এই কাজগুলো করতে গিয়ে আমাকে একনাগাড়ে প্রায়ই চব্বিশ থেকে ছত্রিশ ঘণ্টা ল্যাবে কাটাতে হতো। অধিকাংশ সময়ে ল্যাবে আমিই থাকতাম একমাত্র মানুষ প্রাণি।
Published : 16 Jan 2025, 06:48 PM
যে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়াকে তাপ বা চাপ বাড়িয়ে ত্বরান্বিত করা যায়, যেমন রান্না করে খাবার প্রস্তুত করা। জেনে রাখা ভালো যে আমাদের প্রতিদিনের রান্নাও অসংখ্য রাসায়নিক বিক্রিয়ারই সমাহার। আবার কোনো কোনো অণুঘটক, ইংরেজিতে যাকে এনযাইম বলা হয়, রাসায়নিক বিক্রিয়াকে কোটি কোটি গুণ বেশি ত্বরান্বিত করে দিতে পারে। যেমন, গরুর মাংসে কাঁচা পেঁপে-বাটা মিশালে মাংসটি অল্প সময়েই রান্না হয়ে যায় – কারণ, পাপাইন নামে এক ধরণের অণুঘটক পেঁপেতে প্রচুর পরিমাণে আছে। জীবিত মানুষ বা অন্য প্রাণির দেহের রাসায়নিক বিক্রিয়া তো আর আগুন জ্বালিয়ে ত্বরান্বিত করা যায় না! প্রকৃতি তাই মানুষ, জীব এবং যাবতীয় প্রাণি দেহের আনুমানিক লক্ষাধিক রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রায় প্রতিটির জন্য এক বা একাধিক প্রাণিজ অণুঘটক বানিয়ে রেখেছে। পেঁপের পাপাইনও তেমনি একটি অণুঘটক।
আমার শিক্ষাগুরু অধ্যাপক আনোয়ার আজিম চৌধুরি স্যারের পরামর্শে ঢাকায় থাকতেই জাপানে আমার গবেষণার বিষয় ঠিক করে রেখেছিলাম। বিষয়টিকে ইংরেজিতে ‘ইম্মোবিলাইযড এনযাইম’ বলা হয়। এনযাইমকে বাংলায় প্রাণিজ অণুঘটক বলা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাণিজ অণুঘটক আমিষের তৈরী হয়ে থাকে।
ইংরেজি ইম্মোবিলাইযড শব্দের অর্থ হচ্ছে স্থবিরকৃত, অর্থাৎ যার চলাফেরা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রক্তে, চোখের পানিতে এবং মুখের লালায় যে যে অণুঘটক দ্রবীভূত থাকে তা তরল পদার্থের সাথে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তরিত হতে পারে। কিন্তু চামড়ায়, হৃদপিণ্ডে, ফুসফুসে অথবা বৃক্কের পেশী বা পর্দায় আটকে থাকা অণুঘটক প্রাকৃতিকভাবেই ইম্মোবিলাইযড বা স্থবিরকৃত হয়ে আছে। প্রাণির দেহে প্রাকৃতিকভাবে না হয়ে মানুষ কৃত্রিম উপায়েও অণুঘটককে স্থবির করে দিতে পারে। প্রাণিদেহ থেকে আহরণ করে তা গবেষণাগার অথবা শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত কঠিন বস্তুর সাথে জোড়া লাগিয়ে একটি অণুঘটককে স্থবির করে দেয়া যায়। ইম্মোবিলাইযড এনযাইম হচ্ছে এমন কোনো প্রাণিজ অণুঘটক যার চলচ্ছক্তি রহিত করা হয়েছে।
আমার গবেষণাটি হবে এক বা একাধিক প্রাণিজ অণুঘটককে স্থবির করে দিয়ে তার কার্যক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী ও বারবার ব্যবহার উপযোগী করে তোলা।
অধ্যাপক সাবুরো ফুকুই-এর ল্যাবে আমার গবেষণার মূল তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সহকারী অধ্যাপক আতসুও তানাকা, যার কথা আগে উল্লেখ করেছি। তাঁর অধীনে আন্ডারগ্র্যাড, মাস্টার্স, পিএইচডি এবং বিভিন্ন কোম্পানি থেকে আসা – সব মিলিয়ে প্রায় দশ জন গবেষক কাজ করতেন। তিনি অধ্যাপক ফুকুই-এর হয়ে সবাইকে দিকনির্দেশনা দিতেন ও ল্যাবটি পরিচালনার করতেন। আতসুও তানাকা ছাড়াও অধ্যাপক ফুকুই-এর আরেকজন সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন যিনি পৃথক ১০/১৫ জন ছাত্রের গবেষণার তত্ত্বাবধান করতেন।
বিশেষ এই ল্যাবের গবেষণায় অনভিজ্ঞ নূতন কোনো সদস্য যোগ হলে তাঁকে প্রতিদিন হাতে কলমে শিক্ষা দেয়ার জন্য জ্যেষ্ঠ এক ছাত্র-গবেষককে দায়িত্ব দেয়া হতো। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে এই দায়িত্ব আমিও পালন করে এসেছি।) কনিষ্ঠজনের কাছে জ্যেষ্ট এই শিক্ষক সেম্পাই বলে পরিচিত ছিলেন।
আমার সেম্পাই ছিলেন মিস্টার তেতসুও ওমাতা, আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়। মাস্টার্স শেষ করে জাপানের ‘তোরেয় কেমিক্যাল কোম্পানি’তে কর্মরত অবস্থায় কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর গবেষণায় রত ছিলেন। তাঁর কোম্পানি সহজ পদ্ধতিতে পানিতে অদ্রবনীয় ওষুধ জাতীয় পদার্থ সৃষ্টিতে আগ্রহী বলে গবেষণার মাধ্যমে তা শিখতে তাঁকে ফুকুই ল্যাবে পাঠিয়েছে। তিনি ছিলেন আমুদে, প্রাণশক্তিতে ভরা, অত্যন্ত কর্মঠ এবং বন্ধু বৎসল।
যেহেতু এই ল্যাবে আমার স্থায়ীত্ব হবে মাত্র আট মাস, প্রাণিদেহ থেকে অণুঘটক আহরণের সময়সাপেক্ষ অংশটুকু বাদ দিয়ে সেম্পাই ওমাতা সান আমার গবেষণার পরিধি নির্ধারণ করতেন। সেম্পাই মানে সিনিয়র ভাই বা ছাত্র। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে কাজ শেখার পাশাপাশি আচিরেই আমরা ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলাম। তাঁর কথা আরো দুই স্থানে উল্লেখ করেছি।
হরমোন শব্দটির সাথে সবাই কমবেশি পরিচিতি থাকার কথা। হরমোন প্রাণিদেহের বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ও ক্রিয়াকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও স্ত্রী ও পুরুষের ভেদাভেদ করে থাকে। স্টেরোয়েড তেমনই এক জাতের হরমোন গোষ্ঠী। এর একটি রাসায়নিক রূপের নাম টেস্টোস্টেরোন, যা প্রাণির পুরুষত্ব নির্ধারণ করে থাকে। এর আরেকটি রাসায়নিক রূপের নাম এস্ট্রোজেন, যা স্ত্রীজাতীয় প্রাণির দেহে অধিক পরিমাণে থাকে। এই দুটি স্টেরোয়েড এবং এদের অন্যান্য রাসায়নিক রূপ মানব ও অন্যান্য জীবের অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি সারাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং ফলপ্রসু ওষুধ হিসাবে অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ বিশেষ অণুঘটকের সাহায্যে স্টেরোয়েডগুলো এক রূপ থেকে অন্যটিতে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। নকার্ডিয়া রডোক্রাউস নামে এককোষী ইস্ট বা ছত্রাকের দেহাভ্যন্তরে এই ধরনের বেশ কয়েকটি অণুঘটকের উপস্থিতি ইতোমধ্যেই জানা ছিল।
আমার কাজ ছিল নকার্ডিয়া রডোক্রাউস এর অণুঘটকের সাহায্যে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরোন এর কী কী রাসায়নিক পরিবর্তন করা যায় তা খুঁজে বের করা। তৈলাক্ত ধর্মের জন্য টেস্টোস্টেরোন সহ সব স্টেরোয়েডই পানিতে সহজে দ্রবীভূত হয় না, কিন্তু বেনযিন ও টলুইন জাতীয় খনিজ তরলে ওরা খুব সহজেই গলে যায়। আবার শেষোক্ত তরলের সান্নিধ্যে আমিষের তৈরি অণুঘটক দ্রুত নষ্ট হয়ে গিয়ে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, কিন্তু আমি প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলাম নকার্ডিয়া রডোক্রাউস ছত্রাক কোষ বেনজিন ও টলুইন তরলে অনেকটা সময়ই বেঁচে থাকে এবং তার অভ্যন্তরের অণুঘটকের কার্যকারিতাও ধরে রাখে।
আমার কাজ ছিল উপযুক্ত খাবার দিয়ে ফ্লাস্কে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে ছত্রাকটিকে চাষ ও পরিচর্যা করা এবং ঘণ্টা ধরে ধরে তার প্রবৃদ্ধি মাপা। এই কাজগুলো আমাকে করতে হতো এক বিশাল অতিবেগুনী বা আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির বাক্সের ভেতরে। এরপর ছিল রয়ে যাওয়া খাদ্য-দ্রবণ থেকে ছত্রাকটিকে আলাদা করা এবং পানি দিয়ে ধোয়া। এরপর নিক্তিতে অল্প পরিমাণে মেপে অসংখ্য ছোটো ছোটো শিশিতে ভরে -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ফ্রিজে রেখে দেওয়া। পরবর্তীতে এক বা একাধিক শিশি বের করে তাতে বেনযিন বা পানিতে মিশ না খাওয়া অন্য কোনো তরল পদার্থ ঢেলে জমাট বাঁধা ছত্রাকের জমাটটিকে ছত্রভঙ্গ করে দিতাম। আরেকটি শিশিতে দুই বা ততোধিক পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে কোমল প্লাস্টিক অথবা রাবার জাতীয় দ্রবণ বানাতাম। এই দ্রবণটিকে ছত্রভঙ্গ হওয়া ছত্রাকের সাথে মিশিয়ে অতিবেগুণী অথবা আলট্রাভায়োলেট রস্মির সামনে ধরলে তা জমাট বেঁধে যেতো। এই পদ্ধতিতে ছত্রাকটিকে স্থবির বা ইম্মোবিলাইজ করে দেয়া হলো।
স্থবিরকৃত ছত্রাককে এবার বেনযিন অথবা পানিতে মিশ না খাওয়া অন্য দ্রবণে চুবালে ছত্রাকের বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না কিন্তু তাতে টেস্টোস্টেরোন ঢাললে ঠিকই দ্রবীভূত হয়ে যায়। হরমোনটি এবার সহজেই ছত্রাকের ভেতরে প্রবেশ করে ছত্রাকের দেহাভ্যন্তরের অণুঘটক দ্বারা বিভিন্ন রাসায়নিক রূপ ধারণ করে আবার বেরিয়েও আসে। ব্যাপারটি অনেকটা মোরব্বা বানাতে গিয়ে চালকুমড়ার টুকরা চিনির সিরাপে চুবিয়ে রাখা এবং মিষ্টি মোরব্বা পানিতে চুবিয়ে রাখলে যা হয়, ঠিক সেই রকম। তরল পদার্থটিকে এবার স্থবিরকৃত ও জমাটবদ্ধ ছত্রাক থেকে সেন্ট্রিফিউজ-এর সাহায্যে আলাদা করতাম। তরল পদার্থকে ‘থিন লেয়ার ক্রোমাটোগ্রাফি’ পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করলে টেস্টোস্টেরোন ও তা থেকে উৎপাদিত অন্যান্য হরমোন আলাদা হয়ে যেতো। পরস্পর থেকে পৃথক হওয়া পদার্থগুলোর পরিমাণ মাপতে আমাকে আবার অতিবেগুণী রস্মির সাহায্য নিতে হতো।
এই কাজগুলো করতে গিয়ে আমাকে একনাগাড়ে প্রায়ই চব্বিশ থেকে ছত্রিশ ঘণ্টা ল্যাবে কাটাতে হতো। অধিকাংশ সময়ে ল্যাবে আমিই থাকতাম একমাত্র মানুষ প্রাণি। এভাবে আমার নিয়মিত গবেষণার তিনটি প্রধান পর্যায়ে অনেকটা সময়ই অতিবেগুণি রশ্মির সংস্পর্শে কাটাতে হতো। প্রাথমিকভাবে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন না করায় আমার চোখ, মুখমণ্ডল ও দুই হাতে যে অভাবনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক জখমের সৃষ্টি হয়েছিল তা অন্যত্র উল্লেখ করেছি।
এই গবেষণা থেকে আমি দুইটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলাম যার একটি ছিল এক বিখ্যাত ইউরোপিয়ান জার্নালে। এই ল্যাবে আমার পূর্বে কোনো ইউনেস্কো ছাত্র তা করতে পারেনি বলে আমাকে জানানো হয়েছিল।
উচ্চতর শিক্ষার চেষ্টা – পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে জাপানে আসার আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল একটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা। বর্তমান ইউনেস্কোর যে কোর্সটিতে আমি এসেছি, সেটি ১০ মাসের একটি ডিপ্লোমা শিক্ষাক্রম। ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর মূল দায়িত্বে থাকলেও জাপানের আরো ৬/৭টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ এই কোর্সের শিক্ষক ও গবেষণা পরামর্শক। স্বল্প মেয়াদের এই কোর্সে এসেই আমার পূর্ববর্তী চার বছরে চারজন বাঙালি প্রাণরসায়নবিদ সেই অধ্যাপকদের সম্মত করিয়ে তাঁদের অধীনেই পিএইচডি গবেষণা করে চলেছেন। আর দুবছর পর থেকে তাঁদের ডিগ্রি পাওয়া শুরু হবার কথা।
আমার লক্ষ ও চেষ্টাও হবে পূর্বসূরীদের মতোই। কিন্তু ফলাফল কী হবে তা যেহেতু জানা নেই, জাপানে নেমেই আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি ও আর্থিক অনুদানলাভের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমেরিকায় পড়াশোনারত অনেক বন্ধুদের সাহায্যও চাইলাম। তাঁদের লিখতাম, হিসাব করে দেখেছি ইউনেস্কো কোর্স থেকে যে পয়সা জমাতে পারবো, তা দিয়ে প্রয়োজনে আমেরিকায় মাস ছয়েকের থাকা-খাওয়ার খরচের জোগান হয়ে যাবে। অবার্ন ক্যাম্পাসে অবস্থিত এলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র শরফুদ্দিন খসরু (ঢাবি’র রসায়নের স্নাতক) থেকে জবাব পেয়েছিলাম। সে লিখেছিল, ‘ভর্তির যদি কোথাও কিছু না হয় তবে সাহস করে একটা টিকেট কেটে চলে এসো, একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই’। ওর এই আশ্বাসবাণীটি সেই সময়ে আমার মানসিক অস্থিরতা প্রশমিত করতে যে কী পরিমাণ সহায়ক ছিল তা বোঝাতে পারবো না। সেই চিঠি পাওয়ার পর দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশটি বছর কেটে গেছে, কিন্তু খসরুর সাথে দেখা বা কথা হলে আজও আমার সেই কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল হয় না।
একই সময়ে আমেরিকার ইণ্ডিয়ানা রাজ্যের ব্লুমিংটনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ইন্ডিয়ানা থেকে জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র পড়ে খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। তাঁরা ব্যাক্টেরিয়া কীভাবে সুগন্ধ-উৎপাদনকারী বিভিন্ন কিটো-এসিডের পরিবর্তন ঘটায় (মেটাবোলিযম) তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ঘটনাক্রমে জাপানে আসার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে আমিও ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা সংগঠিত এই কিটো-এসিড মেটাবোলিযম নিয়েই কাজ করছিলাম। কাজেই উক্ত গবেষণাপত্রটি পাঠ করার সাথে সাথেই একই বিষয়ে সেখানে স্নাতকোত্তর গবেষণা করার ইচ্ছা জানিয়ে চিঠি লিখলাম। উত্তরও পেলাম সাথে সাথে। নিজে বিভাগীয় ভর্তি-কমিটির প্রধান উল্লেখ করে সেই অধ্যাপক উৎসাহ দিয়ে আমাকে ‘টোয়েফল’ এবং ‘জিআরই’ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে ফলাফল পাঠাতে বললেন। প্রায় চল্লিশ হাজার ইয়েন ব্যায় করে টোকিয়ো গিয়ে টোয়েফল পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। আর জিআরই পরীক্ষাটি দিয়েছিলাম ঢাকায় পৌঁছার এক সপ্তাহ পরে, নটরডাম কলেজে।
পিএইচডি করতে চাই ইচ্ছাটি জাপানিদের কাছে প্রকাশ করার আগে আমার নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। এই কাজে জাপানি ভাষাটি না জানা শাপে বর হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করেছি যে, তোরেয় কোম্পানির চাকুরে ও আমার সেম্পাই মিস্টার ওমাতা আমার প্রাত্যহিক কাজের তদারক, সহকারী অধ্যাপক ড. হিদেহিকো তানাকাও খোঁজ নিতেন প্রতিদিন। কাজেই নাওয়া-খাওয়া ভুলে কিয়োতোর ফুকুই-ল্যাবে দিনরাত গবেষণা ও পড়াশনায় ডুবে থাকি। অধ্যাপক ফুকুই বসেন ওপরতলায়, দেখা হয় সপ্তাহে এক আধবার, কিন্তু আমার সব খবরই জানেন। আমার ল্যাবটি ছিল মাটির নিচে, সূর্যের আলো পৌঁছাতো না বলে বৈদ্যুতিক আলোতে দিনকেও রাত মনে হতো। তার মাঝে আগে উল্লেখ করা তেজস্ক্রিয় অতিবেগুণী রস্মি নিয়ে অনবরত কাজ করার ফলে অন্ধ হয়ে যাবার মতো দুঃসহ অবস্থা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও অল্প দিনেই কাজের অগ্রগতি বর্ণনা করে একটি গবেষণাপত্রও লিখে ফেললাম, যা একটি ইউরোপীয় জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে সন্তুষ্ট হয়ে অধ্যাপক ফুকুই এবং অধ্যাপক তানাকা বলেই ফেললেন যে তাঁদের ল্যাবে আমার মতো সফল বিদেশি ছাত্র আর আসেনি! আমি এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলাম।
অধ্যাপক ফুকুইকে আমার আসল উদ্দেশ্যটি ব্যক্ত করলাম, আমি তাঁর অধীনে পিএইচডি করতে চাই। তিনি একটু চিন্তিত হয়ে পরদিন তাঁর মত জানাবেন বললেন। পরদিন বললেন দেখ, আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি, আর এক বছর পরেই অবসরে যাবো। আমারই ল্যাবে অধ্যাপক তানাকার অধীনে তুমি পিএইচডি করতে পারবে তা ঠিক, তবে আমি চাই তুমি আরো আধুনিক, আরো আন্তর্জাতিক পরিবেশের কোনো ল্যাবে পিএইচডি করো। অধ্যাপক কেঞ্জি সোদা নামে আমার এক কনিষ্ঠ বন্ধু আছেন, তিনি শুধু আন্তর্জাতিক মানের গুণী এক বিজ্ঞানীই নন, একাধারে ক্রীড়াবিদ,ইংরেজি জানেন ও বলেন খুব ভালো এবং অতি ভদ্র এক ব্যক্তিও বটে। তোমার যে ব্যক্তিত্ব এবং আগ্রহ আমি লক্ষ করেছি, তাতে তিনিই তোমার যোগ্য তত্ত্বাবধায়ক বা পরামর্শক হবেন বলে আমি মনে করি। তাঁর ক্যাম্পাসটি এখান থেকে বেশ দূরে, উজি শহরে। তুমি তাঁর সাথে দেখা করো, আমি যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি।
যোগাযোগ তিনি করিয়ে দিয়েছিলেন, এবং সেই যোগাযোগ আমার পরবর্তী জীবনের দিকনির্দেশনা ও সাফল্য হিসেবে কাজ করেছিল। অধ্যাপক কেঞ্জি সোদার সাথে আমার পিতা-পুত্রবত যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা আজও অবনত মস্তকে গভীর শ্রদ্ধাভরে আমি স্মরণ করি। ‘অধ্যাপক কেঞ্জি সোদা’ শিরোনামে এর কিছুটা বর্ণনা পরে আপনাদের জানাবো। স্মরণ করি এই মহৎ অধ্যাপক সাবুরো ফুকুইকেও।
পিএইচডি-র গবেষণা করবো এই মর্মে মোনবুশো-খ্যাত জাপান সরকারের বৃত্তির বিশাল দরখাস্তটি আমার হয়ে অধ্যাপক সোদা ও তাঁর সহকারীরা প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। সেটি নিয়েই আমি ঢাকা রওনা হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় সই সহ সেটি ঢাকা থেকে টোকিওর সরকারী অপিসে পাঠাতে হবে।
২৪শে মার্চ, ২০২৩
চলবে