মৃত্যুর মতো জীবনের কষ্টের পর্ব শেষ করে ওপারে ভালো থাকবেন।
Published : 13 Dec 2024, 11:58 PM
চলে গেলেন একজন কষ্টের ফেরিওয়ালা কবি হেলাল হাফিজ। মৃত্যুর আগে তিনি একা একা একটি আবাসিক হোটেলে থাকতেন। কিন্তু আজ ১৩ ডিসেম্বর দুপুরের পর সেখানে আর থাকা হবে না। তাঁর মৃতদেহ কয়েকজনকে বহন করতে হলো। কয়েকজনের কাঁধে ভর করে তিনি অনন্তলোকের দিকে যাত্রা করেছেন। ভর করলেন দাফনের সময় নির্ধারণের জন্য ভাতিজা নেহাল হাফিজের সিদ্ধান্তের ওপরও। তিনি ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় আসছেন আজ রাতের মধ্যেই। নেহাল হাফিজের দেয়া দাফনের সিদ্ধান্তের পর কবিকে সেই গোরস্থানে অনেকের সঙ্গে একা একা শুয়ে থাকতে হবে।
মানুষ মূলত হেলাল হাফিজের মতো একা। জীবিতাবস্থায় যৌথতার অভিনয় করে সমাজের মধ্যে নানা সম্পর্কের রোল প্লে করে যায়। কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সামাজিকভাবে তিনি কেবল নেহাল হাফিজের চাচার রোল প্লে করলেন। তাঁর স্ত্রী এবং সন্তান থাকলে হয়তো এই সিদ্ধান্ত তারাই দিতেন। তখন হয়তো তিনি একটি পরিবারের প্রধানের রোল প্লে করতেন। মানুষের জীবন এমন একাকিত্বের ফুলে যৌথতার একটি মালার সমন্বয়।
ভাবছেন, দেশের একজন স্বনামধন্য কবির রোল নিয়ে আমি এসব কী যা তা বলে যাচ্ছি?
আসুন একটু খুলেই বলা যাক।
'সামাজিক' ব্যাপারটা মানবেতিহাসে বায়োলজির সঙ্গেই বেশি যুক্ত। একটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে যৌথতার রোল প্লে করা অভিনয়ের ভূমিকা বেশ গৌণ। এখানে ব্যক্তিকে সৃজনশীল চিন্তাটা একলাই করতে হয়। কবি হেলাল হাফিজ সারাজীবন সমাজের গড়ে দেয়া কাঠামোর মধ্যে একাই থেকে গেছেন।
কবি যেমন যৌবন আছে যার তাকে যুদ্ধে যেতে বলেছিলেন, তেমনি এই কথাও বেশ বলিষ্ঠভাবে বলেছিলেন:
মিছিলের সব হাত
কন্ঠ
পা এক নয়।
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।( নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়)
কবি এটাও দেখেছিলেন যে লড়াইয়ের রাজপথে না চাইতেও বহু কিছু ঘটে। লড়াইয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত না হলে যেকোনো বিপ্লব বেহাত হয়ে যায়।
কিন্তু বিপ্লব থেকে ফিরে আসা যুবককে কেন কষ্ট ফেরি করে বেড়াতে হয়? কবির ভাষায়:
ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট। (ফেরীওয়ালা)
কবির মনে কী এমন কষ্ট ছিলো? তিনি তো যৌবনপূজারি ছিলেন। বেঁচেছেন নির্ঝঞ্ঝাট উপায়ে।
যখন স্কুলে পড়তাম তখন দেখতাম স্কুলের বড়ো আপুরা কবি হেলাল হাফিজের নানা কবিতা স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতেন। কলেজ এবং ভার্সিটিতেও দেখতাম বড়ো ভাইদের তুলনায় আপুরাই বেশি 'কষ্ট নেবে কষ্ট'-এর 'ফেরিওয়ালা' কবিতাটি আবৃত্তি করতেন। মেয়েরা কেন এতো হেলাল হাফিজ-ভক্ত ছিলেন তা তখন আমার বুঝে আসতো না। এখন মনে হয় হেলাল হাফিজ নারীদের অবরুদ্ধ মনোলোকে বেশ ভালোভাবেই প্রবেশ করতে পেরেছিলেন।
ভার্সিটির হোস্টেলে থাকার সময় প্রথম আমার কাছে যে জলে আগুন জ্বলে-এর একটি কপি হাতে এলো। রুমমেটদের মধ্যে যারা কোনোদিনও কবিতা পছন্দ করতেন না তারাও দেখতাম তাদের বিভিন্ন মনোকষ্টে ভোগার সময় 'কষ্ট নেবে কষ্ট' কবিতাটি পাঠ করতেন। উৎকৃষ্ট মানের ছ্যাঁকা খেয়ে বলে উঠতেন "নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না!" তারা কবি হেলাল হাফিজকে মোটামুটি প্রাসঙ্গিক করে তুলতেন নিজের জীবনের পোড়া উপলব্ধির সঙ্গে।
কষ্টের ফেরিওয়ালা এই কবির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২০১৬ সালের দিকে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে। দেখলাম হাতে কিছু হ্যান্ডব্যান্ড আর গলায় কীসের যেন মালা পরা একজন গৌরবর্ণের যুবাদর্শী পৌঢ় কবি নানাজনের সঙ্গে হাস্যরসিকতায় মত্ত। হোটেল শেরাটনের ছাদখোলা সবুজ চত্বরে কবি কিছু না বুঝে আমাকে না চিনেই আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলেন। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে গেলাম কবির অনুরোধে। ছবি তুলে দিলেন আমার বর।
ওই প্রথম আমি 'কষ্টের ফেরিওয়ালা' 'যৌবন যার'- এর কবিকে দেখলাম। তখন মনে হলো, কবিরা কি এমনই হয় সবসময়? এমন আবোল তাবোল 'একলা চলোরে'-এর পথিক?
আজ কবি হেলাল হাফিজ আমাদের মাঝে নেই। আমাকে অনুরোধ করা হলো মৃত কবিকে নিয়ে কিছু লেখবার জন্য। দারুণ 'কষ্ট' নিয়ে আমি আমার স্মৃতি ভাণ্ডার থেকে লিখছি। এই কষ্ট কবির শারীরিক মৃত্যুর জন্য যতোটা না, তার থেকে বেশি জীবিত কবির কবিতার ওপর আলোচনা বা প্রবন্ধ লিখতে না পারার। আমাদের এই অনুন্নত মনস্তত্ত্বের দেশে জীবিতের চেয়ে মৃতরাই যেখানে মহান হয়ে ওঠেন, সেখানে কবি হেলাল হাফিজের মতো শারীরিকভাবে মৃত কবিদের মৃত্যু নিয়ে লেখাই বরং জনসমাজের স্বভাবসিদ্ধ কাজ।
আমাকে এবং আমাদেরকে ক্ষমা করবেন কবি। মৃত্যুর মতো জীবনের কষ্টের পর্ব শেষ করে ওপারে ভালো থাকবেন।