Published : 05 May 2025, 08:42 PM
উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশের সবচেয়ে বড়ো শহর হল সিমলা। সেখানকারই পাহাড়ি অঞ্চলের লোককথার তর্জমা এগুলো। Alice Elizabeth Dracott পুনঃকথিত ‘Folk Tales from Simla: Stories from the Himalayas’ বই থেকে পাঁচটি লোককথা পুনঃকথিত এবং অনূদিত হল এখানে। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে। মোট ৫৬টি লোককথার সংকলন এই বই। গল্পগুলো মূলত পাহাড়ি মানুষদের মুখে মুখে প্রচলিত।
সমালোচনার প্রত্যুত্তরে বানরের প্রতিবাদ
কোনো এক সময় একটি বানর একটি গাছের ডালে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এসে বসল, যেহেতু বৃষ্টি পড়ছিল, আর একটি ছোটো পাখি বসে ছিল তার বাসায় সেই একই গাছে; আর, কিছুক্ষণ পরই সে বানরটার দিকে তাকিয়ে ভাবল— একটি প্রাণী যার হাত পা মানুষের মতো সে কেন ঠান্ডায় এভাবে কাঁপবে, অন্যদিকে একটি ছোট্ট পাখি নির্বিকার স্বস্তিতে।
শেষপর্যন্ত সে তার মনের কথা বানরটাকে বলে, তার উত্তরে বানরটা বলে: “আমার বাড়ি বানানোর সামর্থ্য নেই, তবে তোমার বাড়ি ভাঙার সামর্থ্য আছে,” আর তখনই সে হাত বাড়িয়ে পাখির বাসাটা টুকরো টুকরো করে দিল, আর পাখির ছানাগুলোকে উলটে ফেলে দিল।
ঈশ্বর যখন প্রথম পৃথিবীর সৃষ্টি করলেন, তিনি দু-মুঠো ছাই নিয়ে একটি কোনায় রেখে দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেললেন। সেসব রূপান্তরিত হল একটি নারী ও পুরুষে। ঈশ্বর তখন মানুষদুটোকে “মানো,” বলে ডাকলেন আর মানুষদুটো “হা জি” (হ্যাঁ জীবন)-এর বদলে “মানো,” বলে উত্তর দিল।
এই কারণেই তাদের অমরত্ব দেওয়া হয়নি, আর যেখানে তারা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে তাদের মৃত্যুর পরের ছাই ছিল। আজকের দিনেও যদি কোনো মানুষ নিজের চামড়ায় আঁচড় কাটে, সে দেখবে ছাইয়ের একটি সাদা দাগ যেটা দিয়ে সে তৈরি, দেখা যাবে। যদি কোনো মানুষ অন্য একজন মানুষকে “জি” বলে উত্তর দেয়, তাতে তার মঙ্গল হয়।
একদিন একটি ছোটো পাখি কাদায় আটকা পড়ে আর বেরোতে না পেরে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন অপরিচিতের কাছে সাহায্য চায়।
“আমাকে উদ্ধার করো, হে অপরিচিত, পুরস্কার হিসেবে তুমি আমাকে ভক্ষণ করতে পারবে যখন আমার পালক শুকনো হবে।”
লোকটি তাকে সাহায্য করল; বেরোনোর পরই কৃতজ্ঞতা না জানিয়েই সে ডানা মেলে উড়ে যায়।
অল্পদূর যেতেই সে একটি কৌড়ি১ খুঁজে পেল, আর আনন্দে বলে উঠল: “আমি একটি কৌড়ি পেয়েছি, আমার টাকা আছে— আমি এখন রাজার থেকে বড়ো।”
এক রাজা সেটা জানতে পেরে সেই কৌড়ি কেড়ে নিতে লোক পাঠায়। “দ্যাখো,” তিনি বললেন, “পাখিটা বলে কিনা সে রাজার থেকে বড়ো।”
লোকটা কৌড়িটা এনে রাজাকে দিল।
অতঃপর পাখিটা বলল: “দ্যাখো, রাজা ক্ষুধার্ত ছিল বলে টাকাটা নিয়ে গেল।”
এটা শুনে রাজা এতটাই বিব্রত হলেন যে, (শুধুমাত্র হতদরিদ্ররাই কৌড়ি নিয়ে কারবার করে) তিনি তৎক্ষণাৎ সেটা ফিরিয়ে দিলেন পাখিটাকে, সেটা দেখে পাখিটা আরও বলে উঠল: “দ্যাখো, রাজা ভয় পেয়ে আমার কৌড়ি ফিরিয়ে দিলেন।”
ব্যাপারটা বেশিদূর গড়াচ্ছে দেখে রাজা রেগে গিয়ে অপমানকারীকে হত্যার নির্দেশ দিলেন।
টীকা
১. কৌড়ি: খুচরো পয়সাকে কৌড়ি বলা হয়।
একসময় কোনো একটি নির্দিষ্ট গ্রামে এক গরিবের বাস ছিল, যে প্রতিদিন ভারতের সাধু ফকিরদের মতো হাতে কমণ্ডলু নিয়ে ভিক্ষায় বেরোত।
সেটাতে করে সে বাড়ি ফেরার সময় নিজের জন্য আন্দাজমতো অল্প আটা নিয়ে ফিরত।
একদিন সে ফাঁকা কমণ্ডলুটা রেখে জল পান করার জন্য একটু দূরে গিয়েছিল।
আসার পর পাত্রভরতি কাঁকড়াবিছা দেখে অবাক হল।
দেখার পর পাত্রটাকে কাত করে একটি পাথরে টোকা দিল আর তার ফলে ভিতরের বিষধর বিছাগুলো বেরিয়ে গেল।
তারপর যা ঘটল সেটা দেখে সে আরও অবাক হল, পাত্রের মধ্যে কিছু বিছা তখনও আটকে, ঈশ্বর তাদেরকে খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত করে দিয়েছেন, সেটা তাদের নিজস্ব অবয়বেই।
সেই ভালো বৃদ্ধ মানুষটা সমৃদ্ধ হল, কিন্তু তার ভীষণ নিরাশাও জন্মাল, এটা ভেবে যে সে অনেক বিছাকেই না জেনে ফেলে দিয়েছে, থাকলে তারাও এখন সোনায় রূপান্তরিত হত।
ভারতে অগর নামে একটি জায়গা আছে, সেখানকার একটি পুকুরের নাম “বনজারা টুল্লাও”, তা সত্ত্বেও কোনো বনজারা১ ওখান থেকে জল পান করবে না।
অনেক বছর আগে এখানে কোনো পুকুর ছিল না, আর দেশজুড়ে তখন খরা শুরু হয়েছে, গরিব মানুষেরা জল না পেয়ে মারা যাচ্ছিল।
তখন এক ফকির ভবিষ্যদ্বাণী করল, যদি কেউ তার একটি ছেলে ও মেয়ের বলি দিয়ে ঈশ্বরকে নিবেদন করে, তার ফলস্বরূপ সবসময় জল পাওয়া যাবে।
সেই রাতে এক বনজারা তার দুই সন্তানের বলি দিয়ে একটি গভীর গর্তে নিক্ষেপ করে।
সকালে সূর্যোদয়ের পর সবাই উঠে দেখে আশ্চর্য! গর্তটার জায়গায় একটি বড়ো পুকুর। সেই অভাগা ছেলেমেয়েদুটোকে আর দেখা গেল না। তারপর গরিবেরা সবাই বুক ভরে আনন্দে মেতে উঠল।
কথিত আছে যে কখনো কখনো ছেলেমেয়েদুটোর মাথা জলে ভেসে উঠতে দেখা যেত, তারা যেন পথচারীদের হাত উঠিয়ে ডাকত; কৃষকেরা মাটি ফেলার পর তাদের আর দেখা যায়নি।
“বনজারা টুল্লাও”-এর মাঝে একটি স্মৃতিশৌধ বানানো হয়েছিল।
সিপড়ি বাজারের কাছে আর-একটা পুকুর ছিল, ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষের স্নান করা কাপড় ধোওয়ার পরও সবসময় স্বচ্ছ আর সুন্দর থাকে।
সেখানে যে-গুরুমশাই থাকে এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানালেন।
“অনেক বছর আগে কোনো একজন দেবতা নিজের স্নানের জন্য সিপড়ি বাজারের পুকুরকে বেছেছিলেন, তারপর থেকে সর্বদা এর জল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ।”
টীকা
১. বনজারা: ভবঘুরে মানুষদের বনজারা বলা হয়।