হুমায়ূন কবির এই নিপাট ষড়যন্ত্রের কলাকৌশলগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ভাষার মিহি সুতোয় বোনা যুক্তি ও বিশ্লেষণের নিপুন বিন্যাসে।
Published : 14 Jul 2024, 12:26 AM
ভারত ভ্রমণের দিনপঞ্জী: ভ্রমণে নয়, ভুবনে
ইকবাল করিম হাসনু লেখক হিসেবে খুব যে পরিচিত তা নয়। তবে তার প্রকাশিত যে-তিনটি বই আছে, তাতে করেই বোদ্ধা পাঠক বুঝতে পারবেন তিনি স্বল্পপ্রজ হলেও ভাবনায় এবং শৈলীতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। দুটি ভ্রমণ কাহিনি, আর একটি প্রবন্ধের বই চলচ্চিত্র বিষয়ে। কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যেমন বলেছিলেন ভ্রমণে নয়, ভুবনে, ইকবাল করিম হাসনুর ভ্রমণকাহিনি দুটো পড়লে আমাদের স্বীকার করতে দ্বিধা হবেন না যে তিনি পর্যটকের মতো কেবল ভ্রমণই করেননি, ভ্রমণ থেকে অভিজ্ঞতার আখরে নির্মাণ করেছেন দুটি ভুবন: একটি ভারত, অন্যটি কুবা। ভারতবিষয়ক ভ্রমণপঞ্জীর নাম কলকাতা ছুঁয়ে: ভারত ঘোরার দিনলিপি, আর কুবা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট হয়েছিল মুখ ঢাকেনি বিজ্ঞাপনে। কুবা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কোনো কোনো বাঙালি লিখেছেন, কিন্তু ইকবাল করিম হাসনুর চোখে আমরা অন্য এক কুবাকে দেখতে পাই।
একইভাবে কলকাতা ছুঁয়ে বইটিতেও তিনি অন্য এক কোলকাতা, মুম্বাই, আজমির, বারানসি, বিকানিরসহ ঐতিহাসিক ও পর্যটকপ্রিয় স্থানগুলো দেখার অভিজ্ঞতার এক হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন। আছে—যা আমার খুবই কাঙ্ক্ষিত—যে-কোনো নতুন জায়গায় নিম্নবর্গীয় খাবারের স্বাদগ্রহণের অভিজ্ঞতা। সেই ৮২ সালে হোটেল “আমানিয়া ছেড়ে দুএক গজ দূরের সস্তা একটা হোটেলে ১ টাকা ৪০ পয়সা দিয়ে রুটি, গোশ আর এক কাপ চা” খাওয়ার বর্ণনা। কলকাতা শহরের নানান জায়গা ঘুরে দেখার এত জীবন্ত বর্ণনা আছে তার এই বইটিতে যে পড়তে পড়তে মনে হয় এ যেন অভিজ্ঞ ও পেশাদার কোনো দক্ষ লেখকের হাতে তৈরি। অথচ লেখকের বয়স তখন মাত্রই কুড়ি। কিন্তু পাঠে, মননে তিনি বয়সের তুলনায় অনেক অনেক বেশি পরিণত, অন্তত লেখার ক্ষেত্রেতো বটেই। তখনকার কোলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলটিকে যদি কেউ বুঝতে চান তাহলে লেখকের এই বইটি এক উত্তম উপায় হতে পারে। উত্তম বলার কারণ লেখক বহিরাগত বলেই, কোলকাতার যা কিছু আকর্ষণীয় তা এই বিদেশির চোখে ধরা পরলেও, সেখানকার অধিবাসীর চোখে তা ধরা পরবে না।
কারণ একই পরিমণ্ডলে সেখানকার অধিবাসীর অবিরাম প্রাত্যহিক যাপনের ফলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যা-কিছু আছে, তা কখনোই তাদের কাছে আর আলাদাভাবে চোখে পড়ে না। ঠিক এই কারণেই ইকবাল করিম হাসনুর এই বই আমাদের কাছে যেমন, তেমনি কোলকাতাবাসীর কাছেও নিজেকেরকে আবিস্কারের এক শিহরণ অনুভূত হওয়ার মতো। কিন্তু এই বই কেবল কোলকাতা ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই নয়, ভারতের আরও কয়েকটি প্রদেশে ট্রেনে ভ্রমণের খুঁটিনাটি বর্ণনাও রয়েছে। আছে চলার পথে চেনা অচেনা বহুজনের সাথে পরিচয়ের কথা। অনেক কৌতুককর ও মজার মজার ঘটনাও বাদ যায়নি এই ভ্রমণে।
ভাবতে অবাক লাগে লেখক ওই অল্পবয়সেই দৃষ্টিভঙ্গির এত স্বচ্ছতা, বর্ণনার এমন প্রসাদগুণ কিভাবে অর্জন করেছিলেন! বইটি যদিও দিনলিপি আকারে সেই ৮২ সালেই লেখা,কিন্তু বই আকারে সেটি প্রকাশিত হলো প্রায় ৪২ বছর পর। ভাগ্যিস, তিনি বই আকারে প্রকাশ করেছেন। তা নাহলে চিত্তাকর্ষক এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বঞ্চিতই থেকে যেতাম। লেখককে ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানাই বইটির জন্য।
হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী ও অন্যান্য প্রবন্ধ: প্রবন্ধ যখন উন্মোচনে
কথাসাহিত্যিক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হুমায়ূন কবির মূলত তার উপন্যাসের জন্য বেশি পরিচিত। বিশেষ করে পারস্য পরবাসে, এক জীবনের কথা এবং তীর্থযাত্রী তিনজন তার্কিক উপন্যাস তিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও বিষয় অবলম্বনে রচিত।
সত্যি বলতে কি তার প্রবন্ধের সঙ্গে আমার পরিচয় সেভাবে ছিল না। তার লেখা প্রবন্ধের যে বইটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় সেটি এই আলোচ্য বই।
প্রবাসীদের অনেকেই খুব ভালো গল্প উপন্যাস কবিতা ছড়া লিখছেন, কিন্তু সেই তুলনায় উল্লেখ করার মতো ভালো প্রবন্ধ, যাকে বলে চিন্তায়, ভাবুকতায়, ভাষা ও বুননে এবং গভীরতায় চিত্তস্পর্শী প্রবন্ধ খুব একটা দেখা যায় না। দীপেন ভট্টাচার্য, সেজান মাহমুদ, আহমাদ মাযহার, আদনান সৈয়দ, হাসান ফেরদৌস কিংবা আবেদীন কাদের প্রমুখ প্রাবন্ধিক হিসেবে প্রাতস্মরণীয় এবং ইতিমধ্যেই তারা বিশ্রুত। কিন্তু দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাহাব আহমেদ এবং হুমায়ূন কবির-এর কথা এই সূত্রে উচ্চারিত হতে দেখি কম। শাহাব আহমেদের গদ্যের এক আলাদা স্বাদ আছে, তার গদ্য কল্পনা ও সৃষ্টির সঙ্গম থেকে নিসৃত। ওটা কেরানি গদ্য নয়। অথচ তার গদ্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে খুবই কম। প্রায় হয়না বললেই চলে। অন্যদিকে হুমায়ূন কবির ‘ঘুংঘুর’ পত্রিকার সম্পাদনার জন্য এবং তার কথাসাহিত্যের জন্য যতটা পরিচিত, তার হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী ও অন্যান্য প্রবন্ধ শীর্ষক বইটির জন্য কতটা বিশ্রুত? এই বইটি তার গভীর মননশীলতা, ভাবুকতা আর পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাষ্য এত সুনিপুন ও গোছানো, চিন্তা এত স্বচ্ছ ও সাবলীল, অভিব্যক্তি এত শীলিত ও স্পর্শমধুর যে এই বইটির প্রতিটি প্রবন্ধ চুম্বকীয় শক্তিতে পাঠককে আটকে রাখে। এই বইয়ের নাম-প্রবন্ধটির প্রতি সামান্য কৌতূহল থাকলে পাঠক হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী সম্পর্কে এক স্পষ্ট ধারণা পাবেন। কারণ আমাদের চারপাশে এই চাতুরীর জাল ছড়ানো। প্রবাসীদের অনেকেই একটু পয়সাকড়ি হলে তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হয়ে ওঠে একটু লেখক হওয়া। লেখাটা যে অনুশীলন করে অর্জন করতে হয়, ওটা যে টাকাকড়ি দিয়ে পাওয়া যায় না, মূর্খ লেখকগুলো তা বোঝে না। কোন লেখক বিদ্বান এবং মেধাবী, বোদ্ধা পাঠকরা তা পড়ামাত্রই বুঝতে পারেন। হুমায়ূন কবীবের বইটি পড়লে তার মনন ও বিশ্লেষণীশক্তি পাঠক নিশ্চিতভাবেই টের পাবেন।
আলোচ্য বইয়ে ‘সাহিত্য’, চিন্তা’, ‘ ভাষা’, এবং ‘মহামারি ও যুদ্ধ’ শীর্ষক চারটি বিভাগে মোট আটটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন এই বিষয়ের বৈচিত্র্য থেকেই বুঝা যায় লেখকের বিস্তার। ‘হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরী’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে এমন সব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে যা সাহিত্যের প্রচার, প্রতিষ্ঠা, পুরস্কারের অন্তরালে অশুভ উদ্দেশ্যকে উন্মোচিত করে। আমরা হলুদ সাংবাদিকতার কথা জানতাম, কিন্তু সাহিত্যও যে পীতবর্ণ ধারণ করেছে তা জানা থাকলেও আমরা এ সম্পর্কে কদাচিত মুখ খুলেছি। হুমায়ূন কবির এই নিপাট ষড়যন্ত্রের কলাকৌশলগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ভাষার মিহি সুতোয় বোনা যুক্তি ও বিশ্লেষণের নিপুন বিন্যাসে।
‘অভিবাসী সাহিত্য: উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্যের নতুন অধ্যায়’ শীর্ষক প্রবন্ধটি আমাদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক এই কারণে যে এডওয়ার্ড সাইদের প্রাচ্যবাদ নামক তত্ত্বের উদ্ভবের পর সাহিত্যকে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় দেখার পাশাপাশি তার সাথে ক্ষমতাকাঠামোর সম্পর্কটি ক্রমশই অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সাহিত্যকে ডায়াসপোরা আখ্যা দেয়ার প্রথা কেন শুরু হলো এর কারণ যদিও লেখক দেখিয়েছেন, কিন্তু আমি নিজে এ ব্যাপারে খুব একটা বিশ্বাসী হতে পারিনি। ডায়াসপোরা মানে অভিবাসীদের সাহিত্য, লেখক তার প্রবন্ধে বিভিন্ন জনের প্রস্তাবিত শব্দ, যেমন ‘অনাবাসী’, ‘উন্মূল’, ‘অন্য বাংলাবোধ’ এবং‘ অভিবাসী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই যদি হয়, এই বাংলা থেকে বাংলাভাষী বহু লেখক পশ্চিমবঙ্গ নামক আরেকটি রাষ্ট্রে চলে গিয়ে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন এবং তারা শেষ পর্যন্ত ওখানকারই বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন। আমরা কি এদের সাহিত্যকে ডায়াসপোরা সাহিত্য বলবো? শুধু বাংলায় কেন পৃথিবীর বহু ভাষায় এমন অনেক লেখক আছেন যারা নির্বাসিত অবস্থায় বা স্ব্ছোনির্বাসনে সাহিত্য রচনা করেছেন। যেমন কুন্ডেরা, যেমন সদ্যপ্রয়াত ইসমাইল কাদারে। কিন্তু প্রবাসে বা নির্বাসনে রচিত তাদের সাহিত্যকে ডায়াসপোরা হিসেবে বিচার করেন বলে শুনিনি। আমি মনে করি, সাহিত্যের একমাত্র পরিচয় সাহিত্যই। যাইহোক,এই প্রবন্ধটি ছাড়া অন্য যে-প্রবন্ধগুলো এই গ্রন্থে রয়েছে, সেগুলোতে লেখকের তথ্যউপাত্ত সন্নিবেশের পাশাপাশি আছে লেখার মুনশিয়ানা। হুমায়ূন কবীরের প্রবন্ধের একটা চুম্বকীয় গুণ আছে, সেটা আছে বিষয়ের উপর পরিপূর্ণ দখল থেকে আলোচনাকে ধীরে ধীরে পল্লবিত করার মধ্যে। তার চিন্তার স্বচ্ছতা যেমন রয়েছে তা প্রকাশেও রয়েছে সাবলীলতা।
যারা ভাবেন হুমায়ূন কবীর বুঝিবা শুধুই চিকিৎসক এবং কথাসাহিত্যিক। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বাণিজ্যের পারস্পরিক নির্ভরতাশীলতা কিভাবে কাজ করে তাও তথ্যউপাত্তসহকারে আমাদের সামনে হাজির করেন ‘যুদ্ধ বাণিজ্য’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে। এটি পড়লে বুঝা যায় হুমায়ূন কবীর কোনো আলাভোলা লেখক নয়, বিশ্বময় তার দৃষ্টির বিস্তার; দৃষ্টির অন্তরালে লীলাময় নানা ষড়যন্ত্র ও বাণিজ্যের যোগসূত্রগুলো তুলে ধরেন। এর ফলে বাণিজ্য, রাজনীতি ও মুনাফা—এরা যে পরস্পরের সাথে গভীর বন্ধনে জড়িয়ে আছে, তা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।
এই বইয়ের সবগুলো প্রবন্ধই সুলিখিত, ফলে সুপাঠ্য। হুমায়ূন কবীরের প্রবন্ধ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। কিভাবে পুনরুক্তি না করে সুনিপুন গ্রন্থনায় চিন্তাকে লক্ষ্যাভিমুখী রাখতে হয়, এ ব্যাপারে তার দক্ষতা মুগ্ধ করার মতো। লেখককে অভিনন্দন ভালো প্রবন্ধের আকালের যুগে একটি সুলিখিত প্রবন্ধের বই উপহার দেয়ার জন্য।