জীবন যেন এক পূর্ণ চক্র, ঘুরে আবারও একই জায়গায় ফিরে এসেছেন কান্ত প্রসাদ।
Published : 14 Jun 2021, 09:10 AM
ভাইরাল এক ভিডিও তার ভাগ্য বদলে দিয়েছিল, রাস্তার দোকান ছেড়ে অল্প দিনেই খুলেছিলেন একটি রেস্তোরাঁ। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে তাকে ফিরতে হল সেই রাস্তায়।
খুব কম সময়ে অনেক পেয়ে আর হারিয়ে দিল্লির ৮০ বছরের এই বৃদ্ধ বলছিলেন “আমরা যেখানে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে আসিনি, আমরা আসলে সবসময় এখানেই ছিলাম।”
ভাগ্য বদলে যাওয়া ছোট এই ব্যবসায়ীর উত্থান আর পতনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে। করোনাভাইরাস মহামারীতে ভারতের কম আয়ের মানুষের জীবনের গল্প এটা।
২০২০ সালের অক্টোবরে খবরের শিরোনাম হয়েছিল কান্ত প্রসাদের ফুটপাতের খাবারের দোকান ‘বাবা কা ধাবা’ । গৌরব ভাসান নামে এক ব্লগার টুইটারে তার একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন, যেখানে মহামারীতে ব্যবসায় মন্দার কথা জানিয়ে কাঁদছিলেন কান্ত প্রসাদ।
ভিডিওতে দিন শেষে পড়ে থাকা খাবারগুলো দেখাচ্ছিলেন তিনি। রোজগার কত হল জিজ্ঞেস করায় কয়েকটি ১০ রুপির নোট দেখিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, লকডাউন শুরুর পর জীবন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
বলিউড তারকা, ক্রিকেটার থেকে শুরু করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালেরও নজর কেড়েছিল ‘বাবা কা ধাবা’।
কান্ত প্রসাদ আর তার স্ত্রী বীমা দেবী মিলে ১৯৯০ সালে খাবারের দোকানটি চালু করেন। ঘরে তৈরি পরটা, মাখন দেওয়া রুটি, ঝোল, ভাত, ঘন ডাল- এই হল খাবারের মেন্যু। ৫০ রুপিরও কম দামে পাওয়া যেত নির্ভেজাল এই খাবার।
ভারতে রাস্তার খাবার বেশ জনপ্রিয় হলেও মহামারীতে পথে বসেছেন কান্ত প্রসাদের মত দোকানিরা। লোকজন বাইরে খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় এই দম্পতি দিন শেষে রুজি নিয়ে সমস্যায় পড়ে যান।
এমন দশা কান্ত প্রসাদের একার না। মহামারীর শুরুতে ভারত জুড়ে কঠোর লকডাউন দেওয়া হলেও কোনো সামাজিক নিরাপত্তা না থাকায় বিপাকে পড়েন দিনমজুর আর ছোট ব্যবসায়ীরা। নগর থেকে গ্রামে ফিরে যায় বিপুল সংখ্যক মানুষ।
Let’s help put their smile back ... our neighbour hood vendors need our help to ❤️. https://t.co/X4RNcYOA9w
— Suniel Shetty (@SunielVShetty) October 8, 2020
ব্লগার গৌরব ভাসান ভিডিওটি অনলাইনে শেয়ার করার পর রাতারাতি পাল্টে যায় কান্ত প্রসাদ আর তার স্ত্রীর জীবন। তাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরায় লোকজনের প্রশংসায় ভাসেন গৌরব ভাসানও।
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই প্রসাদ অভিযোগ করেন, তার নামে সংগ্রহ করা তহবিল তছরুফ করেছেন ভাসান। এমনকি পুলিশের কাছে একটি অভিযোগও করেন তিনি।
অবশ্য ছয় মাসের মধ্যে বদলে গেছে সব। কান্ত প্রসাদ এখন মনে করছেন, তিনি ভুল করেছেন। আর ব্লগার গৌরব ভাসান জানিয়েছেন, তিনি আর এসবে নেই।
তবে সেই ভাইরাল ভিডিও প্রসাদের জীবন পাল্টে দিয়েছে। খ্যাতি ছড়ানো ‘বাবা কা ধাবা’য় মানুষের ভিড় লেগে যায়, যা নিয়ে অসংখ্য সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন কান্ত প্রসাদ। সারা দেশ থেকে অনুদানও এসেছে প্রচুর।
ওই অর্থ দিয়ে তিনি ঋণ শোধ করেছেন, জীর্ণ বাড়িটাও মেরামত করেছেন। আটজনের পরিবারের রুজির ব্যবস্থাও ওই অর্থেই তিনি করে আসছিলেন।
শুরুতে কিছুটা নামডাক হলেও তার ওই নতুন ব্যবসা ভাগ্যদেবীর মুখ দেখেনি। তিন মাসের মধ্যে খাদের কিনারে টলতে থাকে তার নতুন রেস্তোরাঁ।
কান্ত প্রসাদ বলেন, “মাসে আমার বিক্রি কখনো ৪০ হাজার রুপি পার হয়নি, যেখানে খরচ ছিল এক লাখ রুপি।
“এছাড়া আরও অনেক খরচ আছে- ভাড়া দিতে হয় ৩৫ হাজার রুপি, তিনজন কর্মীর বেতনে যায় ৩৬ হাজার রুপি। আমি যদি জানতাম এমন কঠিন হয়ে উঠবে, তবে কখনোই রেস্তোরাঁ দিতাম না।”
লোকসানের মুখে পড়ে অবশেষে গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সেই রেস্তোরাঁ তিনি বন্ধ করে দেন। মে মাসে আবারও ফিরে আসেন নিজের পুরনো খাবার স্টল ‘বাবা কা ধাবা’য়।
করোনাভাইরাস মহামারীতে বিপর্যস্ত হয়েছে সারা বিশ্বের অর্থনীতি। দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ভারতে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে কান্ত প্রসাদের মত ছোট ব্যবসায়ীরা।
সেন্টার ফর মনিটরিং দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) তথ্য অনুযায়ী, মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত মে মাসে প্রায় ১৭ কোটি দিনমজুর ও ছোট ব্যবসায়ী তাদের জীবিকা হারিয়েছেন।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ কমে আসতে শুরু করায় কিছু রাজ্য আবারও খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা জানিয়েছেন, সতর্ক না হলে মহামারীর আরেকটি ঢেউয়ের আগে এটা হবে কেবল একটু বিরতি।
“আমার রোজগার এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল। দিন শেষে আমার হাতে কমপক্ষে ১৩ থেকে ১৪ হাজার রুপি থাকে।”
বিক্রির এই অঙ্ক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিনগুলোর ধারেকাছে না হলেও কান্ত প্রসাদ মনে করছেন ‘যথেষ্ট হয়েছে’।
“লোকজন জানতে চায়, ওই টাকা দিয়ে আমরা কী করি। বাড়ি তৈরির জন্য আমরা কিছু খরচ করি, কিছু রেস্তোরাঁয় খরচ করি, আর কিছু ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করি।”
কান্ত প্রসাদ বলেন, “আমরা এখন যে অবস্থায় আছি, তাতেই সুখী।”