দশ বছরের পাতাঝরা শ্রম লেগে আছে তাঁর শেষ উপন্যাসে।
Published : 13 Sep 2024, 08:40 PM
নীল আকাশের পাখি
কত গান শুনি। তবু একেকজনের গায়কীতে স্বরপ্রক্ষেপণে নিবেদনে একেকটা গান এমন মূর্ত হয়ে ওঠে, সেই গানটি যেন তাঁরই হয়ে যায়। বা, বলা উচিত— কোনো কোনো শ্রোতার সংস্কারে সেই গানের সঙ্গে বিশেষ গায়কটির কণ্ঠ এবং গায়কী এমন একান্ত হয়ে যায় যে যিনি গাইছেন, গানটি যেন তাঁরই।
সাতাত্তর সাল। ফের বকখালি গিয়েছি। নানা অর্থে ভারী দল। পার্থ (প্রতিম কাঞ্জিলাল), সোমক (দাস), প্রসূন (বন্দ্যোপাধ্যায়) আর আমি। তখনো বকখালি নির্জন। এক বিকেলে বিচে যাওয়ার পোশাক হিসেবে পার্থর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। সেই প্রথম ওঁকে দেখি ওই পোশাকে। তীরে হাঁটার সময় ধুতি উড়ে-উড়ে যাচ্ছে দেখে পার্থর মন্তব্য ছিল— হৃদয়ে হাওয়া লাগে ধুতি পরে!
কখন যেন বসে পড়েছি বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ির এককোণে। হাতে হাতে সিগারেট। সিগারেটের উত্তমর্ণ বিকল্প। কখন যেন কথা থেমে গেছে আমাদের। শুরু হয়েছে গান। ‘আজি শ্রাবণঘন-গহন-মোহে/ গোপন তব চরণ ফেলে/ নিশার মতো নীরব ওহে/ সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।...’
গান কখন শেষ হয়ে গেছে, জানি না। বসে আছি নতমস্তকে। আবার, যেন আচমকা, কানে আসে—‘ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি,...‘ বাঁয়ে ঝাউবন, ডাইনে বিপুল জলরাশি, মাথার ওপরে অবিশ্বাস্য আকাশ। ‘ওই গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি--/ হোথায় হারাতে চায় এ গীত-উচ্ছ্বাস।।‘
পার্থর গলা। এই আর্তধ্বনি আর কখনো শুনিনি। যেমন আজো ভুলতে পারি না তাঁর গাওয়া প্রথম গানের ওই অংশটুকু—‘কূজনহীন কাননভূমি,/ দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে/ একেলা কোন্ পথিক তুমি/ পথিকহীন পথের ’পরে।...‘
কত বিখ্যাতজনের কণ্ঠে এ-দুটো গান শুনেছি। আজ সবিনয়ে স্বীকার করি, কেউই ভুলিয়ে দিতে পারেননি সেদিনের শোনার স্মৃতিকে।
(২৪ এপ্রিল ২০১৭)
আমার কলকাতা আসা-যাওয়া
ভোরে বিশ্বভারতী ধরতে গেলে আহম্মদপুর স্টেশনে চা খেতেই হয়। শীত হোক বা গ্রীষ্ম। শীতে মনটা চা-চা করে বেশি। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই চাওয়ালা। এমনও ভোর গেছে, ধুসর কুয়াশার ভেতর নির্দিষ্ট জায়গায় থাকলেও সুভাষকে দেখা যেত না। মানে চাওয়ালাকে। মারা যাওয়ার পর এখন সুভাষের ভাগ্নে। সেই একই জায়গা, হয়তো শুরুর সময় ভাগ্নে পেয়েছিল মামার জনতা স্টোভটিও!
সেই ১৯৬০-এর বড়দিনের ছুটিতে কলকাতা আসা শুরু। তখন রেজাল্ট বেরিয়েছে আর আমি উঠেছি ক্লাস সিক্সে। তারপর নিয়মিত আসা-যাওয়া চুয়াত্তর থেকে।
এখন আর আসি না। যাই। কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়ি।
(৭ জুন ২০১৭)
শেষ লেখা
ফিনিগানস ওয়েক। বলা হয়-- লার্জলি আনরিড। পুরোটা পড়েছেন, এমন কারোর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ এ-জীবনে হবে? যদি হয়, কেমন হবে সেই কথোপকথন?
কথা বলতে প্রথমত লাগে তাগিদ, প্রয়োজন আর বাকশক্তি। তারপর ইচ্ছে-অনিচ্ছের দ্বন্দ্বের ফেরে ঘুরতে হয়। ইচ্ছে একটি আলোর মই। অনিচ্ছে নিজেকে বন্দি করে রাখতে চায় অন্ধকার কক্ষে। শেষ পর্যন্ত ইচ্ছে যদি জেতে, মন তরঙ্গায়িত হয়। উনিশশো আটাশ সালে জয়েস যখন লিখতে শুরু করেন তাঁর শেষ উপন্যাস, জানতেন, এটাই শেষ। এরপর আর কিছু লেখার থাকতে পারে না। এমনকি, এই উপন্যাস নিয়েও কথা যে কীভাবে এগোবে, সংশয় থেকেই যায়, যদিও বিশ্বের বহু পণ্ডিত নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
উপন্যাসটির সংলাপ একটু দেখি:
Jute. — One eyegonblack. Bisons is bisons. Let me fore all your
hasitancy cross your qualm with trink gilt. Here have sylvan coyne, a
piece of oak. Ghinees hies good for you.
Mutt. — Louee, louee! How wooden I not know it, the intellible
greytcloak of Cedric Silkyshag! Cead mealy faulty rices for one dabblin
bar. Old grilsy growlsy! He was poached on in that eggtentical spot.
Here where the liveries, Monomark. There where the missers moony,
Minnikin passe.
Jute. — Simply because as Taciturn pretells, our wrongstoryshortener,
he dumptied the wholeborrow of rubbages on to soil here.
Mutt. — Just how a puddinstone inat the brookcells by a riverpool.
১৯২৮ থেকে ১৯৩৭--- দশ বছরের পাতাঝরা শ্রম লেগে আছে তাঁর শেষ উপন্যাসে। আর সেই শ্রম নিয়োজিত হয়েছে আইরিশদের ভাষা আর পুরাণের সঙ্গে জয়েসের জানা বিশ্বের নানা ভাষার আর পুরাণের দুঃসাহসী অন্তঃকার্পাসীয় বুননে। কেউ কেউ বলেছেন উপন্যাসটি জোরে পড়তে, সম্ভব হলে একসঙ্গে একটা দল তৈরি করে। পরামর্শটি অবশ্য জগতের সেই অন্ধকার গবাক্ষের অস্তিত্বকে স্বীকার করে, যেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলেও দলের অনেকের কাছে দৃশ্য-পরম্পরা অস্পষ্টই থাকবে।
সতেরোটি অধ্যায়ে বিভক্ত উপন্যাসটির বিচিত্র শৈলী এবং বিষয় রয়েছে, লম্বা আর আঁকাবাঁকা রাতের পর অস্পষ্ট ভোরের ভেতর দিয়ে ধীরপায়ে চলাচলের জন্যে একটি চূড়ান্ত অসমাপ্ত বাক্যই যেখানে একমাত্র পথ, যে-পথ উপন্যাসের একেবারে শুরুতে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
কে পড়বে এই উপন্যাস! বুকে হাত রেখে আমিই কি বলতে পারব-- পুরোটা পড়েছি?
(১৯ জুলাই ২০১৭)
অবরুদ্ধ
‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে কোতার নামের নিরীহ মানুষটিকে মনে পড়ে, যে প্লেগপীড়িত ওরানে সারা শরীরে অনিষ্টের চাঞ্চল্য নিয়ে ঘুরে বেড়াত। কোনো বাড়িতে দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠলে যার উত্তেজনা যেত বেড়ে আর আগুনের শিখায় যার চোখদুটো চিকচিকিয়ে উঠে মুখমণ্ডলকে উদ্ভাসিত করত। কিন্তু কোতারকে এককভাবে দেখার সুযোগ রাখেননি কাম্যু। সেরকমটা হলে কবিতা-বিষয়ে লাকাঁর বাক্য সার্থকতা পেলেও পেতে পারত। কর্তব্যনিষ্ঠ ডাক্তার রিও, ঈশ্বর-আশ্রয়ী পানেলু, এমন এক লেখক গ্রাঁ— যে সারাজীবন একটিই মাত্র বাক্য লিখে চলেছে, প্লেগবন্দি শহরে আটকে-যাওয়া সাংবাদিক রবেঁয়ার, উৎকণ্ঠিত— এরা সবাই এত সুসমঞ্জসভাবে বিন্যস্ত যে, প্রতিটি চরিত্র লেখকেরই অংশ যেন। বা, আর একটু এগিয়ে বলা যায়— আমাদের অন্তর্গত গঠনে এরা সবাই একইসঙ্গে সদাক্রিয়াশীল। যেমন একটা লম্বা, কোমরবাঁকা খেজুর গাছ। খোঁচা-খোঁচা রুক্ষ শরীর। কোথাও-বা পেট-চাঁছা। মাথার চারপাশে কালচে-সবুজ পাতার গম্বুজ। ঘন পাতার ফাঁকে খুদে-খুদে হলুদ খেজুরের কাঁদি। সেই কাঁদির গোড়াটি নির্মম ভাবে চাঁছায় গুঁড়ির সাদা বেরিয়ে গেছে। সেখানে একটা টিনের চোঙা গাঁথা। চোঙা এসে শেষ হয়েছে বেড় দিয়ে ঝোলানো মাটির হাঁড়িতে।
এমন একটা রুক্ষ শরীর থেকে স্বর্গীয় পানীয় সেই হাঁড়িতে টুপটুপ করে পড়ছে কিনা, নীচের থেকে বোঝা যায় না।
(১৭ অগাস্ট ২০১৭)
সঞ্জয় ভট্টাচার্য
একটি পত্রিকা-সম্পাদনা কোনো কবিকে কবিতা থেকে কতটা বিযুক্ত করতে পারে?
চরম অর্থকষ্ট, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি নানাবিধ বিড়ম্বনার ফাঁদ থেকে বাঁচাতে নিরুপায় সত্যপ্রসন্ন দত্ত শেষমেশ সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে নিয়ে গিয়ে তুললেন তখনকার শহরতলি ঢাকুরিয়ায়।
শান্তি পেয়েছিলেন? স্পষ্ট জানার তো উপায় নেই। তবে, বলতে পারা যায়-- ফণা গুটিয়ে পূর্বাশা লিমিটেডের যাবতীয় দায়দায়িত্ব মাথা থেকে নেমে গিয়েছিল। ক্রমে নতুন এক মানুষ হয়ে উঠছিলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য।
সেই সময়কার খাতা থেকে মাত্র তিনটি নামহীন কবিতা:
১
এক দিঘি জল এক তরুণীর ছায়া নিয়ে খেলে।
আসবেই দিঘিতে সে সকালে-বিকেলে
শুধুই ফেলতে ছায়া, নামবে না জলে।
মাছের মতন তা'কে নিয়ে যেতে চায় না অতলে
দিঘিজল? চাইলেও পারে না তো নিতে।
সে আসে নিজের ছায়া দেখতে নিভৃতে।
২
ডোবায় দুইটি হাঁস, পাড়ে লাউ-মাচা,
কোনায় কলার গাঢ় ঝোপ।
সময়ের ভুলে রয়ে গেছে।
কী সৌভাগ্য এই যুবতীকে আজ দেখা!
৩
তুমি তো মায়ের পাশে এখনও বালিকা হয়ে থাকো,
একা হ'লে যৌবন দেখাও
এবং তা দিতে চাও। আমি
কী নেব অপেক্ষা ছাড়া আর?
একটি বালিকা যেন যৌবনের অপেক্ষায় আছে,
অপেক্ষা ছাড়া কি আর কিছু নেওয়া যায়!
(২৩ অগাস্ট ২০১৭)
খুনি
তখন সত্যযুগের অন্তিমকাল। তখনো আমাদের নীচু গ্রামটি আকাশছোঁয়া বৃক্ষরাজিতে ঢাকা। মানুষজনের অস্তিত্ব তেমন উচ্চকিত নয়। কেননা, বিদ্যুৎ আসেনি গাঁয়ে। নিভু আলোয় মানুষের মুখে অন্ধকারের গাঢ় প্রলেপ। শুধু মাঝে মাঝে, একেক রাতে, শহর থেকে এসে আচমকা দলবদ্ধ বুটের শব্দ সন্ত্রস্ত করত গ্রামবাসীদের। রাষ্ট্রের প্রবল ক্ষমতাকে নিঃশব্দে চারিয়ে দিত তাদের খাকি পোশাক আর বেঁটে টমিগান দিয়ে। সাতের দশক শুরু। কলেজে আমার প্রথমবর্ষ। সম্ভবত চৈত্রমাস তখন।
এক রাতে, অনেক রাতে, লন্ঠনের আলোয় কিছু-একটা করছি। সন্ধে থেকে জ্বলে-জ্বলে লন্ঠনের চিমনি— যেটাকে তার জেনেরিক নামে চিনতাম কাচ বলে— ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। পাশের ঘরে মা। বারান্দায় উমেদালি ভাই। তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঘুমে। পরিপার্শ্ব নিঝুম। হঠাৎ ঘরে আস্ত একটা ঝটপট শব্দ ঢুকে পড়ল। জীবন্ত কিছু, যে উড়তে পারে। এবং খুব ছোটো কিছু নয়। আমি ছিলাম অজস্র লিখিত শব্দের দলে। নীরব কথোপকথনে ব্যস্ত। আচমকা কোনো প্রাণের এমন সরব অনুপ্রবেশে চমকে গিয়েছিলাম। ভয়ও পেয়েছিলাম। কী সেটা, জানার কৌতূহল একেবারেই ছিল না। চেষ্টা ছিল-- যা-ই হোক, তাড়াতে হবে ঘর থেকে, যাতে ফের ঢুকে যেতে পারি ওই নীরব বিকিরণময় জগতে। প্রাণের শব্দের চেয়ে মুদ্রিত শব্দের ঝংকারে তখন আমি ফের আচ্ছন্ন হতে আগ্রহী।
টেবিলে কাঠের স্কেল চোখে পড়ে। সেটাকেই সম্বল করে আমার চেষ্টা শুরু হয় তাড়ানোর। দু-একবারের চেষ্টাতেই বুঝতে পারি, যেটাকে তাড়াতে চাইছি, সেটা কোনো অচেনা পাখি। পথ ভুলে ঢুকে পড়েছে বাইরের বারান্দার দিকের খোলা দরজা দিয়ে।
সে বেরোবে না, আমিও নাছোড়। এই আলমারির মাথায়, এই টেবিলে, এই বিছানার দূরবর্তী কোণে, সে লুকোতে চায়। যেন আকাশপথে দশরথপুত্র আর লঙ্কেশভগ্নীর লড়াই। এমনই ধ্বস্তাধস্তির সময় আচমকা স্কেলের একটা আঘাত ঘাড়ে লাগতেই তার সব চেষ্টার সমাপ্তি। লণ্ঠনের আবছা আলোয় অপরূপ একটি পাখি মেঝেয় পড়ে আছে। শেষবারের মতো নড়ছে তার সাদা-কালো ছিট-ছিট ডানাদুটো। ততক্ষণে উঠে পড়েছে উমেদালি ভাই। পাখিটার কাছে গিয়ে ডানা ধরে সে তোলে। নড়ছে দেখে টেবিল থেকে জলের গ্লাস নিয়ে পাখির ঠোঁটে ধরে। ততক্ষণে সব শেষ। মৃদু তিরস্কারের সুরে উমেদালি ভাই বলে— করলে কী, এ তো লক্ষ্মীপেঁচা! কেউ মারে?
সেই ভয়ংকর প্রসঙ্গটি কিছুদিন আগে উঠেছিল প্রায়-সমবয়স্ক একজনের বাড়িতে। শুরুটা শুনেই তাঁর কাতর অনুরোধ— ‘একরাম, এটা যদি আমি না শুনি?’
বুঝতে পারি, নরম মন। এতটা তিনি নিতে পারবেন না। ফলে চুপ করে যাই।
কিন্তু নিশ্চুপ আমি ভাবি-- সামনে-বসা এক হন্তারকের স্বীকারোক্তি শুনে, যদি হয়, শ্রোতার অন্তরে কোন জ্ঞানের জন্ম হওয়ার আমি পক্ষপাতী? নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষজ্ঞান নাকি অতীন্দ্রিয় জ্ঞান? কেননা, অন্যের কথা শুনে বা বই পড়ে আমাদের যে জ্ঞান হয়, অর্থাৎ যা শব্দজ্ঞান হতে উৎপন্ন, নৈয়ায়িকরা সেই জ্ঞানকে বলেছেন নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষজ্ঞান। জৈন দার্শনিকদের সিদ্ধান্ত ভিন্ন। তাঁরা বলেছেন-- ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন হলেও এ জ্ঞান স্বয়ং প্রত্যক্ষ বলে অতীন্দ্রিয়।
আমি কোন দলে? বিষয়ভেদে হয়তো-বা দুই দলেই!
(১৯ অক্টোবর ২০১৭)
অচিনপাখি
দুপুর একটা পঁয়তাল্লিশ। ফোনে মুজিবের গলা— ‘লিয়াকতদা চলে গেল।‘
‘মানে?’
‘হ্যাঁ। (মুজিব রিপিট করে) লিয়াকতদা চলে গেল।‘
‘চলে গেল’ শুনে লিয়াকতের হাঁটার ভঙ্গিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বা, বলা উচিত, একটু একটু করে ভাসিয়ে তোলার চেষ্টা করে আমার চোখ।
বহু বছর আগে, সাতের দশকের মাঝামাঝি, প্রথম যখন তাকে দেখি, তখনই তার হাঁটা ছিল পা টেনে টেনে। ছোট্ট, রোগাটে শরীর। প্রায় ওজনহীন। তবু যেন ওই শরীরটুকু বইতেই তার যত কষ্ট। তবে কি সে কোথাও যেতে চাইত না? আসলে লিয়াকত কোথাও থাকতেই চাইত না। চাইত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে।
কেন?
সিউড়ি কলেজে ছাত্র আন্দোলন, মানে নকশাল আন্দোলন করতে গিয়ে দমদম সেন্ট্রাল জেল। দেড় বছর জেলবাসের পর যখন সে বেরোয়, আলাপ তার সঙ্গে। কত রকমারি জায়গায় তাকে দেখেছি, কত-কত অচেনা দিগন্তের মুখোমুখি সে আমাদের দাঁড় করিয়েছে। হয়তো নিজেও চেয়েছে দাঁড়াতে। এবং আবার প্ররোচিত করেছে অন্য কোথাও যেতে।
আশির দশকের মাঝামাঝি লিয়াকত, লিয়াকত আলি, কী ভাবে যেন মধ্য বাংলার সহজিয়া সাধকদের নিকটজন হয়ে গেল। হতে পারে, ওই সব আউল-বাউল-ফকিররাই হয়তো-বা খুঁজে পেয়েছিল তাকে, এক পরিত্রাতা-বন্ধুকে, যে তাদের বুঝত।
বাউল-ফকিরদের নিয়ে অল্পই লিখেছে সে। যা দু-চার পাতা লিখেছে, বাংলার হাজার বছরের সাধনার বর্তমান রূপটির গোপন হাওয়ায় সেই ক-টি নিঃসঙ্গ পাতা আজও কাঁপছে।
সিরিয়া নামের এক মেয়ের সঙ্গে-- সম্ভবত সুইডিশ-- একবার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। ক্যাথরিন নামের একটি ইতালীয় মেয়ের সঙ্গেও। ছোট্ট একটা লেখায় বাউল সাধনার গূঢ় কিছু কথা একবার লিখেছিল লিয়াকত। তাতে সিরিয়া-প্রসঙ্গও ছিল। আসলে, সিরিয়ার সঙ্গে তখন সে বেরিয়েছিল ভারতভ্রমণে। সেই ভ্রমণেই কোনো-এক পথ-হোটেলে পাশাপাশি দুই খাটিয়ায় শুয়ে লিয়াকত জানতে চেয়েছিল— ধর্ম সম্বন্ধে সিরিয়ার বক্তব্য কী। সে কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে?
যে-আকাশের দিকে মুখ করে শুয়েছিল দুজনে, সেই আকাশে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে শূন্যকে সবেগে কাটতে কাটতে সিরিয়া বলেছিল, ‘নো, নো, নো।’
এ-কথা লিয়াকত নিজেই লিখে গেছে। কিন্তু লেখেনি, সে নিজে ঠিক কী বিশ্বাস করত।
(১২ নভেম্বর ২০১৭)
(ক্রমশ)