Published : 21 May 2024, 05:34 PM
২০২২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে যশোর শহরে অনুষ্ঠিত হলো পূর্বপশ্চিম সাহিত্য উৎসব। এই উৎসবের একদিনের অনুষ্ঠানের একটি সেশনে কথাশিল্পী জাকির তালুকদার বিস্ফোরণ ঘটালেন। বিস্ফোরণ মানে চরম বিস্ফোরণ। খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক হোসেনউদ্দীন হোসেনকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে না কেন? কী অপরাধ তাঁর? তিনি তাঁর তেজস্বী বক্তব্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের ভেতরের অনেক কথা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকসহ অনেকেই। জাকির তালুকদারের বক্তব্যের রেশ ধরে অনেক বক্তাই হোসেন ভাইয়ের পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়টা নিয়ে কথা বললেন। ব্যাপকভাবে শোরগোল হলো। যে লেখকের বয়স আশি বছর পার হতে চলেছে। যাঁর লেখা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য; দেশের বাইরে যাঁর লেখা অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ; তাঁর মতো একজন গুণী লেখক বাংলা একাডেমি পুরস্কার পায় না, এটা নিয়ে রীতিমত হৈচৈ উঠল। বিব্রত হলেন একাডেমির মহাপরিচালক। উপপরিচালক তপন বাগচীও ছিলেন। তাঁরা সবাই নাখোশ হলেন জাকির তালুকদারের উপর। বিষয়টা এভাবে না বলে পার্সোনালি তিনি বলতে পারতেন। বেশি বিব্রত হলেন হোসেনউদ্দীন হোসেন ভাই। দুই রাত আমরা এক ঘরেই ছিলাম। তিনি বললেন-- 'জাকির ওভাবে বলতে গেল কেন? আমি কি পুরস্কারের জন্য লিখি?' আমি বললাম, 'ঠিক আছে ভাই! আপনি তো নিজে বলছেন না, অন্যরা বলছে, অসুবিধা কি!' তিনি বললেন -'শোনো, ওরা আমাকে সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার দিয়েছে। ওটাও তো বাংলা একাডেমির। ওরা আমাকে আর পুরস্কার দেয়?'
যা হোক, সেবার সাহিত্য উৎসবে টক অব দ্য ফেস্টিভ্যাল ছিল হোসেন ভাইকে বাংলা একাডেমির পুরস্কার না দেয়া। প্রথম দিন পার হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন দুপুরের দিকে আমাকে খুঁজছেন পূর্বপশ্চিমের অন্যতম কর্ণধর কথাসাহিত্যিক আশরাফ জুয়েল। তিনি জানালেন, এক ঘন্টার মধ্যে হোসেনউদ্দীন হোসেনের যতগুলো বই সম্ভব, জোগাড় করে দিতে হবে, হুদা ভাই চাইছেন। বিকেলেই উনার ফ্লাইট। আমি হোসেন ভাইকে খুঁজে ঘটনাটি তাঁকে বললাম। তিনি বললেন, 'এক ঘন্টার মধ্যে সব বই এনে দেওয়া কি সম্ভব? তাছাড়া আমি বাড়িতে না গেলে তোমার ভাবী দিতে পারবে না।' বললাম -' তারপরও চেষ্টা করুন।' হোসেন ভাই বাড়িতে ফোন করলেন, ফোন করে ভাবীকে বুঝিয়ে বাড়ির কাজের লোককে দিয়ে যেবইগুলো সম্ভব আনিয়ে নিলেন। বইয়ের বাণ্ডিল পেয়ে তুলে দিলাম জুয়েলের হাতে। তিনি পৌঁছে দিলেন হুদা ভাইয়ের হাতে। সেবারই হোসেনউদ্দীন হোসেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন। পেলেন গবেষণা - প্রবন্ধ সাহিত্যে অবদানের জন্য। যার পাওয়ার কথা ছিল কথাসাহিত্যিক হিসেবে। কেননা সমকালীন কথাসাহিত্যে হোসেনউদ্দীন হোসেন একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম। যা হোক, প্রবন্ধে প্রতিযোগিতা কম, তাই বোধ হয় এক্ষেত্রে পুরস্কার দেওয়া অনেকটা নিরাপদ। যেমনটি ঘটেছিল কবি আজীজুল হকের ক্ষেত্রেও। পঞ্চাশ দশকের শক্তিমান এই কবিও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রবন্ধ সাহিত্যে। তাঁর একটি মাত্র প্রবন্ধের বই ছিল ক্ষুদ্রকায় বাংলা কবিতা নিয়ে। সে তুলনায় হোসেনউদ্দীন হোসেনের অনেকগুলো প্রবন্ধের বই।
হোসেনউদ্দীন হোসেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর এলাকায়, চারিদিকে তাঁকে সম্বর্ধনার জোয়ার শুরু হলো। এই পুরস্কারই যেন সব সাফল্যের চাবিকাঠি। হোসেন ভাই এটা বিশ্বাস করতেন না। আমরাও বিশ্বাস করি না। মনে করি এই পুরস্কার দিয়ে বাংলা একাডেমি সম্মানিত হয়েছে, হোসেন ভাই নন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট বলেছেন-- "আমি পুরস্কারের লোভে লিখি না।" শুধু হোসেন ভাই কেন, মনে করি প্রকৃত গুণী লেখক কেউই পুরস্কারের লোভে লেখেন না।
হোসেনউদ্দীন হোসেনের জন্ম ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে। পিতা কলিম উদ্দীন। মাতা আছিরন নেছা। কৃষক পরিবারের সন্তান। নিজেকে কৃষক পরিচয় দিতেই ভালোবাসতেন তিনি।
হোসেনউদ্দিন হোসেন জানিয়েছেন, তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় বাড়ির বৈঠকখানায়। তখন বৈঠকখানাকে পাঠশালা বলা হতো। তালপাতায় লেখা হতো আর বাঁশের কঞ্চির মধ্যে কালি দিয়ে কলম বানানো হতো। সে সময় মাস্টার মশাই সুর ও তাল দিয়ে বই পড়াতেন। পরে গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় কৃষ্ণনগর সমিতির স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিছুদিন স্কুলটি চলার পরে সমিতির স্কুল তুলে দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। সেই স্কুলের নাম দেয়া হয় কৃষ্ণনগর পল্লীমঙ্গল প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রমোশন পেয়ে তিনি হাই স্কুলে ভর্তি হন। মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন ঝিকরগাছা ইংরেজি হাই স্কুলে। তখন হাই স্কুলে বাংলা বিষয়টি পড়ানো হতো, বাকি বিষয়গুলো পড়ানো হতো ইংরেজিতে । নবম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। দশম শ্রেণিতে পড়াশুনার জন্য যশোর শহরে এসে ভাল পরিবেশ না পেয়ে বাড়িতেই পড়াশোনা করতে থাকেন। পরে যশোর জিলা স্কুল থেকে ঢাকাবোর্ডের ফরম তুলে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে তিনি প্রাইভেটভাবে পরীক্ষা দিয়ে ২য় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার জন্য তিনি যশোর মাইকেল মধুসুদন দত্ত কলেজে গিয়েছিলেন কিন্তু ভর্তি হননি। বাড়িতে পড়াশোনা করে ঢাকা বোর্ডের অধীনে প্রাইভেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে মানবিক বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না। তিনি ভাবতেন --বই পড়ে কি হবে? সার্টিফিকেট অর্জন ও চাকুরি লাভ ছাড়া আর কিছু হবে না। তাই স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে শুরু করেন পুরোদমে সাহিত্যচর্চা। সারারাত জেগে বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়তেন আর নিজের মতো করে কবিতা, গল্প ও উপন্যাস লিখতেন।
জানা যায়, অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি দেয়াল পত্রিকায় প্রথম লেখেন। দেয়াল পত্রিকায় লেখা দেখে প্রধান শিক্ষক আব্দুল বাকির তাঁকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর লেখার খোঁজ নিয়ে গণিত টিচার কালিবাবুরকে তাঁর লেখা দেখার দায়িত্ব দেন। তিনি তাঁকে লেখার ছন্দ, নিয়ম-কানুন অনেক কিছু শিখিয়ে দেন। এর আগে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন তখন কোলকাতার দৈনিক লোকসেবক পত্রিকায় একটি কবিতা পাঠান। কবিতাটি পত্রিকার ছোটদের বিভাগে ছাপা হয়।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকায় চলে যান। সেখানে বাম রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা জন্মে। অতঃপর তিনি বাম রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকার দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। মাত্র বিয়াল্লিশ টাকা বেতনে এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসাবে এক বছর দায়িত্ব পালন করেন। এসময় সাপ্তাহিক মজলুম পত্রিকায়ও তার লেখা প্রকাশ হতো।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে যশোরে সেনাবাহিনীর ইন্টারভিউ দেখে কৌতুহলবশতঃ ইন্টারভিউ দিলে চাকুরি হয়ে যায়। তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। চাকুরির পাশাপাশি তিনি লেখালেখি চালিয়ে যান। চাকুরিরত অবস্থায় তিনি বিবাহ সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই সময় তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধের মধ্যে তাঁকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নিত করা হয়। যুদ্ধ-বিগ্রহ আর সেনাবাহিনীর কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে তিনি বেশীদিন আবদ্ধ থাকতে পারেননি। এমতাবস্থায় ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্বেছায় সেনাবাহিনীর চাকুরি ছেড়ে গ্রামে চলে আসেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে যশোর শহর থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক 'নতুন দেশ' পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি গ্রামে চলে আসেন। নিজের জমিতে শক্ত হাতে লাঙ্গল চাষ শুরু করেন,আর রাতের বেলায় শক্তহাতে কলম ধরেন। একাডেমিক শিক্ষা বেশি না হলেও তিনি কিন্তু স্বশিক্ষায় দেশি-বিদেশি সাহিত্য সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে অর্জন করেন প্রভূত জ্ঞান।
হোসেনউদ্দীন হোসেন তরুণ বয়সে সম্পৃক্ত হন যশোর সাহিত্য সংঘের সঙ্গে। প্রতি রবিবার কবি অবলাকান্ত মজুদারের নেতৃত্বে যশোর শহরের গুরুদাস বাবু লেনে সাহিত্য আসর বসত। তিনি এখানে নিয়মিত আসতেন নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য। রবিবার সাহিত্য আসর প্রতিবছর মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের জন্মবার্ষিকী ২৪ জানুয়ারি যশোরে এবং ২৫ জানুয়ারি সাগরদাঁড়ীতে উদযাপন করত। ওই অনুষ্ঠানে কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জসিম উদদীন, ঔপন্যাসিক মনোজ বসু, সাহিত্যিক-অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য্যসহ অনেক খ্যাতিমান লেখকরা আসতেন। তাঁদের সংস্পর্শে হোসেনউদ্দীন হোসেন সাহিত্য সাধনায় অনুপ্রেরণা লাভ করেন। কবি জসিম উদদীনের কাছে অনুপ্রাণিত হয়ে এ সময় তিনি বাংলা একাডেমিতে লোকজ সাহিত্য সংগ্রহ করে পাঠাতেন।
যশোর শহর থেকে প্রকাশিত হতো বেগম আয়েশা সর্দার সম্পাদিত 'শতদল' পত্রিকা। হোসেনউদ্দীন এ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। যশোরের নওয়াপাড়া থেকে নাসিরউদ্দীন প্রকাশ করতেন মাসিক মুকুল। এ পত্রিকাতেও তিনি লেখালেখি করতেন।
কলকতার দৈনিক লোকসেবক পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশিত হলেও জাতীয় পর্যায়ে দৈনিক বাংলার কিংবদন্তিতুল্ল্য সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীবের হাত ধরে সাহিত্যাঙ্গনে কবিতা - প্রবন্ধ নিয়ে আগমন। সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত 'সমকাল' পত্রিকাতেও তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। তারপর বাংলাদেশ - ভারতের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতে থাকে তাঁর গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। কবি হিসেবে ছিলেন তিনি ছিলেন ছন্দসফল। খুব বেশি লিখলেই বড় লেখক হওয়া যায় না। হোসেনউদ্দীন হোসেন কম লিখেছেন। প্রকাশকরা তাঁর কাছে বই চেয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে হতাশ হয়েছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা ত্রিশের অধিক নয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য -- গদ্য-গবেষণা-প্রবন্ধ--যশোরাদ্য দেশ (১৯৭৪), যশোর জেলার কিংবদন্তী (১৯৭৪)- ১ম খণ্ড, যশোর জেলার কিংবদন্তী (১৯৭৯)- ২য় খণ্ড, অমৃত বৈদেশিক (১৯৭৫), ভলতেয়ার ফ্লবেয়ার কলসত্ব ত্রয়ী উপন্যাস ও যুগমানস (১৯৮৮), ঐতিহ্য আধুনিকতা ও আহসান হাবীব (১৯৯৪), বাংলার বিদ্রোহ (২০০৩) ১ম খণ্ড, বাংলার বিদ্রোহ (২০০৬) ২য় খণ্ড, সমাজ সাহিত্য দর্শন( ২০১০), রণক্ষেত্রে সারাবেলা ( ২০১২), লোকলোকোত্তর গাঁথা ( ২০১২ ), অনন্য রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বমানব ভলতেয়ার, কালান্তরের রূপকথা, সাহিত্যে চিত্রবিচিত্র। ছোটোগল্প-- বনভূমি ও অন্যান্য গল্প, মন-মানুষের চালচিত্র। উপন্যাস --নষ্ট মানুষ (১৯৭৪), প্লাবন এবং একজন নুহ (১৯৭৯), সাধুহাটির লোকজন (২০০১), ইঁদুর ও মানুষেরা (২০০৮), সোনালি জলের কাঁকড়া (২০১১), উত্তর পুরুষ, জগজ্জীবন। সম্পাদনা-- উনাশির শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৭৯)। কাব্যগ্রন্থ-- শেষ বিদায়ের আগে, হে আদি হে বৃক্ষ। সর্বশেষ গ্রন্থ-- গবেষণা --বাংলার সংস্কৃতি ও লোকজীবন ( ২০২২ )।
তিনি 'মরাল' নামে একটি সাহিত্যের ছোটকাগজ সম্পাদনা করতেন। যা ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছিল।
২০০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর 'প্লাবন ও একজন নূহ' উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে Flood and Nooh নামে ইংল্যান্ডের মিনার্ভা পাবলিশেকন্স থেকে প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশের পর ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে Top -100 writers হিসেবে মনোনীত করা হয়। এই সম্মাননা গ্রহণের জন্য তিনি সস্ত্রীক ইংল্যান্ড গমন করেন এবং পুরস্কার হিসেবে স্বর্ণপদকসহ দুহাজার পাউন্ড প্রাপ্ত হন।
ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে তাঁর 'ইঁদুর ও মানুষেরা' উপন্যাসটিও। ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁর এই উপন্যাসটি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।
সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম -চাঁদের হাট পদক, ১৯৯০; মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মৃতি পদক, ১৯৯৬; বিজয় দিবস পদক, ১৯৯৭; মধুসূদন একাডেমি পুরস্কার, ২০০১; কোলকাতা শিমুল পলাশ সম্মাননা পদক, কোলকাতা লিটল ম্যাগাজিন সম্মাননা পদক,২০০৩; কোলকাতা বিধান নগর (সল্টলেক) মেলা পদক ২০০৪; কন্ঠশীলন সম্মাননা পদক ২০০৬; গুণীজন সম্মাননা পদক, এম,এল হাই স্কুল সম্মাননা পদক, কপোতাক্ষ সম্মাননা পদক, সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার ,আয়েসা জব্বার সম্মাননা পদক ২০০৭; বইমেলা সম্মাননা পদক,মণিরামপুর ২০০৮; বিবর্তন আজীবন সম্মাননা পদক ( ঢাকা), বইমেলা সম্মাননা পদক (যশোর ইনস্টিটিউট), সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক সম্মাননা পদক ২০১০; বাংলা একাডেমি পুরস্কার ২০২২।
হোসেনউদ্দীন হোসেন শেকড়সন্ধানী লেখক। রাজধানী কখনও তাঁকে টানেনি। যাঁরা মনে করেন লেখক হতে গেলে রাজধানীতে পাড়ি দিতে হবে; তাঁদের কাছে তিনি একটি দৃষ্টান্ত হতে পারেন।
ঢাকায় যখন ছিলেন তখন তিনি উপলদ্ধি করেন,--সংবাদপত্রে কাজ করলে সংবাদ-সাহিত্য হবে কিন্ত প্রকৃত সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন কোনদিন পূরণ হবে না। তাঁর প্রকৃত স্বপ্ন একজন সাহিত্যিক হওয়ার। তাই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ছেড়ে গ্রামে চলে আসেন। সাহিত্যচর্চার জন্য গ্রামই উপযুক্ত জায়গা, তিনি এটা ভাবেতন সবসময়। সাক্ষাৎকারে একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন--
"লেখক হওয়ার জন্য শহরে কিংবা রাজধানীতে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখার জন্য বিশেষ প্রয়োজন নির্জনতা। প্রয়োজন কোলাহলমুক্ত একটি উপযুক্ত স্থান। কারণ শিল্পকর্মের মূল হচ্ছে রূপ সৃষ্টি করা। যারা শহরে কিংবা রাজধানীতে যেতে চান, তারা খ্যাতিমান হওয়ার উদ্দেশ্যেই যান। খ্যাতিমান হতে গেলে যে কর্মসাধনার দরকার, তা মফস্বলে থেকেও করা যেতে পারে।" ( সাক্ষাৎকার, দৈনিক যুগান্তর, ১৩ আগস্ট ২০২১ )।
২০ মার্চ ২০২৪, তিরাশি বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমাদের একজন শক্তিমান লেখক হোসেনউদ্দীন হোসেন। তাঁর সাহিত্যে উঠে এসেছে গ্রামীণ জীবন, প্রান্তিক মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ধর্মান্ধতা-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধ, শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার দুর্দমনীয় মন্ত্রধ্বনি। তিনি আমাদের সাহিত্যের সংশপ্তক হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন নিশ্চিত।
তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।