অত্যন্ত অমায়িক হলেও জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে অবস্থানটি তাঁর খুব স্বস্তিদায়ক ছিল না, কারণ ময়মিসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কাজের জন্য তিনি গিয়েছিলেন, সেখানকার বাঙালিরা ঘুষ চেয়ে চেয়ে তাঁর কাজের ব্যাঘাত ঘটাতেন।
Published : 07 Jan 2025, 08:29 PM
আমাদের ওসাকা বাসের দুই মাস শেষ হয়ে গেল। সহপাঠীরা এবার বিভিন্ন শহরের আটটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ নিজ পছন্দের ল্যাবরেটরিতে চলে যাবে। সাধারণতঃ যে যার সময়মতো আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিতাম। কিন্তু ওসাকা ছাড়ার আগের রাতে আমি ডর্মিটরির সবাইকে টেবিলে একসাথে ‘লাস্ট সাপার’ খাওয়ার প্রস্তাব দিলাম। এতোদিন একসাথে চলাফেরা এবং ক্লাশ করলেও প্রায় পনেরো জন এভাবে কখনো এতো কাছাকাছি ও মুখোমুখি বসি নি। কাজেই প্রায় সবাই খুব চুপচাপ বসেছিল। নিরবতা ভাঙতে আমিই কথা বলা শুরু করলাম। বললাম বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতি থেকে এসে এই দুইমাসে আমরা একটি আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। এই বন্ধন যেন দীর্ঘস্থায়ী ও সুখকর হয় তাই একসাথে খেতে বসেছি। এরপর আমার অনুরোধে প্রত্যেকে প্রায়ই আবেগপূর্ণ ছোট ছোট বক্তব্য রাখলো।
দশ মিনিটে এই পর্ব শেষ হয়ে গেলে টেবিলে আবার নীরবতা নেমে এলো। এবার আমি বললাম যে যার দেশের একটি পরিচিতি গান, নাচ, বা কৌতুক শোনালে বা দেখালে কেমন হয়? প্রথমে মুখ চাওয়া চাওয়ি এবং উসখুস করলেও আমার পীড়াপীড়িতে একে একে সবাই অংশগ্রহণ করলো। লাভ হলো এই যে টেবিলে বসার আগে সবার মাঝে যে জড়তা ছিল এখন তা পুরোপুরি তিরোহিত হলো।
মালপত্র নিয়ে পরদিন শুক্রবার সকালে ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হলাম। আমাদের সাথের চারজন এখানেই থাকবে – পরবর্তী সাত মাস এখানকার বিভিন্ন ল্যাবে গবেষণার করবে। যারা দূরের শহরে যাবেন তাঁরা এক একজন সিনিয়র জাপানি ছাত্র বা শিক্ষকের সাথে দ্রুতগামী শিংকানসেন ট্রেন স্টেশনে চলে গেলেন। আমি এবং কোরিয়ার মিস্টার কোয়ান যাবো কাছের, মাত্র ৫৫ কিলোমিটার দূরে কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে। রেলে, বাসে, এবং গাড়িতে যাওয়া যায়। মিসেস সোয়াযুমি আমাদের দুজনকে গাড়িতে নিয়ে চললেন।
কোয়ান বয়স্ক লোক, ইংরেজি বলতে পারে না, তার ওপর খুব চুপচাপ থাকে, স্বভাবও বেশ রুক্ষ। কাজেই আমি এবং মিসেস সোয়াযুমিই সারা পথ বকর বকর করে চললাম। তিনি জানালেন কোয়ান থাকবে ওর দেশি কিছু ছাত্রের সাথে। কিন্তু আমি যে বাসায় থাকবো সেটি কিয়োতো শহরের সুন্দরতম একটি যায়গা। কিন্তু আমার বিছানা কিনতে হবে। আর সেখানে অনেক শীত ও বরফ পড়ে বলে এক্ষুণি না হলেও আমার কিছু গরম কাপড়ও কিনতে হবে। তা আমি তো কিয়োতোর পথঘাট চিনি না, আর জাপানি ভাষাও বলতে বা বুঝতে পারি না। আমি কী করে এসব কিনবো? বললেন, কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবুরো ফুকুই যার ল্যাবে ও তত্ত্বাবধানে আমি গবেষণা করবো, তিনিই আমার বিছানা পত্র কিনে দেবেন। আমার কোন পয়সা দিতে হবে না। শীতের ওভারকোট পরে কিনলেও চলবে।
ওভারকোট কিনতে হবে শুনে বেশ চিন্তিত হলাম। কোরিয়ার ছাত্রদের মুখে শুনেছি শীতের ওভারকোটের অনেক দাম, ষাট-সত্তর হাজার ইয়েন, এবং ক্ষেত্র বিশেষে এক লাখ ইয়েনও হয়ে থাকে। বাংলাদেশের টাকার হিসাবে পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা! ওসাকা ছেড়ে আসার আগের দিনগুলোতে ওভারকোটের দাম নিয়েই আমাদের মাঝে আলোচনা হয়েছে অনেক। বিশেষ করে ভারতের প্রমোদ শ্রীবাসতভ এবং সুরেশ ঘাইয়ের দুশ্চিন্তাই ছিল বেশি। সুরেশ বিলাতে এক বছর ছিল বলে পুরোপুরি না হলেও শীতের জন্য কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। শীঘ্রই আমিও ওদের মতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। বৃত্তির মাসোহারা পাই দুই লক্ষ বারো হাজার ইয়েন। পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ থেকে এসেছি। লক্ষ শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, মাসোহারা থেকে যে কয়টি পয়সা বাঁচাতে পারি তা সাথে নিয়ে দেশে ফেরা। বাকি পুরোটা পথ এই ওভারকোট কেনার দুশ্চিন্তাতেই আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম।
দুপুরের কিছু পর কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে পৌঁছালাম। মাইক্রোবায়োলজি পড়তে এসে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে কেন? কারণ অধ্যাপক ফুকুই হচ্ছেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক। এই অধ্যাপক তাঁর প্রথম তলার অপিস কক্ষে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁর মত নামজাদা এবং একষট্টি বছর বয়স্ক অধ্যাপকের জন্য অপিস ঘরটি আমার কাছে খুবই ছোট এবং অপ্রশস্ত মনে হলো। তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত আছেন বোঝা গেল। ছোট ও পিটপিট চোখে তাকানো এবং উচ্চারণে যথেষ্ট জাপানি প্রভাব থাকলেও ইংরেজি ভালোই বলতে পারেন। একটু মনযোগ দিলে সবকিছুই বোঝা যায়। বললেন আজ কোনো কাজ নয়, আজ আমার বিছানা কেনা হবে। একটি ব্যাগ থেকে নতুন কেনা সুন্দর, রঙিন ও তুলতুলে একটি কম্বল হাতে দিয়ে বললেন এটি তোমার জন্য আমার একটি উপহার। আজকে যে বিছানাটি কেনা হবে সেটিও উপহার তবে তা ল্যাবের পক্ষ থেকে। বললেন, তুমি চলে যাবার সময় বিছানাটি রেখে যাবে কিন্তু ব্যবহার করার পর কম্বলটি দয়া করে সাথে করে দেশে নিয়ে যেও।
এরপর বললেন, মধ্য জাপানের এই অঞ্চলে কিয়োতোর শীত বেশ প্রকট। তুষারপাতের সময় ব্যবহার করার উপযোগী একটি ওভারকোট তোমার লাগবে। কিন্তু তেমন ওভার কোটের দাম অনেক। তুমি কি নতুন ওভারকোট কিনতে চাও? কী উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে আমার ইতঃস্তত ভাব দেখে তিনিই আবার মুখ খুললেন। বললেন, আমি মনে করি মাত্র চার পাঁচ মাস ব্যবহার করার জন্য নতুন ওভারকোটের দামটি অনেক বেশি। দেয়ালে ঝুলতে থাকা একটি ওভারকোট নামিয়ে বললেন, দেখ তো এটি তোমার গায়ে লাগে কি না? এই কোটটি নতুন নয়, এটি ল্যাবেরই সম্পত্তি। এর আগে রাশিয়া থেকে যে ছাত্রটি এসেছিল সে ব্যবহার করেছিল। এই বলে তিনিই আমার গায়ে সেটি চড়িয়ে দিয়ে বললেন তোমার শরীরে একটু বড় হয় কিন্তু ওভারকোট তো বড়ই হয়, তুমি বরং নতুন কেনার চিন্তা বাদ দাও। এটিই ব্যবহার করো। শীত চলে গেলে ফেরত দিয়ে দিও। পরের বারে যে ছাত্র আসবে সে পরতে পারবে।
বাইরে পানি- ও বরফ-নিরোধক এবং ভেতরে সাদা পশমে তৈরী ওভারকোটটি দেখতে মোটেই সুন্দর ছিল না। কিন্তু সেটি গায়ে দেয়ার সাথে সাথে নিজেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে হতো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি যা মনে হতো, তা হচ্ছে এতো দামি একটি বস্তু কেউ কাউকে উপহার দেয়? আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। প্রায় সাড়ে তিন বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করে সর্বসাকুল্যে আমার মাসিক বেতন ছিল ১১০০ টাকা। সেখানে প্রায় দশ হাজার টাকা মূল্যের একটি ওভারকোট কেউ আমাকে উপহার হিসেবে দিচ্ছে? সেটি কি ভাবা যায়? এটি আগে কেউ ব্যবহার করেছিল তা আমার চিন্তায় একবারের জন্যও উদিত হয় নি। কিছুক্ষণ আগে প্যাকেটে মোড়া চকচক করতে থাকা নতুন ও সুন্দর কম্বলটি দেখে এই ওভারকোটটিকেও হয়তো নতুন বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কোন চিন্তা থেকে অধ্যাপক ফুকুই আমাকে এই দামী উপহারটি দিলেন? সব জাপানি অধ্যাপকই কি এমন চিন্তাশীল ও ছাত্রবাৎসল্যপূর্ণ?
ওভারকোটটি পাওয়ার পর যখনই আমার পরিচিত কারো দেখা পেয়েছি, সুযোগ পেলেই জানিয়ে দিয়েছি আমার অধ্যাপক থেকে অসামান্য এই উপহার পাওয়ার কথাটি। আমার জানানোর উদ্দেশ্য ছিল কী মহৎপ্রাণ এক অধ্যাপকের ছাত্র আমি হয়েছি! ইউনেস্কো মাইক্রোবায়োলজি পাঠ্যক্রমে আমার সহপাঠীরা তো বটেই, বাঙালি বা অবাঙালি অন্য যে ছাত্রই শুনেছে তাঁরা যুগপৎ আশ্চর্য ও ঈর্ষান্বিত হয়েছে।
‘ওভারকোট’ নামে রুশ লেখক গোগোল এর একটি বিশ্বখ্যাত গল্প আছে। ওভারকোট পোষাকটি রূপক হিসাবে তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির আয়না হিসাবে রাশিয়ার জার শাসনের নিন্দনীয় দিকটিকে প্রকটভাবে উন্মোচন করে দিয়েছিল। প্রথমবার জাপানে গিয়ে ওভারকোট নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা ও আবেগে আপ্লুত হওয়ার ঘটনা আজ স্মরণ করে তখনকার বাংলাদেশের জীর্ণ আর্থসামাজিক অবস্থাকে সুদূর অতীতের বলে মনে হয়!
যাই হোক, এভাবে প্রাথমিক অভ্যর্থনার পর অধ্যাপক ফুকুই কাউকে ফোনে ডাকলেন। বললেন নিজে ব্যস্ত বলে তাঁর ল্যাবরেটরি দুই সহকর্মী দেখভাল করেন। প্রাত্যহিক কাজকর্মে আমাকে যিনি সব শেখাবেন তিনি সহকারী অধ্যাপক আৎসুও তানাকা। সেই সহকারীই আমার বিছানাপত্র কিনে আমার থাকার বাসায় নিয়ে যাবেন। বাসাটির মালিক মিসেস নাহা। মিসেস নাহা কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক প্রয়াত অধ্যাপকের স্ত্রী।
প্রথম আলাপে ডক্টর আৎসুও তানাকা-কে আমার কাছে কোনো বিজ্ঞান গবেষক মনে হয় নি। চোখে অধিক শক্তির চশমা এবং মাথায় ছোট করে ছাঁটা খাঁড়া খাঁড়া চুলের এই ব্যক্তিটিকে আমাদের দেশের কোনো ক্ষ্যাপা কেরানির মতোই মনে হয়েছিল। অধ্যাপক ফুকুইয়ের প্রতিটি কথার প্রত্যুত্তরে মাথা ও শরীর ঝুঁকিয়ে একান্ত অনুগত ভৃত্যের মতো শুধু জ্বী, জ্বী, বলে যাচ্ছিলেন। এই ব্যক্তি আমাকে কী গবেষণা শেখাবেন তা ভেবে আমি আকুল হচ্ছিলাম।
ডক্টর তানাকার ইংরেজিও বুঝতে বেশি অসুবিধা হয় না। তিনি আমাকে মাটির নিচে বেইজমেন্টের একটি ল্যাবে নিয়ে গেলেন। বহু বছর ব্যবহারে কালচে হয়ে যাওয়া তিনটি লম্বা পরীক্ষা-টেবিল, প্রায় ছয় সাতটি বসার চেয়ার-টেবিল, এবং অসংখ্য ছোটখাটো জিনিসপত্রে ঠাসা একটি ঘর। ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বানানো আলোয় ঝলমলে ল্যাব যা দেখে এসেছি সেই তুলনায় এটিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন গুদামঘরের বেশি কিছু মনে হলো না। এসবের মাঝে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলে শেষ মাথায় একটি টেবিল ভর্তি কাগজপত্র নিয়ে তাঁর অপিস। হে হে, হে হে, করে হাসি দিয়ে জাপানিতে তিনি কিছু শব্দ উচ্চারণ করতেই ল্যাবের বিভিন্ন কোন থেকে সাত আট জন ছাত্র বেরিয়ে এলো। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বুঝলাম এরা সবাই অধ্যাপক ফুকুইয়ের ছাত্র হলেও ডক্টর তানাকাই তাঁদের প্রাত্যহিক অভিভাবক। ছাত্রদের প্রায় কেউই ইংরেজি বলতে পারে না, এবং বেশ লাজুক। অনেক কসরত করে ইংরেজিতে দুই একটি শব্দ উচ্চারণ করলেই পাশে দাঁড়ানো বাকিরা হাসাহাসি করতে থাকে।
দুজনকে দেখিয়ে বললেন এঁদের সাথে যাও। এরা তোমার বিছানা কিনে তোমার বাসায় নিয়ে যাবে।
রিনসিংকিও-র একাকীত্ব – জাপানি যে দুটি ছাত্র বিছানা কিনে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেল ওরা ছিল লাজুক প্রকৃতির, অন্ততঃ অপরিচিত আমার সামনে। দুই একটি শব্দ ও বাক্যের বেশি ইংরেজিতে বলতে পারে না। ফলে বন্ধুত্ব হওয়া তো দূরের কথা মনে হচ্ছিল কতক্ষণে ওদের থেকে আলাদা হতে পারবো। কিন্তু অচিরেই আবিষ্কার করলাম বাড়িওয়ালী মিসেস নাহা’র তুলনায় ওদের সান্নিধ্য অনেক বেশি ভালো ছিল। স্নেহময়ী ব্যক্তিত্বের মিসেস নাহা ‘ইয়েস’, ‘নো’, ‘থ্যাংকিউ’ এর বেশি জানলেও একটি শব্দও ইংরেজিতে বলতে পারেন না। যা বলেন তাঁর সবই হাতের ইশারায়, বাকিটুকু হাতে ধরা ডিক্সনারি দেখে বাক্যহীন ইংরেজিতে লিখে বোঝান।
স্থানের নাম ইয়াসে, বাড়িটির নাম রিনসেংকিয়ো। তিন চারজনের একটি মেসবাড়ি, জাপানিরা বলে গেইশুকু। কিয়োতো শহরের প্রায় দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত দোচালা লম্বা বাড়িটিতে ঢুকলে বাঁ দিকে পরপর তিনটি ঘর, মাঝেরটি আমার। ঘরের ভেতর দেয়াল জুড়ে আলমারির মতো কাপড়চোপড় ও বিছানা তুলে রাখার জায়গা। মেঝেতে আছে একটি কোতাৎসু বা নিচু টেবিল এবং একটি নিচু চেয়ার। বাড়িতে ঢুকেই ডানদিকের ছোট ঘরটি কুয়া-পায়খানা। এরপরে আছে মুখহাত ধোয়ার যায়গা। তারপর বেশ বড়সড় রান্নাঘর। এরপর আরেকটি শোয়ার ঘর। দুটি ঘরের মাঝের দেয়াল খুব হালকা মণ্ড-জাতীয় পদার্থে তৈরী। দরজাগুলোতে তালা থাকলেও কাঠের ফ্রেমের ওপর কাগজে তৈরী। দুই তিন বছরের শিশুও অনায়াসেই তা ভেঙে বাঁ ছিঁড়ে ফেলতে পারবে। ঘরের মেঝেতে সনের (বা ছনের) তাতামি। তাতামিকে আমাদের পাটির সমকক্ষ বলা যায়। তবে প্রতিটি তাতামির একটি নির্দিষ্ট মাপ আছে। আমরা যেমন বর্গফুটের হিসাবে ঘরের মাপ বোঝাই, জাপানিরা তখন তাতামির হিসাবে ঘরের আয়তন বোঝাতো। আড়াই তাতামির ঘর তখন স্ট্যান্ডার্ড বা সচরাচর দেখা যেতো। আমার ঘরটি ছিল ছয় বা সাত তাতামির।
এই বাসায় গোসলখানা নেই। লম্বালম্বি বাসার একধারে রাস্তার ওপাশে মিসেস নাহা’র বিশাল বাড়ি। সেখানে সপ্তাহে দুইবার গোসলের পানি গরম করা হয়। সময়ের ঠিক আগে আগে মিসেস নাহা জানিয়ে দেবার সাথে সাথেই রাস্তা পাড়ি দিয়ে যেতে হবে গোসল করতে। দেরি হলে পানি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করলে নিমোনিয়ায় মৃত্যু নির্ঘাত।
যতদূর মনে পড়ে মাসিক ভাড়া ছিল কুড়ি হাজার ইয়েন। এর বাইরে আছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল। পরে জেনেছিলাম বিদেশিদের জন্য ছাত্রাবাসে সব মিলিয়ে ভাড়া লাগতো আড়াই হাজার ইয়েন! তা শুনে গাত্রদাহ হলেও মেনে নিতে হয়েছিল কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জেনেশুনেই আমার এই থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্ভবতঃ কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের এই বিধবা স্ত্রীর আয়ের একটি ব্যবস্থা করাও একটি উদ্দেশ্য ছিল।
বাড়িটির একপাশে খরস্রোতা কামি-তাকানো নদী। আরেক পাশে সুউচ্চ হিয়ে পর্বত। বাড়ি থেকে ঢালু হয়ে যাওয়া সামনের দিকে তাকালে মনে হয় নদী ও পাহাড় যেন পরস্পরের সাথে কোলাকুলি করতে ছুটে চলেছে। মনোমুগ্ধকর সে দৃশ্য। সামনে বাঁ দিকে একটি ঝুলন্ত পুল। পুল পেরিয়েই রেলস্টেশন। নাম ইয়াসে ইউয়েন। ইউয়েন মানে পার্ক। স্থানটি গ্রীষ্মকালে একটি পার্কেই রূপান্তরিত হয়। স্টেশনের অপর পাশে একটি বড়সড় সুইমিং পুল। শীতে বন্ধ থাকে। বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে ডান দিকে একটি দড়ি-টানা গাড়ি বা ক্যাবল কার। শীত-গ্রীষ্ম উভয় সময়েই এতে করে প্রায় সাড়ে আট শত মিটার উঁচু চূড়াতে যাওয়া যায়। বাড়ির পাশের রাস্তা ধরে পেছন দিকে গেলে পাহাড়ে ওঠার পায়ে হাঁটার একটি রাস্তা। সেটি ধরে এগিয়ে গেলে গাছপালার আড়ালে ছোট একটি মন্দির। এটি ছাড়িয়ে আরো ওপরে উঠলে যাওয়া যাবে এখানকার বিখ্যাত ও তেরো শত বছরের পুরনো এনরিয়াকু-জি বৌদ্ধ মন্দিরে। এক হাজার বছর পূর্বে শিবিকো মুরাসাকি নামে এক মহিলা লেখকের বিশ্বের প্রথম রোমান্টিক উপন্যাস ‘দি টেইলস অফ গেঞ্জি’তে এই মন্দিরের উল্লেখ আছে।
এখন শীত এগিয়ে আসছে। লোকজনের দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু গ্রীষ্মে স্থানটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। গাঢ় সবুজ গাছ ও তৃণলতার মাঝে পাহাড়ের গায়ে ও নদীর কূলে নানা বর্ণের ও বাহারের বুনো ফুল ফুটে থাকে। দড়ি টানা গাড়িতে করে মানুষ পর্বত চূড়ায় যায়। রং বেরংয়ের পোষাক পরে শিশুরা নদীর পানির কাছে গিয়ে মাছ ধরে। কাছে দাঁড়িয়ে মায়েরা বন্ধুদের সাথে গল্প করে। পর্বতারোহীর পোষাকে কেউ বা খাঁড়া পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। পাহাড়ের গা ছুঁয়ে এক শীর্ণকায় জলপ্রপাতের নিচে ছোট ছোট ছেলেমেয়া জড়ো হয়। বাতাস গাছের পাতায় আছড়ে পড়ে সঙ্গীতের লহরী তোলে। কিছু দূরে বিকিনি পরা মেয়েদের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়। রেলগাড়ি থেকে নেমে স্কুলের পোষাক পরা ছেলেমেয়েদের দল ঝুলন্ত পুলে দাঁড়িয়ে নিচে পানির নাচন দেখে। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
এর বিপরীতে শীতের সময় একটি কাকপক্ষীরও দেখা মেলে না। ধীরে ধীরে বরফ পড়া শুরু হয়। স্টেশন, গাছপালা, কামি-তাকানো নদী, পাহাড় ও বাড়ির ছাদ সাদা বরফের আস্তরণে ঢাকা পড়ে। যেন কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। উঁচু কোনো গাছ তাঁর ডগা থেকে এক দলা বরফ ঝুরঝুর শব্দে নিচে ফেলে দিলেই শুধু প্রাণের অস্তিত্ব যেন টের পাওয়া যায়। অসম্ভব সুন্দর সে দৃশ্য, সে অনুভূতি!
আমার এই বাড়ির পরিবেশ এতোই সুন্দর ছিল যে কোনো কারণে কেউ একবার এখানে এলে সহসাই চলে যেতে চাইতো না। কিন্তু শীতকালে একদিনের বেশি কেউ থাকতেও চাইতো না। ওসাকার মতিন সাহেবের কথা আগে বলেছি। প্রথম দিন এসেই তিনি বলেছিলেন আমি আজ আর ওসাকায় ফিরে যেতে চাই না। এভাবে ওসাকার মতিন সাহেবের সাথে সেন্দাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাউদ্দিন ভাইও একরাতের অতিথি হয়েছিলেন এই বাসায়। মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। পরে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছিলেন। ওসাকায় বন্ধুত্ব হওয়া ভারতীয় এক ছাত্র ওর ফিলিপিনো বান্ধবী নিয়ে বেড়াতে এসেছিল। একটি রাত এখানে না থেকে সে কিছুতেই ফিরে যাবে না। আর এসেছিলেন টোকিয়োর নিকটবর্তী চিবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকায় আমার এক বছরের সিনিয়র বন্ধু ইশতিয়াক মাহমুদ ভাই, পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার হিসাবে অবসরে যান। বরফ থাকতে থাকতেই নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মোসাদ্দেক হুসেইন এবং ইফফাত রেজা এসেছিল। ঢাকায় ওরা আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল। আমার কাজ ছিল ওদের নিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে বা দড়িটানা গাড়িতে করে হিয়ে পর্বতের চূড়ায় নিয়ে যাওয়া।
রিনসেংকিও-তে পৌঁছে দিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে ল্যাবের ছেলেরা বিদায় নেবার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম রাতের খাবার কোথায় খাবো? হয়তো আমার কথা বুঝতে পারেনি অথবা আমি ওদের কথা বুঝতে পারিনি। ফলে কোন সদুত্তর পাই নি। মিসেস নাহাও যে কোনো উপকারে আসেনি তা বলাই বাহুল্য। অথবা ভাষার জটিলতার কারণে আমি নিজেই হয়তো তাঁদের সান্নিধ্য থেকে পরিত্রাণ চাইছিলাম। ফলে রাতটি আমার উপোস করেই কাটাতে হলো।
আপনি কি কখনো একাকীত্বের জ্বালা অনুভব করেছেন? একাকীত্বের সৌন্দর্য অনুভব করেছেন? আমি করেছি, এবং দুটোই। একই সাথে কী দুরূহ সেই যাতনা, কী অপরূপ সেই সৌন্দর্য! আমার ওসাকার দিনগুলো ছিল দিনরাত বিভিন্ন দেশের বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে। জাপানি ছাত্র ও শিক্ষকরাও ছিলেন বন্ধুবৎসল। কথা বলতে কোনোই অসুবিধা হতো না।
কিয়োতো এসে আমি যেন অথৈ সাগরে পড়লাম। চারিদিকে মানুষ, কিন্তু কথা বলার কেউ নেই। ল্যাবে যতক্ষণ থাকি কাজে ব্যস্ত থাকি, কথা বলার প্রয়োজন বেশি হয় না। প্রায় কুড়ি পঁচিশ জন পুরুষ ছাত্রের মাঝে একজন মাত্র মহিলা কর্মচারী। কারো কারো সাথে গায়ে পড়ে আলাপ করতে যাই। গবেষণা-পড়াশোনার বাইরে অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে ভাষান্তরের যে সমস্যা হয় তাতে হাঁপিয়ে যাই। তাই খুব প্রয়োজন না পড়লে চুপ করে থাকি। তবুও আশেপাশে মানুষের অস্তিত্ব থাকে।
কিন্তু ঘরে ফিরলে? কেউ নেই। এই বাড়ির বাসিন্দা এখন আমি একাই। পড়শী বলতে দুই বিশাল কুকুর নিয়ে বাড়িওয়ালী মিসেস নাহা। অত্যন্ত স্নেহময়ী ও অমায়িক হলেও শুধু প্রয়োজনেই তাঁদের সাথে দেখা হয়। আমার সঙ্গী হয়ে থাকে কামিতাকানো নদীর একঘেয়ে গর্জন। গভীর রাতে মাঝে মাঝে নদীর ওপরে ঝুলন্ত সেতুটির ওপর দাঁড়াই। আমার উপস্থিতি জানান দিতে শরীরটি ঝাঁকাই। তাতে পুলটি আর্তনাদ করে ওঠে। সেই শব্দে নদীটি আরো জোরে গর্জন করে নিজের অভিযোগ জানায়। পাথরের গায়ে আঘাত পেয়ে যে শুভ্র ফেনা তুলে এগিয়ে যাচ্ছে সে কি আমার দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে গেল? কত হাজার বছর ধরে যে একাকী এভাবে বয়ে চলেছে, আমার একাকীত্বের কথা শুনে ওর কী লাভ?
নদী ছেড়ে এবার আমি ঘনকালো পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়াই। চিৎকার করে মাকে ডাকি, বাবাকে ডাকি, ভাইকে, বোনকে ডাকি। পাহাড় ঠিকই আমার ডাক শুনতে পায়। পরক্ষণে সেও ওর মা, বাবা, ভাই-বোনকে ডেকে ডেকে আমার সাথে সমমর্মীতা প্রকাশ করে।
ঘরে ঢুকে বাইরের কাঁচের দরজাটি টেনে বন্ধ করলে শুরু হয় সূচপতন নিস্তব্ধতা। একটি ঝিঁঝিঁ পোকার আহবানও শোনা যায় না। একাকীত্ব লাঘবে টেপ রেকর্ডারে সাগর সেনের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি। কিন্তু কথা বলি কার সাথে? মুখ, জিভ ও চোয়ালের পেশী যে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। একদিন পাশের ঘরে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব টের পেলাম। ছুটে ঘর থেকে বেরোতেই এক জাপানি যুবকের মুখোমুখি। আজই নতুন ভাড়াটে হিসেবে এসেছে। ওকে স্বাগত জানিয়ে আমার ঘরে শুকনো খাবার যা ছিল ওর হাতে তুলে দিলাম। বুঝতে পারছি সে আমার সব কথাকেই দুর্বোধ্য মনে করছে। কিন্তু তাতে কি? আমি কথা বলার সুযোগ পেয়েছি! কোন কথা খুঁজে না পেয়ে টেপ রেকর্ডারে বাজতে থাকা রবীন্দ্রসঙ্গীতটির ইংরেজি করে সম্মোহিতের মত অনবরত বলে যাচ্ছি। যুবক ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সোমবারে কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ছাত্র অপিসে গেলাম। তিনজন কর্মচারী। এঁদের মাঝে সর্বদা হাসিমুখো মিস ওহাশি খুব ভালো ইংরেজি বলেন এবং সবার কাছেই খুব প্রিয়। আমার ভাষাগত সমস্যার কথা শুনে সমবেদনা জানিয়ে বললেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের অন্য আরেকজনই মাত্র ছাত্র আছে। মিস্টার মতিনকে প্রতিদিন ক্লাশে আসতে হয় না, থাকেনও ওসাকায়। ভারত উপমহাদেশেরও আর কোনো ছাত্র নেই। তবে ভারতীয় এক ছাত্রী মাসের তিন সপ্তাহ কাটায় টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে আর এক সপ্তাহ কাটায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিয়োতোয় ওর বাসস্থান তোমার খুব কাছেই, তোমার স্টেশন থেকে মাত্র তিন স্টেশন পরে মেয়েদের ডর্মিটরিতে। নাম্বারটি তুমি রাখ, মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজ নিও ফিরেছে কি না।
আরো জানালেন আগামী অমুক তারিখ কিয়তো কাইকানের সম্মেলন কক্ষে ক্রিসমাস পার্টি হবে। আমি যেন অবশ্যই সেখানে যাই কারণ সেখানে অনেক বিদেশি ছাত্র থাকবে। কীভাবে গিয়েছিলাম মনে নেই কিন্তু ল্যাবের কাজ শেষ করে গিয়ে পৌঁছাতে পার্টি প্রায় শেষ হওয়ার পর্যায়ে। পানাহার শেষে ততক্ষণে নাচ শুরু হয়েছে। আমার সাথে বন্ধুত্ব করার লোক কোথায়? নরনারীর একত্রে নাচ দেখার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। ফলে এঁদের কারো কাছাকাছি যেতে লজ্জা ও সংকোচ আমার প্রবল। ফলে দেয়ালের পাশে রাখা কিছু খাবার হাতে নিয়ে আমি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলাম অনাহুতের মত।
দেখতে পেয়ে মিস ওহাশি বললেন রাত তো অনেক হয়ে গেল, পথঘাট তো চেন না, তুমি ঘরে ফিরবে কীভাবে? এমন সময় তিন বাচ্চাসহ এক শ্বেতকায় দীর্ঘদেহী দম্পতি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। একটি বাচ্চার হাত ধরা লোকটিকে ডেকে মিস ওহাসি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আহমেদ সান জাপানি ভাষা বোঝে না। বাসে তোমাদের পথেই তো পড়বে, অমুক স্টেশন এলে ওকে এতো নম্বর বাসে উঠিয়ে দিয়ে বাসের ড্রাইভারকে অনুরোধ করো যেন দেমাচিইয়ানাগি স্টেশনে নামিয়ে দেয়। ওখান থেকে শেষ ট্রেনটি ধরে সে ঘরে ফিরতে পারবে।
কথা বলে জানলাম লোকটি জার্মান দেশ থেকে আসা ছাত্র। হাতে ধরা একটি এবং কোলে আরেকটি বাচ্চাসহ মহিলাটি তাঁর স্ত্রী। লোকটি ইংরেজি ভালোই বলতে পারে, মহিলা ইংরেজি বুঝলেও বলতে পারে না। বাসে উঠে সুযোগ পেয়ে আমি একনাগাড়ে কথা বলে গেলাম। বললাম আমার বাচালতাকে যেন ওরা আপাততঃ নিজ গুণে সহ্য করে নেয় কারণ প্রায় একমাস থেকে আমি কথা বলার জন্য হন্যে হয়ে আছি। সামনের সিট থেকে উঠে মহিলাটি আমার পাশে এসে বসলো। স্বামীকে বাচ্চাটি দেখিয়ে অনুনয় করে জার্মান ভাষাতেই বললো আমার হাত তো বন্ধ, নাও না, তুমি লিখে নাও না ওর নাম ও ফোন নম্বর। স্বামীটি আমার ফোন নেই কথাটি জার্মান ভাষায় তর্জমা করে বলার পর মহিলা বললো, তাহলে ওর ঠিকানাটাই লিখে নাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার সময় ক্লাশ শেষে আমার শিক্ষাগুরু অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরি স্যার আরো তিনজনের সাথে আমাকে জার্মান ভাষা শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। তখন শিখে রাখা পরিচিত কয়েকটি শব্দ ও এই জার্মান দম্পতির দেহভঙ্গি থেকে কথোপকথনের ভাবটি বুঝে নিয়েছিলাম। বিদায় জানানোর আগে আমাকে বললো ভেবো না, আমরা দুজনেই আসবো তোমাকে সঙ্গ দিতে।
সপ্তাহ খানেক পর এক রোববার আমার ঘরের দরজায় টোকা পড়লো। সেদিন রাতের সেই জার্মান লোকটি। বললো আমরা দেশে চলে যাচ্ছি পরশু। তিনটি বাচ্চা নিয়ে জিনিসপত্র গুছাচ্ছে আমার স্ত্রী। নিজে আসতে পারেনি কিন্তু আমাকে ঠেলে পাঠিয়েছে তোমার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে, তোমাকে কথা বলার সুযোগ দিতে।
আমি কী কথা বলেছিলাম তার কিছুই মনে নেই। যা মনে আছে তা হচ্ছে আমার একাকীত্ব লাঘবে ক্ষণিক পরিচয়ের নির্বোধ ভাষাভাষী এক মহিলার আন্তরিকতার কথা। নিজে যা পারেনি, স্বামীকে পাঠিয়ে সে তাঁর কথা রক্ষা করেছিল। কিন্তু তাঁর কী দায় ছিল? কী স্বার্থ ছিল তাঁর? এর উত্তর আমি আজও পাই নি! তবে ধারণা করি জার্মান ও ইংরেজি না জানা দেশে এই মহিলা আমার মতোই কারো সাথে কথা না বলতে পেরে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তাই ক্ষণিকের পরিচয়ে আমার প্রতি তার আন্তরিক মমতা প্রকাশ পাচ্ছিল। অথবা স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো সব মানুষের মাঝেই এই গুণটি লুকানো থাকে। আমরা তা দেখতে পাই না। প্রয়োজনেই তা প্রকাশিত হয়।
জাপান বাসের এই যাত্রায় একাকীত্ব, বিশেষ করে ঘরে ফিরলে, আমার নিত্য সঙ্গী হয়ে রইলো। এপ্রিলের কোন এক সময় কাগোশিমা থেকে এক বাঙালি ছাত্র এলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেখা গেল সে আমার পূর্ব পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যাটিস্টিক্সের ছাত্র। নাম রাকিব। আমার এক বছরের সিনিয়র হলেও ছাত্র হিসেবে আমার সাথেই অনার্স পরীক্ষা দিয়েছিল। একজন বাঙালি, তাও আমার বন্ধু এতো ভালো জাপানি বলতে পারে ভাবতেই গর্ববোধ করতাম। কিন্তু সে থাকে ইয়ামাশিনা’র বিদেশি ছাত্রাবাসে, অনেক কম ভাড়ায়। বন্ধু হলেও ওকে বেশি চালাক মনে হতো। ওর তুলনায় আমি বোকাই ছিলাম। তাই ছুটির দিনে সুযোগ পেলেই চলে যেতাম ওসাকা, মতিন সাহেবদের ডর্মিটরিতে।
ততদিনে জাপানি ভাষার বেশ কিছু শব্দ রপ্ত করে ফেলেছিলাম। গ্রীষ্মে বেড়াতে আসা অতিথিদের সাথে যেচে আলাপ জমাতে চেষ্টা করতাম। লজ্জা কাটিয়ে যারা সাড়া দিত তাঁদের আমার ঘরে আমন্ত্রণ জানিয়ে ঘরে রাখা শুকনা খাবার ও কোমল পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করতাম। ওরা চলে গেলে এবং সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমিও আবার সেই অসহনীয় নীরবতার কাছে আত্মসমর্পন করতাম।
একপ্রকার গায়ে পড়ে আলাপ জমানো জাপানিদের মাঝে দুই জনের সাথে আমার ভালোই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। একজন ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার। বেড়াতে এসেছিলেন ছোট দুটি নাতনিকে সাথে করে। ষাটের দশকে বাংলাদেশে কাটিয়েছিলেন মাস কয়েক। অত্যন্ত অমায়িক হলেও জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে অবস্থানটি তাঁর খুব স্বস্তিদায়ক ছিল না, কারণ ময়মিসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কাজের জন্য তিনি গিয়েছিলেন, সেখানকার বাঙালিরা ঘুষ চেয়ে চেয়ে তাঁর কাজের ব্যাঘাত ঘটাতেন। আমাকে তাঁর বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু জাপানি খাবার নিয়ে আলোচনার সময় তাঁদের প্রিয় কাঁচা মাছ ও বিশেষ ভাবে প্রস্তুত গরুর কাঁচা মাংসের কথাও জানালেন। শেষোক্ত এই বিশেষ খাবার খাওয়ানোর জন্যে আরেকদিন সময় চাইলেন। আমি মতিন সাহেব ও আলাউদিন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি ঐতিহ্যবাহী এক জাপানি রেস্তোরাঁয় আমাদের আপ্যায়ন করেছিলেন।
চলবে...