পিতৃদত্ত নাম ছিল প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাক নাম মানিক। প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম ‘অতসীমামী’। বাংলা কথাশিল্পে স্বাতন্ত্র্যখচিত বৈপ্লবিক ধারার প্রবর্তক এই লেখক। অতীব ধারালো তাঁর বিশ্লেষণ, বর্ণনা, নিবিড় গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা। জীবনকে তিনি দেখিয়েছেন নিংড়ে খুঁড়ে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে পিতার কর্মস্থল তৎকালীন বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে তাঁর জন্ম। এই দুমকা এখন ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্গত। তাঁর পৈতৃকবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের কাছে মালবদিয়া গ্রামে। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েট। তিনি চাকরি করতেন সেটেলমেন্ট বিভাগে। শেষজীবনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর নেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মায়ের নাম নীরদাসুন্দরী দেবী। মায়ের বাবার বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের গাওদিয়া গ্রামে। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে এই কথাশিল্পীর প্রয়াণ ঘটে কলকাতায়, ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর।
‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। কলেজ ছাত্র থাকাকালে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে গল্প লেখার সূচনা। কীভাবে সেই গল্প লেখা হয়েছিল, লেখক হিসেবে ডাকনাম ব্যবহারের কাহিনী তিনি নিজেই বলেছেন। যে লেখায় একথা বর্ণিত আছে, সে লেখার নাম ‘গল্প লেখার গল্প’। কেন ব্যবহার করলেন ডাক নাম? এ প্রসঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য: “ভাবলাম এই উচ্ছ্বাসময় গল্প, নিছক পাঠকের মন ভুলানো গল্প এতে নিজের নাম দেব না। পরে যখন নিজের নামে ভাল লেখা লিখব, তখন এই গল্পের কথা তুলে লোকে নিন্দে করবে। এই ভেবে বন্ধু ক’জনকে জানিয়ে, গল্পে নাম দিলাম ডাক নাম--মানিক।” ‘গল্প লেখার গল্প’ শিরোনামের এই রচনা প্রথম প্রচারিত হয় কলকাতা বেতারে। ১৯৪৫ সালে। বেশ কয়েকজন লেখকের ‘আমার গল্প লেখা’ পর্যায়ের অন্যতম ভাষণ হিসেবে প্রচারিত হয়। সেটি মুদ্রিত হয় পরে (শ্রাবণ ১৩৫৩)। জ্যোতিপ্রসাদ বসু সম্পাদিত সংকলন গল্প লেখার গল্প বইয়ে। পরে লেখকের কথা নামে লেখকের একমাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থে রচনাটি সংকলিত হয়।
এই ‘গল্প লেখার গল্প’ লেখাটিতে আমরা পাই প্রথম সাহিত্যচর্চার ইতিহাস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,
“কোনদিন এক লাইন লিখিনি, কিন্তু গল্প তো পড়েছি অজস্র। সাহিত্য হবে না, সৃষ্টি হবে না, কিন্তু সম্পাদক ভুলানো গল্প নিশ্চয় হবে।” এই লেখারই অন্যত্র তিনি বলছেন,“ লেখক হবার ইচ্ছে সম্মন্ধে হঠাৎ সচেতন হইনি। স্কুল-জীবনের শেষের দিকে ইচ্ছেটা অল্পে অল্পে নিজের কাছে ধরা পড়েছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে হাত মেলেছিল বহুদূরের ভবিষ্যতে--সঙ্গে সঙ্গে লেখবার তাগিদ যোগায়নি। লিখব?--এই বয়স আমার! বিদ্যাবুদ্ধি অভিজ্ঞতা কিছু আমার নেই। কোন ভরসায় আমি লিখব? লেখা তো ছিনিমিনি খেলা নয়! বাড়িতে লুকিয়ে লেখার চেষ্টাও আমি কখনও করিনি। আমার অধিকার নেই বলে।”
এইসব মন্তব্য, বিশেষ করে ‘কোনদিন এক লাইন লিখিনি’ এমন স্বীকারোক্তির ফলে স্বভাবতই এমন একটা ধারণা হতে পারে যে ‘অতসীমামী’ই বোধহয় তাঁর লেখালেখির আদিতম নিদর্শন। গদ্যরচনা প্রসঙ্গে একথা যথার্থ। তবে ‘অতসীমামী’ লেখার অনেক আগে ১৬ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ষোলো থেকে একুশ বছর বয়সপরিধিতে রচিত কবিতাবলি তথা আদিতম সাহিত্যচর্চার কিছু নিদর্শন রয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা নামের গ্রন্থে।
বাবার ছিল বদলির চাকরি। সে কারণে মানিককে দুমকা, আড়া, সাসারাম, কলকাতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বারাসাত, টাঙ্গাইল ও মেদিনীপুরের নানা স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। তিনি কিছু সময় পড়েছেন টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে। শেষে তিনি মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে অঙ্কে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পাস করেন। বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ন মিশন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি (১৯২৮) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। তারপর অঙ্কে অনার্স নিয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএসসি-তে ভর্তি (১৯২৮) হন। পাঠ্যবিষয়ে অনাগ্রহ, গল্প উপন্যাস পাঠে অধিক সময় ব্যয় করার কারণে অনিবার্য বিপর্যয়। পর পর দু’বার বি,এসসিতে ফেল। কলেজের শিক্ষা সমাপন করা আর হয়ে উঠল না।
অতঃপর পেশাগত জীবনে প্রবেশ। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করা থেকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সহোদর সুবোধকুমারের সঙ্গে যৌথভাবে ‘উদয়াচল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস’ পরিচালনা করেন। একইসঙ্গে তিনি বঙ্গশ্রী (১৯৩৭-৩৯) পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। কিছুদিন ভারত সরকারের ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের প্রভিন্সিয়াল অরগানাইজার এবং বেঙ্গল দপ্তরে প্রচার সহকারী পদেও কর্মরত ছিলেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের একজন শক্তিমান লেখক হিসেবে বিবেচিত। নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়, অন্তর্ভেদী অবলোকন, লেখার গুণগত মানের কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের মর্যাদা অর্জন করেন। বিশ শতকের তিরিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র ধারার বিরোধিতা করে যে কল্লোল গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে, সেই গোষ্ঠীর লেখক হিসেবে গড়ে ওঠে মানিকের স্বতন্ত্র পরিচয়।
জীবনের প্রথম পর্বে মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড, ইয়ুং, অ্যাডলার প্রমুখ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা নেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হন এবং আমৃত্যু এই দলের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই বিপ্লবী লেখক। সাহিত্যের মাধ্যমে মার্কসের শ্রেণিসংগ্রামতত্ত্বের বিশ্লেষণ এবং মানুষের মনোরহস্যের জটিলতা উন্মোচনে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শিল্পী। আমরা গভীর বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, মানবিক মনস্তত্ত্ব, শহরের পাশাপাশি গ্রামজীবনের দ্বদ্বসঙ্কুল পটভূমিও তাঁর উপন্যাস ও গল্পে গুরুত্ব পেয়েছে। স্বল্পায়ু জীবনে অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও দুশো চব্বিশটি গল্প তিনি উপহার দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গন্থ: উপন্যাস জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০-৪১), চিহ্ন (১৯৪৭), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), সার্বজনীন (১৯৫২), আরোগ্য (১৯৫৩) প্রভৃতি; আর ছোটগল্প অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), হলুদ পোড়া (১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩) ইত্যাদি। পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাস দুটি তাঁর বিখ্যাত রচনা। এ দু’টির মাধ্যমেই তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পদ্মানদীর মাঝি চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া হয়েছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রচনায় মানুষের অন্তর্জীবন ও মনোলোক বিশ্লেষণে শক্তিমত্তা ও নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রথম দিকের রচনায় নিপুণভাবে উপস্থাপিত, বিশ্লেষিত হয়েছে মানুষের অবচেতন মনের নিগূঢ় রহস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর পরবর্তী রচনায় তাঁর সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সাফল্যের সঙ্গে চিত্রিত। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নাগরিক জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তার নিখুঁত শৈল্পিক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর এ পর্যায়ের রচনায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যচর্চাকেই পেশা হিসেবে আঁকড়ে ছিলেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্রজীবন থেকেই বিজ্ঞানের অপরিসীম অনুরাগী ছিলেন। এই অনুরাগবশত বিজ্ঞানের বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করে তিনি অর্জন করেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা দেখতে পাই উপন্যাসে সমাজ বাস্তবতার অনুসন্ধানে তার প্রয়োগ ও রূপায়ণ। বিজ্ঞান পড়া কেন প্রয়োজন? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে,“সরাসরি বিজ্ঞানের কিছু শিক্ষা পাওয়া নয়, উপন্যাস লেখার জন্য দরকার খানিকটা বৈজ্ঞানিক বিচারবোধ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজ্ঞান প্রভাবিত মন উপন্যাস লেখার জন্য অপরিহার্যরূপে প্রয়োজন।”
জীবনবাদী এই কথাসাহিত্যিক বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গ প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এর যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। দু’বার তিনি এ সঙ্ঘের সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে ঐক্য ও মৈত্রী স্থাপনের প্রয়াসে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের গণসাহিত্য শাখায় এবং ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ আয়োজিত জোসেফ স্টালিনের শোকসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।