আমাদের পরিবার কখনোই ধার্মিক ছিল না, একদমই না। হ্যাঁ, এখানে-ওখানে পূজো হতো, তবে এটি কোনো ধার্মিক পরিবার ছিল না।
Published : 19 Mar 2025, 08:48 PM
২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল নারীবাদী, বুদ্ধিজীবী ও অনুবাদক ও গবেষক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের জন্মদিন। এ বছর তিনি ৮০ পেরুলেন। দুদিন আগেই (১৭ মার্চ ২০২৫) তিনি Holberg Prize নামক নোবেলতুল্য সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন জ্ঞানের জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য। তাঁকে জন্মদিনের বিলম্বিত শুভেচ্ছা এবং এই বিরল সম্মানের জন্য তাঁকে জানাই অভিনন্দন। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ৮০ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে সম্প্রতি আনজুম কাটিয়ালের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন হয়। সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল Scroll.in পত্রিকায়। ইংরেজি থেকে বাংলায় তর্জমা করেছেন নীলিমা রশীদ তৌহিদা।
তারিখটা ২৬ জানুয়ারি। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস, যেদিন সবাই ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির ৭৫ বছর উদযাপন করছে। আমি অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের শহর কলকাতায় অবস্থান করছি। মিস স্পিভাক একজন খ্যাতনামা “উত্তর-ঔপনিবেশক” বিদ্বান, যিনি বর্তমানে তাঁর হাঁটুর প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপাচারের জন্য নিউইয়র্ক সিটি হাসপাতালে শয্যাশায়ী এবং অস্ত্রোপাচারের পরে সুস্থ হয়ে উঠছেন।
একটি কম্পিউটার স্ক্রিনের মাধ্যমে আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করি। তাঁর পরনে রয়েছে হাসপাতালের একটি নীল রঙের পোশাক(সার্বজনীন), যার ওপরে হাতে কারুকাজ করা বাদামী রঙের অত্যন্ত স্থানীয় একটি শাল তিনি জড়িয়ে আছেন। ঝাড়খান্ডের সীমানায় অবস্থিত রাজনগর জেলার একজন ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার তাঁকে এই শালটি উপহার দিয়েছেন। এটা ঠিক সেই স্থান যেখানে তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয়ের সাথে কাজ করেন। হাসপাতালের পেছনের দৃশ্যপটের সাদামাটা পরিবেশটাকে মুছে ফেলে মিস স্পিভাকের নিজের অভিপ্রায়ে সেখানে সেই বিদ্যালয়গুলোরই একটি ডিজিটাল ছবি বসানো হয়েছে।
বিভিন্ন সংকেতে পরিপূর্ণ চমকপ্রদ এই পরিবেশে তিনি তাঁর আসন্ন ৮০ তম জন্মদিন উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং তাঁর ভাষ্যমতে, আমার সাথের এই কথোপকথন তাঁর সেই অনেকগুলো উদযাপনের প্রথমটি।
“তুমিই প্রথম ব্যক্তি যার সঙ্গে আমি ৮০ তম জন্মদিন উদযাপন করছি!” তিনি বলেন, ‘’মূলত, যা আমাকেখুব খুব বেশি আনন্দিত করেছে তা হলো আমি এতটা দিন বেঁচে আছি। জানো, সাধারণত আমি জন্মদিনের ভোজসভা পছন্দ করি না। কিন্তু এবছর আমি নিজের জন্য জন্মদিনটি উদযাপন করছি, এবং আমি মনে করি এটি যথার্থ: আমার মনে হয়, ৮০ খুব সুন্দর একটি পরিপূর্ণ সংখ্যা। তো আমি এখানেই আছি।
আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, বেঁচে থাকার এই দীর্ঘ সময়ে, আঁকাবাঁকা পথ ধরে, তার বিভিন্ন বাঁক, মোড় ও অপ্রত্যাশিত সব প্রতিবন্ধকতা অনুসরণ করে আমরা ভার্চুয়ালভাবে পাশাপাশি হাঁটব। এবং অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির চিহ্নে আঁকা স্মরণীয় সব মুহূর্তে আমরা থামব। যেমনটা তিনি বলেন, ‘’জানো, আমি মনে করি, আমরা মুক্তভাবে, ও সহজভাবে চলতে পারি—তুমি আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং আমি তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যাব।” এবং ঠিক এভাবেই এই কথোপকথনটি চলতে থাকে।
আনজুম কাটিয়াল: আমি আসলে ভাবছিলাম, এটা যথেষ্ট আকস্মিক একটা বিষয় যে প্রজাতন্ত্র দিবসে আমাদের এই কথোপকথনটি হচ্ছে, এবং আমাদের স্বাধীন ভারত থেকে আপনি পাঁচ বছরের বড়। এক প্রকার বলা যায় যে, ‘মধ্যরাতের আগে জন্মানো এক শিশু’। আপনার শৈশব—আমরা কি এখান থেকেই শুরু করবো?
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: পিছনে তাকিয়ে দেখলে এখন আমি বুঝতে পারি যে আসলে প্রতিটি দিক থেকেই আমার শৈশবটি খুব সম্পূর্ণ ছিল। খুব ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটি পরিবার। আমার বাবা-মা তাদের সন্তানদের প্রতি খুবই একনিষ্ঠ ছিলেন।‘নৈতিক ভাগ্য’ বলে বার্নার্ড উইলিয়ামসের একটি ধারণা আছে। আমি সত্যিই অনুভব করি যে, এরকম বাবা-মা পাওয়া ছিল আমার নৈতিক ভাগ্য। শৈশবে আমি প্রচন্ড ভালোবাসায় ঘেরা ছিলাম এবং জীবনে আমি যা কিছুই অর্জন করেছি তার কারণ এটাই।
আমার শৈশবটা ছিল সেইসময় যখন বড় পরিবার প্রায় কমে আসছিল, তাই নয় কি? আমার মামা বাড়ি( জ্ঞান মজুমদারের বাড়ি) ছিল আসলে আমাদেরই বাড়ি। ৬ আয়রনসাইড রাস্তায় (যা এখন জ্ঞান মজুমদার সরণী নামে পরিচিত) অবস্থিত আমার বড়ো মামা প্রতুল মজুমদারের বাড়িতেই আমার জন্ম হয়েছিল। আমার দাদী, দুদুন, রসেশ্বরী দেবী পরিবারের প্রধান হিসেবে সেখানেই থাকতেন। এটা আসলেই বেশ অসাধারণ একটা ব্যাপার ছিল।
কিছুদিন আগে, বড়দিনে, আমার বোনকে কল করেছিলাম এবং তাকে– “গড রেস্ট ইউ মেরি জেন্টলমেন”—এই গানটি গেয়ে শুনিয়েছিলাম, কারণ আমাদের দুজনেরই সান্ত্বনা ও আনন্দের দরকার ছিল। এরপর আমরা একটি গান গাইতে শুরু করি যা আমাদের দাদী ক্রাইস্টচার্চ স্কুলে পড়াকালীন সময়ে শিখেছিলেন, এবং যেটি আমরা অনেক গাইতাম। গানটি আমাদেরকে কোনো ভীতিকর ইশ্বরের তত্ত্বাবধানে থাকা শিশুদের মতো করে তুলতো, যা আমাদের পরিবারের চেয়ে খুব ভিন্ন ছিল।
আমাদের পরিবার কখনোই ধার্মিক ছিল না, একদমই না। হ্যাঁ, এখানে-ওখানে পূজো হতো, তবে এটি কোনো ধার্মিকvপরিবার ছিল না। কিন্তু একটা গান ছিল—‘’সাবধান, ছোটো হাত, যা ধরো।‘’ (ছোটো হাতেরা, যা কিছুই ধরো, সাবধানে ধরো।) বড়দিনে আমার বোন এবং আমি, সে দিল্লিতে, আমি নিউ ইয়র্কে, আমরা এই গানটি গাইতে শুরু করি, যা ১০০ বছর পুরনো। এক অর্থে, এর সবকিছুই আমার শৈশব।
এরপর, অবশ্যই, স্বাধীনতা এসেছিল, যা আমাদের জন্য ছিল দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ। আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ শেষ হয়ে গিয়েছিল, তবে দুর্ভিক্ষের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি আসলে দুর্ভিক্ষের শেষ নয়। দুর্ভাগ্যবশত, আমার স্বাধীনতার অভিজ্ঞতা ছিল দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ—যা ছিল খুবই জীবন্ত ও সহিংস...
আনজুম: আমার মনে আছে, আপনি বলেছিলেন যে আপনার বাবা, যিনি একজন চিকিৎসক ছিলেন, দাঙ্গার সময় সাহায্য করেছিলেন – এটা কি আপনার একদম নিখুঁত কোনো স্মৃতি?
গায়ত্রী: হ্যাঁ, এটা একদম ঠিক। আমার বাবা গেটগুলো খুলে দিয়েছিলেন যাতে, এখন যা নিম্ন আয়ের এলাকা নামে পরিচিত, তবে আসলে যা ছিল একটি বস্তি, সেখানকার সমস্ত মুসলিম আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে। এটা ছিল বেশ ছোট একটি বাড়ি।
তাই আমার মনে আছে, আমরা খুব জনাকীর্ণ অবস্থায় ছিলাম—মহিলারা ও শিশুরা ছিল নিচতলায় এবং পুরুষরা ছিল বাড়ির ছাদে।
আমার বাবা ছিলেন একদমই অহিংস একজন মানুষ, যিনি কখনোই কোনো বন্দুক চালাননি। তবে কোনো একটি কারণে হাদু মামার (রাজেন মজুমদার, যিনি পরবর্তীতে কলকাতার মেয়র ছিলেন) একটি ডাবল-বারেল রাইফেল আমাদের বাড়িতে পড়ে ছিল। এবং আমার বাবা ওই রাইফেলটি নিয়ে উপরের তলায় ছিলেন, তিনি জানতেন না এটা কিভাবে চালাতে হয় এবং বলছিলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত পরেশ চক্রবর্তী বেঁচে আছে, কেউ তোমাদের ছুঁতে পারবে না।” এটা ছিল এক ধরণের প্রতীকী পদক্ষেপ –
আনজুম: কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গায়ত্রী: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আনজুম:আমরা বিদ্যালয়ের গঠনমূলক অভিজ্ঞতার কথায় আসি। প্রথমে আসি ডায়োসেসান গার্লস স্কুলে, “একটি দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।” এটা আসলে একদম স্বাভাবিক যে, একজন নিবেদিত শিক্ষক হিসেবে, তিনি নিজের স্মৃতি থেকে, মহিলা শিক্ষকদেরকেই শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতার সাথে স্মরণ করেছেন।
গায়ত্রী: সম্প্রতি আমি একটি লেখা পড়ছিলাম, যেটা আসলে বিনয় মজুমদার সম্পর্কে, তবে এতে আমার ব্যাপারে কিছুটা বলা হয়েছে। যেখানে আমাকে “convent girl” হিসেবে বর্ণনা করছে, যা “Dio girl” হওয়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটা ‘convent’ ছিল না। আমাদের সব শিক্ষিকা বাঙালি ছিলেন; খ্রিস্টান হওয়া সাবঅলটার্ন।
আমার মনে হয়, আমার বাবা-মা খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন, যারা উপলব্ধি করেছেন যে এই মানুষগুলো অত্যন্ত অসাধারণ শিক্ষক হবেন। এবং তারা ছিলেনও। তাদের জন্য, এই উচ্চবর্ণ হিন্দু ও সচ্ছল মুসলিম শিক্ষার্থীদের পড়ানো ছিল একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার, এবং তারা এমনভাবে পড়াতেন যেন আগামীকাল বলতে কিছু নেই।
আমি নিজে বহু দশক ধরে একজন শিক্ষক ছিলাম , তাই যখন আমি পিছনে তাকাই, আমি বুঝতে পারি তারা কতটা অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন, ভালোভাবে পড়ানোর উপর তাদের জীবন ঠিক কতটা নির্ভর করত। এবং আমাদের প্রধান শিক্ষিকা, মিস চারুবালা দাস, প্রতিনিয়ত আমার অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে উঠছেন। তার কোমরে একটা বাঁশি থাকতো যার মাধ্যমে তিনি পুরো বিদ্যালয়কে একত্রিত করতেন। তিনি ছিলেন একদম অসাধারণ। ডায়োসেসান বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে আজকের আমি হয়ে উঠতে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। আমি প্রায়ই বলি, ডিও আমাকে গড়েছে।
আর তারপর, লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ। প্রথম বছরে আমরা প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হতে পারলাম না, সেটা ছিল তৃতীয় বছরে। আমাদের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর এটি প্রথম বছর থেকেই মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। ব্র্যাবোর্নও আমার জন্য একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল কারণ সব শিক্ষকই ছিলেন অনুপ্রাণিত মহিলা শিক্ষিক। তবে আমার জন্য যিনি সত্যিই আলাদা হয়ে উঠেছিলেন, তিনি ছিলেন সুকুমারি ভট্টাচার্য। তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে তিনি সংস্কৃত পড়াতেন।
আপনি জানেন, তাকে সংস্কৃত বিষয়ে ইশান স্কলারশিপ দেওয়া হয়নি, কারণ তিনি খ্রিস্টান ছিলেন, সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট। আর তাই, তিরস্কারের চিহ্ন হিসেবে, তাকে দ্বিতীয় ইশান স্কলারশিপ দেওয়া হয়, তবে এবার ইংরেজিতে! এমন একজন মহিলার কাছ থেকে ইংরেজি শেখার অভিজ্ঞতা আমি কখনোই ভুলবো না যিনি ছিলেন প্রথমত একজন দুর্দান্ত, আত্মবিশ্বাসী ও পুরোপুরি বেপরোয়া ব্যক্তিত্বমধুর এক মানুষ তিনি। তার সৌন্দর্য ছিল একদম আকর্ষনীয়, তবে এর চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় হলো তিনি এসবকে একদম গুরুত্ব দিতেন না। তাকে দেখে এটা বোঝা যেত যে, তিনি বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে একদমই চিন্তিত ছিলেন না। তার সব ভাবনা ছিল অভ্যন্তরীণ জীবন নিয়ে।
এবং ১৯৫৬ সালে সুকুমারি দি-ই আমাকে বিতর্কে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘’আমি জানি না সে বিতর্ক করতে পারবে কি না, তবে সে ইংরেজি খুব ভালো বলতে পারে; ওকে পাঠিয়ে দাও।‘’ পরে আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে গেলাম এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি জিতলাম। তখন আমার বয়স ছিল ১৪। সেই বিশাল কফি টেবিল বইটি জেতার কথা আমার মনে আছে। এবং সেই বইটিকে আলিঙ্গন করার কথাও আমার মনে আছে। এবং আমার মনে আছে যে বালিগঞ্জ ফাড়ি বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে নেমে আমি নিজেই নিজেকে বলছিলাম, ‘’হি!হি! ফার্স্ট হয়েছি। আমি প্রথম হয়েছি।‘’
পরে আমি জেনেছিলাম যে, কেউ একজন আমাকে আমার বইটি আলিঙ্গন করতে দেখে ও আনন্দে বিড়বিড় করতে দেখে আমাকে অনুসরণ করছিল কারণ সে জানতে চাচ্ছিল আমি কোথায় থাকি। সেই দিনগুলো কি সুন্দর দিন ছিল!
আনজুম: তখনকার সময়ের প্রধান একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রেসিডেন্সি কলেজে, কিশোরী বয়সে তার অভিজ্ঞতা ছিল মিশ্র। যেমনটা আমরা দেখি, সৌভাগ্য ও ঘটনাবলি জীবনের গৃহীত পথকে যেমন প্রভাবিত করে,তেমনি জীবনের পথে প্রায়ই ফিরে আসে। প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজি পড়া ছিল এর একটি উদাহরণ।
গায়ত্রী: আমি ছিলাম বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী, আমি পদার্থবিদ্যায় স্নাতক করতে চাইতাম। আমি পদার্থবিদ্যার প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম তবে গণিতে ফেল করেছিলাম। তাই আমি সেখানে ভর্তির সুযোগ পেলাম না। আমি ভাবলাম, উচ্চ মাধ্যমিকে আমি ইংরেজিতে প্রথম হয়েছি। তারা তো আমাকে ইংরেজিতে ভর্তি নিতে অস্বীকার করতে পারবে না। তো ইংরেজি, যা সুকুমারি-দির জন্য ছিল, তা আমার জন্যও ছিল! আমি স্নাতকে ইংরেজিতে ভর্তি হলাম এবং মাত্র দু'সপ্তাহ ক্লাস করার পর বুঝতে পারলাম, আসলে এটাই আমার বিষয়।
আনজুম: তখনকার কোন কোন শিক্ষককে আপনার মনে আছে?
গায়ত্রী: অবশ্যই, তারকনাথ সেন। সম্প্রতি আমি তার সম্পর্কে কিছু লিখেছি। সবাই তাকে পছন্দ করত। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভ্রান্তির এই নিরব যুদ্ধের প্রতি তার বিতৃষ্ণার কারণে কেউ আসলে যা লিখত তার জন্য দাঁড়াত না। আমি মনে করিনা যে আমরা ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম। সম্প্রতি আমি তার কিছু লেখা আবার পড়েছি, এবং আমি বুঝতে পারি যে তিনি ঠিক কতটা বিরল মানুষ ছিলেন। অনেক দিক দিয়েই, তিনি সত্যিই আমাদের পড়তে শেখাতে পেরেছিলেন।
আর তারপর ছিলেন সুবোধ বাবু, সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত, একজন বুদ্ধিজীবী, যিনি সংস্কৃত বিষয়গুলো তার বার্নার্ড শ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়াতেন। আর ছিলেন অমল বাবু – অমল কুমার ভট্টাচার্য – আমরা তখন তাদের দাদা বলতাম না, তারা সবাই ছিলেন বাবু। আর ছিলেন তারাপদ বাবু – তারাপদ মুখোপাধ্যায় – যিনি খুব অসাধারণভাবে শেক্সপিয়ার পড়াতেন।
আনজুম: তবে অন্য একটি কারণে এই অসাধারণ শিক্ষকদের উষ্ণ স্মৃতিগুলি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়, যেটি ছিল অন্য একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত পড়েছিলেন, ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সে। এক ভালোবাসাপূর্ণ পরিবার ও ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসা এক কিশোরী, যাকে মেয়ে হওয়ার কারণে কিছু নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
গায়ত্রী: প্রেসিডেন্সি কলেজ আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটি ছিল সেই জায়গা, যা প্রথমবারের মতো আমার কাছে লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা নিয়ে এসেছিল। বারবার আমাকে এটা মনে করিয়ে দেওয়া হত যে শিক্ষকরা আমাকে পছন্দ করত কারণ আমি সুন্দর ছিলাম, কিন্তু আসলে মেধাবী ছিল এসএস নামের আরেকজন শিক্ষার্থী, যে একজন ছেলে ছিল। বাড়িতে আমি কখনোই এসবের মুখোমুখি হইনি। আমার মা নিজেও ছিলেন এক অনবদ্য বুব্ধিমতী।
কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজ আমাকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অসুরক্ষিত করে তুলেছিল – এবং আজও আমি সেই অসুরক্ষা অনুভব করি। এটা হাস্যকর – আমি ভালো না কি খারাপ সেটা বলতে পারি না, তবে আমার অসুরক্ষিত হওয়ার কোনো কারণ নেই! তবুও আমি অসুরক্ষিত। আমি এখনও সেটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
আনজুম: ১৯৬১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার কলেজ জীবন সম্পর্কে আমি আগ্রহী। কলকাতার এই তরুণীটির জন্য সেখানের ক্যাম্পাসের জীবন কেমন ছিল? এটা ছিল একটা চিত্তাকর্ষক সময়: জন এফ কেনেডি সদ্য প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সিভিল রাইটস আন্দোলন তখন গতি পাচ্ছিল, এবং স্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলি ছিল জাতিগত বিভাজন উচ্ছেদের সংগ্রামের কেন্দ্রে।
আন্তর্জাতিক উত্তেজনা ছিল চরমে: বার্লিন প্রাচীর নির্মাণ হচ্ছিল, সেই বছরই বেই অব পিগস ঘটনাটি ঘটেছিল, এবং ভিয়েতনামে আমেরিকান সামরিক উপস্থিতি বাড়ছিল। সর্বোপরি, কেউ হয়তো ভাবতো,, তাঁর মতো এক উদ্যমী তরুণীর জন্য এটা নিশ্চয়ই একটা রোমাঞ্চকর সময় ছিল।। কিন্তু তিনি বলেন, – "আপনি জানেন, আসলে তেমন ছিল না।"
গায়ত্রী: এটি ছিল লিন্ডন জনসনের অভিবাসী কোটা ও বিদেশী নিবন্ধন ইত্যাদি উন্মুক্ত করার চার বছর আগে। তখন কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ধারণা ছিল না। অভিবাসীদের লেখা এমন কোনো উপন্যাসও ছিল না যা তাদের কষ্টের কথা সুন্দরভাবে বর্ণনা করত। যেমনটা রেমন্ড উইলিয়ামস বলতেন যে পরিশেষে, উপন্যাস, অনুভূতির কাঠামো তৈরি করে।এবং তাই আমি মনে করেছিলাম যে আমি সবকিছু জানি। আমি টাইম ম্যাগাজিন পড়েছি! আমার কোনো সমস্যা ছিল না। আমি তখন মাত্র ১৯ বছর বয়সী ছিলাম।
আনজুম: আরও কিছু ঘটনাবলি অথবা আপনি যদি মনে করেন নৈতিক সৌভাগ্য –তাঁর পথ অনুসরণ করতে তাঁকে নিয়ে যায় একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে, দুর্দান্ত একাডেমিক খ্যাতির দিকে। তিনি তুলনামূলক সাহিত্যের দিকে ঝোঁকেন, সেখান থেকে মূল ফরাসি ভাষা থেকে জ্যাক দেরিদা অনুবাদে।
গায়ত্রী: মাত্র ২০ বছর বয়সে, আমি ছিলাম কর্নেলে, এবং সেখান থেকে আমাকে কোনো আর্থিক সাহায্য বা শিক্ষণ সহকারী পদ দেওয়া হয়নি, কারণ আমি স্থানীয় ইংরেজি ভাষায় কথা বলতাম না। পল দে মান সদ্য কম্প্যারেটিভ লিটারেচার প্রোগ্রামের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তিনি আর্থিক সাহায্যের জন্য যেসব স্লট পেয়েছিলেন, সেগুলি সব পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু একটি স্লট খালি ছিল। তিনি নতুন ছিলেন, এবং যদি তিনি সব আর্থিক সাহায্যের পদ পূর্ণ করতে না পারতেন, তবে এটা তার জন্য ভালো কিছু হত না; এছাড়া, তিনি তহবিলও হারিয়ে ফেলতেন, বুঝতেই পারছেন।
এবং তিনি ভেবেছিলেন আমি একটা ভালো ঝুঁকি হতে পারি। যদি আমি কাজ না করি, তবে সেটা সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে হতে পারে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি এটি নিতে চাই। এবং আমি বললাম, অবশ্যই! আমার কোনো কাজের অনুমতি ছিল না, আমার টাকা ছিল না, এবং আমার নিজ দেশে ফেরত আসার অবস্থা ছিল, তাই আমি হ্যাঁ বললাম। এবং এভাবেই আমি কম্প্যারেটিভ লিটারেচারে চলে গেলাম!
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার বিদেশী ভাষা কোনটি এবং আমি বললাম, ইংরেজি, তিনি বললেন, না, সেটি বিদেশী ভাষা হিসেবে গণ্য হবে না। তারপর আমি বললাম, আমি কলকাতায় আলিয়ঁস ফ্রাঁসেইজে এক সেমিস্টারে ফরাসি পড়েছিলাম, এবং একজন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার জার্মান স্ত্রী মিস ভাদুরির কাছে আমি তিন মাস জার্মানও পড়েছিলাম।
আনজুম: এবং আবারও ঘটনাচক্র আসে, যখন, ফরাসিতে আরও দক্ষ হয়ে, তিনি একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত লেখকের চমকপ্রদ শিরোনামের একটি বইয়ের সন্ধান পান।
গায়ত্রী: ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়াতে যখন আমি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ছিলাম, তখন ভাগ্যবশত "ডে লা গ্রাম্যাটোলজি" নামের একটি বই আমার সন্ধানে আসে, লেখককেও আমার খুব অদ্ভুত মনে হয়েছে এবং মুহূর্তের মধ্যেই কোনো কিছু না ভেবেই আমি বইটি কিনে ফেললাম।
এটি ১৯৬৭ সালের কথা। আমার বয়স ছিল মাত্র ২৫। এটি ছিল খুব কঠিন ফরাসি। আমি জানি না কীভাবে, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম যে এটি খুব ভালো একটি বই এবং এটি নিয়ে আমি কিছু লিখতে চাচ্ছিলাম। তবে আমি জানতাম যে, একজন অচেনা সহকারী অধ্যাপক একজন অচেনা মানুষের বই নিয়ে লিখছে, এটি সফল হবে না। আর আমি দেরিদা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তাই আমি ভাবছিলাম যে কি করা যায়।
তখন আমি শুনলাম যে ইউনিভার্সিটি অফ মাসাচুসেটস প্রেস অনুবাদ প্রকাশ করছে। আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, আমি তাদেরকে এই বইটি অনুবাদ করার প্রস্তাব দেব এবং আমি বলব যে আমি শুধুমাত্র তখনই অনুবাদ করব যদি তারা আমাকে একটি মনোগ্রাফ-ধরণের ভূমিকা লেখার অনুমতি দেয়। আমি তাদেরকে এটা জানালাম এবং তারা এই কথায় খুব বিস্মিত হল এবং আমাকে একটি সুযোগ দিল। শুরুটা এভাবেই হল। আমি জানতাম না তিনি কে, এবং কেউ জানত না আমি তার বইটা অনুবাদ করতে যাচ্ছি।
এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমার ভূমিকাটিকে ক্লাসিক হিসেবে দেখা হয়েছিল। তবে আমি নিজে মনে করি না যে এটি একটি ক্লাসিক। আমার মনে হয় বইটির বেশ কিছু প্রতিরোধ এখানে বাদ পড়ে গেছে। আমি তার ইনফরমেটিকস সম্পর্কিত তর্কের অনেক অংশও মিস করেছি, যা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বেশিরভাগ ইংরেজি পাঠকরা এটি দেখেনি, স্পষ্টতই, কারণ আমি তাকে মাত্র পরিচিত করিয়ে দিচ্ছিলাম। তাই আমি মনে করি যে ভূমিকাটি দুর্ভাগ্যজনক হলেও আইকনিক ছিল। এর নিজস্ব জীবন রয়েছে। আমি নিশ্চিত নই তবে আমি আমি বিশ্বাস করি যে এটি ফরাসিতে অনুবাদ করা হয়েছে।
আনজুম: তার সাথে আপনার প্রথম দেখা কখন হয়? আপনার কি প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে আছে?
গায়ত্রী: হ্যাঁ, তার সাথে আমার দেখা হয় চার বছর পর। ১৯৭১ সালে। তার বয়স ছিল ৪১ এবং আমার বয়স ছিল ২৯। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখা করি। হিলিস মিলার আমাকে একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "গায়ত্রী, এই মানুষটির সাথে আপনার দেখা করা উচিত।" আমি বললাম, "হ্যাঁ, অবশ্যই, আমি খুব পছন্দ করব।" সুতরাং, হিলিস আমাকে একটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন, এবং দেরিদা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে তিনি আমার শ্রোতা ছিলেন। আমি তাকে চিনতে পারিনি, কারণ আমি তাকে কখনো দেখিনি। আমার জন্য আয়োজিত হিলিসের পার্টিতেই আমি জানতে পারলাম যে তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
আনজুম: মুখোমুখি এই সাক্ষাৎ টি কেমন ছিল?
গায়ত্রী: আমার মনে হয়, তিনি আমার প্রতি বেশ আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে তার অনুবাদক এতটা অদ্ভুত হবে। সেই সময়, শাড়ি পরা মহিলারা সার্বজনীন বুদ্ধিজীবী ছিল না। আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি। অপরদিকে, আমাদের দেখা হওয়ার পর, এটা পরিষ্কার হয় যে আমি কোনও অদ্ভুত মানুষ নই। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন, এবং আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠলাম।
আনজুম: তারপর আসে আপনার একাডেমিক সাফল্য। "বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ধৃত বিদ্বানদের মধ্যে একজন..."
গায়ত্রী: ওহ, সেটা আমি ছিলাম না, দেরিদা ছিল। দেরিদার অনুবাদ ও সেই ভূমিকা লেখার কারণেই আমি বিখ্যাত হয়েছিলাম।
আনজুম: আমি মনে করি, এটা এক ধরণের অতিসরলীকরণ। যদি আপনার কাজ ভালো না হতো, তা হলে তা খুব খারাপভাবে ব্যর্থ হত। আমি জানি আপনি কতটা কঠোর একজন গবেষক। আপনার কাজগুলো খুব সততার সাথে করা।
গায়ত্রী: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমি সততার দাবি করতে পারি। আমি খুব বড় গবেষক নই, তবে বৃহত্তর অর্থে, যাকিছুই আমি করি, তাতে ফাঁকি থাকে না। এত গুলো বছর পরে এসে এই বিষয়টি আমি দাবী করতে পারি।
আনজুম: তিনি খুব বড় গবেষক না? এটি কি তাঁর বেখেয়ালি কথা? তিনি মানবিক বিদ্যায় অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত এবং খুব পাকা-পোক্ত কাজের ভিত্তিতেই তার এই খ্যাতি। যদি কিছু থাকে, তবে মানুষ তাকে একটু বেশিই বুদ্ধিজীবী মনে করেন: কঠিন, গভীর, ও দুর্ভেদ্য।
কিন্তু এই অকপট ও সমালোচনামূলক মূল্যায়নই তার বৈশিষ্ট্য; এবং তাঁর গবেষণার যাত্রার পরবর্তী ধাপ নিয়ে কথা বলার সুযোগ নিয়ে আসে। "থ্রি উইমেনস টেক্সটস অ্যান্ড এ ক্রিটিক অফ ইম্পিরিয়ালিজম" ও "ক্যান দ্য সাবঅলটার্ন স্পিক?" – যেগুলো তাকে এমন খ্যাতি এনে দিয়েছে সেই তিনি বলেন "এগুলো শুধুমাত্র আমার দেবিরা বিষয়ক কাজ থেকে উদ্ভূত নয়।"
গায়ত্রী: এগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলো ছিল একজন মেট্রোপলিটন ডায়াসপোরিক সমালোচকের জন্য প্রচলিত সংকট মুহূর্ত, যে এক ধরনের সংকটের মধ্যে ছিল (আমি এখনো ভারতীয় নাগরিক, কিন্তু কাগজপত্রের মাধ্যমে কেউ ডায়াসপোরিক হয় না; যেমন নাগরিকত্ব ও শুধু কাগজপত্র দিয়ে হয় না।) আমার সংকট ছিল যে আমি বিদেশী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছিলাম।
"থ্রি উইমেনস টেক্সটস" ছিল সেইসব পাঠ্যবইগুলোর মধ্যে একটা যা উপনিবেশবাদী চিন্তার সন্ধানে আমি বহুবার পড়েছিলাম। যা আমি মিস করেছিলাম, যা আমি লক্ষ্য করিনি, তা ছিল দাসত্বের চিহ্ন।
মূল পাঠ্য ‘'জেন আয়ার’ এ জ্যামাইকাতে রোচেস্টারের চিনি উৎপাদন ক্ষেত্র রয়েছে, এবং রয়েছে হাজার হাজার দাস, এবং সেসম যদি আমি ব্রিটেনের ইতিহাসে খুঁটিয়ে দেখতাম, তবে শুধু উপনিবেশবাদের চিহ্ন নয়, আমি দাসত্বের চিহ্নও দেখতে পেতাম।
এটা ভেবে আমি খুবই কষ্ট পাই যে উপনিবেশবাদ অধ্যয়ন ও দাসত্ব অধ্যয়ন একে অপর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গিয়েছিল; তবে সেই পাঠ্য বইটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল কারণ এতে দেখানো হয়েছিল যে নিজের জটিলতাকে না দেখে শুধুমাত্র “তারা খারাপ, আমরা ভালো” বলে বেড়ানোও আসলে সম্ভব। এটা এখনও এতটাই উদ্ধৃত হয় যে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, এটা আমাকে সাবঅলটার্ন স্টাডিজ সার্কিটে ঠেলে দিয়েছে এবং একইসাথে আমাকে এমন এক খ্যাতি এনে দিয়েছে যা আমার দেরিদাবিষয়ক কাজের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
"ক্যান দ্য সাবঅলটার্ন স্পিক?" ছিল অনেক বেশি সংকটময় যে কীভাবে আমি ফরাসি তত্ত্ব ও বিনির্মাণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলাম। এর থেকে আমি বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, এবং আমার দিদিমার বোন ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ীকে বেছে নিয়ে আমি এর থেকে বেরোলাম। এই গল্পটি আমি পাঠালাম। আমার সম্পাদককে আমি বহুবার বলেছি যে এটা খুব বড় ও খুব কঠিন। দয়া করে এটা ছোট করতে আমাকে সাহায্য করুন। তারা কিছুই করল না। যেমন ছিল তেমনভাবেই লেখাটা প্রকাশ করলো। এবং মানুষের অভিযোগ ছিল যে এটা খুব বড় ও খুব কঠিন।
সম্পাদনার দায়ভার এখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও এটা প্রচন্ড ভুলভাবে বোঝা হয়েছে – কারণ এটা খুব বড় ও খুব কঠিন এবং মানুষ বুঝতে পারে না যে আমি এখানে কী বলার চেষ্টা করছি। অন্য পাঠ্যটির সাথে সাথে এটাও আমাকে এমন একটি খ্যাতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল যা আবশ্যিকভাবে দেরিদা-সম্পর্কিত ছিল না। এবং একই সময়ে, অবশ্যই, দেরিদাপন্থীরা ও বিশেষভাবে “বিনির্মাণপন্থী লোকজন” এটা পছন্দ করত না যে আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, কারণ আমি ফরাসি পিএইচডিপ্রাপ্ত ছিলাম না, আমি ছিলাম একজন আগন্তুক। সুতরাং তারা আমাকে যতটা সম্ভব “তৃতীয় বিশ্ব” বানানোর চেষ্টা করেছিল।
আনজুম: সুতরাং, তিনি ছিলেন, একজন "আগন্তুক" বিনির্মাণবাদী, একজন বিকাশমান উপনিবেশ পরবর্তী সমালোচক, এবং একই সাথে – মহাশ্বেতা দেবীর বাংলা কথাসাহিত্যের অনুবাদক। অনুবাদ সম্পর্কে তিনি কী ভাবেন? তিনি কি আরও বেশি অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন?
গায়ত্রী: অনুবাদ এক বিশাল পরিশ্রমের কাজ। আমার ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে, তারা আমার অনুবাদের একটি বই ও কিছু প্রবন্ধ একত্রিত করেছে, এবং আমি বারবার বলি: এটা পড়ার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ কাজ। এটা এমন কিছু নয় যা আপনি সহজেই করতে পারেন। দেরিদার পরে, আমি মহাশ্বেতা দেবীর কিছু কাজ অনুবাদ করি কারণ রণজিৎ গুহ আমাকে দ্রৌপদী অনুবাদ করতে বলেছিলেন।
আনজুম: তাহলে আপনি কি মনে করেন যে মহাশ্বেতা দেবীকে অনুবাদ করা ছিল আপনার ক্যারিয়ারের পরবর্তী মাইলফলক?
গায়ত্রী: আসলে না। অন্তত আমার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের দিক থেকে তো নয় ই। নিশ্চয়ই আমি মহাশ্বেতার কাজ অনুবাদ করা উপভোগ করেছি, কিন্তু এটা আমার কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল না। দেরিদার কাজ নিয়ে আমি আরও এগিয়ে গিয়েছি; আমি তার দর্শন, সাহিত্য, ও পৃথিবী সম্পর্কিত চিন্তা থেকে আমি একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
আনজুম: এই দুই আশ্চর্য মহিলার মধ্যে এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা, সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখেছিলাম, যা অনেক দিক থেকে এত আলাদা এবং তবুও অনেক গুণে একে অপরের সাথে তুলনীয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল পুরুষতন্ত্রের অস্বীকৃতির বিরুদ্ধে কঠিনভাবে অর্জিত এক শক্তিশালী রক্ষাকবজ। তাদের দুজনের মধ্যে এক ধরণের দূরত্ব তৈরি হতেও আমি দেখেছিলাম। আমি ভাবলাম, তিনি কি এটি নিয়ে কথা বলবেন? তিনি বলেছিলেন।
আমার মনে আছে, সীগাল অফিসে আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল, যেখানে আসাটা মহাশ্বেতা দিদির সাথে আপনার কাজ ও অবশ্যই আপনার বিদ্যালয়গুলোর সাথে সম্পর্কিত ছিল...
গায়ত্রী: মহাশ্বেতা দি’র সাথে আমার সম্পর্ক ছিল দুঃখজনক। আর এটা এমন একটা বিষয় যা আমি এখনো মেনে নিতে পারিনি। তার সাথে পরিচিত হওয়ায় আমি খুব আনন্দিত, কিন্তু এটা একটা অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল। অনেক দিক থেকে, মহাশ্বেতাদি’ও ছিল একটি খুব ভালোবাসায় ভরপুর শৈশবের নিদর্শন, যার বাবা-মা ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান।
কিন্তু একই সময়ে আমাদের বেড়া ওঠা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ শেষ পর্যন্ত মহাশ্বেতাদি ছিলেন মনীষ ঘটকের আদরের মেয়ে আর আমি সম্পূর্ণভাবে আমার পরিবারের সীমানা অতিক্রম করেছিলাম। আর আমি আসলে এমন কেউ ছিলাম না যে মানুষের পূজা করত। তার চারপাশে অনেক মানুষ ছিল যারা তাকে পূজা করত, এবং আমি কখনোই সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। তাই এটি একটি অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল। এবং আমি বুঝতে পারি যে শেষ পর্যন্ত তিনি কেন আমার বিদ্যালয়গুলোকে সমর্থন করতে পারেন নি।
আনজুম: প্রকৃত শিক্ষা, একটি স্বাধীন সত্তা, ও একটি মানুষের বিকাশের গভীর বিশ্বাস থেকে এই বিদ্যালয়গুলোর জন্ম হয়েছিল—যার সাথে নম্বর, র্যাঙ্ক, ও পরীক্ষায় পাশ করার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তার অন্তরের অন্তস্থল থেকে এটা উঠে এসেছিল এবং তিনি এরকম একজন শিক্ষক না হয়ে পারলেন না।
গায়ত্রী: প্রশান্ত রক্ষিত নামে সেই অঞ্চলের একজন তরুণ আন্দোলনকারীর কারণে এই বিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমি যে সেখানে একা একা যেতাম, মানুষদের পড়াতাম, এটা সে লক্ষ্য করেছিল। আমার পদ্ধতিটা এরকমই ছিল। আমি তাদের বলতাম, ‘’এই শারথী, তুমি তোমার নামের বানান এভাবে লিখছো কেন? তোমাকে অবশ্যই ‘I’ ব্যবহার করতে হবে। অথবা একটি ডাল নিয়ে মাটিতে সহজ কোনো গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতাম।
একদিন তিনি আমাকে লিখলেন, ‘’দিদি, শুধুমাত্র টাকা দেওয়ার বদলে তুমি কেন এখানে কিছু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছো না?’’ যখন আমি সেখানে কাজ করছিলাম, তখন এভাবেই বিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হলো। তবে রাজনৈতিক কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেল, এবং ২০ বছরের কাজের ক্ষতি মেনে নিয়ে পুরুলিয়া ছাড়তে আমি বাধ্য হলাম।
তাদের সাথে আমাকে পরিচিত করানোর জন্য আমি মহাশ্বেতা দি’র কাছে কৃতঙ্গ কারণ তিনি না থাকলে আমি কখনোই ওই এলাকায় প্রবেশ করতে পারতাম না। কিন্তু তিনি আসলে বিদ্যালয়গুলো নিয়ে সেভাবে কিছু ভাবেন নি বা সত্যি বলতে তেমন একটা সমর্থনও করেন নি। তহবিলের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি অবশ্যই বিদ্যালয়ের জন্য ছোট ছোট কিছু ভবন তৈরি করেছিলেন। তবে আমার যতদূর মনে পড়ে, তিনি কখনোই কোনো বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন নি। তাছাড়া তিনি আমার পক্ষে এগিয়েও আসেন নি।
তবে আমি এটা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারছিলাম যে আমাকে সাহায্য করার জন্য গ্রামীণ এলাকার একজন সহযোগীকে ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যার জন্য তিনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন নি। আর তাই আমাদের মধ্যে একটি অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল।
‘Pterodactyl’ নামক তার একটি রচনা নিয়ে আমি লিখেছিলাম। আমি নিশ্চিতভাবে মনে করি এটা চমৎকার একটা কাজ। রাধা চক্রবর্তী সম্পাদিত রাউটলেজ সংগ্রহে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হচ্ছে। তোমার এটা পড়া উচিত যে এই রচনাটি পড়ার মাধ্যমে আমি কতটা বেড়ে উঠেছি এবং আমার ওপর এর প্রভাব ঠিক কতটা! একটি হাতিকে নিয়ে ‘জগমোহনের মৃত্যু’ নামে তার আরেকটি রচনা আছে। আমি এরকম একটা রচনা কল্পনাও করতে পারি না।
অনেক দিক থেকেই, তিনি ছিলেন বিষন্ন এক চরিত্র—একজন দুর্বল মানুষ। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এটা জানতো না। তারা তাকে অন্যরকমের এক নায়িকা মনে করত। আমি মনে করি, কোনো একদিন মানুষ মহাশ্বেতার বাস্তবতাকে কিছুটা আলাদা ভাবে ভাবতে শুরু করবে। তবে যেমনটা আমি বলছিলাম আমার সাথে তার সম্পর্কটা ছিল বেদনাদায়ক।
আনজুম: এখন স্বাভাবিকভাবেই, তার একজন নারীবাদী, একজন সক্রিয় কর্মী হওয়া নিয়ে কথা বলা যায়। এবং যেহেতু আমরা গায়ত্রী দি’র সাথে আড্ডা দিচ্ছি, তাই আচমকাই আমরা হংকয়ে তার ক্যানটোনিজ শেখা দিয়ে শুরু করি। অবশ্যই, কেন নয়?
গায়ত্রী: সেসময়ে, ১৯৮৪ সাল থেকে, আমি হংকংয়ে অনেক বেশি যেতাম। এক সময়ে আমি হংকং ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াতাম এবং অনিবার্যভাবেই আমি ক্যানটোনিজ শিখেছিলাম। তবে এর আরেকটি কারণ ছিল। আমি সবসময়ই একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম তবে এটাকে কখনোই নিজের ইমেজ হিসেবে বিক্রি করতে চাইতাম না। তাই আমি সবসময় এই দিকটাতেই মনোযোগী ছিলাম, যেটাকে পরবর্তীতে আমি বলতাম ‘কল্পনামূলক সক্রিয়তা’।
হংকংয়ে “সাময়িকভাবে স্থায়ী”, অনেক কোরিয়ান নারী কর্মী ছিল যারা কখনো ইউনিয়নের সদস্য হয়নি, এবং তারা একটি কোম্পানির কাছ থেকে কিছু সুবিধা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, যেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ধরণের স্কলারশিপ দিয়ে থাকত। সুতরাং, কোরিয়ান নারীদের ওপর এই অবর্ণনীয় নিপীড়নই ছিল সবচেয়ে আঘাতপ্রবণ বিষয়। “তরুণ মানুষদের সাহায্য করাই” ছিল মূল লক্ষ্য। এটা মোটামুটি সাধারণ একটা বিষয় ছিল।
ওই সময়টায়, আমি হংকংয়ে পড়াতাম এবং এশিয়া লেবার মনিটর নামক চমৎকার একটা জার্নালের অফিস ছিল কোওলুনে। আমি তাদের অফিসে গেলাম এবং তাদের কাছে জানতে চাইলাম যে যেসব নারীরা দুই দিক থেকেই চাপের মধ্যে থাকে, নারী হিসেবে কীভাবে তাদের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব?
এবং সেই অফিসের এক কর্মী আমাকে বলল, “প্রফেসর স্পিভাক, এই প্রশ্নটা কেউ করে না। কেউ জানতে চায় না যে এই নারীদের মধ্যে এমন কী রয়েছে যা তাদেরকে এইভাবে কাজ করতে বাধ্য করে। আপনি যদি সত্যিই তাদের বুঝতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে ক্যানটোনিজ শিখতে হবে। কারণ, আপনি তখন তাদের আপন ভাষায় কথা বলবেন, এবং দ্বিতীয়ত, তারা একটা কিছু আপনার থেকে বেশি ভালো জানবে কারণ আপনি কখনোই তাদের মত অত ভালো করে ক্যানটোনিজ জানবেন না। আর এটাই আপনাদের সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটাবে।
ভাবুন তো, ওই এশিয়া লেবার মনিটর অফিসের নারীরা আমার জন্য কি করল! মানুষ কোথা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে শেখে? আমি সত্যিই খুব, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় শিখেছিলাম যা নিয়ে আমি এখনও আমার বিদ্যালয়গুলোতে কাজ করি। এটা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাবঅলর্টানদের হাতে কর্তৃত্ব ফিরিয়ে দেওয়া। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।
আনজুম: আমাদের সময়ের অসাধারণ কিছু নারীবাদী ও কর্মীরা আপনার বন্ধু ছিলেন। আপনি এলিস ওয়াকার কে জানতেন, আপনি জুডিথ বাটলারকে জানতেন। এবং আরোও অনেককে…
গায়ত্রী:‘ফেমিনিজম' শব্দটি ছোট এবং মানুষ কোনো বাস্তব প্রসঙ্গ ছাড়াই এটি ব্যবহার করে। কারণ ফেমিনিজমের কোনো নেতা নেই। এই যে মার্কসিজমের জন্য আছে মার্ক্স, কিন্তু ফেমিনিজমের জন্য কেউ নেই।
ফেমিনিজমের একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে যা শুরু থেকেই আমার মধ্যে ছিল। কারণ আমার মা সবসময় নিজের ওপর নির্ভর করেছেন। যখন আমার বয়স ১৫ এবং আমি সবেমাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছি তখন মা আমাকে বলতেন, ‘’আমি ভালো একটা পরিবারের বড় মেয়ে, দেখতে সুন্দর, এবং দুই বছর আগে আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন, আমার মা ছিলেন ৪৩ বছর বয়সী একজন বাঙালি বিধবা, ঠিক না? তার বয়স যখন ২৮ তখন আমার জন্ম হয়।‘’
তিনি আমাকে বলেছিলেন, " জানো গায়ত্রী, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ সবসময় খারাপ নয়।" আমার মা বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছিলেন এবং যখন তিনি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেন তখন তিনি খুব উচ্চস্তরের বাংলা বলতে পারতেন। তাই "লিবিডিনাল চয়েস" হিসেবে তার ব্যবহৃত শব্দগুলো যখন আমি অনুবাদ করি, তা তার বাংলা বলার যে উচ্চ ধরন ছিল তার জন্য উপযুক্ত হয়। তিনি বলেছিলেন: "একজনের যৌন তাড়না, যেটাকে বলা হয় প্রেমে পড়া, সেটা আসলে কোনো সিদ্ধান্ত নয়। ভাল অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে, ভবিষ্যতে সন্তানদের জন্য কি ভালো হবে তা নিয়ে বাবা-মায়েরা খুব সচেতন হয়। এত তদন্ত করা হয় যা আসলে এক ধরণের সামাজিক চুক্তি। কিন্তু অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ সফল হবে কি না তা নির্ভর করে সন্তানের কিসে ভালো হবে তা বাবা-মা কতটা ভালো জানে।
তবে, পরিবারের বাইরেও তোমার একটি জীবন আছে আর আমি জানিনা তুমি কিসে সুখী হবে। তাই আমি তোমার জন্য বিয়ে ঠিক করতে পারছি না। ভাবুন তো। আমার মা আমাকে আরোও বলতেন যে আমাকে নিজের শরীরের যত্ন নিতে হবে—সাঁতার কাটা, ব্যায়াম ইত্যাদি। আর তখনকার দিনে এটা বেশ অস্বাভাবিক ছিল। যখন লোকেরা আমার বিষয়ে তার কাছে সমালোচনা করত যে আমি তাকে অসুখী করেছি, আমার কোনো স্বামী-সন্তান নেই, তখন আমার মা বলতেন ,'প্রথমে গায়ত্রী সম্পর্কে কথা বলার অধিকার অর্জন কর, তারপর আমার সাথে কথা বল’—ঠিক যেমনটা তিনি আমাকে বলতেন। এটাই নারীবাদের স্পর্শ।
এছাড়াও, আমাকে বলতেই হবে যে আমার বাবা স্বীকার করতে পেরেছিলেন যে আমার মা একজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন। অবশ্য যদিও এরকম তুলনা করা যাবেনা, তাও মা সম্ভবত বাবার চেয়ে বেশি করিতকর্মা ছিলেন, যেটা তিনি কোনো দ্বিধা ছাড়াই স্বীকার করতেন। এটাই ছিল আদি-নারীবাদী অবস্থা যা আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম। আর প্রেসিডেন্সিতে কি ঘটেছিল তা তো আপনাকে বলেছি।
তারপর আমি প্রথম প্রজন্মের একাডেমিক নারীবাদীদের একজন হয়ে উঠলাম। জুডিথ বাটলার, বেটি ফ্রিডান, জেন মার্কাস, গ্লোরিয়া স্টেইনেম এর মতো মহৎ ব্যক্তি ও সাধারণভাবে বলতে গেলে, উদার নারীবাদীদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হল।
আমি যখন তাদের সাথে ছিলাম, আমরা সবাই সমান ছিলাম। আমি বলতে চাচ্ছি যে, বেটি ফ্রিডান, গ্লোরিয়া স্টেইনেম, যথার্থ কারণেই তারা অনেক বেশি বিখ্যাত ছিল তবুও আমি যখন তাদের সাথে ছিলাম, আমি তাদের সমান ছিলাম। সেই অনুভূতিটিই আমার নারীবাদকে চিহ্নিত করল।
আরেক ধরনের নারীবাদ ছিল বাংলাদেশে। ফরিদা আখতার – আমার মনে আছে একজন এনজিও প্রবর্তনার সদস্য হিসেবে ফরিদার সাথেই ১৯৯৪ সালে আমি কায়রোতে জাতিসংঘের প্রথম এনজিও ফোরামে গিয়েছিলাম। এটা ছিল একদম আলাদা এক অভিজ্ঞতা। ফরিদার সাথে একটি নির্দিষ্ট ধরনের বাংলা নারীবাদে আমি খুব সক্রিয় হয়ে উঠলাম। তারপর আমি বুঝতে পারলাম যে পশ্চিমবঙ্গের নারীবাদ সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। তাই একজন সাংবাদিকের খালা যার নাম—সোমিনি সেনগুপ্ত, এবং যিনি নিউইয়র্ক টাইমসে কাজ করতেন, তার সাথে আমি দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে মধ্যমগ্রাম ইত্যাদি পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম। এবং এটা ছিল একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
ভারতীয় নারীবাদে আমার খুব বেশি কৃতিত্ব নেই। ভারতে একটি শক্তিশালী নারীবাদী, মহিলাদের আন্দোলন রয়েছে, কিন্তু সেই বিশেষ ঘটনাটির সাথে আমি তেমন জড়িত নই। আমি এটাকে প্রশংসা করি, যখন পারি তখন এতে যোগ দিই। তবে আমার দুটি দিক রয়েছে, প্রথমত, বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বা প্রথম প্রজন্মের একাডেমিক নারীবাদ। এটি একটি অদ্ভুত সংমিশ্রণ।
আনজুম: তিনি এখন ক্লান্ত। বিশ্রাম নেওয়ার সময় এসেছে, যদিও এমন আরও অনেক কিছু আছে যা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি এবং হাসতে পারি। তাই আমি প্রশ্ন করি, "এখন যেহেতু আপনি ৮০ বছরে পা দিয়েছেন, আপনি কোন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী?"
গায়ত্রী: আমি এখন ডু বোইসের ওপরে লেখা আমার বইটি শেষ করার চেষ্টা করছি। অনেকটা সময় ধরে আমি কাজটা থামিয়ে রেখেছি, যা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু এটা আমাকে শেষ করতেই হবে। আমি তাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি, জানিনা বুঝতে পেরেছি কিনা। তবে এর শিরোনামটি খুবই অদ্ভুত— ‘মাই ব্রাদার বারগার্ট’। ডব্লিউ ই বি ডু বোইস, তাই তো? উইলিয়াম এডওয়ার্ড বারগার্ট ডু বোইস। এবং যেভাবে তিনি ‘বারগার্ট’ নামটি গ্রহণ করেছিলেন তা খুবই আকর্ষণীয়। তাই বইয়ের শিরোনামটি এমন।
আমরা এখনও মরিয়াভাবে বাংলার দ্বিভাষিক সংস্করণগুলির সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি, এটাকে অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষিত করার জন্য কাজ করছি। এটা খুবই রোমাঞ্চকর একটি প্রকল্প। আমি এটা নিয়ে আগ্রহী।
আর 'রেডিয়েটিং গ্লোবালিটি' নামক একটি প্রকল্পে লক্ষ্মী সুব্রামণিয়ান, আমি, ও আরও কয়েকজন একসাথে যুক্ত আছি, যেমন ছিলেন প্রয়াত হরি ভাসুদেবন।
আর আমার বিদ্যালয়গুলো আছে। সেগুলো উঠে আসছে। আমি শিখেছি কিভাবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বুদ্ধিমত্তাকে সাধারণ করা যেতে পারে, এবং কিভাবে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত একটি বিশাল দলকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে সচেতন করা যেতে পারে; কিভাবে আমরা তাদের বুঝাতে পারি যে জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপর্যয়ের সময়ে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যদিও তারাই এর সবচেয়ে কম প্রাপ্য ছিল। এবংপরিবর্তন ঘটছে। সত্যিই ঘটছে।
আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে এতটা পরিবর্তন হবে। যেমন আমি তাদের বলি, যেভাবে তোমাদের অবহেলা করেছি তাতে আমি জানিনা যে এখন কীভাবে তোমাদের স্পর্শ করব। অন্যদিকে, আমি তোমাদের রোমান্টিসাইজ করছি না, কারণ, যেমনটা ফ্রেইর বলেছেন–এবং আমি তাদের সব কিছু বলি–অত্যাচারিতরা উপ-অত্যাচারী হতে চায়; তাই তোমরা আমাদের মতোই লোভে পরিপূর্ণ, কিন্তু আমরা নৈতিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত কারণ আমাদের টাকা আছে। আর এখন যেহেতু তোমরা টাকা উপার্জন করছ, লোভ ও অন্যান্য সব থেকে তোমরা নিজেদের দূরে রাখতে পারছ না। আসলে, আমরা এসব বিষয়ে কথা বলি।
এই ধরনের প্রকল্পগুলো আমার জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আমি এখনও যতটা সম্ভব সেখানে যাই। এখনো আমি একটি মোটরবাইকের পেছনে বসতে পারি, এবং এখন আমি এতটা প্রবীণ হয়ে গেছি যে আমি অনলাইন থেকে স্থূল মানুষের জন্য পাওয়া যায় এমন একটি বেল্ট কিনেছি, যার মাপ ৭৩ ইঞ্চি। যাতে করে যখন আমি মোটরবাইকের পেছনে উঠি তখন বেলটি দিয়ে চালকের সাথে নিজেকে আটকে রাখতে পারি এবংপড়ে না যাই।
কারণ অবশ্যই আমি অবিশ্বাস্যভাবে জেটল্যাগে ভুগি। কলকাতায় আমার লাগেজটা ফেলে দিয়েই আমি চলে যাই, এবং আমি গলা ছেড়ে গান গাই যাতে ঘুমিয়ে না পড়ি। কিন্তু এতেও তেমন কোনো কাজ হয় না। যাহোক, এই বেলটি নিয়ে মোটরবাইক চালক সুনীল লোহর (যার বিষয়ে, সেখানকার লোকেরা বলে, হেভি মোটরসাইকেল চালায়) বলেন, ‘’এটা ভালো। আমি খুব চিন্তিত থাকি যে দিদি পড়ে যায় কিনা, কিন্তু এখন যেহেতু আমি এই বেল্টের সাথে আটকে আছি, আর কোনো সমস্যা নেই।
এখন আমি ৮০ বছরে পা দিচ্ছি এবং তাই মৃত্যুর কথা ভাবছি। আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমি পৃথিবীটাকে ভালোবাসি, কিন্তু অন্যদিকে, একজনকে বাস্তববাদী হতে হবে। এই যে অনুভূতি যে তেমন একটা সময় নেই, এটা এই প্রকল্পগুলোকে এক ধরনের গুরুত্ব দেয়, এবং আমার জীবনকে পূর্ণ করে। আমি একজন সুখী প্রবীণ মেয়ে। আমি চেষ্টা করছি উপকারী হতে যা আমাকে সুখী করেছে।
আনজুম: এবং এভাবেই, আমরা আমাদের শেষ কথাটি পেলাম। আমি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে মোটরবাইকের পেছনে, ড্রাইভারের সাথে খুব শক্ত করে বাঁধা অবস্থায়, গলা উঁচু করে গান গাইতে গাইতে অজানা এক পথে চলে যেতে দেখি। অশীতিপর রকস্টার, তোমাকে জানাই, শুভ জন্মদিন। দীর্ঘদিন ধরে ‘’সুখী প্রবীণ মেয়ে’’ হিসেবে থাকো।