এই তথাকথিত শান্তি আলোচনাকে আমরা গালিগালাজই করতাম কারণ তা শুধুমাত্র ইজরায়েলের জমিচুরি এবং আমাদের জনগণের উপর অত্যাচারকেই বৈধতা দিত।
Published : 06 Nov 2023, 06:59 PM
আহেদ তামিমি ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বাবা প্যালেস্তাইনের মুক্তি আন্দোলনের শরিক। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইজরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদের শাস্তি হিসেবে তাকে তুলে নিয়ে যায় সেনা। তামিমিকে অবশ্য বিশ্ব চিনেছে অনেক আগেই। ভাইয়ের গ্রেফতারির সময় তর্জনি তুলে ইজরায়েলি মিলিটারির সঙ্গে বাহাসে জড়িয়ে পড়লে সেই ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। তখন তার বয়স এগারো। এর তিন বছর বাদে পাথর ছোড়ার অপরাধে ইজরায়েলি বাহিনী তাঁর ভাইকে ফের বাড়ি থেকে তুলে নিতে গেলে তাকে এক সেনাকর্তার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। জ্ঞান হওয়া ইস্তক প্রিয়জনদের অত্যাচারিত হতে দেখা মেয়েটির সশস্ত্র সেনাকর্তাকে চড় কষাতে হাত কাঁপেনি। দীর্ঘসময় জিজ্ঞাসাবাদের সেলে বসে যখন মূত্রথলি ফেটে যাওয়ার জোগাড়, অথচ তাক করে রাখা ক্যামেরার ভয়ে বাথরুমে যাওয়া যাচ্ছে না, তখন সে সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্বকে সব জানিয়ে দেবে সে। এই লেখা তামিমির মতো কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনির সঙ্গে হওয়া চরম অন্যায় আর তামিমিদের দেশপ্রেমের দলিল।
দেনা তাকরুরি এই লেখায় তামিমির সই। দেনা ফিলিস্তানি শরণার্থীর সন্তান। বড় হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বারবার ফিরে গেছেন বাপ মায়ের ভিটেয়। বর্তমানে তিনি AJ+ এ কর্মরত। লিঙ্গনিরপেক্ষতার কারণে They Called me Lioness (২০২২) শিরোনামের সিংহ শব্দটি বেছে নেয়া হয়েছে। বইটি মূলত আহেদ তামিমির বয়ানে রচিত। দেনা তাকরুরি বইটি সম্পাদনায় সহায়তা করেছেন। ইংরেজি থেকে পুরো বইটি অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক অর্ক। আজকে বইটির দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো। বি. স.
চার সন্তানের মধ্যে আমি ছিলাম দ্বিতীয়, একমাত্র মেয়ে। আমার দাদা ওয়ায়েদ আর আমার বয়সের ব্যবধান তিন বছর। বেড়ে ওঠার সময় আমার নেতা ছিল সে-ই, সে-ই ছিল আমার একমাত্র বিশ্বস্তজন। একসঙ্গে স্কুল যাওয়ার কত স্মৃতি আছে আমার কাছে, আমার ছোট ভাইরা স্কুল যেতে শুরু করার আগের কথা সেসব। আমি, আমার মেয়েবেলায়, সকালেও স্বপ্ন দেখতাম, বিশেষত স্কুলে যাওয়ার সময়টায়। কারণ আমি তখনও আধঘুমে থাকতাম। আমার মাথা টলমল করত, পা জড়িয়ে যেত, আমাকে দেখে মনে হত আমার হাতে অনেক সময়, আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই। আমায় ব্যাগসুদ্ধ টানতে টানতে নিয়ে যেত ওয়ায়েদ, আমার দিকে চোক পাকিয়ে তাকাত যাতে আমি জেগে যাই আর দ্রুত হাঁটা লাগাই। কিন্তু ফেরার পথে এই ছেলেই আমার দিকে তার ব্যাগ ছুঁড়ে মারত। রীতিমতে প্রতারণা করে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার জন্য ছুট লাগাত।
আমরা একসঙ্গে যখন খেলতাম, আমি যে মেয়ে, আলাদা করে ওয়ায়েদ আমায় বুঝতে দেয়নি কখনও, এই ঘটনা আমার ভিতরটাকে শক্ত করেছে। ওয়ায়েদ প্রায়শই প্রভাব খাটিয়ে আমায় আর আমার অন্য ভাইবোনদের দিয়ে এমন নানা কাজ করাত যা ওর করার কথা ছিল। কিন্তু আমি কিছু মনে করতাম না। ওর করিশ্মা আমাদের মুগ্ধ করে রাখত। যে-ই ওর সঙ্গে দেখা করত, ওর স্বতঃস্ফূর্ততায় মুগ্ধ হয়ে যেত। সবসময় হাসি, সারাক্ষণ মজার মজার কথা বলা--সব মিলিয়ে ওয়ায়েদের উপস্থিতি ছিল আনন্দময়। বরং আমি একটু গম্ভীর ধরনের ছিলাম, অনেকেই আমাকে ভুল বুঝত, ভাবত লাজুক অথবা আত্মকেন্দ্রিক। আমার আসলে তেমন চুম্বকের মতো আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বই ছিল না, আমি খুব একটা সামাজিকও ছিলাম না। আমার হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু ছিল, আমি নিজের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করতাম।
আমার জন্মের প্রায় তিন বছর পর আমার ছোটভাই আবু ইয়াজানের জন্ম, যার নামের অর্থ দাঁড়ায় "ইয়াজানের বাবা"। অল্প বয়সি একটা ছেলের এমন একটি অদ্ভুত নাম কেন, কেউ ভাবতেই পারেন। আসলে ওর নাম ছিল মোহাম্মদ, কিন্তু এই গ্রামে মোহম্মদ নামে আরো অনেক ছেলেপিলে আছে। তাই আমরা আলাদা করার জন্যেই ওকে আবু ইয়াজান বলে ডাকি।
কীভাবে এই ডাকনাম এল, সেই গল্পখানা বেশ মজার।
আমার ভাই ছোটবেলায় ঘুরঘুর করত আবু ইয়াজান নামের পাশের গ্রামের এক বৃদ্ধের পায়ে পায়ে। ওরা দেখতেও অনেকটা একরকম ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই, আমরা তাকেও আবু ইয়াজান নামে ডাকতে শুরু করি, অবশেষে সেই নামটাই রয়ে গেল। আবু ইয়াজান আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে একমাত্র যে অল্পেই মেজাজ হারাত, কিন্তু এই নামকরণ নিয়ে সে কখনও কিছু মাথা ঘামায়নি। ওর মেজাজ এমনিতে এই ভালো, এই খারাপ। চূড়ান্ত একগুঁয়ে ছেলে, কেউই ওঁর খারাপ দিক দেখতে চাইবে না। তবে আমি ওকে অধিকাংশ মানুষের চেয়ে ভালো চিনি। আর আমরা কেউই নিজেদের খুব কেউকেটা মনে করিনি কখনও, আমাদের মিলেমিশে থাকার রহস্য এটাই।
আবু ইয়াজানের জন্মের বছর দুয়েক পরে সালামের জন্ম হয়। পরিবারের সবাই ওকে সব সময় আদর দিয়ে এসেছে। ওর মুখটা যেমন গোলগাল, মিষ্টি, স্বভাবটাও একদম তেমন। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে ওই একমাত্র যার জন্যে বাবা-মাকে কোনো ঝক্কি পোহাতে হয়নি, ও ছিল পুরোদস্তুর এক সংবেদনশীল শিশু যে কাউকে কষ্ট দিতে চায়নি কখনও। কিন্তু এই ছেলেই ছয় বছর বয়সে কেঁদে ভাসানো শুরু করল। বাবা-মায়ের কাছে নিরন্তর ঘ্যানঘ্যান করে সে জানান দিল পিতামাতার দেওয়া সালাম নামটা তার আদৌ পছন্দ নয়। সে এই নাম বদলাতে চায়। "আমাকে কেন এমন ভয়ানক নাম দিয়েছ?" এই বলে সে উত্তেজনায় বাতাসে হাত পা ছুঁড়তে দেখেছি আমরা। আরবিতে সালাম শব্দের মানে "শান্তি"। তাহলে অশান্তিটা কীসের! আসলে ইজরায়েল ও ফিলিস্তিনি নেতাদের মধ্যে অভিশপ্ত শান্তির আলোচনার কথা বারবার গুরুজনদের মুখে শুনে ও প্রবল ক্ষেপে গিয়েছিল। এই তথাকথিত শান্তি আলোচনাকে আমরা গালিগালাজই করতাম কারণ তা শুধুমাত্র ইজরায়েলের জমিচুরি এবং আমাদের জনগণের উপর অত্যাচারকেই বৈধতা দিত। প্রতি ফিলিস্তিনি জানে যেখানে ন্যায় অনুপস্থিত সেখানে শান্তি থাকতেই পারে না - তাই "শান্তি" র এই ধারণা শুধু বিভ্রমই নয়; প্রহসনমূলকও। আমার বেচারা ছোট ভাইয়ের কাছে ওর সমস্ত অস্তিত্ব আমাদের জাতির সম্মিলিত হতাশার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। তাই ও একটা নতুন নাম চেয়েছিল।
আমার মা, নরিমন- সেই আঠা যা গোটা পরিবারটাকে জুড়ে রেখেছে। চার সন্তানকে একা মানুষ করার কাজটা খুব সহজ ছিল না তার জন্যে। একা বলছি কারণ তার স্বামী হয় জেলখানায় থাকত অথবা তার পরবর্তী অনিবার্য গ্রেফতারি এড়াতে বাড়ি থেকে দূরে ঘুমোতে বাধ্য হতে। কিন্তু মা ব্যাপারটা সহজ করে রাখত আমাদের জন্য। তাঁকে যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তার তল পাওয়া সম্ভব ছিল না। মা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করত প্রাণ খুলে, সবসময়েই যেন আশায় বুক বেঁধে থাকত। অদম্য প্রাণশক্তি তাঁর। আমার মায়ের মন সব সময়েই অন্যের ভালো চেয়ে এসেছে। এই কারণটার জন্যেই তাকে যারা চেনেন তারা প্রত্যেকে তাকে সম্মান করে, পছন্দ করে। বড় হওয়ার দিনগুলিতে সব বয়সের পুরুষ এবং মহিলাদের আমার মায়ের কাছে পরামর্শ নেওয়ার জন্য আসতে দেখেছি। তারা গোপন কথা বলেছেন মাকে বিশ্বাস করে। এই ঘটনা দেখে গর্বে আমার মন ভরে গেছে। আমার জানা মতে, মা একজন অন্যতম শক্তিশালী নারী, তাকে নিরন্তর দেখা অনেক কিছু শিখিয়েছে। শিখিয়েছে কীভাবে আত্মনির্ভর এবং স্বাধীন হতে হয়।
ছোটবেলায় আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতাম রাস্তায় খেলে বেড়াতে বা আমাদের গ্রামের পাহাড়গুলোতে ঘুরে বেড়াতে। ছুটির দিনে আমি সকাল সাতটায় বেড়িয়ে গিয়েছি, নবি সালেহ-র ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দিনভর খেলে রাতে বাড়ি এসেছি, এমনও হয়েছে। অন্যান্য ফিলিস্তিনি ছেলেমেয়েদের মতোই আমাদের প্রিয় খেলা ছিল জয়শ ও আরব সেনা ও আরব। কাউবয় অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস নামের প্রচলিত খেলার ফিলিস্তিনি সংস্করণ ছিল এটা। আমরা নিজেদেরকে দু'টি দলে ভেঙে নিতাম: একটি দল সাজত ইজরায়েলি সেনাবাহিনী, এবং অন্য দলটি ছিল ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনি দলে আমরা নিজেদেরকে চিকিৎসক, সাংবাদিক এবং অবশ্যই প্রতিবাদকারীদের ভূমিকায় দেখতে পছন্দ করতাম। যারা ইজরায়েলি সেনা সৈন্যদের ভূমিকা পালন করত তারা রাইফেলের আকারের লম্বা কাঠের টুকরো রাখত নিজেদের কাছে, কোনো কোনো ভাগ্যবানের অবশ্য খেলনা বন্দুকও ছিল।
খেলা শুরু হতেই দুই পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়ে যেত, আমরা খবরে যে দৃশ্যগুলি দেখেছি সেগুলি অনুকরণ করতাম।
শুক্রবার আমাদের গ্রামের প্রতিরোধ মিছিলের সময়ে যা দেখেছি তাই আমরা নকল করতাম। খেলার ফিলিস্তিনি দলটা সেনাবাহিনীর দিকে ছোট পাথর ছুঁড়ত, আর ইজরায়েলি পক্ষ খেলনা বন্দুক উঁচিয়ে গুলি চালাত। ফিলিস্তিনিরা ধরাশায়ী না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলত। ফিলিস্তিনিরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়ত। কিন্তু ওই সেনাদল ফিলিস্তিনিদের গ্রেফতার করত অবিলম্বে। জুতোর ফিতে দিয়ে হাতকড়া পড়াত। আমরা অনেক সময় গুলি খেয়ে চিৎকার করে উঠতাম, 'আমায় গুলি করা হলো!'
আমি সাধারণত অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ডাক্তার সাজতাম। যখন শুনতাম একটা বাচ্চা চিৎকার করে বলছে তাদের গুলি করা হয়েছে, আমি সেই স্বদেশী আহতদের কাছে ছুটে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাম। অনেক সময় আঘাতের চিকিৎসার জন্য খেলনা অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে হতো তাদের। যে সময় ডাক্তারিতে অংশ নিচ্ছি না, তখন আমি ছিলাম প্রতিরোধের অংশ। এদিকে সৈন্যরাও তেড়ে এসে যাকে পারছে গ্রেফতার করে নিত। যারা সাংবাদিক সাজত, তারা সব নথিভুক্ত করার ভান করত, মাঝে মাঝে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীকে ধরে এনে সাক্ষাৎকার নিত। গোটা ব্যাপারটায় আমাদের কাছে মজার ছিল।
খেলায় নিয়ম অনুযায়ী গ্রেফতার হওয়া মানে বাতিল হয়ে যাওয়া। আর কেউ যদি মারা যায়, শহিদ হয় তবে সে ফিরে এসে অন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। আমরা অবশ্য নিয়ম ভাঙতাম কখনো সখনো। কখনও-কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি করতাম, যেখানে- একবছর জেল খেটে আমাদেরই কেউ ফিরে আসছে, সেদিনটায় যুদ্ধ ভুলে আমরা সবাই গানে গানে সেই ফেরাটা উদযাপন করতাম।
একটু ফাঁকতাল পেলেই আমরা জয়শ ও আরব খেলতাম। মাঝে মাঝে সকালে শুরু হয়ে ঘুমের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও আমাদের খেলা চলত। সূর্য ডুবে যাওয়ার পরে, আমাদের বাবা-মা আমাদের বাড়িতে আসার জন্য ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। আমরা খেলায় যে যার ভূমিকায় এত বেশি ডুবে থাকতাম যে একে অন্যের প্রতি অনেক সময় হিংস্রতাও দেখিয়ে ফেলেছি। আমরা এমন আবেগ আর এমন দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে খেলতাম যে আমাদের মনে হতো যে আমরা আসলেই প্যালেস্টাইনের মুক্তির জন্য লড়ছি। তবে, আমি স্বীকার করি, এটা কোনো স্বাস্থ্যকর খেলার নমুনা হতে পারে না। আসলে যে মানসিক আঘাত আমাদের নিয়মিত সহ্য করতে হয়েছে, তার অনিবার্যতার কারণেই আমাদের হাসিমজার মুহূর্তেও সেই ঘটনাগুলিই উঠে আসত। অন্য ভাবে বললে, সইয়ে নেওয়ার এটা একটা উপায়ও ছিল।
আমরা ব্যাট-বুটও খেলতাম, ব্যাট-বুট তুলনামূলক কম হিংস্র খেলা। অনেকটা বাড়ি তৈরির খেলার মতো। যদি জয়শ ও আরব আমাদের মুক্ত প্যালেস্টাইনের স্বপ্ন প্রতিফলিত করে, তবে এই খেলাঘর সাজানোর খেলা ছিল আমাদের স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ। আমরা আমার বাড়ির পিছনে, পাহাড়-চূড়োয় খেলতাম। খেলার শুরুতে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জুটি বেঁধে নিতাম। প্রতিটি দম্পতি পাহাড়ের এক একটি এলাকাকে তাদের বাড়ি বলে দাবি করত। আমরা প্রতিটি বাড়ির প্রবেশপথটুকু পাথর সংগ্রহ করে সাজাতাম। সর্বদা প্রবেশপথের জন্য একটা ফাঁক রাখা থাকত। আমরা আমাদের মায়ের রান্নাঘর থেকে দই এবং লবনের খালি পাত্র চুরি করে আনতাম। সেই পাত্রে রান্না করার অভিনয় করতাম। আদতে পাত্রগুলিকে মাটি দিয়ে ভরাট করতাম। রাস্তার ওপারে হালামিশ বসতি নজরে আসত। সুন্দরভাবে সাজানো, লাল-টাইলেরর ঢাকা এই বাড়িগুলিকে আমরা অন্য দেশ হিসেবে কল্পনা করতাম। কখনও কখনও আমাদের মধ্যে কেউ একজন হয়তো সেই দূর দেশে ভ্রমণ করার ভান করত এবং তারপরে দূর দেশ থেকে দুর্দান্ত সব গল্প নিয়ে ফিরে আসত।
আমার বয়স যখন প্রায় ছয় বছর, আমাদের গ্রামে হঠাৎ করে ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের কারণে আমাদের খেলা গেল ভেস্তে। যে সাপ্তাহিক প্রতিবাদমিছিলগুলির জন্যে বিশ্বের দরবারে নবি সলেহ বিখ্যাত হয়েছিল, এটা তারও আগের কথা। আমরা তখনও সৈন্যদের নিয়মিত দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম না। ততদিন পর্যন্ত, আমরা তাদের কেবল দূর থেকেই দেখতে পেতাম। আমরা জানতাম, যদি তারা গ্রামে প্রবেশ করে তবে বুঝে নিতে হবে তা গভীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত-- যেমন কাউকে গ্রেফতার করা। এসব প্রায়শই গভীর রাতে ঘটত।
আমার খুড়তুতো ভাই এবং সবচেয়ে ভালো বন্ধু মারাহ, মারাহ-র ভাইবোন, আমি এবং ওয়ায়েদ-সহ আমরা প্রায় দশজন খেলছিলাম। হঠাৎই আমরা দেখলাম তিনটি সেনা জিপ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, সেনাকর্মীরা জিপ থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে ছুটতে শুরু করে। আমরা ভয় পেয়ে যাই। লুকনোর জন্য রাস্তা থেকে নেমে সোজা মারাহ-র বাড়িতে ঢুকে পড়ি। আগুপিছু চিন্তা না করেই আমরা সোজা মারাহ আর ওর দিদি বিসানের বেডরুমে ছুটে যাই। ওদের আলমারির মধ্যে জায়গা হয় আমাদের। ওয়ায়েদ আর আনান, বিসান এবং মারাহর ভাই, আলমারির উপর উঠে পড়ে, আর আমরা বাকিরা আলমারির ভেতর, হ্যাঙারে মেলা জামাকাপড়ের সমুদ্রে ঝুলন্ত সার্ডিন মাছের মতো ছটফট করতে থাকি। আমরা ভয়ে কাঁপছিলাম, কেউ শব্দ করার সাহস পাইনি। আমাদের লুকোনোর জায়গা থেকেই আমরা শুনতে পেলাম যে সৈন্যরা ঘরে ঢুকেছে। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ওরা হিব্রু ভাষায় কী কথা বলছে, আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। ওদের কণ্ঠস্বর কাছাকাছি আসার সাথে সাথে আমরা বুঝে গেলাম যে বেডরুমে প্রবেশ করা, আমাদের আবিষ্কার করা আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ছিল।
আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন সেনাকর্মী আলমারির দরজা খুলে দিল। আমরা সবাই হুড়মুড়িয়ে তার বুটের উপর পড়লাম। বিসান ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বিসান কুকুরছানার মতো চোখ করে “আম্মো” বলে ডেকে উঠল। ও ভেবেছিল, কাকু সম্বোধনটার জন্য আমরা বেঁচে যেতে পারি। ও জিজ্ঞেস করল, "আপনি আমাদের মেরে ফেলবেন?" সেনাকর্মীটির পায়ের কাছে, মেঝেতে আমরা শুয়ে আছি। তিনি এই দৃশ্যটি দেখে মজাই পেয়েছিলেন মনে হয়। সেদিন তিনি আমাদের হত্যা করেননি। কিন্তু এই দিনটা ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিন।