উম্মুল জুনদবকে পেতে ইমরুল কায়েসের প্রেমের চেয়ে একপ্রকার জেদ কাজ করছিল।
Published : 21 Jun 2024, 09:16 PM
"কবি তো সে-ই
যার আকাঙ্ক্ষার সীমা নেই,
কামনার শেষ নেই,
প্রতিদিন যার জীবন নতুন একটি বাঁকবদলের দিকে ছুটে যায়।
কবি তো সে-ই
যার দিন কাটে এক মরুভূমিতে
আর রাত কাটে আরেক মরুতে।
আর সে একাই পা রাখে এমন সব বিপদের উপত্যকায়
যেখানে যাবার কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় বীরপুরুষেরও।
কবি তো সে-ই
কারো কাছে যে বিপদ নিয়ে অভিযোগ করে না;
বরং বিপদ নিয়ে খেলতে ভালোবাসে।"
কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার উপরোক্ত চরণের মধ্য দিয়ে শুরু করেছেন 'কবি ও কামিনী' উপন্যাস। এটি আইয়ামে জাহেলিয়া অর্থাৎ অন্ধকার সময়ের প্রেমোপাখ্যান।
দেড় হাজারেরও বেশি বছর আগের প্রাচীন এই বিস্ময়-প্রতিভা নিয়ে আশ্চর্য এক আখ্যান লিখেছেন একুশ শতকের বাঙালি লেখক জাকির তালুকদার।
আরবদের কাছে কবিতার চাইতে প্রিয় আর কিছু নেই। কবিতার প্রতি তাদের এই গভীর অনুরাগের কথা এক বক্তৃতায় খুব সুন্দরভাবে বলেছিলেন সিরিয় কবি নিজার কাব্বানি:, "প্রতিটি আরবদের ত্বকের নিচে তেল নয়, কবিতা প্রবাহিত।( অনুবাদ: রাজু আলাউদ্দিন)"
আরবের এই ঋদ্ধ ঐতিহ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিপুরুষ ছিলেন ইমরুল কায়েস।
ইমরুল কায়েস হলেন ষষ্ঠ শতকের আরবি ভাষার উল্লেখযোগ্য ও শ্রেষ্ঠ কবি। তার পুরো নাম হল ইমরুল কায়েস বিন হুযর আল কিন্দি। তাঁকে ঘিরেই, তাঁকে কেন্দ্রে রেখেই আবর্তিত হয়েছে পুরো উপন্যাসটি।
কবির হৃদয় মহত্তম উপলব্ধিকে ছুঁয়ে কোথায় না যেতে পারে; কবির কোনো দিন নেই, রাত নেই; নেই সীমানা। কবির সাহস বীরপুরুষকেও হার মানায়। ইমরুল কায়েস এমন একজন কবি।
ইসলাম-পূর্ব যুগ বলি, আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ বলি আর অজ্ঞতার যুগ বলি -- সেই সময়ের কবি ইমরুল কায়েসের কবিতা আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। ইমরুল কায়েস যেমন ছিলেন তার যুগের কবিশ্রেষ্ঠ, তেমনি ছিলেন বীর যোদ্ধা, প্রেমিক আর দুর্ধর্ষ।
ইসলাম পূর্ব যুগে আরবে উকাজ এর মেলা খুব প্রসিদ্ধ ছিল। এই মেলায় কবিরা তাদের কবিতা শোনাতেন। যে কবিতাটি সব থেকে ভালো হত সেই কবিতাটি সোনার হরফে লিখে পবিত্র মক্কার কাবার দরজায় টাঙিয়ে দেওয়া হত। যেহেতু এগুলো টাঙিয়ে রাখা হত তাই এর নাম রাখা হয় মুআল্লাক্বা। ইমরুল কায়েস ছিলেন মুআল্লাক্বা রচয়িতাদের একজন।
ঘরের চাইতে বাইরের দিকেই তার টান ছিল বেশি। তাই তিনি ‘ভবঘুরে যুবরাজ’ নামে পরিচিত ছিলেন। উপন্যাসটিতে ইমরুল কায়েসকে যেভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন লেখক তা একটু দেখা যাক:
"কিন্দ গোত্রের গোত্রপতি হজরের পুত্র কায়েস।
আল মালিকুদ দিল্লিল (ভবঘুরে রাজকুমার) কায়েস। মরুরাজ্যের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ কায়েস। সহস্র তরুণী ও যুবতীর ধ্যানের পুরুষ কায়েস। কাবার গায়ে আসসাবউল মুয়াল্লাকার (ঝুলন্ত কবিতার) রচয়িতা কায়েস।" (পৃ: ১১)
যদিও কবির সৃষ্টি ও প্রেম এই আখ্যানের কেন্দ্র, কিন্তু এর আড়ালে লেখক ছবির মত জীবন্ত করে তুলতে চেয়েছেন কবির সমসময় যেখানে চিত্রিত হয়েছে তৎকালীন আরবের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি; গোত্র, দাসপ্রথা ও শ্রেণীসম্পর্ক, নর-নারীর সম্পর্ক; প্রেম, যৌনতা, ঈর্ষা, ঘৃণা, যুদ্ধ, হিংসা। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে যেভাবে এসব মনো-দৈহিক চর্চা স্থান পেয়েছিল সেভাবে সেখানে পৌঁছায়নি বিজ্ঞান কিংবা দর্শন।
উপন্যাসটি সারসংক্ষেপে ইমরুল কায়েসকে কেন্দ্রে রেখে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু চরিত্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রেমোপাখ্যানের চুম্বক-প্রবাহে ঢোকার চেষ্টা করছি লেখক জাকির তালুকদারকে অনুসরণ করে।
উপন্যাসের শুরুই হয়েছে সেই সময়ের সংস্কৃতি নিয়ে। কোনো কিছুর আমন্ত্রণ জানানোর জন্য, সংবাদ জানানোর জন্য সেই সময় ব্যবহার করা হতো বিশেষ বাদ্যযন্ত্র -- দফ। লেখকের ভাষায়, "মরুভূমিতে দফ বেজে উঠেছে। আজকের দফ ঘোষণা করছে কিন্দ-গোত্রের আনন্দবার্তা। কিন্দ-রাজবংশের গোত্রযুবরাজ, মরুভূমির উজ্জ্বলতম যুবাপুরুষ ইমরুল কায়েসের বিয়ে। আরবের মরুভূমিতে যার মতো কবি কোনোকালে জন্মায়নি, সেই কবিশ্রেষ্ঠ ইমরুল কায়েসের বিয়ে।" (পৃ:১০)
বিয়ের আসরে ইমরুল কায়েসের সঙ্গীদের সাথে অবিশ্রান্ত রসালাপে উঠে এসেছে এমন সব বাচ্য ও চিত্র -- খুব সহজেই অনুমান করা যায় আরবের সেই সময়ের মানুষ কতটা আমুদে এবং সামাজিক ছিলেন। সঙ্গীদের মধ্যে আছেন দূরের-কাছের সকল গোত্রের গোত্রপতি এবং অভিজাত ব্যক্তিবর্গ, আছেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং সকল ধর্মের পুরোহিতবৃন্দ, আর জ্যেষ্ঠ থেকে শুরু করে তরুণতম কবি পর্যন্ত। কবিদের মধ্যে তরফা বিন আল-আবদ, আ'শা থেকে আল কামাহ পর্যন্ত।
আসরের মধ্যে বসে থেকেও প্রায় নির্লিপ্ত হয়ে আছে আল কামাহ। গরীব ঘরের সন্তান বলে কিছুটা হীনমন্যতায় ভোগা আল কামাহ'র তীব্র ঘৃণা রয়েছে ইমরুল কায়েসের প্রতি। কারণ, ইমরুল কায়েস একবার তার কবিতা নিয়ে জনসমক্ষে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল। জীবনে এতো অপমান বোধ কখনো করেনি আল কামাহ।
সঙ্গীদের প্রশ্নের উত্তরে এক পর্যায়ে ইমরুল কায়েস বলে ওঠেন, "আমার প্রেমাভিযান, আমার গর্ব প্রথম হোঁচট খেলো উম্মুল জুনদবের দুয়ারে। আমার সমস্ত সম্মোহন ব্যর্থ হলো তাকে ফাঁদে ফেলতে। তাকে পেতে হলে আমার বদলাতে হবে নিজেকে। প্রেম প্রেম খেলার বদলে সত্যিকারের প্রেমিক হতে হবে। আসলে আমি নিজেও নিজের অবচেতনেই সেই পরিবর্তন কামনা করছিলাম। যে জীবন আমি যাপন করছিলাম, সেই জীবনে বৈভব আছে কিন্তু প্রশান্তি নেই। উত্তেজনা আছে কিন্তু পরিপূর্ণ আনন্দ নেই।"
উম্মুল জুনদব একজন সুদক্ষ রাবি। অর্থাৎ প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন আবৃত্তিকার।
একজন কবি যদি একজন রাবিকে খুঁজে পায় তাহলে সে অমরত্বের দিকে এগিয়ে যায় এক ধাপ। তারা তাদের প্রিয় কবির কবিতা যখন আবৃত্তি করে শোনায় অভিজাত সমাবেশে তখন একটি কবিতা একজনের মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ে শত শত মানুষের বুকে। উম্মুল জুনদবের এই অহংকারটি টের পেয়েছিলেন ইমরুল কায়েস।
প্রেম এবং সম্মোহনের মধ্যে একটা যে পার্থক্য রয়েছে তা ইমরুল কায়েসের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে লক্ষনীয়। উম্মুল জুনদবকে পেতে ইমরুল কায়েসের প্রেমের চেয়ে একপ্রকার জেদ কাজ করছিল। সে কথা কায়েস নিজেই একসময় স্বীকার করেছেন। ওদিকে আল কামাহ উম্মুল জুনদবের রূপের প্রেমে পড়ে এবং ঈর্ষার আগুনে জ্বলতে থাকে।
"উম্মুল জুনদবের কথা রসালো গলায় পরিতৃপ্ত হৃদয়ে সঙ্গীদের কাছে প্রকাশ করার এক পর্যায়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে আল কামাহ চিৎকার করে বলে,
"কাব্য শিরোপা নয় এমন রমণী রত্ন লাভ করেই তুমি সত্যিকারের বিজয়ী হলে আর অভিশপ্ত এই আমার ভাগ্যকে শত ধিক্কার জানাচ্ছি এমন রত্ন আমার কপালে জুটল না।" (পৃ: ১৯)
"এই কষ্ট কে কোন ভাষায় রূপ দেবে আল কামাহ? লোকে ভাববে এই তীর ঈর্ষার। কিন্তু আল কামাহ জানে কেবল ঈর্ষা নয় তার চেয়ে অনেক অনেক গুন শক্তিশালী ধনুর্ধর তার তূণ থেকে অবিরল নিক্ষেপ করে চলেছে যন্ত্রণার ফুলশর। তার নাম প্রেম। মরুশ্রেষ্ঠ পুরুষ ইমরুল কায়েসের বক্ষলগ্না দয়িতা জুনদব জানে না, একজন অক্ষম প্রেমিকের বুকজুড়ে মরু সাইমুমের হাহাকার মাথা কুটে
মরছে। "( পৃ: ২০)
একটি নারীর কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে সবকিছু।
একটি সুন্দর মুখের ক্ষমতা এতটা আগ্রাসী। সচ্চরিত্র স্বভাবশিষ্ট আল কামাহ এখন আর কবি নেই। গোত্রের সবাই আল কামাহকে নিয়ে খুব চিন্তিত।
প্রেমিকা উম্মুল জুনদবকে নিজের স্ত্রী করে পাবার জন্য একের পর এক কৌশল আঁটতে থাকে আল কামাহ এবং সেখানে যোগ দেয় স্বামীর প্রতি প্রতিশোধপরায়ন উম্মুল জুনদব নিজেও।
"আরবের মরুবাসীর কাছে একজন কবি যে কত মূল্যবান, তা শুধু একজন আরবই অনুভব করতে পারে। কবি না হলে কেউ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হতে পারে না, জ্যোতির্বিদ্যার রহস্য শিখতে পারে না, দেবতার অস্ফুট ইঙ্গিতের রহস্য উন্মোচন করতে পারে না। " -- এমন বর্ণরায় শুধু মরুবাসীর কাছে নয় লেখক জাকির তালুকদারের কাছে কবির প্রতি প্রতিষ্ঠিত মর্যাদাই প্রকাশ পেয়েছে। 'কবি ও কামিণী' উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতাও এমন অসংখ্য বর্ণনাভঙ্গির মধ্য দিয়ে লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন।
লেখকের সুস্পষ্ট উচ্চারণ,
"মরুভূমিতে জীবন ও জীবিকার জন্য যুদ্ধ করতেই হয়। অন্য গোত্রের সম্পদ ছিনিয়ে আনার জন্য যুদ্ধ, আবার নিজের গোত্রের সম্পদ রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ, প্রয়োজন হয় বীর যোদ্ধা ও অস্ত্রের। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন কবির। কারণ যোদ্ধার হাতে কেবল অস্ত্র থাকলেই চলবে না, থাকতে হয় দৃঢ় মনোবল, সাহস আর শৌর্য। যে যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে বিসর্জন দেবে নিজের প্রাণ, তাকে নিয়ে মর্সিয়া রচনা করতে পারবে একমাত্র কবিই। তাই যে গোত্রের কবি নেই, সে গোত্রের কোন সম্মান নেই।" (পৃ: ২২)
বাসররাতে উম্মুল জুনদব ইমরুল কায়েসের কাছে ব্যক্তিগত দেনমোহর পরিশোধস্বরূপ কবিতা চেয়ে বসলে তিনি আপ্লুত হয়ে যান। একের পর এক ষোলোটি ছন্দে কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে নেকাব সরানো, চুলের কাঁটা খোলা, চুলের বন্যায় মুখ ডোবানো এবং অবশেষে পুরুষশ্রেষ্ঠ কবিশ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রমাণ করলো ইমরুল কায়েস উম্মুল জুনদবের কাছে।
এদিকে ইমরুল কায়েসের বিয়ের খবরে তিন তরুণীর মৃত্যু সংবাদে আহত হয়ে ঘোড়ার পিঠে পাগলের মতো ছুটে চলে চাচাতো বোন উনায়জার কাছে। মিখলাফে থাকা উনায়জা মনে মনে কবিকে ভালবাসতো। যেতে যেতে কবি ভাবেন, "উনায়জা যদি আত্মহত্যা করে, তাহলে আমারও বেঁচে থাকার কোনো অধিকার থাকবে না"। সেখানে কবি পৌঁছে গেলে উনায়জার মা-বাবা তাঁর জন্য পানাহারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দিন গড়িয়ে রাত কেটে গেলেও উনায়জার কোনো দেখা পাওয়া যায় না। এতদিন উম্মুল জুনদবকে বিয়ে করে নিজেকে মস্ত বড় সৌভাগ্যবান করা ইমরুল কায়েস আজ যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলো। হৃদয়ের কাছে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছে, উম্মুল জুনদবের প্রতি তার কোনো প্রেম ছিল না। ছিল তাকে নিজের দখলে আনার জেদ। সেই জেদ পূর্ণ হবার পর উম্মুল জুনদব তার কাছে একজন সাধারণ নারী হয়ে উঠেছে। আর ওদিকে ইমরুল কায়েস এখন উনায়জার প্রেমাসক্ত হয়ে বাড়ির ভেতর বাহির খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। ইমরুল কায়েসের দেওয়া প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ আঘাত-বেদনার ধকল কাটিয়ে ওঠার জন্য ইমরুল কায়েসের সাহচর্যের চেয়ে বেশি উপশম আর কোথায় খুঁজে পাবে উনায়জার মতো তরুণীরা।
"উনায়জার মনের উপরিতল চেয়েছে ইমরুল কায়েস চলে যাক, কিন্তু অতল-মন চেয়েছে ইমরুল কায়েস প্রত্যাখ্যানের এই ঠুনকো চেহারা দেখে যেন পিছু না হটে। উনায়জা জলকেলি করছে সখীদের সাথে। এমন সময় ইমরুল কায়েসের উপস্থিতিতে সবাই ভীষণ বিব্রত ও অপ্রকৃতস্থ হয়ে একে একে চলে যাবার পর উনায়জাকে থামিয়ে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন। বিস্মিত উনায়জা দেখতে পায় তার শরীরের ওপর নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কায়েসকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেবার পরিবর্তে সে বরং সর্বশক্তিতে আঁকড়ে ধরে।" (পৃ: ৪৪)
উম্মুল জুনদব ইমরুল কায়েসের কোনো খোঁজ না পেয়ে অন্তরের অতল থেকে উপলব্ধি করে, "ইমরুল কায়েসের মতো মানুষরা কোনোদিন কারো একান্ত হয়ে থাকে না। কোনো নারীরও একান্ত হয় না। কোনো পুরুষেরও একান্ত হয় না। কোনো গোত্রেরও একান্ত হয় না। এমনকি কোনো জাতিরও একান্ত হয় না। তবু পুরো একটি দিন ও রাত্রি কোথায় ছিল ইমরুল কায়েস তা জানার আগ্রহ কমে না উম্মুল জুনদবের। স্বামীর জন্য তার অন্তর হাহাকার করতে থাকে। স্বামীর কবিতার খাতায় উনায়জাকে নিয়ে নতুন তশবিব ( প্রেমের কবিতা) দেখে চোখ থেকে কষ্টের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে উম্মুল জুনদবের।" এই বর্ণনা পড়ে মন থেকে একটি কথাই বেরিয়ে আসে -- কবিরা যেমন প্রেমে বাঁধে তেমনই বাঁধে শোকে ও ঘৃণায়। তবুও কবির অপরাধ ক্ষমাযোগ্য হতে পারে, প্রতিশোধযোগ্য নয় -- এমনটাই হয়তো উপন্যাসের এক পর্যায়ে ইমরুল কায়েসের কাব্যপ্রতিভা এবং অন্তর্দৃষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে বলতে চেয়েছেন লেখক।
ওদিকে আল কামাহর পাগলামির খবরটা পৌঁছে গেছে উম্মুল জুনদবের কানেও। মরুভূমির তপ্ত বালুকণায় পায়ের লুপ্ত প্রায় চামড়া পুড়ে ছাই হয়ে বালুকণায় মিশে যাচ্ছে আল কামাহর। পুরো পা হারালেও সে বোধহয় হাঁটা বন্ধ করবে না। তার এই অবিশ্রান্ত হাঁটা কেবলই উম্মুল জুনদবের দিকে ।
আল কামাহ বিভিন্নভাবে উম্মুল জুনদবকে তার প্রেমের তীব্রতার কথা বোঝাতে থাকে। যেমন, "গরীব পরিবার ও গোত্রের সন্তান হয়েও আমি কবি হতে পেরেছি, আমার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবে সেটুকুই কি যথেষ্ট নয়? কবিতা রচনার জন্য ইমরুল কায়েস পেয়েছে অবকাশ, পেয়েছে অভাবশূন্য প্রাচুর্যময় জীবন, পেয়েছে জ্ঞানী শিক্ষিত মানুষের সাহচর্য, পেয়েছে অভিজাত জীবনচর্যার আদব-কায়দা, পেয়েছে নিজের প্রতিভার পরিচর্যা। অন্যদিকে আমি আল কামাহ কী পেয়েছি? পেয়েছি শুধু যুদ্ধ। দুঃখের সাথে যুদ্ধ, অভাবের সাথে যুদ্ধ, অবহেলার সাথে যুদ্ধ। তাই আমি শুধু কবি নই। আমি যোদ্ধাও।" একসময় উম্মুল জুনদবের মন বিগলিত হয়ে ভালবাসার স্পন্দন বিচ্ছুরিত হতে থাকে আল কামাহর জন্য। এখানে লেখক ইমরুল কায়েসের আভিজাত্য ও প্রতিপত্তিকে কবিতার মাপকাঠি হিসেবে দাঁড় করান এবং আল কামাহর কাব্যপ্রতিভাকে প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং এটাই পুরো ঘটনাকে অন্য দিকে নিয়ে যায়।
আল কামাহকে স্বামী হিসেবে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে কবি লড়াইয়ের আয়োজন করে উম্মুল জুনদব। নিজেকে বিচারকের আসনে বসিয়ে ইমরুল কায়েস ও আল কামাহর মধ্যে ছলচাতুরী করে আল কামাহকে জিতিয়ে দেন। পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে আল কামাহকে বিয়েও করে উম্মুল জুনদব।
এই দুঃখে ইমরুল কায়েস পাগল প্রায় হয়ে ঘুরে বেড়ান মরুভূমির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। মরুভূমির কবিশ্রেষ্ঠ পুরুষশ্রেষ্ঠ আজ দিকশূন্য!
একদিন ইমরুল কায়েসকে হত্যা করার জন্য আল কামাহ ও উম্মুল জুনদব ভাড়াটে খুনি পাঠায়। সেখানে শত্রু মোকাবিলা করার সময় ইমরুল কায়েসকে সহযোগিতা করে আনতরা নামে এক কালো বর্নের তরুণ যার পিতা আরবের আরেক গোত্রের গোত্রপতি শদ্দাদ কিছুদিন পূর্বেই দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। যদিও শদ্দাদের ঔরসেই জন্ম হয়েছিল আনতরার। আনতরাকে তো আর এমনি এমনি মুক্তি দেয়নি। পিতা ও তিন হাজার উটকে ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করেছে আনতরা। তার আগ পর্যন্ত আনতরাকে দাস হিসেবে ব্যবহার করতো শদ্দাদ। ডাকাতের আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে পিতা যখন আনতরাকে প্রথমে হুকুম করে এবং পরে অনুনয় করে বাঁচাতে বলে তখন আনতরা বলে ওঠে, "কেন যুদ্ধ? কার জন্য যুদ্ধ? যুদ্ধে জিতলে কার লাভ? লাভ শুধু মালিকেরই। আনতরা যে গোলাম সেই গোলামই থেকে যাবে। গোলামের জীবন-মৃত্যু দুই-ই সমান।" দাসপ্রথা-বিরোধ কিংবা মানবাধিকারবোধ নিয়ে ওই অন্ধকার যুগেও কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেন আরব দেশে -- আনতরা চরিত্রটি নির্মাণ করে লেখক সেটা প্রমাণ করতে চেয়েছেন।
ইমরুল কায়েসের পিতা হজরকে হত্যা করেছে তাদের অধীন গোত্র বনু আসাদের কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী। এটা শোনার সাথে সাথে হা হা শূন্যতায় আক্রান্ত হয় ইমরুল কায়েসের বুক। লেখকের ভাষায় "ইমরুল কায়েস বিড় বিড় করে যা বলে তাতে পিতার প্রতি গভীর আবেগ, পিতাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ভালবাসার ব্যক্তি এটাই প্রমাণ করে। ইমরুল কায়েস বলে, ছোঁব না! শরাব স্পর্শ করব না! গোশত স্পর্শ করবো না! যতদিন পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারব, ততদিন এই দেহের কোনো যত্নও করব না। চিরুনি বুলাবো না কোনদিন চুলে। তেলস্পর্শ পাবে না মাথার চুল, শরীরের কোন অংশ।" দেবতার চেয়ে জন্মদাতা পিতাই বড় -- এমন আবেগকে সঙ্গে নিয়ে দেবতার নিষেধ থাকা সত্বেও, এমনকি নিজের মৃত্যু অবধারিত জেনেও ইমরুল কায়েস বেরিয়ে পড়ে।
উম্মুল জুনদব এগিয়ে আসে ইমরুল কায়েসকে পিতৃহত্যার প্রতিশোধে সহযোগিতা করার জন্য। তাকে রোম সম্রাটের সাথে দেখা করতে বলে সম্রাটের সহযোগিতা নেবার জন্য। উম্মুল জুনদব বলে, "সম্রাট অনেক রাজ্য জয়ের পরে এখন নাম করতে চান জ্ঞানী-গুণী এবং শিল্পীর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। কারণ তিনি এটুকু এখন বুঝেছেন যে রাজ্যজয় আর ধনসম্পদ মানুষকে অমর করতে পারে না। অমর হতে হলে তার দরকার কবিকে। একমাত্র কবিরাই পারে তুচ্ছতম মানুষকেও অমর করতে।" সম্রাটের সাথে দেখা করতে যাবার জন্য যত প্রস্তুতি সবই উম্মুল জুনদব করে রেখেছে -- চারটি ঘোড়ার বহর, সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হবার মতো পোশাক, এক সহস্র আশরাফি এবং দরবারে পাঠ করার জন্য ইমরুল কায়েসের কবিতার খাতা।
উপন্যাসটি যেভাবে শেষ করেন জাকির তালুকদার তার ভাষার বুনন এবং যাদুকরী উপস্থাপন দিয়ে তাতে উপন্যাসটিকে একটি ট্র্যাজিক উপন্যাস হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়।
" তিন দিন আগে উম্মুল জুনদবের দেওয়া পোশাক পরে, তার দেওয়া ঘোড়ার পিঠে চড়ে, তার দেওয়া অর্থ ও পত্র নিয়ে রওনা দিয়েছিল ইমরুল কায়েস। তখন মনে ছিল বিপুল উদ্যম আর আশা। আর আজ সে পড়ে আছে দিকচিহ্নহীন মরুভূমির মধ্যে। মাথার ওপরে উড়ছে শকুন। মূমুর্ষু অবস্থায় ধুঁকছে সে। তার গা থেকে খসে খসে পড়ছে চামড়া, মাংস। উম্মুল জুনদবের আদর করে পরিয়ে দেওয়া বিষমাখা পোশাক কাজ শুরু করেছে সুনির্দিষ্ট সময়ে, যখন ইমরুল কায়েসেকে সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না পাশে। উম্মুল জুনদবের সবকিছুই নিখুঁত হিসাব করা থাকে।"
উম্মুল জুনদবের এমন দানবীয় প্রতিশোধপরায়ণ রূপ সত্যিই মনে করিয়ে দেয় সেই সময়ের প্রেম-প্রতিশোধ কতটা সর্বনাশা, বিধ্বংসী ছিল। মানুষের আদিরূপের সাথে স্বল্প জ্ঞান যুক্ত হলে তা যে তাকে বৃহত্তর মানবিক চিন্তার সাথে একাত্ম না করিয়ে পশ্চাৎপদ করে রাখে উম্মুল জুনদব তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
অন্ধকার-সময়ের এমন এক প্রেমোপাখ্যানকে ঘিরে রচিত জাকির তালুকদারের বই 'কবি ও কামিণী' আলোকিত করেছে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতাকেই।
উপন্যাসটি পড়া শেষ হবার পর উপলব্ধিটা এমন হয় যে কবি ও কবিতার প্রতি আমাদের হৃদয় শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় পূর্ণ হয়ে যায়, অন্তর্দৃষ্টিতে যুক্ত হয় বৈভবের স্ফুরণ, প্রেমের জন্য আকাঙ্ক্ষা, অপ্রাপ্তির জন্য বেদনা; আর প্রতিশোধপরায়ণ হৃদয়ের জন্য অসীম তীব্র ঘৃণা।
আর শুরুতে যে-কবিতাটি উদ্ধৃত হয়েছে তা ইমরুল কায়েস সম্পর্কে বলা হলেও এটি যে-কোনো শিল্পী লেখকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এটি এই লেখকের নিজেরই আদর্শকে ব্যক্ত করেছেন। জাকির তালুকদারকে কৃতজ্ঞতা জানাই এরকম অসামান্য প্রেমের এক উপখ্যানকে তিনি সমকালের জন্যও প্রসাদগুণে ও শৈল্পিক নৈপুণ্যে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।