কারণ পাশ্চাত্যে এবং জাপানের সংবাদপত্রে ততোদিনে, অর্থাৎ ১৯৮৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশ নামটির সাথে দুর্যোগ, বন্যা, খরা, কলহ, খুনোখুনি, জোচ্চুরি, দারিদ্র্য,বুভুক্ষু, পুকুরচুরি ও নারী কেলেংকারীর মতো বিশেষণগুলো সম্পূরক হিসেবে লেখা হচ্ছিল।
Published : 27 Mar 2025, 09:18 PM
ওসাকা বিমানবন্দরের ব্যস্ততা কেটে যাবার পর থেকে বাসে, ট্রেনে, পথঘাট ও দোকানপাটে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র জাপানি পুরুষ ও মহিলাদের অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত কিন্তু লৌকিক বা ফর্মাল মনে হয়েছে। সবাই সবার কাজে ব্যস্ত, কেউ কারো দিকে তাকিয়ে বা কথা বলে সময় নষ্ট করছে না। বাস বা ট্রেনের লম্বা যাত্রায় প্রত্যেকের মুখের সামনে একটি বই বা পত্রিকা ধরা আছে। কিন্তু পরিচিত-অপরিচিত ছেলে-বুড়ো বা পুরুষ-মহিলা, যাদেরই কাছেই সাহায্যের হাত পেতেছি, সবাই প্রয়োজনাতিরিক্তভাবে এগিয়ে এসেছেন। সেখানে শুধু সাহায্য নয়, থাকে নিখাদ আন্তরিকতা।
এভাবে সাহায্য নিয়ে কারো সাথে সম্পর্কটি মিনিট পাঁচেক গড়ানোর পর প্রথম যে প্রশ্নটি তাঁরা করেন, তা হচ্ছে ও-কুনি দোকো দেসকা বা ও-কুনি ওয়া? এর অর্থ হচ্ছে আপনার বাড়ি কোন দেশে? আমেরিকার কথা ভিন্ন কারণ এই আধুনিক দেশটিই গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অভিবাসী দ্বারা। কিন্তু বাংলাদেশ বা এধরনের আরো অগণিত দেশের জনগণও কোনো বিদেশি দেখলে হয়তো এই প্রশ্নটিই প্রথম করবেন। তা সত্ত্বেও জাপানের ক্ষেত্রটি সম্ভবতঃ ভিন্ন। কারণটি ঐতিহাসিক ও জটিল।
পৃথিবীর এক প্রান্তে অবস্থিত একটি দ্বীপ-রাষ্ট্র হওয়ায় বহু শতাব্দি ধরে জাপানিরা ঘরকুনে কিন্তু স্বাধীন হয়েই সন্তুষ্ট ছিল। বিদেশিদের ঘৃণা করতো। কিন্তু ইউরোপীয় শক্তিগুলো ঊনবিংশ শতক নাগাদ আমেরিকা ও আফ্রিকার পর একে একে এশিয়ার স্বাধীন দেশগুলোকে পরাধীন করতে থাকলে জাপানিরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তাঁরা বুঝতে পারেন, পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও শিল্পবিপ্লবের সুফল আয়ত্ত করে তাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে না পারলে তাদের পদানত হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। যদিও তখনই জাপানিদের শিক্ষার হার শতকরা ৭০ ভাগ, জাপানের উচিৎ বিদেশিদের সাথে মিশে তাঁদের ভালো গুণগুলো আয়ত্ত করা।
তখনকার রেলগাড়ি ও প্রযুক্তি-শিল্পের শীর্ষস্থানীয় দেশ যুক্তরাজ্যে জাপানি লোক পাঠালো ইঞ্জিনিয়ারিং শিখতে, শীর্ষস্থানীয় জার্মানিতে পাঠালো বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণা শিখতে, হল্যান্ড থেকে আনলো নগরের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য টিউলিপ ফুল, পাশ্চাত্যের দর্শন শিক্ষার জন্য শিশু ছাত্রদের পাঠিয়ে দেয়া হলো আমেরিকায়। তাঁদের কেউ কেউ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ফিরে এলো খৃষ্টান ধর্মান্তরিত হয়ে। তাঁদের অর্জিত শিক্ষা জাপানে অতি সম্মানের সাথে প্রচলনের সুযোগ করে ওদের দেয়া হলো অবারিত। কিন্তু খৃস্টধর্মাচার অনুযায়ী টোকিওর ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালের উপাচার্য যেদিন জাপানের সম্রাটের সামনে মাথা নোয়াতে অস্বীকার করলেন, তাঁকে টেনে নামানো হলো। বলা হলো বিদেশের ভালো তুমি সবকিছুই গ্রহণ করতে পারবে কিন্তু জাপানি আচার ও ঐতিহ্যকে হেয় বা অবহেলা করে নয়!
তা সে যাই হোক, এই যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দেশের প্রতি ওদের যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, এরই ধারাবাহিকতায় আজকের সাধারণ একজন জাপানিও পরিচয়ের প্রারম্ভেই আপনার দেশের খোঁজ নিতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ। কিন্তু‘ও-কুনি দোকো দেসকা’প্রশ্নের কারণ এতোটুকু বলেই ছেড়ে দিলে জাতটির প্রতি চরম অবিচার করা হবে। বিগত প্রায় দুইশত বছরের পরিশীলনের ফলে যে কোনো বিদেশির প্রতিই তাঁদের যে আগ্রহ লক্ষ করেছি তা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। শুধুমাত্র উন্নত দেশের প্রতিই যদি তাঁদের আগ্রহ থাকতো তবে জাত বা বর্ণ ভেদাভেদ না করে আমরা, নেপাল, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের ছাত্ররা কোনো সমাদরই পেতাম না। অথচ জাপানি পরিচালিত ছাত্রাবাসে ইউরোপ-আমেরিকার শ্বেতচর্মধারী ছাত্রদের সাথে সাথে বসবাস করাকালে কোনোরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ অনুভব করিনি। একই ল্যাবে ফরাসী, রুশদেশীয় এবং কোরিয় গবেষকদের পাশাপাশি কাজ করার সময়ও বৈষম্য অনুভব করিনি। নিচে আমার ‘গাইজিন’ প্রবন্ধে এ নিয়ে আরো আলোচনা করেছি।
দেশ হিসেবে আমেরিকা এবং আমেরিকান নাগরিকদের প্রতি ওদের একটি বিশেষ ধরনের মনোভাব লক্ষ করেছি। আমেরিকা দেশটি বিশাল ও বৈচিত্র্যময়। ইতিহাসে আমেরিকাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেটি জাপানকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিল, অর্থাৎ আমেরিকা জাপান থেকে শ্রেষ্ঠতর! এই দুই কারণে আমেরিকান নাগরিকদের প্রতি ওদের যেমন অপ্রকাশিত একটি ক্ষোভ আছে, তেমনি আছে ভীতিমিশ্রিত শ্রদ্ধা। প্রায় সব সামাজিক স্তরের জাপানিদের মাঝেই জীবনে একবার হলেও আমেরিকা দেখার সখ লক্ষ্য করেছি। অপরদিকে, আমার জাপান-বাসের শেষ দিকে এবং পরবর্তী দুবার সেখানে গিয়ে বাংলাদেশ নামটির সাথে যে উন্নাসিকতা লক্ষ করেছি, তার প্রেক্ষিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, যা অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
জাপানিদের সাথে পরিচয়ের পর দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি করা হতো তা হচ্ছে ‘ও-কুতসু দেসকা’? অর্থাৎ, আপনার বয়স কত? বাংলাদেশে এবং অবশ্যই পাশ্চাত্যের কোনো দেশে এভাবে বয়স জিজ্ঞেস করাটা খুবই অসৌজন্যমূলক বিবেচনা করা হয়। তবে বিদেশ সম্পর্কে এতোসব জানার পরও জাপানিরা কেন এই প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকে না? সঠিক উত্তরটি আমার জানা নেই তবে কিছুটা ধারণা করে নিতে পারি। পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে জাপানে বয়স (ও সামাজিক-দাপ্তরিক অবস্থান) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশে বয়স বুঝে সহজেই আমরা আপনি, তুমি ও তুই-এর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। বাংলার মতো জাপানি ভাষাতেও তা পরিস্ফুট। ‘ওতাকু’ (আপনি), ‘আনাতা’ (তুমি) এবং ‘কিমি’ (তুই) এর প্রথম দুটির ব্যবহার বয়স অনুযায়ী হয়ে থাকে। শিক্ষক ছাত্রকে তুই সম্বোধন করা একটি অধিকার। যদিও আমার অধ্যাপকদের কেউই আমাকে এভাবে সম্বোধন করেননি। এর বাইরে মেয়েদের ভাষার ব্যবহারও পুরুষদের থেকে ভিন্ন। পুরুষদের ওরা শুধু আপনিই সম্বোধন করবে না, মৌখিকভাবে সেটি প্রকাশের সময়ও তা স্ত্রীসুলভ হওয়া বাঞ্চনীয় ছিল। অন্যদিকে, পুরুষদের দেখেছি মেয়েদের তুই তোকারি করতে।
গাইজিন – কীভাবে মনে নেই তবে জাপানে পৌঁছে খুব শীঘ্রই যে কয়টি শব্দের সাথে পরিচয় ঘটেছিল, তার একটি হচ্ছে ‘গাইজিন’। শব্দটির অর্থ খুবই সাধারণ, বিদেশি। কিন্তু এই সাধারণ একটি শব্দের মাঝেই জাপানীদের অসাধারণ কিছু মনোভাব প্রকাশ পেতো, অন্ততঃ আমি যখন সেদেশে বাস করছিলাম। শহরের পথে ঘাটে বা কর্মস্থলে কোনো বিদেশিকে দেখলেই ওরা অবাক, ঔতসুক্য, ঘৃণা বা ভীতির দৃষ্টিতে তাকাতো। কিন্তু গ্রামদেশে বিদেশিদের ওরা নিশ্চিতভাবে ঘৃণা ও ভয়ের চোখেই দেখতো। ব্যাপারটি হয়তো বাংলাদেশ বা অন্য যে কোনো দেশের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু জাপানে পৌঁছার আগে কলকাতা, হংকং ও তাইপেতে, এবং পরবর্তীতে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিদেশিদের প্রতি স্থানীয়দের এই মানসিকতা লক্ষ করিনি। ‘গাইজিন’দের নিয়ে জাপানিদের এই মনোভাবের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণ আছে বলে তখন বিদেশিদের মাঝে আলোচনা হতো।
এশিয়ার সর্বপূবে এবং চারিদিকে সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় জাপান বহু বছর পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্নই ছিল বলা যায়। ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছানো সাধারণ মানুষের জন্য তো নয়ই, চীনা সম্রাটগণ বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভিযান চালিয়েও জাপানের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারেননি। ফলে জাপানিরা নিশ্চিতভাবে নিজেদের অপরাজেয় বলে ধরে নিয়েছিল। তদুপরি বিদেশিদের আগমন নিষিদ্ধ করে প্রায় সাতশত বৎসর ধরে শোগুন নামে সামুরাই যোদ্ধাদের শাসনামলে জাপানিদের একটি স্বতন্ত্র জীবনপ্রণালী ও সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এর মূলে ছিল প্রচলিত নিয়মকানুন ও গুরুজনদের প্রতি প্রশ্নাতীতভাবে সম্মান প্রদর্শন এবং পরিচ্ছন্নতা। এই সভ্যতা ও ঐতিহ্য নিয়ে তাঁরা বেশ গর্ববোধও করতো।
কিন্তু পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দি থেকে শুরু করে স্পেন, পর্তুগাল, ওলন্দাজ ও বিলাতের নৌপরিব্রাজকদের কেউ কেউ জাপানে পৌঁছে যেতে শুরু করে। অন্যদিকে, ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে দুটি আফিম-যুদ্ধে বৃটেনের কাছে চীনের পরাজয় থেকে জাপানীরা এই শিক্ষালাভ করেছিল যে পাশ্চাত্যের শিক্ষা, শিল্প ও সামরিক কৌশল অবলম্বন ছাড়া বিদেশীদের সামনে টিকে থাকা সহজ হবে না। ফলে একশ্রেণির লোক পশ্চিমা শিক্ষার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে, এবং তা দ্রুত জনপ্রিয়তাও পেয়ে যায়। পরবর্তীকালে আমেরিকার কাছে নতি শিকার করে জাপান ১৮৫৪ সালে বিদেশিদের জন্য দুয়ার খুলে দিতে বাধ্য হলেও পরাজয়ের ক্ষোভটি মনে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছিল। তার ওপর জাপানিদের মূলতঃ সাদা চামড়ার যে বিদেশিদের দেখার সুযোগ হলো, তাদের আকৃতি শুধু দীর্ঘই ছিল না, তাঁদের আচরণ ছিল বর্বর ও অসভ্য, এবং গায়ে ছিল দুর্গন্ধ! সাধারণ জনগণের কাছে গাইজিন মানেই ছিল অপরিচ্ছন্ন! (বিদেশিদের সম্পর্কে এই মনোভাব প্রাচীন রোমবাসীরা পোষণ করতো।) তাঁদের কাছে গাইজিনের পরিচয় এরচেয়ে বেশি কিছু ছিল না। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৫ সালে সাদা-কালোর মিশ্রণে গঠিত আমেরিকার সৈন্যদের কাছে পরাজয়ের ফলে মুখে প্রকাশ না করলেও বিদেশিদের প্রতি ঘৃণা-ভীতি-শ্রদ্ধার প্রকাশ দেখেছি সেদেশে আমার পুরো বসবাসের সময়। অনেকের কাছে বিদেশি মানেই আমেরিকান, এই ধারণা পোষণ করতেও দেখেছি।
এইসব ইতিহাস ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি বা গাইজিনদের সম্পর্কে জাপানিদের যে ধারণা ও আচরণ দেখেছি তা ছিল মিশ্র। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সাথে জড়িত এবং তৎসংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানার ছাত্র-অধ্যাপক-গবেষকরা ছিলেন অতি বিনয়ী, দয়ালু, বন্ধুভাবাপন্ন,এবং আমার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকারী। আচরণে সরাসরি প্রকাশ না ঘটালেও শিক্ষা, জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে একই সাথে তাঁদের কারো কারো মনোভাবে যে অহংবোধ ছিল, তাও বুঝতে পারতাম খুব সহজেই। আবার গ্রামাঞ্চলে এবং খেটে খাওয়া ও স্বল্প শিক্ষিতদের চোখে ভীতি ও ঘৃণার দৃষ্টিও লক্ষণীয় ছিল। জাপানে সর্বমোট চার বছর বাস করার শেষের দিকে মৌখিক ও দৈহিক ভাষাটি যখন অনেকটাই বুঝতে পারতাম, তখন সর্বস্তরের জাপানিদের মাঝে ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিই চোখে পড়তো বেশি। শেষের পর্যবেক্ষণটি অবশ্য সব গাইজিনদের প্রতি ছিল কিনা তা বলা মুশকিল। কারণ পাশ্চাত্যে এবং জাপানের সংবাদপত্রে ততোদিনে, অর্থাৎ ১৯৮৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশ নামটির সাথে দুর্যোগ, বন্যা, খরা, কলহ, খুনোখুনি, জোচ্চুরি, দারিদ্র্য,বুভুক্ষু, পুকুরচুরি ও নারী কেলেংকারীর মতো বিশেষণগুলো সম্পূরক হিসেবে লেখা হচ্ছিল।
আমি বা আমরা বিদেশি বলে জাপানি অধ্যাপকগণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্র কর্মচারী থেকে যে কী ধরনের সম্মান ও সহযোগিতা পেয়েছি ও মুগ্ধ হয়েছি তা এই ধারাবাহিক লেখাটির বিভিন্ন বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাবে। তাঁরা ছিলেন খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। কিন্তু গাইজিন সম্পর্কে জাপানিদের মনোভাবটি ভালো বোঝা যাবে নিচের কয়েকটি উদাহরণে।
কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুকুই ল্যাবে ইউনেস্কোর কাজ শুরু করার পরপরই আমার গবেষণার পরিচর্যাকারী মিস্টার ওমাতা খুব বিনয়ের সাথে একটি অনুরোধ করতে চাইলেন। অনুমতি দিলে বললেন, তাঁর বাবার খুব ইচ্ছা একজন গাইজিন তাঁদের বাসায় অন্ততঃ একটি রাত কাটাক। অনুরোধটি রাখলে মিস্টার ওমাতা খুবই বাধিত হবেন। প্রায় এক বছর পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সোদা ল্যাবে কাজ শুরুর প্রথমদিকে ল্যাবের অন্যতম জোশু (সহকারী অধ্যাপক সমপর্যায়ের) ডক্টর তানিযাওয়া ঠিক একই অনুরোধ করেছিলেন। দুইবারই তা রক্ষা করলে তাঁরা অতি ভদ্রতার সাথে যথেষ্ট আদর-আপ্যায়ন করেছিলেন। পরবর্তী তিন বছরে বিভিন্ন সময়, এমন কি আমার জাপান-বাসের প্রায় শেষ পর্যায়ে ল্যাবের অন্ততঃ তিন গবেষক-ছাত্রবন্ধু তাঁদের বোনদের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর অনুরোধ করেছিল, কারণ ওরা কখনো গাইজিনের সাথে কথা বলেনি! বলা বাহুল্য, সবার অনুরোধই আমি রক্ষা করেছিলাম।
একবার ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে বাসায় ফিরছি। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে দশ বারো বছরের একটি বালক ভয়ার্ত স্বরে ‘গাইজিন’ বলে চিৎকার করে বাবাকে ডাকতে ডাকতে উলটোপথে ভোদৌড় দিয়েছিল। শুনেছি কোনো কোনো মা গাইজিনের ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়াতো। আবার এক আমেরিকান বন্ধুর সাথে একটি জাপানি পানশালায় দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় কাছে ও দূরে বসা খদ্দেররা বড়বড় চোখ করে তাকাচ্ছিল। ব্যাপারটি এতোটাই অস্বস্থিকর ছিল যে বন্ধুটি ভদ্রতার মাথা খেয়ে চেহারায় প্রচণ্ড রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, দেখ্, দেখ্, ভালো করে গাইজিন দেখ! অন্য আরেকবার ল্যাবের জাপানি বন্ধুদের সাথে স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে অপরিচিত ও বেশভূষায় স্বল্প-সভ্য মনে হওয়া এক ব্যক্তি আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলছিল দেখে আমার বন্ধুরা অস্বস্থিবোধ করছিল। তখনো জাপানি ভাষার কিছুই বুঝি না, কিন্তু লোকটির চেহারা ও অঙ্গভঙ্গি থেকে বুঝতে পারছিলাম সে আমাকে গালি দিচ্ছে। তবুও লোকটি কি বলছে জানতে চেয়ে এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে আমতা আমতা করে সে বানিয়ে বললো, ‘লোকটি বলছে তুমি খুব ভালো লোক’!
গাইজিনদের সম্পর্কে এতো সবের পরেও আমার সার্বিক অভিজ্ঞতাটি হচ্ছে জাপানিরা অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, শ্রদ্ধাশীল, দয়ালু ও উন্নত সামাজিক নীতিবান একটি জাতি। একক জাতি হিসেবে আমার চোখে এখনও ওরা শেষ্ঠতম।
চলবে