বছরজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেসব পেশা, যৌন ব্যবসা তার একটি। ইউরোপে সরকারি বিধি-নিষেধের পাশাপাশি গ্রাহকরা তাদের আচরণে লাগাম দেওয়ায় যৌনপল্লীগুলো বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।
Published : 31 Dec 2020, 10:56 PM
আমার এক বাঙালি বন্ধু প্রায় তিন দশক ধরে জার্মানির নুরেমবার্গে থাকেন। জুয়ার আড্ডা আর যৌনপল্লীতে যাতায়াতের অভ্যাস তার বহুদিনের। ধরা যাক তার নাম বাকু।
প্রবাসের দিনগুলোতে অসংখ্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে বাকু। তবে অস্থির চরিত্রের কারণে কোনোটাই বেশিদিন টেকেনি। মহামারীর মধ্যে সংক্রমণের ভয়ে তার যৌনপল্লীতে যাওয়া বন্ধ হলেও জুয়ার নেশা যায়নি।
আমার এ বন্ধুর অনেক ‘দোষের’ মধ্যে একটি ভালো গুণ হলো সে খুব পরোপকারী এবং বন্ধুবাৎসল। তার বাসায় কেউ গেলেই বিরাট আপ্যায়ন-আয়োজন করে।
আমি একবার একজন যৌনকর্মীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বাকুর সাহায্য চাইলাম। বন্ধু আমাকে ‘দিলারা’ নামের এক হাঙ্গেরিয়ান যৌনকর্মীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
ভদ্রমহিলার ব্যবহার চমৎকার। তার বয়ফ্রেন্ড আছে, এবং সে জানে তার বান্ধবীর পেশা কী। এমনকি তার বয়ফ্রেন্ড কাজের শেষে যৌনপল্লী থেকে তাকে নিয়েই একসাথে বাসায় ফেরেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর আমার সাথে সেদিন দিলারা তার বন্ধুরও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
মহামারীর ছোবলের পর লকডাউনে যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ ছিল, যৌনপল্লী সে তালিকায় এক নম্বরে ছিল। গবেষণাধর্মী একটি বইয়ের কাজে কোভিড সংক্রমণের মধ্যেই একবার কোনো একটি যৌনপল্লীতে যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল আমার। ইচ্ছা ছিল- প্যানডেমিকের সময় সঙ্কটে পড়া যৌনকর্মীদের সাক্ষাৎকার নেব। তাই বাকুকে জানিয়ে রেখেছিলাম।
একদিন ঘুম থেকে উঠে ফোনে বাকুর কয়েকটি মিসড কল দেখলাম। পাল্টা ফোন করতে জানালো, শহরে ঘোরার সময় সে ও তার এক তুর্কি বন্ধু যৌনপল্লীর কাছাকাছি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল, তখন তিনজন যৌনকর্মী তাদের পিছু নেয়। জার্মানি বা ইউরোপে সাধারণত এমন ঘটে না।
ওই যৌনকমীর্রা কাছাকাছি এসে গেলে বাকু তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, লকডাউনের মধ্যে দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। তারা যেন আর না এগোয়।
ওই তিনজন এসেছিলেন রোমানিয়া থেকে। তারা জানায়, তাদের কাছে কোনো টাকা নেই, সবকিছু বন্ধ, তাদের ব্যবসাও নেই। দেশে ফিরে যাওয়ার মতো অর্থও নেই। বাকু ও তার বন্ধু ‘সেবা’ নিলে তাদের খুব উপকার হয়।
তাদের মধ্যে একজন বলেন, স্বাভাবিক সময়ে তারা ৫০ ইউরো নেন, কিন্তু এই দুঃসময়ে ১০ ইউরোতেও রাজি। বাকু ও তার বন্ধু তাদের ফোন নম্বর নিয়ে বলে, প্রয়োজনে তারা যোগাযোগ করবে।
আমি বাকুর কাছে জানতে চাইলাম, “আমাকে ফোন করার কারণ কী? শুধুই কী ঘটনা জানানো? না অন্য কিছু?”
সে বললো, “এখন শহরের সবকিছু বন্ধ, ভুতুড়ে অবস্থা। তুই এর আগে একটা নিবন্ধ লিখতে চেয়েছিলি। এখন এসে সরেজমিনে দেখে কিছু ছবি তুলতে পারিস এবং একটা রিপোর্ট করতে পারিস।”
আমি তাকে ‘ধন্যবাদ’ জনিয়ে প্রস্তাবে সাড়া দিলাম। তবে বাকুকে জানালাম, তার থাকার দরকার নেই। তার কাছ থেকে যৌনকর্মীদের টেলিফোন নম্বর নিলাম।
জার্মানিতে ঠিকমত কর না দিয়ে ব্যবসার সুযোগ নেই। ব্যতিক্রম যৌন ব্যবসা। এখানে আয়কর পুলিশ অসহায়! অনেক যৌনকর্মী বিদেশি, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে আসেন। তারা আসেন, যান এবং আবার আসেন। অনেকের কাছেই এটা খণ্ডকালীন কাজ।
যৌনকর্মীদের জন্য জার্মানিতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। তবে এ নিয়ম অনিবন্ধিত যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না।
জার্মানির যৌনপল্লীতে কাজ যারা করেন, তাদের অধিকাংশই নিবন্ধিত। তা না হলে তাদেরকে বড় ধরনের জরিমানা গুণতে হয়। আর তারা যা উপার্জন করেন, তা ঠিকঠাক কাগজপত্রে দেখালে অর্ধেক চলে যায় আয়কর দিতে। তাই অনেকে কর ফাঁকি দেন। আর সে কারণে প্রণোদনাও পাচ্ছেন কম।
যেখানে একজন যৌনকর্মীর মাসে আয় দশ হাজার ইউরো, তিনি হয়ত কাগজে-কলমে দেখান দেড় হাজার ইউরো। অতএব তিনি পাবেন তার ৬০ ভাগ প্রণোদনা, যদি তিনি একা হন। আর যদি ওই যৌনকর্মীর বাচ্চার বয়স ১৮ বছরের নিচে থাকে, তাহলে বেশি পাবেন।
বাকুর সাথে কথা হওয়ার একদিন পর আমি গেলাম যৌনপল্লীর ছবি তুলতে। ভুতুড়ে গলি বলে মনে হল। কেউ নেই, আমি একা সেই রাস্তায়।
যৌনপল্লীতে যে কাউন্টারগুলোতে যৌনকর্মীদের অপেক্ষা করার কথা, সেসব জায়গা শূন্য পড়ে আছে। ‘মাস্ক ব্যবহার ও দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রাখার কিছু বিজ্ঞপ্তি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে জানালার কাচে এবং দরজায়। সাধারণত জার্মানিতে শুধু মাস্কের কথা বলা হয় না। অন্যান্য সব জায়গায় (যেখানে জরুরি সেখানে) লেখা থাকে- ‘মুখ ও নাসিকাবরণ’ ব্যবহার করার জন্য।
তাদের জার্মান বা ইংরেজি ভাষার জ্ঞান খুবই কম। আমার সামান্য রোমানিয়ান, জার্মান ও ইংরেজি মিলিয়ে কেবল একজনের সাক্ষাৎকার নিতে পারলাম।
তিনি জানালেন- তারা রোমানিয়া থেকে জার্মানিতে এসেছিলেন তিন মাসের জন্য। অনুমোদন ছাড়াই বাসা থেকে এ ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন।
তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কোনো সাহায্য করতে পারি কিনা?
জবাবে আমি বললাম, “আমার স্ত্রী আছে। আর করোনার মধ্যে নতুন বান্ধবী নেওয়াও উচিৎ না। তুমি চাইলে আমার কাছ থেকে দশ ইউরো সাহায্য পেতে পারো, অবশ্যই দূরত্ব বজায় রেখে। এবং এটাও তোমার দশ মিনিটের সাক্ষাৎকারের জন্য। আমি ঘণ্টায় দশ ইউরো উপার্জন করি। তোমাকে দশ মিনিটে দশ ইউরো দেব।”
যখন ওই রোমানিয়ান নারী জানলেন যে নিবন্ধ লিখতে তথ্যের জন্য তাকে ফোন করেছি- তিনি কট করে ফোন রেখে দিলেন। এ অসময়েও দশ ইউরোর তোয়াক্কা করলেন না
লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অল ইউরোপিয়ান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন এবং জার্মান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন।
লেখকের ইমেইল: [email protected]
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |