কোনো কারখানা বানায় বিয়ার, কোনটি সাকে, কোনটি ওয়াইন, আবার কোনটি হুইস্কি।
Published : 08 Dec 2024, 09:37 AM
আমাদের ইউনেস্কো কোর্স ওয়ার্কের আরেকটি বড় অংশ ছিল বিভিন্ন ধরণের মদের কারখানা পরিদর্শন করা। সাধারণতঃ শুক্রবার সকালে এক বা একাধিক মাইক্রোবাসে কোনো অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে যাত্রা করতাম। কারখানায় পৌঁছেই কোম্পানির নির্ধারিত জুতা, জামা ও টুপি পরে নিতে হতো। স্নায়ূ উত্তেজক প্রায় সব পাণীয়কে বাংলায় এক শব্দে মদ বলা হলেও সেগুলোর রাসায়নিক উপাদান ও পরিমাণের তারতম্যের কারণে নামও হয় ভিন্ন। মদের মূল রাসায়নিক উপাদানটি হচ্ছে ইথাইল এলকহল, যেটি শুধু এলকহল নামেই বেশি পরিচিত। কোনো কারখানা বানায় বিয়ার, কোনটি সাকে, কোনটি ওয়াইন, আবার কোনটি হুইস্কি। হুইস্কিতে এলকহলের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ~৬০% আর বিয়ারে সেটি ৩~৫%, বাকিগুলো মাঝামাঝি।
মদের প্রকার অনুযায়ী তাদের কাঁচামালও হয় ভিন্ন – চাউল, বার্লি, মিষ্টি আলু, আঙ্গুর, এবং অন্যান্য ফলমূল। এইসব কাঁচামালের গ্লুকোজ বা চিনি থেকে ফারমেন্টেশন, বাংলায় যাকে পচানো বলা যেতে পারে, এই পদ্ধতিতে এলকহল উৎপন্ন করা হয়। আর পচানোর পদ্ধতিটি সম্পন্ন করে এককোষী অণুজীব ছত্রাক বা ইস্ট। কিন্তু চাউল বা তদ্রুপ কাচামালে গ্লুকোজমুক্ত অবস্থায় না থেকে যৌগিক শর্করা’র মাঝে এক ধরনের রাসায়নিক শিকলে বাঁধা থাকে। কাজেই এই কাঁচামাল ব্যবহার করলে প্রথমে যৌগিক শর্করা থেকে গ্লুকোজকে মুক্ত করে নিতে হয়। মদের কারখানায় ভিন্ন বিশেষ আরেকটি অণুজীবের সাহায্যে একটি বাড়তি ধাপে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় ভিন্নভাবে। বাংলাদেশে পান্তা ভাত থেকে যে দেশিয় মদ উৎপন্ন করা হয়, সেখানেও পচানোর কাজটি করে থাকে বাতাসে বা অ-বিশুদ্ধ পানিতে ভাসতে থাকা বিভিন্ন অণুজীব। এগুলোর মাঝে ক্ষতিকর অণুজীবের উপস্থিতি থাকার ফলেই আমাদের দেশে মদ পান করে মাঝে মাঝে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
মদের কারখানায় কাঁচামাল পচানো বা ফার্মেন্টেশন করা হয়, তার অণুজীবগুলো কারখানার নিজস্ব সম্পত্তি। গুণাগুণ গবেষণাগার বা কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবে প্রতিদিন পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয় যেন তাদের মধ্যে ক্ষতিকর কোনো জীবাণুর উপস্থিতি না থাকে।
কাঁচামালের সাথে ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতের ও বিশেষ প্রজাতির এককোষী ছত্রাক বা ইস্ট মিশিয়ে উৎপাদনের সময়কাল, তাপমাত্রা, এবং পরিশোধিত মদের গুদামজাতের প্রায় প্রতিটি ধাপ আমাদের ঘুরিয়ে দেখানো ও বর্ণনা করা হতো। কারখানা, কাঁচামাল, বিশেষ ধরনের ইস্ট এবং উৎপাদন পদ্ধতির তারতম্যের ফলে মদের স্বাদও হয় ভিন্ন, যা শুধু প্রশিক্ষিত জিভই সনাক্ত করতে পারে। বলা বাহুল্য এদের নাম এবং দামও হয় আলাদা।
কারখানা পরিদর্শ হয়ে গেলে একটি লম্বা টেবিলের কাছে আমাদের নিয়ে আসা হতো। টেবিলের দুই পাশে দুই সারিতে বোতলের গায়ে ইংরেজিতে যথাক্রমে ১, ২, ৩... এবং এ, বি, সি..., ইত্যাদি লেখা থাকতো। আমাদের বলা হতো প্রতিটি বোতল থেকে তরল পদার্থটি ছোট ছোট কাপে ঢেলে এবং চেখে সংখ্যাযুক্ত বোতলের সাথে অক্ষরযুক্ত বোতলটি মেলাতে। এলকোহলে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ আমার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না, আমাদের মাঝে যৎসামান্য যে ক’জন বেশি পান মেলাতে পারতো তাদের মাঝে কোরিয়ান এবং ভারতীয়রা ছিল সবচেয়ে পটু। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের জাপানি সাথীদের মাঝে অধ্যাপক তাগুচি থাকতেন সবচেয়ে এগিয়ে। এক কোম্পানিতে গিয়ে তিনি আমাদের সামনে দুই সারির পনেরোটি করে মদের বোতলকে নির্ভুলভাবে জোড়ায় জোড়ায় মিলিয়েছিলেন।
সবশেষে যেটি আমরা পরিদর্শন করেছিলাম সেটি ছিল ‘সান্তোরি’ কারখানা। তখনকার জাপানের সর্ববৃহৎ মদ উৎপাদনকারীর একটি বাণিজ্যিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এরা হুইস্কি উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। উৎপাদন পদ্ধতির ওপর স্বাদের যে সম্পর্ক ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে, সান্তোরি কোম্পানিটি এর সাথে যোগ করেছে দৃশ্য এবং শব্দ। ওরা আমাদের প্রত্যেককে এক একটি শব্দ-নিরোধক কক্ষে ঢুকিয়ে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে দিল। আর প্রত্যেকের সামনে দিল হুইস্কির গ্লাস, একটি কলম এবং লেখার কাগজ। কিছুক্ষণ পরপর কক্ষের আলোর কোমল রং পরিবর্তনের সাথে সাথে মৃদু লয়ে কানে বাজতে থাকা সঙ্গীতও পরিবর্তিত হয়ে চললো। এভাবে পরিবর্তিত হতে থাকা প্রতিটি পরিবেশের জন্য মদের পেয়ালায় ছোট ছোট চুমুক দিতে থাকা অংশগ্রহণকারীরা তাদের ভালো বা খারাপ লাগা অনুভুতিগুলো ১ থেকে দশ নম্বর দিয়ে লিখলো। এভাবে প্রাপ্ত জরীপের ফলাফল অনুযায়ী কোম্পানীর খদ্দেররা মদ পরিবেশনার পরিবেশ সম্পর্কেও পরামর্শ দিয়ে থাকে। এ ছাড়া পান করার সময়টিও যে স্বাদের তারতম্য করতে পারে তার একটি উদাহরণ কোম্পানিটি দেখিয়েছিল একটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। এক জাপানি যুবতী এবং ওর মাঝবয়সী প্রেমিকের মাঝে এক সন্ধ্যায় দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত ফোনালাপ হচ্ছেঃ
প্রেমিকা - গতকাল আমি অপেক্ষা করছিলাম, তুমি এলে না
চোখে ও দেহে ঘুমের রেশ রয়ে যাওয়া প্রেমিক আয়েশ করে বলছে,
- অতীতের কথা আমি ভুলে গেছি
প্রেমিকা – আগামী কাল কি দেখা হবে?
খোলা জানালার বাইরে শান্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রেমিক বললো,
- ভবিষ্যত সম্পর্কে জ্ঞান আমার অস্পষ্ট
প্রেমিকের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সান্তোরি মার্কা বোতল থেকে এক মৃদু ও মিষ্টি শব্দ-তরঙ্গ তুলে গ্লাসে নিজ থেকেই হুইস্কি ঢালা হয়ে গেল। এই দৃশ্যটির অর্থ হচ্ছে সান্তোরি হুইস্কির সাথে আমি বর্তমানে বাস করি।
যাই হোক প্রতিবার আমাদের আগমনের সাথে সাথে কারখানার সর্বোচ্চ কর্মকর্তা এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁর এক বা একাধিক অধস্তনের সাথে পরিদর্শনে পাঠিয়ে দিতেন। মদ তৈরীর প্রথম থেকে শেষ প্রতিটি ধাপ দেখানো এবং বর্ণনা করার পর আমাদের কোন প্রশ্ন আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হতো। কোম্পানীটির উৎপাদিত পণ্যের বিশেষত্ব কোন বিশেষ জীবাণু (ইস্ট এবং/ অথবা ব্যাক্টেরিয়া) ব্যবহৃত হচ্ছে, আমাদের এধরনের প্রশ্নের উত্তরে তাদের গৎবাঁধা উত্তর ছিল ‘এটি কোম্পানির ব্যবসায়িক গোপনীয় তথ্য বিধায় বলা যাবে না’। শেষের দিকে ‘আমাদের কোন প্রশ্ন আছে কিনা’-র উত্তরে আমাদের দলনেতা ভারতীয় ডঃ ঘাই তীর্যকভাবে বলতো, উত্তরটি তোমাদের ‘কোম্পানির সিক্রেট’ জানি বলেই আমাদের কোন প্রশ্ন নেই।
এই সূত্রে বহুল কথিত একটি গল্প এখানে উল্লেখ করা অপ্রয়োজনীয় হবে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে একসময় আমেরিকা ও জাপানের মাঝে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। তখন জাপানি প্রতিরক্ষা দফতরের একটি প্রতিনিধি দল আমেরিকার একটি বিস্ফোরক পদার্থ উৎপাদনের কারখানা পরিদর্শন করছিল। নিজেদের গোপনীয় তথ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ ছিল বলে আমেরিকানরা প্রতিটি জাপানি সদস্যকে কড়া নজরদারীতে রাখছিল। জাপানিরা কৌশলে নানা প্রশ্ন করেও বিস্ফোরক পদার্থ তৈরিতে ব্যবহৃত বিশেষ একটি কাঁচামালের কোনো তথ্যই আদায় করতে পারছিল না। তখন একজন জাপানি নাক পরিষ্কার করার ওছিলায় পকেট থেকে রুমালটি বের করার ভান করে মেঝেতে ফেলে দেয়। সাথে সাথে ‘দুঃখিত’ বলে মেঝের দিকে ঝুঁকে বসে রুমাল দিয়ে মেঝেতে জোরে ঘষা দিয়ে রুমালটি হাতে তুলে নেয়। আমেরিকানরা ধূর্ত এই কৌশলটি ধরতে পারে নি। অতিথিরা সেই রুমালটি জাপানে এনে রাসায়নিক পরীক্ষা করে আমেরিকানদের মতোই যুদ্ধে ব্যবহারের বিস্ফোরক বানাতে শুরু করেছিল। পরে তা আমেরিকার বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছিল।