তার কাব্যের ছন্দ, শরীর রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমি-র কবর খুঁড়ে তুলে আনা।
Published : 26 Nov 2023, 01:29 PM
সোহেল হাসান গালিবের গদ্য তীব্র, তীক্ষ্ণ কৌতুকরসে অনবদ্য। পোয়াতি স্যামন মাছের মতো উজানপ্রিয়, যাত্রাপথ বিপদসংকুল জেনেও লক্ষ্যে সে অদম্য। ক্ষোভকে তিনি ঠাট্টা ও কৌতুকে মুড়িয়ে ছুড়ে দেন পাঠকের দিকে। পরস্পরবিরোধী ভাবনাকে তিনি কলহপ্রিয় প্রতিবেশীর মতো এক জায়গায় বসিয়ে বাক্যকে কলরবমুখর করে তোলেন। এই গদ্য শয়তানি শান-শওকত নিয়ে নির্ভয়ে প্রকাশ করে তার উশকানিপ্রখর জেল্লা। অন্যরা যখন বাক্যগুলোকে নিষ্প্রাণ বিদ্যুতের তারের মতো বিছিয়ে রাখেন, গালিব তখন ওই তারের মধ্যে বৈদ্যুতিক সংযোগ ঘটিয়ে পাঠককে স্পৃষ্ট করেন, ঠিক যেমনটা মৃতপ্রায় রোগীকে ডাক্তার ডিফিব্রিলেটর (defibrillator) দিয়ে সরব ও সচল করে তোলেন । এই লেখাটি তার প্রকাশিতব্য আমার খুতবাগুলি গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। বি.স.
১
হুমায়ুন কবিরের মতে, দেশের গণ-মানসের অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাব্যে রূপান্তরিত করতে পারাই জসীমউদ্দীনকে কাব্যসিদ্ধি দিয়েছে; কিন্তু সে-শক্তি পশ্চাৎমুখী বলে তা নতুন নতুন রাজ্যজয়ে অগ্রসর হতে পারেনি। কথাটা ভেবে দেখার যোগ্য।
- আনিসুজ্জামান
'দেশের গণ-মানসের অন্তর্নিহিত শক্তি' একটা আজগুবি কথা। বলা উচিত ছিল 'গণমানসের গদগদ গ্রাম্যতার অন্তর্নিহিত ভক্তি'। তবেই তা জুতসই হতো। এবং এই ভক্তি হঠকারী বলেই তা রাজ্যজয় নয়, রাজ্যক্ষয়ে কার্যকরী।
২
পাবলিক প্রোপার্টিকে প্রাইভেট প্রোপার্টি বানানো এবং তা দিয়ে নিজের গরিমা বৃদ্ধি—এই কাজটাকে আপনারা কিভাবে দেখেন?
পাবলিক প্রোপার্টির বাংলা ধরা যাক লোকসম্পদ।
লোকসাহিত্য সংগ্রহের একটা ঢেউ এসেছিল কলোনিয়াল যুগে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন উন্মেষের কালে। তাতে যুবক রবীন্দ্রনাথসহ আরও অনেকে বিপুল উৎসাহে সাড়া দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের রীতিমতো একটা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই লোকসম্পদ কুড়ানো, নিজের মতো অদল-বদল করে শহুরে লোকদের দেখানো। এর সব থেকে জ্বলজ্বলে উদাহরণ দীনেশচন্দ্র সেন।
দীনেশবাবুরা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশ কিছু গাথা-কুড়ানি টাইপের স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছিলেন। এটা ঠিক যে তাদের কল্যাণে আমরা লোকসম্পদের ঐশ্বর্য টের পেয়েছি।
জসীমউদ্দীন এই প্রকল্পের একজন স্টাফ। বাট, প্রকল্প-পরিচালকের চেয়ে একটু বাড়া। তিনি বেশ কিছু গান কাট-ছাঁট করে এমনভাবে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন যে, আমরা ভাবতে প্ররোচিত হয়েছি এসব বুঝি তারই রচনা। ফলে, যে গৌরব পাবার কথা ছিল অখ্যাত লোককবির, তা গিয়ে বর্তেছে জসীম নামের কবি-ধামে।
দেহতত্ত্বের গানগুলিকে প্রণয়গীতে রিডিউস ক'রে বাংলার সাধনমার্গের যে সর্বনাশ তিনি করেছেন, তা নিয়ে কিন্তু কোনো আলাপ নাই। প্রতিবাদ নাই।
অথচ, রবীন্দ্রনাথ বাউলদের ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাদের ভাব চুরি করেছেন, খাতা ছিনতাই করেছেন ইত্যাদি নানারকম অভিযোগ লোক-দরদি ঠিকাদারদের মুখে শোনা যায়।
কিন্তু যে ব্যক্তি পাবলিক প্রোপার্টিকে প্রাইভেটলি পেটেন্ট করে নিলেন, তার ব্যাপারে তাদের কোনো উচ্চবাচ্য নাই। এরই নাম জাতীয়তাবাদী জজবা।
রকব্যান্ড জসীমউদ্দীনের জয়...
৩
জসীম নিজেই পশ্চিমা রাখালি কাব্যের বঙ্গীয় সংস্করণ এবং রবীন্দ্রতলাপাত্রবাহী বনমালী। তার কাব্যের ছন্দ, শরীর রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমি-র কবর খুঁড়ে তুলে আনা। বাংলার ভাবসম্পদের মিনিমালিস্ট মিমিক্রি হলো জসীমের কবিতা।
এখনকার বাউল ব্যান্ডগুলির সাথে তার পার্থক্য সামান্যই। বাউল ব্যান্ড প্রকৃত অর্থেই অনুর্বর, হাইব্রিড ও পরস্ব আত্মসাৎকারী নটরাজ। যাদের একমাত্র কাজ, তাদেরই ভাষায় 'ফিউশন', খাস বাংলায় যাকে বলে জোড়াতালি।
৪
জসীম একটি চালাক ছেলে। কেমন চালাক? নবম শ্রেণির সেই দুষ্টু বালকের মতো—যে কিনা বন্ধুর খাতা দেখে পরীক্ষা দেয়, অথচ বন্ধুর চেয়ে নাম্বার বেশি পায়।
যে গ্রাম আর গ্রামের ধুলার মধ্যে 'আল্লা মেঘ দে পানি দে' বলে গড়াগড়ি খেয়ে বিখ্যাত হলো জসীম, সে গ্রামে কিন্তু একচুয়ালি সে থাকে না। তাই অন্যদের ডাক দেয় : 'তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়'।
কেমন পাঁজি দেখেন! শহরের সুবিধা ত্যাগ করে আপনি যদি যেতে রাজি হন, তবেই সে যাবে, নচেৎ নহে। অবশেষে দেখা গেল কোনো শেয়ালই লেজ কাটতে উৎসাহী না। মানে শহুরে ভ্রাতাগণ গ্রামে বেড়াতে যেতে সম্মত হলেও সেখানে বসত গড়তে কস্মিনকালেও চাহে না। তাদের মনে আছে এই মন্ত্র : যদি পড়ে কহর, তবু না ছেড়ো শহর।
এই কারণে চালাক জসীমকে আবার কবিতা লিখতে হলো :
এমন নগর গড়বে তুমি সকল কোণে তার
সমান হয়ে উদাস বাতাস বইবে অনিবার।
মানে, এবার আইসো আমরা শহরকে গ্রাম বানাই।
এই ডাকে সিটি কর্পোরেশন সাড়া না দিলেও কচি কচি কবিচিত্ত ঠিকই টাল খেয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। তারপর আনন্দে গড়াগড়ি দিতে গিয়ে নিজেরাই কেটেছিঁড়ে ফেলল নিজেদের বুকপিঠ।
কারণ শহরের রাস্তাটি সেই গ্রামছাড়া রাঙামাটির পথ নয় গো, এ যে কালো পিচঢালা পাথুরে পথ। তাও আবার দুই নম্বর পাথর, দুই নম্বর খোয়া।
৫
'যে আমার হোগা মারছে, আমি তার সোনা বান্ধায়া রাখতে চাই'—এমন একটা অশ্লীল মর্ষকামিতার কাব্য-প্রতিরূপ কী হতে পারে?
তা জানতে আপনাদের একটু ফিরে তাকাতে হবে বাংলার নায়ক জসীমের পানে। 'প্রতিদান' নামের একটি সিনেমায় তিনি কাতরে উঠেছেন এই বলে :
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
—এই যে আজাইরা কান্নাকাটি, এর মধ্যেও একটা ছল আছে। সেটা কিন্তু নজরুলের 'শিকল-পরা ছল' নয়। সেটা হলো লড়াই না করার ছল।
তবে কি গ্রামের মানুষ লড়াই-প্রতিরোধ জানে না? কেবলই হুক্কা খায় আর যাত্রা দেখে? তাঁতিপল্লির পানের দোকানদার লালনও কিন্তু গেয়ে ওঠেন : 'মাতবর কানা চোগলখোরে'...
এই মাতবরই তো আমাদের ঘর ভাঙে, সীমানা দখল করে। তারে জসীম ভাই আপন করতে চায় কেন? কুষ্টিয়ার চিনি-ব্যবসায়ী, বিশিষ্ট কৃষিবিদ ড. রবিন এসব শুনে হুঙ্কার ছুড়েছেন :
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে।
কিন্তু জসীম একটি চালাক ছেলে। সে তার দুর্বলতা পীরিতির চাদর দিয়া ঢাইকা রাখতে চায়। খুব খারাপ। এই পীরিতির চর্চা ভয়ঙ্কর। কলোনিয়াল করোনা ভাইরাস।
৬
রবীন্দ্রনাথের থাবা থেকে বাঁচার জন্য তিরিশের বাবাগণ গিয়েছিলেন ইউরোপের দিকে। আমাদের শেকড়-খেকো মন এতে ব্যথিত হলেও বাংলা কবিতার গাছে নতুন ফুল ও ফল যে এসেছিল তাতে, সে আলাপ অন্যত্র করা যাবে।
আর জসীম কাকু রবীন্দ্রনাথের বগলচাপের ধকল সইতে না পেরে আঁকুপাঁকু করেছেন চরাক্ষেতের আইলের পাশে। কেন করেছেন সে ব্যাখ্যায় যাব না।
কিন্তু এখানেই তার সমস্যা। তিনি চরাক্ষেত থেকে নানারকম শিকড়-বাকড় কুড়িয়েছেন। তাতে কলম লাগিয়ে টবে চাষ-উপযোগী চারাও উৎপাদন করছেন। এবং আমাদের পল্লিমায়ের কোলচ্যুত স্মৃতিকাতর পাঠকগোষ্ঠীর মন ভোলাবার ফুরসত পেয়েছেন বেশ কয়েক দশকের জন্য। জসীমউদ্দীনের ভেতর দিয়ে সে পাঠক আশলে জসীমকে নয়, বাংলার গুড়, মধু, দুধ আস্বাদনের স্মৃতি হাতড়ে ফিরেছেন, কোক-স্প্রাইট-ললিপপ খেতে খেতে।
চমৎকার কিছু উপমা-উৎপ্রেক্ষায় আমরা কাবু হয়েছি ঠিকই, কিন্তু তাতে নতুন কোনো চিন্তা যোগ হয় নাই। যোগ হয় নাই, তার কারণ তিনটা :
১ ঔপনিবেশিক বাঙালি মুসলমানের মজ্জাগত সমস্যা হলো এরা কেবলি পুথিসাহিত্যের দিকে যেতে চায়। এবং তার মধ্যে সে তার ক্ষমতাবঞ্চিত হারানো হিয়ার সান্ত্বনা লাভ করে।
২ জসীম নজরুলের মতো পলিটিক্যালি ভায়াব্র্যান্ট ছিলেন না। ছিলেন অ্যাপলিটিক্যাল। এ কারণে লোকজ উপাদানকে সমকালীন আকাঙ্ক্ষায় যুক্ত করতে পারেন নাই, স্মৃতিতে পর্যবসিত করেছেন।
৩ অ্যাস্থেটিক্যালি পশ্চিমা কাব্যতত্ত্ব সম্পর্কে স্বেচ্ছায় বা অনন্যোপায় হয়ে বিরূপতা পোষণ করার ফলে গ্রাম-সরকারকে নতুন রূপ দিতে পারেন নাই। শুধু তার হাড় কালাই হয়েছে। তাতে আগুন ঝলসে ওঠে নি।
এর ফলে বন্দে আলী মিয়া ছাড়া আর কোনো কবিকে তার কবিতা বন্দনা করতে দেখা যায় নি, দীর্ঘকাল। কিন্তু এখন বাঙালি-মুসলমানের জাতীয়তাবাদী জজবা তাকে কবর থেকে তুলে আনার কোশেশ করছে বলে মনে হয়। দিকে দিকে জাগছে বন্দে আলী, ইয়া আলি...
৭
জসীমউদ্দীনের কাব্যশক্তি পশ্চাৎমুখী বলে তা নতুন নতুন রাজ্যজয়ে অগ্রসর হতে পারেনি।
- হুমায়ুন কবির
দুর্বল অনুবৃত্তির কারণে জসীম একটি করুণা-ক্যানেলে পর্যবসিত। নিজের প্রতিভার প্রতি এ রীতিমতো অত্যাচার।
- দীনেশচন্দ্র গালিব
সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা
সবচেয়ে খারাপ কবিতা ও গান রচিত হয়েছে দেশাত্মবোধের দোহাই দিয়ে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। এর কারণ সম্ভবত আমাদের নাবালকীয় চিন্তাহীনতা, জাতীয়তাবাদী আবেগ ও মফস্বলি হৃদয়।
'মফস্বলি হৃদয়' বলতে আমি সেই কবি-ব্যক্তিত্বের কথা বলছি, যে কিনা আত্মপ্রতিষ্ঠার ফিকিরে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিল। তারপর সাফল্য বা ব্যর্থতা যাই ঘটুক, গ্রামে আর ফিরতে চাইছে না।
কিন্তু নগরের ঠাপ-খাওয়া শিশুমন সুযোগ পেলেই নদীতীর, কাশবন, ধান-দূর্বা, সোঁদা মাটি, গোবর ইত্যাদিতে লেপ্টে যেতে চায়। সেটা কিন্তু শহরের ঝাঁ-চকচকে টয়লেটে বসে।
এদের জন্য আদর্শ কবি হলো জসীমউদ্দীন। এরা কাব্যে নতুন চরের মতো প্রিয়ার মুখানি কল্পনা করে, অথচ গ্রামের মেয়ে বিয়ে করতে বেজায় বিমুখ।
এই যে আলগা গ্রামপ্রীতি, এর গালভরা পোয়েটিক ডিকশন হলো 'কবিতার ভূগোল', 'নিজস্ব ভূমি' ইত্যাদির নির্মাণ। কবিতার মধ্যে কবিতার বদলে এরা তাই মানচিত্র খুঁজে হয়রান—এবং স্থানাংক, আই মিন, অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা।
সত্যিকার অর্থেই মানচিত্রের মতো এসব কবির মানসপটে গ্রাম একটা স্থির প্রত্যয় নিয়ে জেগে থাকে। এ কারণে কবিতায় তার পুনরুৎপাদন মানে স্থবিরতার পুনর্জন্ম। প্যালেনজেনেসিস অব প্যারালাইসিস।
এ সমস্তই নাবালকের জাতীয়তাবাদী মফস্বলি প্রয়াস বা প্রকল্প বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ব্যাপারটা এত নিরীহ নয়। এর মধ্যে আল্ট্রান্যাশনালিজমের আভাস আছে। যা পাঠককে টোটালিটারিয়ান করে তোলে বা তুলতে চায়।