বাঙালির এক বিশ্ববান্ধবের শারীরিক প্রয়াণ ঘটলেও, তিনি আমাদের ইতিহাস ও শিল্পের ঐতিহ্যের সঙ্গে বহমান থাকবেন চিরকাল।
Published : 12 Nov 2024, 09:30 PM
১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে আমার অনুবাদে টেড হিউজের নির্বাচিত কবিতা নামে একটি গ্রন্থ বেরিয়েছিল। বাংলাদেশ তখন বলতে গেলে টেড হিউজের জ্বরে আক্রান্ত। সেই জ্বরের তাপ রীতিমত টাইফয়েডের উচ্চতায় পৌঁছেছিল যখন তিনি ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে এশিয় কবিতা উৎসবে বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। অনেকেই তখন টেউ হিউজ( সম্পাদক ও ইংরেজি সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী তৌফিক ইমরোজ খালিদীর মতে সঠিক উচ্চারণ ‘হিউজেস’। তবে এই সঠিক উচ্চারণ জানার আগেই আমরা ওই ভুল উচ্চারণের অনুবর্তন চালিয়ে গেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে, বিশ্ববিদ্যালয়-বহির্ভূত লেখক-পাঠকরা।) আমার সুযোগ হয়েছিল ব্রিটিশ কাউন্সিলে তাঁর কন্ঠে নিজের কবিতাপাঠ শোনার, তাঁর সাথে কথা বলার এবং তাঁর Selected Poems 1957-1981 বইটিতে স্বাক্ষর পাওয়ার।
যদিও তিনি বাংলাদেশ সফরের আগে থেকেই তাঁর কবিতা অনুবাদ করে আসছিলাম। কিন্তু সেসব কবিতা গ্রন্থাকারে বাংলা একাডেমি থেকে বেরুতে বেরুতে ৯৩ সাল গড়িয়ে যায়। আর এই বইটির একটি কপি তারও বছর তিনেক পর পাঠিয়েছিলাম আরেক ইংরেজ লেখক উইলিয়াম রাদিচেকে যিনি কবি, অনুবাদক ও গবেষক হিসেবে তখনই খ্যাতিমান আমাদের কাছে। তাঁর খ্যাতির মূল কারণ ছিল তিনি বাংলা ভাষা জানেন। কেবল জানেনই না, রবীন্দ্রনাথের কবিতা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার কারণে তখন তাঁর জগতজোড়া খ্যাতি। খুশবন্ত সিং তাঁর অনুবাদের তারিফ করছেন। বাংলা ভাষার শীর্ষস্থানীয় কোনো কোনো রবীন্দ্রগবেষকও তাঁর বাংলা ভাষাজ্ঞান ও তর্জমায় পঞ্চমুখ। এমন যার ভাষাজ্ঞান ও সাহিত্যবোধ তাঁর কাছে টেড হিউজেসের কবিতার তর্জমার একটি কপি পাঠাবো না! আমার বয়স কম, ফলে যৌবনের উচ্ছ্বাস থেকে রাদিচের মতো একজন বিখ্যাত জনের অভিমত জানার আগ্রহ তৈরি হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কার কাছ থেকে যেন তাঁর SOAS-এর ঠিকানা জোগার করে বইটি বেরুনোর তিন বছর পর একটি কপি পাঠিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল সৌজন্যমূলক এক চিঠি। চিঠিতে তাঁর লেখা সম্পর্কে আমার ভালো লাগার কথাও বলেছিলাম। ততদিনে আমি তাঁর রবীন্দ্র-কবিতার অনুবাদ এবং বাংলায় প্রকাশিত (সম্ভবত বাংলা একাডেমি থেকে) তিনটি প্রবন্ধের একটি সংকলন পড়ে খানিকটা ওয়াকিবহাল ছিলাম। সেসব নিয়ে ছিল আমার প্রতিক্রিয়া। যদিও আমার জানার বাইরে বাংলা ভাষা নিয়ে আরও বেশ কিছু কাজ করে তিনি সুনাম অর্জন করেছেন। যাইহোক, চিঠি আর বইয়ের কপি পাঠিয়ে আমি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি তাঁর উত্তরের। কিন্তু মাস গড়িয়ে যায়, তাঁর কোনো সাড়া নেই। আরও এক মাস, তিনি নিরব। আমি ধরেই নিয়েছি হয় তিনি আমার চিঠি পাননি, অথবা পেলেও তার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করছেন না। সম্ভবত আড়াই মাস পরে আমার অফিসের ঠিকানায় লন্ডন থেকে থেকে একটি চিঠি এলো। চিঠির খামের এক পাশে তাঁর নাম আর SOAS দেখে আমি রীতিমত উত্তেজিত ও বিহ্ববল। খাম খুলে দেখি টাইপ করা নয়, একেবারে তাঁর নিজ হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার এক দীর্ঘ চিঠি! ওই বয়সে ওরকম একটা চিঠি পাওয়া কী যে গৌরবের তা বলে বোঝানো যাবে না। আমার মতো অজ্ঞাতকুলশীল এক অনুবাদকের চিঠির জবাব তিনি দিয়েছেন এবং বইটি পড়ে তার তারিফও করেছেন—এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! ২৯-৪-৯৬ সালে তিনি যে উত্তর পাঠিয়েছিলেন তা হুবহু নিচে তুলে দিচ্ছি:
Dear Razu Alauddin,
I have been shamefully slow to thank you for your kind latter and for the copy of your translations of Ted Hughes poems. Your latter is undated, so I am not sure when it came; but I think it was at least two months ago. I was appallingly busy last term and then had to catch up with writing commitments in the Easter vacation –so I have only recently found this to look at your book. I also wanted to compare your translation with the original. I have the Crow poems at hand and I must say I take my hat off to you for reading such lines as
Will this cipher divulge itself to digestion
Under hearing beyond understanding?
Crow Communes/ কাক সম্প্রদায়
I wonder if when you finished your translations you admired Ted Hughes as much as you did at the beginning. Translation is, I found, a very good test of the quality of the poem. Weak poems are mercilessly exposed when one tries to translate them.
Your warm interest in my own work is very encouraging –far more than I deserve. My career becomes even more mysterious for me: what strange কপাল is it that makes me increasingly well known and understood thousands of miles from my homeland, yet little known here? May be something will come up the big book of poems I am working on now, which I hope to complete by the end of 1998. I enclose one short poem from it, which may suit your translation style. I am intrigue to know whether the form I have used -- the same word at each pair of lines—is easily translatable into another language, with a different syntax.
I hope we shall meet next time I come to Bangladesh (which may not be till the summer of 1998)
With best wishes, yours sincerely
William Radice
আমি খুব মজা পেয়েছিলাম তাঁর চিঠিতে ‘কপাল’ শব্দটি হুবহু বাংলায় লিখেছেন দেখে। আর চিঠিতে তাঁর নিজের রচনা সম্পর্কে বিনয় ও আমার কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য অনুগ্রহ করে নিজের কবিতা পাঠানো--এসব দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম খুব। উপরন্তু, অনুবাদের ধরন ও কলাকৌশল নিয়ে খুবই স্বচ্ছ এবং গভীর উপলব্ধির কথাও জানাতে কার্পণ্য করেননি। তাঁর মতো একজন রবীন্দ্র-অনুবাদক-বিশেষজ্ঞ যে সময় করে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন এ ছিল আমার জন্য সত্যি খুব শ্লাঘার বিষয়। আমার সেই অনুবাদের প্রতি এখন আর অতটা ভালো লাগা নেই। কিন্তু তাঁর তারিফ আমার জন্য অমূল্য সঞ্চয় হয়ে আছে।
২.
রাদিচেকে আমরা মূলত রবীন্দ্র-অনুবাদক হিসেবে জানলেও, বাংলাসাহিত্য নিয়ে তাঁর প্রথম কাজ কিন্তু রবীন্দ্রনাথেরও আগের এক প্রধান লেখককে নিয়ে, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর পিএইডি মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য নিয়ে, তিনি এর ইংরেজি অনুবাদও করেছিলেন। মেঘনাদবধ কাব্য-এর অনুবাদ আরেক বাংলা-সাহিত্যপ্রেমিক ক্লিন্টন বুথ সিলিও করেছিলেন। তবে কবি ও অনুবাদক কায়সার হকের মতে, ক্লিন্টন বুথ সিলির তুলনায় রাদিচের অনুবাদটি নাকি বেশি মূলানুগ ও উপভোগ্য। মাইকেলের এই অমর মহাকাব্যটি তাঁদের হাতেই রচনার শতাধিক বর্ষ পরে প্রথমবারের মতো ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছিল। এটা বাংলাসাহিত্যের জন্য বিশেষভাবে গৌরবের এতে কোনই সন্দেহ নেই। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথ জগতজোড়া আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে আসবেন, এ তো সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু একজন সাহেবের পক্ষে মাইকেলের মতো ভাষিক দুরূহতায় মণ্ডিত এক কবির একটি দীর্ঘ ও জটিল রচনাকর্মে আগ্রহী হওয়া, এবং তা অনুবাদের মতো ততোধিক জটিল কাজ স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেয়া—এমনটা খুব একটা ঘটতে দেখা যায় না। কিন্তু রাদিচে দুঃসাহসী অভিযাত্রীর মতো সেই কাজটাই করেছেন নিষ্ঠার সাথে বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে। শুধু তো এসবই নয়, Myths and legends from India নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের Selected Poems ছাড়াও তিনি মূল থেকে গীতাঞ্জলি, চতুরঙ্গ এবং ডাকঘর ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সেরা গল্পসমূহও তিনি অনুবাদ করেছেন। এবং অবাঙালি বিদেশিদেরকে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য বাংলা ভাষা বিষয়ক Bengali Teach yourself শীর্ষক বইও তিনি লিখেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা তা সত্যিই তুলনাহীন।
রাদিচের অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মগুলোর একটা বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে বহু বছর পর, অন্তত রবীন্দ্রাথের মৃত্যুর পর রাদিচেই আবার কোনো ইংরেজ অনুবাদক যিনি মূল থেকে অনুবাদ করেছেন। তাঁর আগে বিদেশি কেউ কেউ করে থাকতেন পারেন, কিন্তু তাঁরা কেউ-ই রাদিচের মতো গুণগত মানে যেমন পৌঁছুতে পারেননি, তেমনি তা ব্যাপক মনোযোগও আকর্ষণ করেনি। বুদ্ধদেব বসু সেই পঞ্চাশের দশকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “তাঁর উত্থানের মাত্র দুই দশকের মধ্যে, প্রতীচীতে মৃত্যুলাভ করেছিলেন।” (বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধসমগ্র, বুদ্ধদেব বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, জানুয়ারি ২০১০,পৃ ৩৯৭) বুদ্ধদেব বসু তাঁর এই অভিমতের পাশাপাশি বিদেশি প্রতিক্রিয়াও তুলে ধরেছিলেন: “১৯১২-১৩ সালের আবহাওয়া থেকে প্রতীচী আজ কত দূরে সরে এসেছে তার নিদর্শনস্বরূপ একজন মার্কিনি সমালোচকের মন্তব্য উদ্ধৃতি করি: ... for most non-Indians, he [Tagore] is no longer living... For us, he is not part of a living tradition,' " (প্রাগুক্ত, পৃ ৪০৪) সন্দেহ নেই যে তাঁর এই মৃত্যুর পেছনে একাধিক কারণ ছিল, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য ছিল অনুবাদে মূলের প্রসাদগুণের অভাব। দ্বিতীয়ত, যারা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ কিংবা আলোচনায় যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে ততটা সক্ষমতার পরিচয় দেননি, যেমনটা ঘটেছে রাদিচের অনুবাদ ও আলোচনায়। ফলে ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেও তিনি দ্রুতই এক বিলীয়মান স্মৃতিতে পর্যবসিত হতে থাকেন প্রতীচ্যের দেশগুলোয়। কয়েক দশকের ব্যবধানে তাই রাদিচের আবির্ভাব এক ঐতিহাসিক ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ যে শুধুই সাধক ও মরমী পরিচয়ের আলখেল্লাধারী প্রাচ্যের কোনো ঋষি নন, তিনি যে মূলত শিল্পী, সাহিত্যের সবগুলো শাখায় শিখরছোঁয়া এক রক্তাক্ত আর্তনাদ, বিশ্বজনীন ভাষ্যের এক কালতিক্রমী শিখা—এই ভাবমূর্তিরই পুনরুদ্ধারে রাদিচের ভূমিকা অগ্রগণ্য। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে পশ্চিমের শীর্ণকায় আগ্রহকে তিনি নতুনভাবে পুনরুজ্জীত করেছেন রবীন্দ্ররচনার অনুবাদ ও ভাষ্যের মাধ্যমে। এই কারণে রাদিচের কাছে বাঙালির ও বাংলাভাষীর ঋণ সীমাহীন। বাংলা সংস্কৃতির সাথে ইংরেজি পাঠকদের সেতুবন্ধনে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা অপরিমেয়।
আমার আফসোস হয় এই মানুষটির সাথে কেন দেখা হলো না। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন ১৯৯৮ সালে দেখা হওয়ার সম্ভাবনার কথা। আমি মনে করতে পারছি না ৯৮ সালে তিনি আদৌ এসেছিলেন কিনা। সম্ভবত আসেন নি, এলে নিশ্চয়ই দেখা হতো। এরপরেও হয়তো দেখা হতে পারতো, কিন্তু সেই সম্ভাবনাও শূন্য হয়ে গেছে পরের বছরই আমি প্রবাসী হওয়ার কারণে। আমার স্বভাবের আলস্যের কারণে তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ রক্ষা করা হয়নি। অনেক বছর পর তাঁর সড়ক দুর্ঘটনার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু সেটা যে এত গুরুতর ছিল, তা কল্পনাও করতে পারিনি। কায়সার (হক) ভাইয়ের কাছেই আজকে প্রথম জানতে পারলাম যে ওই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল এক দশক আগে। তাঁর মস্তিষ্ক ও স্মৃতিশক্তিকে তা অকেজো করে দিয়েছিল পুরোপুরি। যিনি কয়েক দশক ধরে বাংলা থেকে অনুবাদ করে গেছেন, তিনি নাকি ওই দুর্ঘটনায় বাংলা ভাষা পুরোপুরি ভুগে গিয়েছিলেন। শারীরিকভাবে কোনো কাজ করার সক্ষমতা ছিল না বলে দশটি বছর তিনি এক রকম বন্দীজীবনই যাপন করে গেছেন। কায়সার ভাইয়ের ভাষ্যমতে, তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন গতকাল। তবে সংবাদমাধ্যমে এই বার্তা এলো একদিন পরে। ভাবতে খুব খারাপ লাগছে যে অমায়িক ও সৌজন্যস্নিগ্ধ এই পণ্ডিত ও মননশীল মানুষটিকে স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাইনি বলে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এমন নিঃস্বার্থ বান্ধব আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। এখনই চলে যাওয়ার মতো অতটা প্রবীণ তিনি ছিলেন না। ৭৩ বয়স তো এমন কিছু নয়। আসলে ৭৩ বছরও নয়, তিনি কর্মহীন মহাপ্রস্থানে চলে গিয়েছিলেন আরও দশ বছর আগেই। সেই হিসেবে তিনি ৬৩ বছরে মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর এই অকাল প্রয়াণে গভীর শোক জানাই। বাঙালির এক বিশ্ববান্ধবের শারীরিক প্রয়াণ ঘটলেও, তিনি আমাদের ইতিহাস ও শিল্পের ঐতিহ্যের সঙ্গে বহমান থাকবেন চিরকাল।