বাংলা ডিকশনারি লেখাতেও হাত দিয়েছিলেন এবং কিছু দূর এগিয়েওছিলেন। কাল মৃত্যু সংবাদ পেয়ে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে দেখি সাদা চাদরে মুড়ে শুয়ে আছেন। মুখে এক ধরণের প্রশান্তি। জীবনের জ্বর ছেড়ে গেছে, অনেক জাগার পর কর্মবীর মানুষটা তখন মহানিদ্রায় আবৃত।