ছানি অপসারণ

মোহাম্মদ কাজী মামুনমোহাম্মদ কাজী মামুন
Published : 11 March 2023, 09:10 AM
Updated : 11 March 2023, 09:10 AM

আমার মা গত কদিন ধরে যাকেই পাচ্ছেন সামনে, হাত দুটো ধরে দোয়া চাইছেন আর মাফ করে দিতে বলছেন মনে কখনো কষ্ট দিয়ে থাকলে - সজ্ঞান বা অজ্ঞানে। না, আমার মা হজ্বে বা অন্য কোন দূরভ্রমণে যাচ্ছেন না। বা, এমন কোন সিরিয়াস অসুখ হয়নি তার যে ফেরার কোন পথ নেই, বা, ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ, মাকে হাসপাতালে যেতে হবে বইকি, কিন্তু একটা রাতও তো থাকতে হবে না! তারপরও মা যখন কাঠ হয়ে যাওয়া মুখে ডাক্তারের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “ছানি অপারেশান?”, ডাক্তার হাসিমুখে উত্তর করলেন, “ধুর, এটা কোন অপারেশন নাকি! এর থেকে কান ফোড়ানি বেশি কঠিন।‘’ কিন্তু আমার মা কানেই তুললেন না, খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলেন, আর তসবিহ্‌ নিয়ে পড়ে রইলেন সারাটা দিন। অবশ্য তসবির বিরতিতে ফোনে কথা বলতে লাগলেন বোন, ভাবি, আর ননদের সাথে; অপারেশনের ব্ল্যাক দিনটা আসার আগেই একটিবার দেখার ইচ্ছে আকুল হয়ে ঝরতে লাগলো তার নির্জীব কণ্ঠের কবর থেকে।

আমার মায়ের চোখের দৃষ্টি তার ফেলে দেয়া চশমাটার ঘষা কাঁচের মতই হয়ে গিয়েছিল; দেখতো সে সবকিছুই, কিন্তু অস্বচ্ছ, ঘোলাটে রেখারা দলা পাকিয়ে যেত সেখানে সারাটা ক্ষণ। আমরা ভাইবোনেরা মাকে বলতে লাগলাম, ‘’পূর্ণিমা রাতের আসমানের মত আবার সব ফকফকা হয়ে যাবে.. মা…একটুও চিন্তা কইরো না।‘’ কিন্তু মায়ের ভয় তো যায়ই না। অপারেশানের দুইদিন আগে যেদিন ডাক্তারের সহকারী ম্যাডাম একটা লিস্ট দেখালেন, যেখানে রয়েছে বাংলাদেশি, ইন্ডিয়ান, আমেরিকান, চাইনিজ আর জাপানি লেন্স, মা দেশের দিকে নজরই দিলেন না! বরং দামগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে নিলেন, এবং সবশেষে বললেন, “আমারে জাপানিডাই দাও।“ ম্যাডাম বিক্রেতার চেয়ারে ছিলেন, কিন্তু তাও তার যেন খারাপ লাগল; এক নজর তাকালেন আমাদের দিকে। তারপর একটু কেশে নিয়ে বললেন, “দেখুন, খালাম্মা, অন্য দেশেরগুলির দাম কম হইলেও খারাপ না, বাকী জীবন সহজেই পার করে দিতে পারবেন। এই তো গেল সপ্তাহে আপনার বয়েসি আরেক খালাম্মা একটা চাইনিজ লেন্স নিয়ে গেল। কী যে সুন্দর লাগছিল দেখতে, দারুণ মানাইছিল!“ কিন্তু মা তার নির্বাচিত লেন্স থেকে আর চোখ ফেরালেন না। একবার অবশ্য ঐ ম্যাডামের দিকে তাকিয়েছিলেন; তখন তার চোখের জমিতে অসংখ্য ছনের সমাবেশ, কখনো কখনো যারা উদ্যত ছনের মত মহড়া দিচ্ছিল! আই হাসপাতালের সেই ম্যাডাম এরপর ভয়ে আর একটা কথাও বলেননি।

সেই ছনগুলো যেদিন লেজার রশ্মির মাধ্যমে কাটা হচ্ছিল, আমরা লাইভ ভিডিওতে তা সরাসরি দেখতে পাচ্ছিলাম দর্শক সারিতে বসে। বলতে কী, মাকে সাহস দিলেও এই কাটাকাটির দৃশ্য আমাদেরও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। খারাপ লাগছিল মায়ের জন্য – যদি কিছু হয়ে যায়, যদি অপারেশান সাকসেসফুল না হয়, যদি চিরতরে অন্ধ হয়ে যান! দুরুদুরু বুকে দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করে দিয়েছিলাম সবাই মিলে। এটি ছিল খুবই স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটি অপারেশান। আর একারণেই হয়ত সেকেন্ড মিনিটে পরিণত হয়েছিল, মিনিট ঘণ্টায়। আমরা ভিডিওতে হারিয়ে গিয়েছিলাম, কাটাছেঁড়া, দলনমলনের মাঝে কখন যে একজন শেষ হয়ে আরেকজন শুরু হল টেরই পাইনি। এক সময় সার্জারি বিভাগের রিসেপশন থেকে ফোন এল - অপারেশান শেষ, চাইলে এখন রোগীর কাছে যাওয়া যেতে পারে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে লিফটে উঠে কেবিনের দরজায় গিয়ে পড়লাম আমরা। তারপর প্রবল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে যখন দরজাটা খুললাম, প্রথম নজরে মাকে দেখতে পেলাম না। যদিও জানি কোথাও যাননি তিনি, এখানেই আছেন, তারপরও কেন যেন অন্তরাত্মা শুঁকিয়ে যেতে লাগলো। এক সময় খুঁজে পেলাম, গুটিশুটি হয়ে শুয়ে ছিল বিছানার এক প্রান্তে, হাসপাতালের সাজসজ্জায়, একাকী। আমরা দৌড়ে গিয়ে কপালে হাত রাখতেই দূর থেকে এক নার্স বলে উঠলেন, “সব কিছু ঠিক আছে। মা ভাল আছেন।“ আমরা কর্ণপাত না করে, হাতে ধরে নাড়ি মাপতে লাগলাম, প্রেসার বুঝতে চেষ্টা করলাম, ইসিজি রিপোর্টটা খুলে দেখলাম। তারপর মাথাটা বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছো, মা?” সাদা বিছানার উপর আরো সাদা এক অ্যাপ্রোনে ঢাকা শরীরটা থেকে মৃতপ্রায় মানুষের মত ক্ষীণ, ভাঙা একটা স্বর ভেসে এল, “চক্ষু দুইডা কেমন জানি বিষ করতেসে!“ আমরা কিছুটা অবাক হয়ে যাই, মায়ের ডান চোখের ছানি অপারেশান হওয়ার কথা, তাহলে দুই চোখেই ‘বিষ’ করবে কেন? সবচেয়ে বড় কথা, ডাক্তার তো ব্যথার অনুভূতিশূন্য এক অপারেশানের কথা বলেছিলেন। তাহলে? কোন কমপ্লিকেশান্স?

ডাক্তারের কাছে গিয়ে দল বেঁধে দাঁড়াই আমরা, কিন্তু সব শুনে চেঁচিয়ে উঠেন তিনি, “আমাদের ডাটা তো বলছে সব ঠিকঠাক!“ “তাহলে মা ভাল বোধ করছেন না কেন?” - আমরা ভাইবোনেরা সমস্বরে জিজ্ঞাসা করি। ডাক্তার সাহেব যেন কিছুটা ভয় পেয়ে যান। এরপর কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকার পর অন্য রকম আর অচেনা একটা আওয়াজ বের হয় তার মধ্যে থেকে, “তাহলে এডমিশান করিয়ে নেন। আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখবো আমরা।“ এরপর আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেই, মা আজকের রাতটা হাসপাতালেই থাকবে, এমন কিছু পয়সা তো আর বেশি লাগবে না। কিন্তু কথাটা পাড়তেই মা তড়াক করে উঠে পড়লেন শোয়া থেকে আর চিৎকার ও ক্রন্দনে কালা করে ফেললেন চারপাশ, “না, না, এইহানে আর এক সেকেন্ডও না’। হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় ঔষধপত্রের সাথে একটা কালো চশমাও কেনা হল মায়ের জন্য। মা এই বিশ্রী জিনিসটা প্রথমে পড়তেই চাননি, চোখ উঠলে এমন পরতে দেখেন মানুষকে, আর সাথে সাথে তার নিজের চোখও জ্বালা করে উঠে! আমাদের অনুরোধ কাকুতি-মিনতি সব অগ্রাহ্য করলেন তিনি। পরে ডাক্তার যখন বললেন, “মাত্র তো তিনটা দিন, না পরলে ইনফেকশান হতে পারে, তখন আরো বড় অপারেশান করতে হতে পারে”, তখন মা কাউকে জানান না দিয়ে ঔষধ গেলার মত করে অনেকটা চুপিসারেই চোখে গলিয়ে ফেললেন চশমা জোড়াকে। কিন্তু মনে হয় এক মস্ত চুম্বক লাগানো ছিল ওতে, মা নাওয়া খাওয়ার সময়ও সরাতে পারলেন না সেই সস্তা প্লাস্টিকের গগলসকে। সত্যিই মনে হয় একটা অতিপ্রাকৃত শক্তি ছিল চশমাটার, না হলে, মা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুরো ঢেকে ফেলেছিলেন কেন নিজেকে ওই চশমায়?

চোখের যত নড়া চড়া তা গ্লাসের আড়ালে-আবডালেই চলতো লাগলো এরপর থেকে, এক মুহূর্তের জন্য আর তাকে দেখতে পেল না কেউ! মায়ের চোখে ছানি গড়তে সময় নিয়েছিল এক যুগেরও বেশী, কিন্তু ছানি অপসারিত হতে সময় নিয়েছিল এক ঘণ্টার সিকিভাগ। এত বড় একটা ঘটনা প্রভাব ফেলবে, সে তো খুবই সত্যি; কিন্তু যেরকমটা ঘটল বা ঘটতে লাগলো, সত্যি বলছি, তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। যেমন, মা সুযোগ পেলেই ড্রেসিং টেবিলে বসে যেতে লাগলেন আর আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে লাগলেন অনিমেষ, আনমনে, আড়চোখে। একদিন খুব সময় নিয়ে যত্ন করে বিনুনি গড়তে দেখা গেল তাকে; অথচ অপারেশনটার আগ পর্যন্ত চুলে তেল মেখে বাড়ির মেয়েটাই বিনুনি, খোঁপা, ঝুঁটি যা করার করে দিত। কথা বলা, হাঁটাচলা - সব কিছুতেই কেমন অন্যরকম হতে লাগলো! তাহলে ছানি অপারেশানের ট্রমাটা মা ভুলতে পারছেন না? আতঙ্ক আর উদ্বেগে তিনি স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি হারিয়েছেন? কী করতে হবে, কী করলে ভাল বুঝতে পারছেন না? এরকম হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যাওয়ার ফাঁকে ভিন্ন রকম একটা চিন্তা ভয় ধরিয়ে দিল আমাদের মধ্যে - মায়ের মধ্যে আবার কিছু আছর করে নি তো? এই থ্রি জি, ফোর জি’র যুগে আমরা কেউই সে কথা মুখে নিতে পারলাম না সংগত কারণেই; কিন্তু আমাদের শঙ্কা দিন দিন বাড়লো বই কমল না! মায়ের সব থেকে বড় সমস্যা ছিল যেন বাবাকে নিয়ে। বাবাকে যেন সে দেখেও দেখছিল না। একটা কথাও বলছিল না নিজে থেকে বাবার সাথে; বরং, বাবা নিজে থেকে কোন কথা বললেও তিনি রেগে যাচ্ছিলেন হুট করেই। যখন কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না, তখন রাগের উতরোল বাতাস ভেদ করে আকাশে পৌঁছাচ্ছিল! অথচ আমরা সবাই যে যার কাজে গেলে বাবাই থাকতো ঘরে, আর তাকে মায়ের প্রয়োজনও হত এটা-সেটার জন্য। এরই মাঝে একদিন বাবা, জানি না সাহস দিতেই কিনা, মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলেন, ‘তগো মায়রে হাসপাতাল থেকে আননের পর এক্কেরে বলিউড নায়িকাদের মত লাগতেছে রে ! ” কথাটা শুনে মা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন এক নজর, তারপর ‘বুইড়া বয়সে ভীমরতি’ বলে যখন পাশের ঘরে চলে গেলেন, তখন তার পায়ের বৈঠাগুলো কেমন নৌকো বেয়ে চলল টাইলসের মেঝে সড়াৎ সড়াৎ করে! তবে মায়ের পরিবর্তনগুলো আমাদেরও আগে টের পেয়েছিল সাত বছর বয়সী জিসান, আমার বড় বোনের একমাত্র ছেলে। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে একমাত্র বড় বোনেরই বিয়ে হয়েছিল, আর তার ছেলে ছিল আমার মায়ের একমাত্র নাতিন। সেই জিসান হাসপাতাল থেকে ফেরার পর মায়ের আঁচল ধরে যখন থেকে থেকে গো গো করছিল, তখন এক জোড়া শীতল চোখ ছানি-চশমার ওপার থেকে হঠাৎ করেই এমন এক সিগনাল্‌ জ্বেলে দিয়েছিল যে তারপর থেকে আর নানু-মুখী হতে দেখা যায়নি তাকে। দলে দলে লোক আসতে শুরু করলো মাকে দেখতে। আর সে খুকি খুকি ভাবে শুধু তাকিয়ে থাকলো না, সুরের পল্লব তুলে, কলকাকলির লহরে ভাসাতে লাগলো চারপাশ। একদিন তো এত খল খল হেসেছিল যে, আর একটু হলেই পড়ে যেত খাট থেকে! বড় ভাবিকে দেখে তার ছোটবেলার গল্পটা করতে ইচ্ছে হয়েছিল, সাইজা ভাই কি করে পেছন লেগেছিল তার, প্রতিদিন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, অথচ সে-ই কিনা আবার বাড়িতে মাথা নীচু করে থাকতো মা যখন সামনে দিয়ে যেত, চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতো না! ভাবী, ননদিদের নিয়ে এতই মেতে থাকলো মা যে, ঘর-গৃহস্থালী শিকেয় উঠতে লাগলো! কাজের লোকেরা মায়ের গিন্নিপনা টের পেতে ব্যর্থ হল বহুদিন বাদে।

তারা বাসনটা মাজবে, কাপড়টা কাঁচবে, তরকারিটাতে মসলা ঢালবে - সবখানেই মায়ের ছানি চোখ আর মুখ ঘোরাফেরা করত ছানি অপারেশানের আগে। এখন মাকে না পেয়ে খুশী হওয়ার কথা থাকলেও কেমন একটা শূন্যতা পেয়ে বসল তাদের মধ্যে। আর সেই শূন্যতা পৌঁছে গেল আমাদের ডাইনিং টেবিলেও, হোটেলে যেতে লাগলাম সবাই দল বেঁধে! আরো একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মা তার যে গহনাগুলো ছেলের বউয়ের জন্য রেখে দিয়েছিল সযত্নে, তা বারবার করে দেখতে লাগলো এবং একদিন পরে ফেলল নিজের গলায় আর কানে। আর তারপর পুরোপুরি সেট হয়ে গেল টিভির সামনে। যেই মাকে জোর করেও টিভি নামক শয়তানি যন্ত্রটার কাছে নেয়া যেত না, সেই কিনা রাত জেগে জেগে সিরিয়াল দেখতে লাগল, একটার পর আরেকটা, তার পরেরটা, তারপরের পরেরটা! যখন দেখতো তখন আমরা তাকে কালো চশমাটা খুলে পাওয়ারের চশমাটা লাগাতে বললেও সে গা করত না। তার চোখের মধ্যভাগে ছিল পৃথিবীর সব থেকে দামি লেন্স, আর চোখের উপরিভাগে লাগানো ছিল সব থেকে কম দামি লেন্স। প্রায়ই বুঝতে অসুবিধে হত, সে আসলে কোনটা দিয়ে দেখে? সদ্য সার্জারি করে সেঁটে দেয়া ভেতরের লেন্সে, না কি বাইরের লেন্সে?এই তো সেদিন অফিস থেকে ফিরে একটু বসেছি ল্যাপটপ নিয়ে, ‘’দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ, কাঁচা সোনা নিয়ে’’ নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েছি। যখন ‘রথি কয়, ভেবো না রে, ডুবে যাও রূপসাগরে’ পর্যন্ত এসেছি, ঠিক তখুনি বাসার মেয়ে রাশেদা এসে কাঁচুমাচু গলায় বলল, “খালাম্মা আপনেরে একটু ডাকতেছে।“ বিরক্তি সপ্তমে উঠেছিল, কিন্তু কণ্ঠকে অনেক কষ্টে শান্ত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন? ঔষুধগুলি দিতে পারোস নাই?’ হয়েছে কি, ছানি অপারেশেনের পর মাকে যে ড্রপারগুলি দেয়া হয়েছিল, তার টাইমটেবল আলাদা আলাদা ছিল। প্রথম প্রথম বাড়ির ছোট আর আনম্যারেড ছেলে হিসেবে আমার উপরই ভার পড়েছিল টাইমটেবল মেনে ড্রপগুলিকে মায়ের চোখে প্রবেশ করানোর। কিন্তু সে যেন এক বিশ্বযুদ্ধ, যতবারই ফোঁটা ফেলব, ততবারই তিনি চোখের ঝাঁপি বন্ধ করে দেবেন, আর সেগুলো পড়তে থাকবে তার গালে, আর নাকে। কিন্তু সেজন্য বকা আবার আমাকেই শুনতে হবে, অকর্মার ঢেঁকি, আবাল, গর্দভ। মায়ের চোখদুটো যেন হীরকখন্ড; যেন আমার আঙ্গুলের সামান্যতম আঘাতও না লাগে, যেন এক ফোঁটা দ্যূতিও নষ্ট না হয়ে যায় - সেদিকে সদা সতর্ক থাকতে হবে আমাকে! তবে একটা সময় আমি রাশেদাকে শিখিয়ে দিতে পেরেছিলাম, ওর বকা গিলে ফেলার সহাজাত ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে। সে মায়ের অনর্গল বকার মধ্যে একটুও দমে না গিয়ে পুরো ঢুকে যেতে পারতো এবং একবারের চেষ্টাতেই অক্ষিপটে নিক্ষেপ করতে পারতো ডাক্তারের দেয়া সঞ্জীবনী রস। রাশেদা চুপ করে ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে থাকলে আমি আর কথা না বাড়িয়ে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়াই। আমার মাথায় তখন নতুন চিন্তা। মা কি তবে বিয়ে নিয়ে মাথাটা আবার নষ্ট করে দেয়ার জন্য ডাকছেন আমাকে? জানি না, কতক্ষণ চলবে আজকের প্যানপ্যানানি! তার দেখা মেয়েটার সেই পুরোনো কিচ্ছা - কী কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ, কি প্রতিষ্ঠিত ফ্যামিলি, অবহেলা করায় আমার কপালে খারাবি আছে, এ করতে করতে মা একসময় এমন কথাও বলতে থাকবেন, যা নিজের ছেলেকেই অভিশাপের মত শুনাবে, আর তারপরই শুধু তিনি থামবেন। মা শুয়ে ছিলেন; আমায় দেখে উঠে বসে খাটের আলনায় মাথা ঠেকালেন, ‘চোখ অপারেশানের খরচ সব তো তোমার বোনেই দিল। কই কি, তোমার নতুন চাকরি, বেতন কম… অত পারবা না… খালি দুইডা শাড়ি… আর শীত আইতেছে, একটা শাল কিইনা দিও। “ আমি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকি মায়ের দিকে! এই গেল ঈদেও মাকে অনেক অনুরোধ করে একটার বেশি দুটো শাড়ি কিনে দিতে পারি নাই; আর তাও সব থেকে কম দামিটাই, কারণ দামি হইলেই মায়ের গায়ে নাকি খসখস করে, আর ফোসকা পড়ে যায়! মায়ের যে ভাল-মন্দ জ্ঞান, রুচি-অরুচি ছিল না, তা না। তবে সেসব শিকেয় তোলা ছিল ঘর-দুয়ার সাজানোর ব্যাপারে! এই তো মাস ছয়েক আগেই একটা সোফা ও শোকেজের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। আমি সেগুনের পরিবর্তে মেলামাইন বোর্ডের কথা তুললে ধমকে উঠেছিলেন, ‘রুচি এত নিস্যা ক্যান তোগো? সামনে যখন আত্মীয়-স্বজনরা আইবো, বাড়িও দেইখা কি কইবো?” মা আমার সম্ভাব্য বৈবাহিক আত্মীয়ের কথাই বলছিলেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেসব এখন ইতিহাস! আমি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতে থাকি নিজেকে? মায়ের অপারেশনটা আসলে কোথায় হয়েছে? ছানি না স্মৃতির পর্দায়? অনেক ভেবেও ধন্দ কাটে না আমার! এভাবে অনেক দিন কেটে গেলে আমরা মা’কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম; বলা ভাল, নিয়ে যেতে পারলাম। ডাক্তার তিনদিন পর দেখানোর কথা বলে দিয়েছিল। অথচ হাতেপায়ে ধরেও রাজী করানো যাচ্ছিল না মাকে! অবশেষে একদিন আমাদের সবার চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তিনি হাসপাতালমুখী হলেন। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার হাসিমুখে বললেন, ‘বাহ্‌, লেন্স তো দারুণ কাজ করছে, মা, আপনার চোখে!... কালো চশমাটা আর পরে থাকার দরকার নেই, খুলে ফেলতে পারেন নির্দ্বিধায়।“ কিন্তু মা ডাক্তারকে অবাক করে দিয়ে জানালেন, চশমাটা খোলা তার পক্ষে সম্ভব না। এটি খুললেই নাকি তার চোখ ব্যথা করে, সবকিছু ঘোলা দেখেন আগের মত! ভিজিবিলিটি রেইট শতভাগ দেখাচ্ছিল, ইনফেকশান এর লেশমাত্র ছিল না, তবু ডাক্তার আরো কিছু পরীক্ষা করলেন। কিন্তু রহস্যটির কোন সমাধানসূত্র বের করতে ব্যর্থ হলেন। এরপর মরিয়া হয়ে তিনি কম্পিউটার রেকর্ড ঘাঁটলেন, আর পরীক্ষাগুলো পুনরায় করলেন। কিন্তু ফলাফল এল সেই অভিন্ন। ডাক্তার বললেন, “অনেকদিন পরে আছেন তো, তাই এমন মনে হচ্ছে। আসলে খুলে ফেললে খারাপ লাগবে না। আমি বলছি, কিচ্ছু হবে না আপনার! বরং এটি পরে থাকলেই সমস্য দেখা দিতে পারে এক সময়, দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে!“ ডাক্তারের কথাগুলো শুনে মায়ের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, মুখ থেকে রক্তের চিহ্ন অদৃশ্য হল ভোজবাজির মত! বেশ কিছুটা সময় ঝিম্‌ মেরে থাকার পর মাথাটা তুলে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে লাগলেন তিনি, “ আইচ্ছা, চশমাডা হালায় দিমু তাইলে! তয় ডাক্তোর সাব, একখান কথা …. আপনে না গেলবার কইছিলেন, আমার বাম চোখডাতেও ছানির আলামত শুরু হইয়া গ্যাছে? কই কি, ঐ ছানিডা আর ধইরা রাহনের কাম কী! অপারেশনডা সাইরা ফালাইলে ভালা না?” ডাক্তারের সাথে সাথে আমরাও বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকি মায়ের দিকে - কালো চশমাটার আড়ালে তার চোখ দুটোতে কি ঘটে চলেছে, তার কোন খবরই নেই আমাদের কারো কাছে!