প্রত্যাখ্যাত আর ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা তার অসংখ্য। পথচলায় জীবন মোড় নিয়েছে বারবার। কিন্তু বর্তমানে তিনি বিশ্বের সেরা ধনীদের একজন। ফোর্বস-এর প্রকাশিত শীর্ষ ধনীদের তালিকায় তিনি আছেন ২০তম স্থানে, আর নিজ দেশ চীনে তালিকার তৃতীয় স্থান তার দখলে।
Published : 10 Sep 2018, 05:59 PM
যার কথা বলা হচ্ছে তার নাম মা ইউয়ান, সবাই চেনে জ্যাক মা নামে। এই মা ইউয়ান কেন জ্যাক মা নামে বিখ্যাত হলেন সে কথা একটু পরে বলা যাক।
সোমবার ৫৪ বছরে পা দেওয়া জ্যাক মা নিজ প্রতিষ্ঠান আলিবাবার ই-কমার্স সাম্রাজ্যের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদ থেকে ‘সরে দাঁড়াচ্ছেন’ বলে সম্প্রতি খবর প্রকাশ হয়েছে। শীর্ষ নির্বাহীর পদ ছাড়লেও তিনি আলিবাবার পরিচালনা পর্ষদে থাকছেন; ‘শিক্ষায় মানবসেবার লক্ষে’ তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।
জ্যাক মা-এর জন্ম ১৯৬৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, চীনের দক্ষিণপূর্বাংশের হাংঝোও অঞ্চলে। পরিবারে তার ছিল এক বড় ভাই আর এক ছোট বোন। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে কমিউনিস্ট চীন যখন ক্রমেই আলাদা হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময়টাতেই বেড়ে উঠেন তারা। অর্থবিত্তের দিক থেকেও যে পরিবারের অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল তা নয়।
১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন, সে বছর তিনি একবার হাংঝোও সফর করেন। এরপর পর্যটকদের কেন্দ্রে পরিণত হয় জ্যাক মা-এর এলাকা। কিশোর বয়সে মা ভোরে ঘুম থেকে উঠে শহরের প্রধান হোটেলটায় যেতেন আর সেখানকার পর্যটকদের শহর ঘুরে দেখানোর প্রস্তাব দিতেন। কিন্তু এতে তার লাভ? বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ইংরেজি শিখতে চাইতেন তিনি। তার বন্ধু হয়ে যাওয়া এক পর্যটকই তাকে ‘জ্যাক’ নামটি দেন, মা ইউয়ান থেকে তিনি হয়ে যান জ্যাক মা।
অর্থ বা কারও সঙ্গে থাকা সংযোগ- দুই ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকা মা-এর জন্য সামনে এগুনোর একমাত্র উপায় ছিল শিক্ষা। হাইস্কুলের পাঠ চুকানোর পর কলেজে ভর্তির আবেদন করেন তিনি। দুইবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দুইবারই ফেইল করেন তিনি। আবারও শুরু করেন পড়াশুনা। অবশেষে হাংঝোও টিচার্স ইনস্টিটিউট-এ ভর্তি হন। ১৯৮৮ সালে স্নাতক শেষ করার পর শুরু করেন চাকরির খোঁজ, যত জায়গায় সম্ভব চাকরির আবেদন করেন।
পরবর্তীতে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে একটি চাকরি পান তিনি। কাজটাকে ভালোবেসে ফেলা জ্যাক তার ছাত্রদের সঙ্গে একদমই সাধারণ আচরণ করতেন। স্থানীয় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চাকরিতে তার মাসিক বেতন ছিল ১২ ডলার।
২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে জ্যাক মা জানান যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বার পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। ফলাফল? প্রতিবারই ফেইল।
কম্পিউটার আর কোডিং নিয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট ব্যবহার করেন জ্যাক, মুগ্ধ হয়ে যান। অনলাইনে প্রথম যে শব্দ লিখে মা সার্চ করেন, তা ছিল ‘বিয়ার’। কিন্তু তাকে অবাক করে দেয় সার্চ-এ আসা ফলাফল। এতে ছিল না চীনা কোনো বিয়ারের নাম। এরপরই চীনের জন্য ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই শুরু করে দেন অনুবাদের ব্যবসা। চীনা একটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের পাওনা অর্থ পেতেও সহায়তা করেন।
‘আলিবাবা আর চল্লিশ চোর’ গল্পে গুপ্তধন লুকানো জায়গার দরজা খুলতে গোপন পাসওয়ার্ড ব্যবহারের বিষয়টি হয়তো সবারই জানা। বিশ্বজুড়ে নিজের প্লাটফর্মের মাধ্যমে ছোট আর মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলর জন্য নিয়ে আসছেন অনেক বড় সম্ভাবনা, এমন আশা মাথায় ছিল তার। এই ধারণা মিলিয়ে স্যান ফ্রানসিসকো’র এক কফি শপে বসে নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘আলিবাবা’ নামটি বেছে নেন তিনি।
শীঘ্রই এই সেবা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষকে টেনে আনতে শুরু করে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি গোল্ডম্যান স্যাকস-এর কাছ থেকে ৫০ লাখ আর এর কিছুদিন পর সফটব্যাংক-এর কাছ থেকে দুই কোটি ডলার সংগ্রহ করে। গোল্ডম্যান স্যাকস আর্থিক সেবাদাতা ও বিনিয়োগকারী একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান। জাপানি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সফটব্যাংক-এর বিভিন্ন ধরনের সম্ভাবনাময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের রীতি আছে।
২০০৫ সালে শতকোটি ডলারের বিনিময়ে আলিবাবার ৫০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় ইয়াহু। এটি ছিল আলিবাবার জন্য বিশাল অর্জন। এ সময় চীনে ইবে-কে টক্কর দেওয়ার চেষ্টায় ছিল প্রতিষ্ঠানটি। ইয়াহু’র সঙ্গে চুক্তির পর আলিবাবা হাজার কোটি ডলার বাজারমূল্য নিয়ে শেয়ারবাজারে প্রবেশ করে। যদিও পরে এই শেয়ার আলিবাবার হাতেই ফিরে এসেছে, আর ইয়াহু নিজেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে।
২০১৩ সালে মা আলিবাবা’র প্রধান নির্বাহী পদ থেকে সরে আসেন জ্যাক মা, হয়ে যান নির্বাহী চেয়ারম্যান। ২০১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে আলিবাবা শেয়ারবাজারে যাত্রা শুরু করে। সে সময় মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি-কে তিনি বলেন, “আজ আমরা যা পেয়েছি তা অর্থ নয়। আমরা যা পেয়েছি তা হচ্ছে মানুষের আস্থা।”
ওই সাক্ষাৎকারে তার জীবনের নায়ক কারা জিজ্ঞাসা করা হলে মা বলেন, “আচ্ছা, আমি আমেরিকা থেকে আমার জীবনের গল্প, আমার স্বপ্ন পেয়েছি। ঠিক ১৫ বছর আগে আমি যখন আমেরিকায় এসেছিলাম, যখন সিলিকন ভ্যালিতে এসেছিলাম। আমি সন্ধ্যায় গাড়িতে ভরা রাস্তা দেখেছি, আলোয় ঝলমলে সব ভবন দেখেছি। এগুলোই আমার আবেগ।”
নভেম্বরের ১১ তারিখ চীনে ‘সিঙ্গল’স ডে’পালন করা হয়। কারও সঙ্গে কোনো প্রেম বা বৈবাহিক সম্পর্কে না থাকা চীনের ‘সিঙ্গল’ ব্যক্তিদের জন্য এ দিনটি উদযাপন করা হয়। চীনা দিনপঞ্জিকায় এটি হচ্ছে আলিবাবা’র ব্যবসায়ের জন্য সবচেয়ে বড় দিন। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি এ দিনে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১৮০০ কোটি ডলার বিক্রির রেকর্ড গড়ে। ২০১৭ সালে এ রেকর্ড ভাঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি, সে বছর বিক্রি হয় প্রায় ২৫০০ কোটি ডলারের পণ্য।
এতটা অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পরেও জ্যাক মা’র শখের তালিকাটা আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। বই পড়তে আর কুং ফু ফিকশন লিখতে ভালোবাসেন তিনি। তার শখের মধ্যে আছে পোকার খেলা, মেডিটেশন আর তাই চি অনুশীলনও। তাই চি হচ্ছে এক ধরনের চীনা মার্শাল আর্ট।
জ্যাক মা-এর আবেগের জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পরিবেশ। পরিবেশবাদী হয়ে ওঠার পেছনেও কারণ রয়েছে তার। নিজের স্ত্রীর পরিবারের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য দূষণ দায়ী ছিল বলে ধারণা হয় তার। এ থেকেই পরিবেশবাদী হয়ে উঠেন তিনি। নেচার কনজার্ভেন্সি’র বৈশ্বিক সদস্য হন তিনি, ২০১৫ সালে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ-এর একটি আয়োজনে বক্তব্যও রাখেন। চীনে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ২৭ হাজার একর জমির তহবিলে যোগানে সহায়তা করেছেন তিনি।
এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা জ্যাক মা। স্বনামধন্য হয়ে উঠার পরেও নিজের পারিবারিক জীবনকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে রাখেন। তার স্ত্রী ঝ্যাং ইং চীনে একজন শিক্ষক। স্কুলের পড়াকালীন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল জ্যাক মা’র।। ১৯৮০ সালের শেষে স্নাতক শেষ করার পর তারা বিয়ে করেন। “তিনি সুদর্শন কোনো পুরুষ নন, কিন্তু আমি তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ি কারণ তিনি এমন অনেক কিছু করতে পারেন যা সুদর্শন পুরুষরা পারে না”- স্বামীকে নিয়ে এমনটাই মন্তব্য ইংয়ের।
প্রতিভাবান জ্যাক মা সারাজীবন প্রচলিত নিয়মের খাঁচায় প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন বারবার। তার প্রতিষ্ঠান এখন আয়োজন করে প্রতিভা দেখানোর বার্ষিক অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে তিনি একজন পুরোদস্তুর বিনোদনদাতা। প্রতিষ্ঠানের এক বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে ২০ হাজার আলিবাবা কর্মীর সামনে এক পারফরম্যান্সের জন্য পাঙ্ক রকারের মতো সাজ নিয়েছিলেন তিরি।
সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ শিরোনামে জায়গা করে নেন মা। বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্পের রক্ষণশীল মনোভাব থাকা সত্ত্বেও জ্যাক মা বলেন, চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো বাণিজ্য যুদ্ধ হওয়ার কথা নয়। জানুয়ারিতে তিনি বলেন, “ট্রাম্পকে কিছু সময় দিন। তিনি উন্মুক্ত মনের।”